নাম আমর কুনিয়াত বা ডাক নাম আবু উমাইয়া। পিতার নাম উমাইয়া। বনী কিনানা গোত্রের সন্তান। ইবন হিশাম তাকে রাসূলুল্লাহর সা: নবুওয়াত প্রাপ্তির কাছাকাছি সময়ের জাহিলী আরবের একজন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরূপে উল্লেখ করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/২০৪,২০৭)। তিনি বদর ও উহুদ যুদ্ধে মক্কার পৌত্তলিকদের পক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। উহুদের পরই তিনি ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় হিজরাত করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর সর্ব প্রথম বীরে মাউনা এর ঘটনায় অংশ গ্রহণ করেন। ঘটনাটি ছিল এই রকম: উহুদ যুদ্ধের পর চতুর্থ মাসে নাজদের বনী কিলাব গোত্রের সরদার আবু বারা আমের ইবন মালেক ইবন জাফর মুলায়িবুল আসিন্নাহ মদীনায় হযরত রাসূলে কারীমের সা: খিদমতে হাজির হয়। রাসূল সা: তার নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। সে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি না করে বললো: আপনি যদি নাজদবাসী কিলাব গোত্রের নিকট আপনার কিছু সংগী পাঠাতেন তাহলে তারা হয়তো ইসলাম গ্রহণ করতো। রাসূল সা: বললেন: নাজদীদের ব্যাপারে আমার শংকা হয়। কিন্তু আবু বারা প্রেরিত দলটির নিরাপত্তা পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করায় রাসূল সা: মুনজির ইবন্ আমেরের নেতৃত্বে চল্লিশ মতান্তরে সত্তর জনের একটি দল পাঠিয়ে দেন। তারা ‘বীরেমাউনা’ নামক স্থানে পৌঁছে তাবু ফেলে অবস্থান করতে থাকেন এবং ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত রাসূল সা: এর পত্রটি হারাম ইবন মালজানের মাধ্যমে আমের ইবন তুফাইলের নিকট পৌঁছে দেন।
আমের ইবন তুফাইল দূত হারামকে হত্যা করে এবং আসিয়্যা, রা’ল, জাকওয়ান প্রভৃতি গোত্রে মুসলিম দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দ্রুত বেরিয়ে পড়ার ঘোষণা দেয়। তারা সমবেত হয়। এদিকে হারামের ফিরতে দেরী দেখে মুসলমানরা তার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। কিছু দূর যেতেই তারা রা’ল,জাকওয়ান প্রভৃতি গোত্রের মুখোমুখি হয়। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম দলটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে সকলকে হত্যা করে। একমাত্র আমর ইবন উমাইয়া প্রাণে রক্ষা পান। তিনি শত্রু বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তাকে আমের ইবন তুফাইলের সামনে আনা হলো। যখন সে জানতে পেল আমর ইবন উমাইয়া মুদার গোত্রের লোক তখন তাকে এই কথা বলে ছেড়ে দিল যে, আমার মার একটি দাস মুক্ত করার মান্নত ছিল। তবে অপমানের চিহ্ন সরূপ তার মাথার সামনের দিকের চুল কেটে দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/১৮৪,১৮৫)।
এই বীরে মাউনার ঘটনায় প্রখ্যাত সাহাবী আমের ইবন ফুহাইরাও শাহাদাত বরণ করেছিলেন। আমর ইবন উমাইয়াকে বন্দী করে যখন আমের ইবন তুফাইলের সামনে আনা হলো তখন সে আমের ইবন ফুহাইরার লাশের দিকে ইঙ্গিত করে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল: এই লোকটি কে? আমর ইবন উমাইয়া বললেন: আমের ইবন ফুহাইরা। তখন আমের ইবন তুফাইল বলেছিল: আমি দেখলাম, সে নিহত হওয়ার পর তার লাশ শূন্যে আকাশের দিকে বহুদূর উঠে গেল, তারপর আবার তা নেমে এল। (হায়াতুসসাহাবা-৩/৫৯৫)
আমর ইবন উমাইয়া বীরে মাউনার শত্রুদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে মদীনার দিকে চলার পথে যখন ‘কারকারা’ নামক স্থানে পৌঁছেন তখন বিপরীত দিক থেকে আগত দুজন লোকের সাথে তার দেখা হয়। তিনি যে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন লোক দুটিও সেখানে এসে বসলো। তাদের সাথে আলাপ পরিচয়ে আমর ইবন উমাইয়া যখন জানতে পেলেন তারা বনী আমের গোত্রের লোক তখন তিনি চুপ থাকলেন। তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমর তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে দুজনকেই হত্যা করেন। তিনি মনে করেছিলেন, বনী আমের রাসূল সা: এর সাহাবীদের সাথে যে আচরণ করেছে, এটা তার একটা বদলা হবে। আমর মদীনায় পৌঁছে রাসূল সা: এর নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করলে তিনি বলেছিলেন: আমর, তুমি এমনটি দুটি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছ যে, আমাকে অবশ্যই তাদের দিয়াত বা রক্তমূল্য আদায় করতে হবে। উল্লেখ্য যে, এ ঘটনার পূর্বেই বনী আমেরের সাথে রাসূল সা: এর চুক্তি হয়েছিল। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/১৮৬) অত:পর রাসূল সা: তাদের দিয়াত আদায় করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৫৬৪)।
হিজরী ৬ষ্ঠ সনে হযরত রাসূলে কারীম সা: আমর ইবন উমাইয়্যাকে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একটি পত্র সহকারে হাবশা যাওয়ার নির্দেশ দেন। এই পত্রে রাসূল সা: নাজ্জাশীকে হাবশায় অবস্থিত মুহাজিরদের আতিথেয়তার সুপারিশ করেন্ এবং হযরত উম্মু হাবীবা বিনতু আবী সুফিয়ান, যিনি তখনও পর্যন্ত হাবশার মুহাজিরদের সাথে সেখানে অবস্থান করছিলেন- তার সাথে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠান। উল্লেখ্য যে, উম্মু হাবীবা ছিলেন উবাইদুল্লাহ ইবন জাহাশের স্ত্রী। প্রথম ভাগে মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করে স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। সেখানে স্বামী উবাইদুল্লাহ ইসলাম ত্যাগ করে খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই দাওয়াতপত্র পেয়ে নাজ্জাশী হযরত জাফর ইবন আবী তালিবের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হযরত রাসূলুল্লাহর সা: পত্রের জবাবে একটি পত্র লিখেন। এই পত্রে তার ইসলাম গ্রহণ, রাসূল সা:এর প্রতি সালাম, মুহাজিরদের প্রতি আতিথেয়তা ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ ছিল। রাসূল সা: পত্র অনুসারে তার পক্ষ থেকে নাজ্জাশী নিজেই উম্মু হাবীবাকে বিয়ের পয়গাম দেন। তিনি নিজেই রাসূলুল্লাহর উকিন হন এবং বিয়ের পর রাসূলুল্লাহর সা: পক্ষ থেকে চারশো দীনার মোহর আদায় করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/২২৪, ৩২৪)। (হায়াতুস সাহাবা-১/ ১৫৮, ৩/৫৯৬-৯৭)।
এই আমর ইবন উমাইয়া যখন রাসূল সা: এর দূত হিসেবে নাজ্জাশীর নিকট পৌঁছেন তখন সেখানে তৎকালীন ইসলামের চরম দুশমন আমর ইবনুল আস ও উপস্থিত ছিল। সে আমর ইবন উমাইয়াকে তার হাতে অর্পণের জন্য নাজ্জাশীর নিকট আবদার জানায় যাতে সে তাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পারে এবং কুরাইশদের নিকট নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/২৭৬-৭৭)।
হাবশায় যে সকল মুহাজির অবস্থান করছিলেন, দুটো জাহাজে করে আমর ইবন উমাইয়া তাদেরকে নিয়ে খাইবার যুদ্ধের সময় মদীনায় পৌঁছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৫৯)।
হাবশার এই দৌত্যগিরি শেষে মদীনায় ফেরার পর আবু সুফইয়ানের এক এক দুষ্কর্মের প্রতিশোধ নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তার ওপর। ঘটনাটি এই : আবু সুফইয়ান রাসূল সা: কে হত্যার জন্য কিছু লোককে উতসাহিত করে। এক ব্যক্তি এই দায়িত্ব্ কাঁধে নেয় এবং আবু সুফইয়ান তাকে প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করে। সে মদীনায় আসে এবং সরাসরি মসজিদে রাসূল সা: এর নিকট পৌঁছে। রাসূল সা: তার উদ্দেশ্য জেনে ফেলেন। তিনি লোকটিকে দেখিয়েবলেন, সে কোন ধান্ধায় এসেছে। লোকটি রাসূল সা: এর ওপর প্রায় আক্রমণ করতে বসেছিল, ঠিক সে সময় হঠাত হযরত উসাইদ ইবন হুদাইর (রা) তাকে পাজা করে ধরে ফেলেন। লোকটির কাপড়ের নীচ থেকে একটি খঞ্জর বেরিয়ে পড়ে। অপরাধ প্রকাশ্য ছিল, কোন সাক্ষীর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু রাহমাতুল লিল আলামীন তাকে মাফ করে দেন। সে আবু সুফইয়ানের পুরো ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়।
যেহেতু এই ঘটনার মূল নায়ক আবু সুফইয়ান এবং তারই জন্য মক্কার কুরাইশ ও মদীনাবাসীদের মধ্যে সর্বক্ষণ যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান থাকে এ কারণে হযরত রাসূলে কারীম সা: আমর ইবন উমাইয়া ও সালামা ইবন আসলাম মতান্তরে জাব্বার ইবন সাখার আল আনসারীকে এক গোপন অভিযানে মক্কায় পাঠান। তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন, যদি সুযোগ হয় তাহলে এই অশান্তির মূলনায়ককে চির দিনের জন্য দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে।
আমর ও সালামা গোপনে মক্কায় পৌঁছলেন, কিন্তু মুআবিয়া কাবার তাওয়াফ করা অবস্থায় তাদেরকে দেখে ফেলেন। কুরাইশদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল। তারা বলাবলি করলো, তাদের আগমন নি:সন্দেহে বিনা কারণে নয়। নিশ্চয় তারা কিছু একটা অঘটন ঘটাবে। এদিকে আমর ও সালামা যখন দেখলেন, তাদের আগমনের বিষয়টি কুরাইশদের মধ্য জানাজানি হয়ে গেছে, তখন তারা মক্কার বাইরে চলে যান। পথে উবাইদুল্লাহ ইবন মালিক এবং বনী হুজাইলের এক ব্যক্তির সাক্ষাত পান। আমর উবাইদুল্লাহকে এবং সালামা দ্বিতীয় লোকটিকে হত্যা করেন।
এদিকে কুরাইশরা তাদের সন্ধানে মক্কার চারদিকে গোয়েন্দা ছড়িয়ে দেয়। আমরও সালামা এমন দুই গোয়েন্দার দেখা পেলেন। তারা গোয়েন্দা দুজনের একজনকে হত্যা করেন এবং অন্যজনকে বন্দী করে মদীনায় রাসূলুল্লাহর সা: নিকট নিয়ে আসেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/ ৬৩৩-৩৪)।
আহমাদ ও তাবারানীর এক বর্ণনায় জানা যায়, খুবাইব বিন আদী মক্কার কাফিরদের হাতে শহীদ হন এবং তার লাশ একটি কাঠের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। হযরত রাসূলে কারীম সা: খুবাইবের লাশ আনার জন্য গোপন মিশন মক্কায় পাঠান। তিনি গোপনে মক্কায় পৌঁছে কাঠ বেয়ে উঠে রশি কেটে দেন এবং খুবাইবের লাশ মাটিতে পড়ে যায়। এমন সময় কুরাইশরা টের পেয়ে তাকে ধাওয়া করে এবং তিনি লাশ ফেলে পালিয়ে যান। অবশ্য অন্য বর্ণনায় জানা যায়, মিকদাদ ইবন আসওয়াদ ও যুবাইর ইবনুল আওয়াম এ দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন এবং তারাই এ অভিযান চালান। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৫৯৬,৯৭)।
হযরত রাসূলে কারীমের সা: ইনতিকালের পর হযরত আমর ইবন উমাইয়া দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে তার পরবর্তী জীবনের বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হযরত আমীর মুআবিয়ার (রা) শাসনকালে হিজরী ৬০ সনের পূর্বে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। হাদীসের গ্রন্থ সমূহে আমর ইবন উমাইয়া থেকে বর্ণিত বিশটি হাদীস পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ, জাফর, ফাদল, যাবারকান,শাবী, আবু সালামা ইবন আবদির রহমান,আবু কিলাবা, জুরমী এবং আবুল মুহাজির তার উল্লেখযোগ্য ছাত্র।
তিনি ছিলেন ততকালীন আরবের অন্যতম বীর ও সাহসী ব্যক্তি। এ কারণে রাসূল সা: দু:সাহসিক অভিযানগুলির দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করতেন। মৃত্যুকালে জাফর, আবদুল্লাহ ও ফাদল নামে তিন ছেলে রেখে যান।