আবু আহমাদ ইবন জাহাশ (রা)

আসল নাম আবদ মতান্তরে আবদুল্লাহ, ডাকনাম আবু আহমাদ। পিতা জাহশ ইবন রিয়াব এবং মাতা উমাইমা বিনতু আবদিল মুত্তালিব। একদিকে রাসূলুল্লাহ সা: এর ফুফাতো ভাই, অন্যদিকে রাসুল সা: এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নাব বিনতু জাহাশের আপন ভাই। (আনসাবুল আশরাফ-১/৮৮, আল ইসাবা-৪/৩)।

মক্কায় রাসূলুল্লাহর সা: ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বে আহমাদ তার অন্য দুই ভাই- আবদুল্লাহ ও উবায়দুল্লাহর সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কায় রাসূলুল্লাহ সা: হযরত আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে আশ্রয় নেওয়ার পূর্বেই তাদের ইসলাম গ্রহণের কাজটি সম্পন্ন হয়। বালাযুরী বলেছেন, তার অন্য দুই ভাই আবদুল্লাহ ও উবাদুল্লাহ হাবশায় হিজরাত করলেও তিনি হাবশায় হিজরাত করেননি। তিনি আরও বলেছেন, যে সব বর্ণনায় তার হাবশায় হিজরাতের কথা পাওয়া যায় তা সবই ভিত্তিহীন। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৯৯)।

ইবন ইসহাক আবু আহমাদের পরিচয় ও মদীনায় হিজরাত সম্পর্কে বলেন: আবু সালামার পর সর্ব প্রথম যারা মদীনায় আসেন, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি নিজ পরিবার এবং অন্য এক ভাই- আবু আহমাদকেও সংগে নিয়ে আসেন। এই আবু আহমাদ এক অন্ধ ব্যক্তি। তিনি মক্কার উঁচু নীচু ভূমিতে কারও সাহায্য ছাড়া ঘুরে বেড়াতেন। আবু সুফইয়ানের কন্যা ‘ফারয়া’ তার স্ত্রী। আর তার মা আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা উমাইমা।

তারা ঘর বাড়ী ছেড়ে মদীনায় চলে এলে একদিন ‍উতবা ইবন রাবীয়া, আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিব ও আবু জাহল ইবন হিশাম তাদের পরিত্যক্ত বাড়ীর পাশ দিয়ে মক্কার উঁচু ভূমির দিকে যাচ্ছিল। উতবা খালি বাড়ীটির দিকে ইঙ্গিত করে কবি আবু দুওয়াদ আল ইয়াদীর একটি কবিতার শ্লোক আওড়িয়ে আফসুসের সুরে বলে: বনী জাহাশের বাড়িটি একেবারেই খালি হয়ে গেল। আবু জাহল তার জবাবে বললো: এতো আমাদের ভায়ের ছেলের কাজেরই পরিণাম। সে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে, আমাদের সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে আমাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।…। মদীনায় কুবার বনী আমর ইবন আওফের পল্লীতে আবু সালামা ইবন আবদিল আসাদ, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ ও আবু আহমাদ বসবাস করতেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৭০-৪৭২)।

 মদীনায় পৌঁছে প্রথমত: তিনি হযরত মুবাশশির ইবন আবদিল মুনজিরের অতিথি হন। মক্কায় একদল লোকের সার্বক্ষণিক কাজ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানো এবং মুসলমানদের কষ্ট দেওয়া। এই দলটির প্রধান ছিল দুই ব্যক্তি: আবু সুফইয়ান ও আবু জাহল। আবু আহমাদ আগে ভাগে হিজরাত করে তাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় সরাসরি তাদের অত্যাচার থেকে বেঁচে যান। তবে আবু সুফইয়ান তাদের পরিত্যক্ত বাড়ীটি অন্যায়ভাবে আমর ইবন আলাকামার নিকট বিক্রি করে দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৯৯)

সম্ভবত আবু সুফইয়ানের মেয়ে ‘ফারয়া’ ছিল এই বাড়ীর পুত্রবধূ, সেই অধিকারে সে বাড়িটি বিক্রি করে। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৫০০)। হিজরী ৮ম সনে মক্কা বিজয়ের পর আবু আহমাদ তাদের বাড়ীর প্রসঙ্গটি রাসূল সা: এর নিকট উত্থাপন করেন। লোকেরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে: আবু আহমাদ, আল্লাহর পথে যা তোমরা হারিয়েছ, এখন ‍তা আবার দাবী কর- রাসূল সা: পছন্দ করেননা। অন্য একটি বর্ণনা মতে আবু আহমাদের দাবীর পর হযরত রাসূলে কারীম সা: হযরত উসমানের (রা) মাধ্যমে তাকে কিছু বলে পাঠান। হযরত উসমান (রা) সে কথা তাকে কানে কানে বলেন। তারপর মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত বাড়ী সম্পর্কে আর একটি কথাও তিনি উচ্চারণ করেননি। পরে তার সন্তানদের কাছে জানা গেছে হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে বাড়ীর দাবী ত্যাগ করতে বলেন এবং বিনিময়ে তাকে জান্নাতে একটি প্রাসাদের সুসংবাদ দান করেন।

তবে তিনি আবু সুফইয়ানের উদ্দেশ্যে একটি জ্বালাময়ী কবিতা রচনা করেন। তার কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ: তোমরা আবু সুফইয়ানকে বলে দাও, সে যা করেছে তার পরিণাম লজ্জা ও অনুশোচনা। তুমি চাচতো ভাইদের বাড়ী বিক্রি করে নিজের ঋণ পরিশোধ করেছ।

মানুষের রব আল্লাহর নামে আমি শক্ত কসম করেছি। যাও, নিয়ে যাও, যা, আমি সেই অর্থ তোমার গলায় কবুতরের গলার মালার মতো মালা বানিয়ে দিলাম, (যা আর কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না বা বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না)। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/ ৬৪৪)।

রাসূল সা: আযাদকৃত দাস যায়িদ ইবন হারিসার সাথে হযরত যয়নাব বিনতু জাহাশের বিবাহ বিচ্ছেদ হলে আবু আহমাদই তাকে রাসূল সা: এর সাথে বিয়ে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৬৪৪) হযরত আবু আহমাদ মদীনায় ইনতিকাল করেন। (আনসাবুল আশরাফ-১/ ১৯৯)।

তবে তার মৃত্যুর সময় সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ আছে। ইবনুল আসীর দৃঢ়ভাবে বলেছেন: তিনি বোন যয়নাব বিনতু জাহাশের পরে মারা গেছেন। অর্থাত হিজরী ২০ সনের পরে। কারণ হযরত যয়নাব মারা যান হি: ২০ সনে। ইবন ‍হাজার এ মত সমর্থন করেননি। তিনি বলেন, এমন বর্ণনাও তো আছে যে, আবু আহমাদের মৃত্যুর পর তার বোন যয়নাব কিছু খোশবু আনিয়ে তার গায়ে লাগিয়ে দেন। বুখারী ও মুসলিমে যয়নাব বিনতু উম্মু সালামা থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন: আমি যয়নাব বিনতু জাহাশের এক ভায়ের মৃত্যুর সময় যয়নাবের ঘরে যাই। তিনি কিছু খোশবু আনিয়ে তার গায়ে লাগিয়ে দেন। ইবন হাজার বলেন, ‍এটা আবু আহমাদের মৃত্যুর সময়ের ঘটনা হবে। কারণ যয়নাবের অন্য দুই ভাই আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর সা: জীবদ্দশায় উহুদে শহীদ হন এবং উবায়দুল্লাহ মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী অবস্থায় হাবশায় মৃত্যুবরণ করে। তার স্ত্রী উম্মু হাবীবাকে রাসূল সা: বিয়ে করেন। (আল ইসাবা-৪/৪)।

Leave a Reply