হযরত আবানের পিতার নাম আবু উহায়হা সাঈদ ইবনুল আস এবং মাতার নাম হিন্দা বিনতু মুগীরা। তার বংশের উপরের দিকের পঞ্চম পুরুষ আবদ মান্নাফে গিয়ে রাসূল সা: এর নসবের সাথে তার নসব মিলিত হয়েছে। (উসুদুল গাবা-১/৩৫)
তার পিতা সাঈদ ছিল কুরাইশদের এক মর্যাদাবান ব্যক্তি। সে হিজরী ২য় অথবা ৩য় সনে কাফির অবস্থায় তায়িফে মারা যায় এবং তাকে সেখানেই দাফন করা হয়। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৪২.৩৬৮)।
তার কয়েকজন সুযোগ্য পুত্র ছিলেন। ইসলামের সূচনা পর্বেই তাদের মধ্যে খালিদ ও আমর ইসলাম গ্রহণ করে হাবশায় হিজরাত করেন। (আল ইসাবা-১/১৩)।
আবান তার অন্য দুই ভাই উবাইদা ও আল আসের সাথে পৌত্তলিক থেকে গেলেন। তার দুই ভাই খালিদ ও আমরের ইসলাম গ্রহণে দারুণ ব্যাথা পান। সে ব্যাথার প্রকাশ ঘটেছে তার রচিত একটি কাসীদায়। তার একটি শ্লোক নিম্নরূপ:
হায়! দ্বীনের ক্ষেত্রে আমর ও খালিদ যে মিথ্যারোপ করেছে, জারীবার মৃত লোকগুলি যদি তা দেখতো! (আল ইসাবা-১/১৩) (উসুদুল গাবা-১/৩৫)।
আবান তার অন্য দুই ভাইয়ের সাথে মিলে রাসূল সা: ও মুসলমানদের বিরোধিতা করতে থাকেন। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে লড়বার জন্য উবাইদা ও আল আসের সাথে মক্কা থেকে বের হলেন। উবাইদা ও আল আস মুসলমানদের হাতে শোচনীয় ভাবে নিহত হলো। আবান কোন রকমে প্রাণ নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন।
আবানের ইসলাম পূর্ব জীবন সম্পর্কিত একটি ঘটনার কথা ইবন হিশাম উল্লেখ করেছেন: ইসলাম পূর্ব যুগে রাসূল সা: তার কয়েকজন কন্যাকে মক্কার কুরাইশ যুবকদের সাথে বিয়ে দেন। কুরাইশদের সাথে রাসূল সা: সংঘাত শুরু হলে কুরাইশ নেতারা রাসূল সা: এর জামাতাদের নিকট তার কন্যাদের তালাক দেওয়ার আবেদন জানায়। রাসূল সা: এর কন্যা রুকাইয়া ছিলেন উতবা ইবন আবী লাহাবের স্ত্রী। কুরাইশরা উতবাকে বললো: তুমি মুহাম্মাদের কন্যাকে তালাক দাও। সে এই শর্তে রাজী হলো যে, যদি তারা আবান ইবন সাঈদের মেয়ে অথবা সাঈদ ইবন আসের মেয়ের সাথে তাকে বিয়ে দিতে পারে তাহলে সে রুকাইয়াকে তালাক দেবে। তারা উতবার দাবী মেনে নিয়ে সাঈদ ইবন আসের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে রুকাইয়াকে তার নিকট থেকে ছাড়িয়ে দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-৬২৫)।
হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে হযরত রাসূলে কারীম সা: তার পয়গাম সহ হযরত উসমানকে (রা) মক্কার কুরাইশদের নিকট পাঠালেন। উসমান (রা) ‘বালদাহ’ উপত্যাকা দিয়ে মক্কার দিকে যাচ্ছেন। কুরাইশরা তাকে জিজ্ঞেস করলো: কোথায় যাও? উসমান তাদেরকে সেই কথাই বললেন যা তাকে রাসূল সা: বলে দিয়েছিলেন। এমন সময় আবান ইবন সাঈদ কুরাইশদের মধ্য থেকে এগিয়ে এসে উসমানকে স্বাগতম জানালেন। উসমানের সাথে তার আগে থেকেই ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। আবান নিজের ঘোড়াটিকে প্রস্তুত করে তার পিঠে উসমানকে উঠালেন এবং তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলেন। অত:পর আবান উসমানকে মক্কায় নিয়ে আসেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৫৬)।
উসমান আবানের বাড়ীতে আসার পর আবান তাকে বলেন: আপনার পোশাকের এ অবস্থা কেন? উসমানের জামা ছিল হাঁটু ও গোঁড়ালির মাঝামাঝি পর্যন্ত। আবান আরও বলেন: আপনার কাওমের লোকদের মত জামা লম্বা করেন না কেন? উসমান বললেন: আমাদের নবী এভাবে জামা পরেন। আবান বলেন: আপনি কাবা তাওয়াফ করুন। উসমান বললেন: আমাদের নবী কোন কাজ না করা পর্যন্ত আমরা তা করতে পারি না। আমরা শুধু তার পদাংক অনুসরণ করে থাকি। (হায়াতুস সাহাবা-২/৩৫৮-৫৯) আল ইসতীয়াব-৩৫, সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩১৫)।
আবান যদিও দীর্ঘকাল যাবত ইসলাম ও ইসলামের নবীর প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন, তবুও এ সময় সত্যের সন্ধান থেকে মোটেও বিরত থাকেননি। এ সময় তিনি বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকট রাসূল সা: এর নবুওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। তখনকার দিনে শাম বা সিরিয়া ছিল জ্ঞানী-গুণী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কেন্দ্র। ব্যবসার কাজে আবানের সেখানে যাতায়াত ছিল। একবার তিনি সেখানকার এক খৃস্টান ‘রাহিব’কে কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমি হিজাযের কুরাইশ গোত্রের সন্তান। এই গোত্রের এক ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি বলে দাবী করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ আমাকেও ঈসা ও মূসার মত নবী করে পাঠিয়েছেন। রাহিব লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলেন। আবান বললেন: লোকটির নাম মুহাম্মাদ। রাহিব আসমানী কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী একজন নবীর আত্মপ্রকাশের বয়স, বংশ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করলেন। তার বক্তব্য শুনে আবান বললেন: এগুলির সবই তো সেই লোকটির মধ্যে বিদ্যমান। রাহিব তখন বললেন: আল্লাহর কসম, তাহলে সেই ব্যক্তি সমগ্র আরবের ওপর আধিপত্য বিস্তারের পর সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করবেন। তুমি যখন ফিরে যাবে, আল্লাহর এই নেক বান্দার নিকট আমার সালাম পৌঁছে দেবে। শামের এই রাহিব বা পাদ্রীর নাম ‘ইয়াক্কা’। এবার যখন আবান শাম থেকে ফিরলেন তখন তার পূর্বের রূপ আর নেই। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতার শক্তি তার শেষ হয়ে গেছে। (উসুদুল গাবা-১/৩৫, আল ইসাবা-১/১৩)।
পিতৃ পুরুষের ধর্মের কথা চিন্তা করে এবং সমবয়সীদের নিন্দা ও বিদ্রুপের কথা ভেবে আবান কিছুদিন সম্পূর্ণ চুপ থাকলেন। কিন্তু সত্যের প্রতি যে আবেগ তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, তা তিনি দীর্ঘদিন দমন করে রাখতে সক্ষম হলেন না। এদিকে তার ভাই আমর ও খালিদ হাবশা থেকে ফিরে আবানের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। অত:পর তিনি খাইবার যুদ্ধের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় হিজরাত করেন। তারা তিন ভাই একত্রে রাসূল সা: এর সাথে খাইবার অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। (আল ইসাবা-১/১৩)।
অন্য একটি বর্ণনা মতে আবান মদীনায় পৌঁছার পর হযরত রাসূলে কারীম সা: একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর আমীর বানিয়ে তাকে নাজদের দিকে পাঠিয়ে দেন। এ অভিযানে সফল হয়ে যখন তিনি মদীনায় ফিরে আসেন তখন খাইবার বিজয় শেয় হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় হাবশার অন্যান্য মুহাজিরদের সংগে করে হযরত আবু হুরাইরা মদীনায় আসেন। তারা দুজন এক সাথে রাসূল সা: এর নিকট যান। রাসূল সা: খাইবারে গণীমতের মাল থেকে কিছু অংশ তাদেরকে দেন। নাজদ অভিযান ছাড়াও আরও কিছু ছোট ছোট অভিযানে ইমারাত বা নেতৃত্ব তিনি রাসূলুল্লাহর সা: নিকট থেকে লাভ করেন।
হযরত আবান হযরত রাসূলে কারীমের সা: সাথে তায়িফ অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। হযরত আবু সিদ্দীক (রা) তায়িফে আবানের পিতার কবরটি দেখে বলে ওঠেন: এই কবরের অধিবাসীর প্রতি আল্লাহর লানাত বা অভিসম্পাত। সে ছিল আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারী। আবান ও তার ভাই আমর সাথে সাথে আবু বকরের কথার প্রতিবাদ করে তার পিতা আবু কুহাফার কিছু নিন্দা করেন। তখন রাসূল সা: বললেন: তোমরা মৃতদের গালি দিওনা। মৃতদের গালি দিলে জীবিতদের কষ্ট দেওয়া হয়। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৪২, ৩৬৮)
হযরত রাসূলে কারীম সা: আবানকে হযরত আলা ইবনুল হাদরামীর স্থলে বাহরাইনের শাসক নিয়োগ করেন। রাসূল সা: এর ইনতিকাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। রাসূল সা: এর ওফাতের খবর শুনে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। (ইসতীয়াব-১/৩৫)।
হযরত আবান রাসূল সা: এর (সাকাতিব বা লেখকের দায়িত্বও পালন করেন। (আনসাবুল আশরাফ-১/৫৩২)।
রাসূল সা: ইনতিকালের পর হযরত আবু বকর (রা) খলীফা নির্বাচিত হলেন। তার হাতে গণ বাইয়াত শেষ হওয়ার পরও যে কজন কুরাইশ ব্যক্তি কিছুদিন যাবত বাইয়াত থেকে বিরত থাকেন, আবান তাদের একজন। বনী হাশেমের লোকেরা বাইয়াত গ্রহণ করলে তার আপত্তি দূর হয় এবং তিনি বাইয়াত করেন।
খলীফা হযরত আবু বকর (রা) রাসূল সা: এর নিয়োগকৃত কোন শাসক বা কর্মচারীকে অপসারণ করেননি। আবানও ছিলেন রাসূল সা: কর্তৃক নিযুক্ত একজন শাসক। আবানকে তার দায়িত্বে ফিরে যাওয়ার জন্য আবু বকর (রা) অনুরোধ করেন। কিন্তু আবান খলীফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কোন কোন বর্ণনায় জানা যায়, খলীফার বার বার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ইয়ামানের শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইবন সাদ বর্ণনা করেন: আবান যখন খলীফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন তখন হযরত উমার (রা) একদিন আবানকে বললেন: ইমাম বা নেতার অনুমতি ছাড়া এভাবে কর্মস্থল ত্যাগ করা তো তার উচিত হয়নি। এখন আবার তার নির্দেশে সেখানে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আবান বললেন: আল্লাহর কসম! রাসূল সা: এর পরে আমি আর কারও জন্য কাজ করবো না। যদি করতাম তাহলে আবু বকরের মর্যাদা, তার ইসলামে অগ্রগামিতা ইত্যাদি কারণে তার ‘আমেল’ বা কর্মচারী হতাম। অগত্যা আবু বকর (রা) বাহরাইনে আর কাকে পাঠানো যায় সে বিষয়ে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। উসমান সা: বসলেন: যেহেতু তার পূর্বে আলা ইবনুল হাদরামী সেখানে ছিলেন, তাই তাকেই সেখানো পাঠানো হোক। উমার বললেন: আবানকেই সেখানে আবার যেতে বাধ্য করা হোক। কিন্তু আবু বকর (রা) তা করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন; যে ব্যক্তি বলে আমি রাসূলুল্লাহর সা: পরে আর কারও কাজ করবো না তাকে আমি বাধ্য করতে পারিনে। অত:পর আলা ইবনুল হাদরামীকে বাহরাইনের শাসক নিয়োগ করেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/৫৯)।
হযরত আবানের মৃত্যুর সময়কাল সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানামত দেখা যায়। মূসা ইবন উকবা ও অধিকাংশ বংশবিদ্যা বিশারদদের মতে হযরত আবু বকরের খিলাফতকালের শেষ দিকে হিজরী ১৩ সনে আজনাদাইনের যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ইবন ইসহাকের মতে তিনি ইয়ারমুক যুদ্ধে এবং অন্য কিছু লোকের মতে ‘মারজুস সাফারের দিন শাহাদাত লাভ করেন। আবার অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, তিনি খলীফা উসমানের খিলাফতকালে হি: ২৭ সনে মারা যান এবং তারই তত্বাবধানে হযরত যায়িদ ইবন সাবিত মাসহাফে উসমানী সংকলন করেন। তবে প্রথমোক্ত মতটি সঠিক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।