মারসাদ ইবন আবী মারসাদ আল গানাবী (রা)

মারসাদের পিতার নাম আবু মারসাদ কান্নায ইবন হুসাইন। মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই পিতা পুত্র উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বদর যুদ্ধের পূর্বেই হিজরাত করে মদীনায় চলে যান। মারসাদ মক্কায় হামযা ইবন আবদিল মুত্তালিবের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন এবং মদীনায় হিজরাতের পর রাসূল সা: তাকে প্রখ্যাত আনসারী ‍সাহাবী উবাদা ইবন সামিতের ভাই আউস ইবন সামিতের সাথে মুওয়াখাত বা ভাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। (তাবাকাত-৩/৪৮. আল ইসাবা-৩/৩৯৮)

হযরত মারসাদ ও পিতা আবু মারসাদ কান্নায বদর যুদ্ধের বীরযোদ্ধা। এ যুদ্ধে মারসাদ ‘সাবাল’ নামক একটি ঘোড়ার পিঠে সাওয়ার হয়ে রাসূলুল্লাহর সা: পাশপাশি অত্যন্ত বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। উহুদ যুদ্ধেও তিনি যোগদান করেন। (তাবাকাত-৩/৪৮, সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৬৬)।

জাহিলী যুগে মক্কার ‘ইনাক’ নাম্নী এক পতিতার সাথে মারসাদের সম্পর্ক ছিল। ইসলামে ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার পর তিনি সেই পতিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী ও সাহসী, সে জন্য যে সকল মুসলমান মক্কায় কাফিরদের হাতে বন্দী অবস্থায় নির্যাতন ভোগ করতো রাসূল সা: তাদেরকে মক্কা থেকে গোপনে মদীনায় নিয়ে আসার দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করেন। এ উদ্দেশ্যে একবার তিনি মক্কায় যান। রাতটি ছিল চন্দ্রলোকিত। তিনি চুপিসারে মক্কার একটি গলি দিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় তার সেই পুরাতন প্রেয়সী ‘ইনাক’ তাকে দেখে ফেলে এবং ডাক দেয়। তিনি থেমে যান। সে অত্যন্ত মিষ্টি মধুর ভঙ্গিতে স্বাগতম জানায় এবং সেই রাতটি তার সাথে কাটাবার প্রলোভন দেয়। মারসাদ বলেন, ‘ইনাক, আল্লাহ এখন ব্যভিচার নিষিদ্ধ করেছেন। তার এমন নিরস উত্তরে ইনাক দারুণ চোট পায়। সে তখন প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মানুষকে মারসাদের আগমনের কথা জানিয়ে দেয়। আটজন লোক তাকে ধাওয়া করে। তিনি একটি নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে পড়েন। শত্রুরা তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেলে তিনি গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে সোজা মদীনার পথ ধরেন। মদীনায় পৌঁছে রাসুলুল্লাহর নিকট উপস্থিত হয়ে ‍আরজ করেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইনাকের সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দিন। রাসূল সা: কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। এর পরই সূরা নূরের এ আয়াতটি নাযিল হয়:

‘ ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যাভচারী নারী অথবা মুশরিক নারীকে বিয়ে করবে এবং ব্যভিচারী পুরুষ অথবা মুশরিক পুরুষই বিয়ে করবে। বিশ্বাসীদের জন্য এগুলি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। (সূরা নূর: ২)

উদাল ও কা-রা গোত্রের কতিপয় লোক উহুদ যুদ্ধের পর মদীনায় আসে। তারা রাসূলুল্লাহর সা: দরবারে হাজির হয়ে আরজ করে, আমাদের গোত্রের কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে, আপনি আমাদের সাথে এমন কিছু লোক পাঠান যারা তাদেরকে দ্বীন ও কুরআন শিক্ষা দিতে পারে। ইবন ইসহাকের বর্ণনা মতে, ‍নবী করীম সা: মারসাদ ইবন আবী মারসাদের (রা) নেতৃত্বে ছয় ব্যক্তিকে পাঠান। তবে বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে আসিম ইবন সাবিতের নেতৃত্বে রাসূল সা: দশ ব্যক্তিকে পাঠান। তাদের মধ্যে মারসাদও একজন। দলটি যখন বনু হুজাইলের জলাশয় ‘রাজী’ নামক স্থানে পৌঁছে তখন উদাল ও কা-রার লোকগুলি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চিতকার শুরু করে দেয়। বনু হুজাইলের লোকেরা কোষমুক্ত তরবারি হাতে ছুটে এসে দলটিকে ঘিরে ফেলে। সাহাবায়ে কিরাম ঘোড়ার ওপর ‍সাওয়ার ছিলেন। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু বনু হুজাইল বললো: আমরা তোমাদের হত্যা করতে চাইনে। তোমাদের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের নিকট থেকে শুধু কিছু অর্থ আদায় করা আমাদের উদ্দেশ্যে। তোমরা নিজেরাই আমাদের কাছে চলে এস, আমরা অঙ্গিকার করছি।

মারসাদ, খালিদ ও আসিম বললেন, আমরা মুশরিকদের অঙ্গিকারে বিশ্বাস করি না। এ কথা বলে তারা যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। অন্য দিকে তাদের অপর তিন সাথী খুবাইব, যায়িদ ও আবদুল্লাহ ইবন তারিক একটু বিনয়ী ভাব দেখিয়ে তাদের হাতে ধরা দেন। যখন শত্রু পক্ষ তাদের হাত পা বাঁধতে শুরু করে তখন আবদুল্লাহ প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এটা হলো তোমাদের প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। তারা আবদুল্লাহকে ‘জাহরান’ নাম স্থানে পাথর মেরে শহীদ করে। অত:পর তারা খুবাইব ও যায়িদকে নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়। কুরাইশদের হাতে বনু হুজাইলের দুই ব্যক্তি বন্দী ছিল। তারা এদের দুজনের বিনিময়ে তাদের দুজনকে ছাড়িয়ে নেয়। উকবা ইবন হারিস ইবন আমির তার পিতা হারিসের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য খুবাইবকে গ্রহণ করে। হযরত খুবাইব (রা) বদর যুদ্ধে হারিসকে হত্যা করেন। অন্যদিকে সাফওয়ান ইবন উমাইয়া তার পিতা উমাইয়া ইবন খালাফের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে যায়িদকে হাতে নেয়। এ ভাবে কুরাইশদের প্রতিশোধ স্পৃহার শিকার হয়ে তারা দুজনই অত্যন্ত অসহায় ও নির্মম ভাবে মক্কায় শাহাদত বরণ করেন। ইতিহাসে এই ঘটনাকে ‘ওয়াকিতু ইউম আল রাজী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইবন সাদ বলেন, ‘রাজী’ এর এই ঘটনাটি ঘটে রাসূল ‍সা: এর মদীনায় হিজরাতের ছত্রিশ মাসের মাথায় সফর মাসে। (তাবাকাত-৩/৪৮)।আসাহুস সীয়ার-১৬০), সীরাতু ইবন হিশাম-১৬৯-১৭৪)।

হযরত মারসাদ (রা) এর যোগ্যতা ও মর্যাদার জন্য এই ঘটনাই যথেষ্ট যে, খোদ রাসূলে কারীম সা: তাকে দ্বীনের মুআল্লিম বা শিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করেছেন। যেহেতু হযরত রাসূলে কারীমের সা: জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন সেহেতু তার ইলমী যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ হয়নি। তবুও হাদীসের গ্রন্থ সমূহ তার থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে একেবারে শূন্য নয়। আহমাদ ইবন সিনান আল কাত্তান তার মুসনাদে ইমাম বাগাবী ও হাকেম তাদের মুসতাদরিকে এবং তাবারানী তার ‘আওসাতে’ মারসাদ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল ইসাবা-৩/৩৯৮)।

মিসতাহ ইবন উসাসা (রা)

আবু আহমাদ ইবন জাহাশ (রা)

Leave a Reply