প্রকৃত নাম আউফ, ডাক নাম আবু আব্বাদ, এবং লকব বা উপাধি মিসতাহ। পিতা উসাসা ইবন আব্বাদ এবং মা হযরত আবু বকরের খালা মতান্তরে খালাত বোন। মাতা পিতা দুজনেই ইসলামের সূচনা পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। (আল ইসাবা-৩/৪০৮)
মিসতাহ ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সা: তার ও যায়েদ ইবন মুযায়্যিনের মধ্যে ভাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। তার হিজরাতের সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কিছু জানা যায় না। তবে তিনি বদর যুদ্ধের পূর্বেই হিজরাত করে মদীনায় চলে যান এবং বদর যুদ্ধে তার যোগদানের কথা ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থ সমূহে পাওয়া যায়। বনী মুসতালিক যুদ্ধে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে, ইফক, বা উম্মুল মুমিনীন আয়িশার (রা) প্রতি অপবাদের ঘটনাটি ঘটে। মুনাফিকরা যখন অপবাদটি ছড়িয়ে দেয় তখন তাতে কিছু নিষ্ঠাবান মুমিন সাহাবীও জড়িয়ে পড়েন। মিসতাহ এই দলেরই একজন।
‘ওয়াকিয়া ই ইফক’ নামে প্রসিদ্ধ ঘটনাটির প্রতি পবিত্র কুরআনের সূরা নূর এর ১১ নং আয়াত সহ কয়েকটি আয়াতে ইংগিত করা হয়েছে। সংক্ষেপে ঘটনাটি এই: উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা) বনু মুসতালিকের যুদ্ধে (৬ হিজরী) রাসূলুল্লাহর সা: সংগে ছিলেন। মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পথে তারা এক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। আয়িশা (রা) শিবির হতে কিছু দূরে বাহ্যক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যান। তখন তার গলার হারটি সেখানে পড়ে গেলে তিনি তা খুঁজতে থাকেন। এদিকে তার হাওদা পর্দায় ঘেরা থাকায় তিনি ভেতরে আছেন মনে করে কাফিলা সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে যায়। পশ্চাতবর্তী রক্ষী সাফওয়ান (রা) তাকে দেখতে পেয়ে নিজের উটের পিঠে উঠিয়ে নেন এবং উটের রশি ধরে পায়ে হেটে কাফিলার সাথে মিলিত হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবন উবাই নানা অপবাদ ছড়াতে থাকে। সূরা নূরের আয়াতগুলিতে আয়িশার (রা) পবিত্রতার ঘোষণা করা হয় এবং অপবাদ রটনাকারীদের কঠোর শাস্তির কথা ব্যক্ত করা হয়।
যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে মিসতা ঘটনাটি তার মায়ের কাছে বর্ণনা করেন। মিসতাহর মা আবার একদিন রাতে কোন কাজে আয়িশার (রা) বাড়ীতে যান। আয়িশা তখন পিতৃগৃহে মায়ের কাছে। ততকালীন আবরে বাড়ীতে পেশাব পায়খানার স্থায়ী কোন জায়গা নির্দিষ্ট থাকতো না। মেয়েরা সাধারণত: রাতে বাড়ীর বাইরে মরু ভূমিতে গিয়ে বাহ্যক্রিয়া সম্পন্ন করতো। আয়িশা (রা) মিসতার মাকে সংগে করে বাড়ীর বাইরে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করতে যান। পথে মিসতাহর মা নিজের আঁচলে জড়িয়ে হোঁচট খান। হোচট খাওয়ার পর আরবের প্রথা অনুযায়ী তার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় ‘মিসতাহর ধ্বংস হোক।’ এতে আয়িশা আপত্তি জানিয়ে বলেন, একজন মুহাজির মুসলমান, যিনি বদরে যুদ্ধ করেছেন তাকে এভাবে বদদুআ করছেন? মিসতাহর মা তখন বললেন: আবু বকরের মেয়ে, তুমি কি কিছু শোননি? তখন মিসতার মা তাকে পুরো ঘটনা বলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/২৯৯-৩০০) (হায়াতুস সাহাবা-১/৫৮৭)।
দরিদ্র মিসতাহ ছিলেন হযরত আবু বকরের (রা) খালাত ভাই। আবু বকর (রা) সব সময় তার সাথে ভালো ব্যবহার ও আর্থিক সাহায্য করতেন। যখন তিনি ‘ইফক’ এর ঘটনার সাথে মিসতাহর জড়িত থাকার কথা জানতে পারলেন এবং কুরআন তাদের প্রচারণাকে মিথ্যা অপবাদ হিসেবে ঘোষণা করলো তখন আবু বকর মিসতাহকে সাহায্য দান বন্ধ করে দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, এখন থেকে আমি মিসতাহর জন্য এক কপর্দকও ব্যয় করবো না। তখন সূরা নূরের নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়: ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয় ও স্বজন অভাবগ্রস্থকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহ ত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দেবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাওনা যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা নূর-২২)।
আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত আবু বকর (রা) আবার আগের মত সাহায্য দিতে শুরু করেন। বুখারী ও মুসলিমে আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। (আল ইসাবা-৩/৪০৮)।
তবে যেহেতু একজন সতী সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপের ঘটনায় তিনি জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং কুরআনও তাদের জন্য নিম্নোক্ত শাস্তির বিধান ঘোষণা করেছিল: যারা সতী সাধ্বী রমণীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি কশাঘাত করবে।’ (সূরা নূর-৪) এ কারণে অন্যদের সাথে তাকেও এ শাস্তি দান করা হয়। মিসতার সাথে আর যে কজন নিষ্ঠাবান বিখ্যাত সাহাবী শাস্তি ভোগ করেন তারা হলেন- হযরত হাসসান বিন সাবিত ও উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নাব বিনতু জাহাশের বোন হামনা বিনতু জাহাশ (রা)। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩০২)। (হায়াতুস সাহাবা-১/৫৯০)।
আমাদের স্মরণ রাখতেহবে, হযরত মিসতাহর (রা) মত যে সকল নিষ্ঠাবান সাহাবী ‘ইফক’ এর ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, তারা নিতান্তই মুনাফিকদের প্রচারণার শিকার হয়েছিলেন। অন্যথায় হযরত মিসতাহর (রা) মত ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এতে জড়িয়ে পড়তে পারেন না। তাছাড়া তারা তাওবাহ করেছেন এবং শাস্তিও মাথা পেতে নিয়েছেন। আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা), আবু বকর (রা), তথা গোটা মুসলিম উম্মাহ তাদের ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তাদের প্রতি কোন রকম বিদ্বেষ পোষণ করা ঈমানের পরিপন্থী কাজ হবে। হযরত মিসতাহর (রা) সবচেয়ে বড় পরিচয় হযরত আয়িশার (রা) মন্তব্যে ফুটে উঠেছে। তিনি প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী, গৃহত্যাগী মুহাজির এবং বদর যুদ্ধের একজন মুজাহিদ। আর এদের প্রশংসায় পবিত্র কুরআনের কত আয়াতই না নাযিল হয়েছে।
হযরত মিসতাহ কখন ইনতিকাল করেন সে বিষয়ে মতভেদ আছে। একটি মতে হিজরী ৩৪ সনে হযরত উসমানের খিলাফতকালে তিনি ইনতিকাল করেন। অপর একটি মতে হিজরী ৩৭ সনে সিফফীনে হযরত আলী (রা) এর পক্ষে যুদ্ধ করার পর সেই বছর মারা যান। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। (উসুদুল গাবা-৪/ ৩৫৫, আল ইসাবা-৩/৪০৮, তাবাকাত-৩/৫২)।