হিশাম ইবনুল আস (রা)

নাম হিশাম, কুনিয়াত বা ডাক নাম আবুল আস ও আবু মুতী। ইবন হিব্বান বলেন: জাহিলী যুগে হিশামের কুনিয়াত ছিল আবুল আস অর্থাত অবাধ্যের পিতা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা: তা পরিবর্তন করে রাখেন আবু মুতী- অনুগতের পিতা। (আল ইসাবা-২/৬০৪) তার পিতা আল আস ইবন ওয়ায়িল। কুরাইশ গোত্রের বনী সাহম শাখার সন্তান। মিসর বিজয়ী প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আমর ইবনুল আসের ছোট ভাই।

সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য বয়সের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে না। হিশাম আমর অপেক্ষা ছোট হলেও বড় ভাইয়ের চেয়ে অধিকতর সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন। আমর যখন পৌত্তলিকতার অন্ধকারে হাবুডুব খাচ্ছেন, হিশামের ললাট তখন ইসলামের নূর ঝলক দিচেছ। মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই তিনি তা কবুল করেন এবং মক্কাবাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুহাজিরদের একটি কাফিলার সাথে হাবশায় চলে যান। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর এই মিথ্যা গুজব শুনেন যে, মক্কাবাসীরা ইসলাম কবুল করেছে, তখন অনেকের সাথে তিনিও মক্কায় ফিরে আসেন। এখান থেকে আবার মদীনায় হিজরাতের পরিকল্পনা করেন; কিন্তু তার পিতা ও খান্দানের লোকদের হাতে বন্দী হন।

এ সম্পর্কে উমার ইবনুল খাত্তাবের বর্ণনা বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি বলেন: ‘আমরা মদীনায় হিজরাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। আমি আইয়াশ ইবন রাবীয়া ও হিশাম ইবনুল আস- এ তিনজন মক্কা থেকে ছয় মাইল দূরে ‘তানদুব’ উপত্যকায় বনী গিফারের ‘উদাত’ নামক কূপের নিকট এই অঙ্গীকার করলাম আমাদের প্রত্যেকেই আগামীকাল সকালে এখানে উপস্থিত হবে। কেউ ব্যর্থ হলে অবশ্যই সে বন্দী হবে। আমি ও আইয়াশ সময়মত হাজির হলাম; কিন্তু হিশাম বন্দী হয়ে অত্যাচারিত হলো। আমরা মদীনায় পৌঁছে কুবার বনী আমর ইবন আওফের অতিথি হলাম। এদিকে আইয়াশকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবু জাহল ইবন হিশাম ও হারিস ইবন হিশাম মদীনায় এলো। তারা দুজন ছিল আইয়াশের চাচাতো ভাই এবং সকলেই একই মায়ের সন্তান। রাসূল সা: তখন মক্কায়। তারা আইয়াশকে বললো, তোমার মা শপথ করেছে, তোমাকে না দেখে চুলে চিরুণী দেবে না, রোদ থেকে ছায়াতেও যাবে না। তুমি ফিরে চল। আইয়াশের অন্তর মায়ের জন্য নরম হয়ে গেল।

উমার বলেন: আমি তাকে বারবার অনুরোধ করলাম তাদের সাথে ফিরে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইয়াশ তাদের সাথে মক্কার দিকে যাত্রা করলো। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা আইয়াশকে বেধে ফেলে এবং অত্যাচার করতে করতে মক্কায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে বন্দী করে রাখা হয়।

উমার বলেন, আমরা তখন মদীনায় বলাবলি করতাম যারা এভাবে নিজেদেরকে বিপদের সম্মুখীন করেছে আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন না। অত:পর রাসূল সা: মদীনায় আসলেন এবং কুরআনের এ আয়াত নাযিল হলো:

বল হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়োনা। আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

উমার বলে: আমি আয়াতটি লিখে গোপনে মক্কায় হিশামের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। হিশাম বলেন, আমি সে আয়াতটি মক্কার ‘যী-তুওয়া’ নামক স্থানে বসে পাঠ করতাম; কিন্তু কিছুই বুঝতাম না। অবশেষে তা বুঝার তাওফীক দানের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করলাম। তারপর আমি বুঝলাম এ ‍আয়াত আমাদের শানে নাযিল হয়েছে। অত:পর আমি মদীনায় রাসূল সা: এর নিকট পৌঁছলাম। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৪৫-৪৬) সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৭৪-৪৭৬) আল ইসাবা-৩/৬০৪)।

ইবন হিশাম বলেন: আমার বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, মদীনায় একদিন রাসূল সা: বললেন: আইয়াশ ইবন রাবীয়া ও হিশাম ইবনুল আসের ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে কে আমাকে সাহায্য করতে পারে? ওয়ালীদ ইবনুল ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, তাদের ব্যাপারে আমি ‍আপনাকে সাহায্য করবো। অত:পর তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। গোপনে মক্কায় প্রবেশ করে তিনি এক মহিলাকে দেখলেন, খাবার নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন: আল্লাহর বান্দী, কোথায় যাচ্ছ? সে বললো: আমি যাচ্ছি এই দুই বন্দীর কাছে। অর্থাত আইয়াশ ও হিশামের কাছে। ওয়ালীদ মহিলাকে অনুসরণ করে বন্দীশালাটি চিনে নিলেন। তাদেরকে একটি ছাদবিহীন ঘরে বেধে রাখা হয়েছিল। তখন রাত হলো, ওয়ালীদ দেওয়াল টপকে তাদের কাছে পৌঁছে গেলেন এবং একটি পাথরের সাহায্যে তাদের বাধন কেটে দিলেন। তারপর তিন জন এক সাথে বেরিয়ে ওয়ালীদের উটে সওয়ার হয়ে মদীনায় পালিয়ে আসেন। তাদের একমাত্র বহান উটটি হোচট খেলে ওয়ালীদের একটি আংগুল আহত হয়ে রক্ত রঞ্জিত হয়। তিনি স্বীয় অঙ্গুলিকে উদ্দেশ্য করে এই শ্লোকটি আবৃত্তি করেন: ‘ হাল আনতি ইল্লা উসবুয়িন দামাইতি ওয়া ফী সাবীলিল্লাহি মা লাকীতি।

ওহে, তুমি একটি অঙ্গুলি ছাড়া আর তো কিছু নও, যা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। তোমার যা কিছু হয়েছে, তাতো আল্লাহর রাস্তায়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১ ৪৭৬)

বদর, উহুদ, খন্দকের যুদ্ধ মক্কায় হিশামের বন্দী দশায় শেষ হয়। খন্দক যুদ্ধের পর তিনি মদীনায় আসেন। খন্দকের পর কাফিরদের সাথে যতগুলি যুদ্ধ হয়েছে, সবগুলিতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ওয়াকিদী বলেন, মক্কা বিজয়ের পূর্বে রমযান মাসে রাসুলুল্লাহ সা: হিশামকে এক অভিযানে পাঠান। (আল ইসাবা-৩/৬০৪)

সেনা পরিচালনা, বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন এসব ছিল হিশামের খান্দানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ পরিবারের সন্তানেরা তরবারির ছায়াতলেই বেড়ে ওঠতো। রাসূল সা: এর ওফাতের পর হযরত আবুবকরের খিলাফতকালে তার এ বৈশিষ্টের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় জানা যায় প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা) তাকে নুঈম ইবন আবদুল্লাহ ও অন্য কতিপয় ব্যক্তি সাথে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দানের জন্য তার দরবারে পাঠান। এ প্রসঙ্গে হিশাম বলেন: কয়েক ব্যক্তির সাথে আমাকে হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠানো হয়। আমরা ‘গুতা’ বা দিমাশকে পৌঁছে জাবালা ইবন আয়হাম আল গাসসানীর বাড়ীতে উপস্থিত হলাম। আমাদের সাথে কথা বলার জন্য তিনি একজন দূত পাঠালেন। আমরা বললাম: আমাদেরকে সম্রাটের কাছে পাঠানো হয়েছে, আমরা কোন দূতের সাথে কথা বলবো না। অনুমতি দিলে আমরা তারই সাথে কথা বলবো। অবশেষে জাবালা আমাদেরকে তার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

জাবালা আমাদেরকে বললেন: আপনাদের বক্তব্য কী? হিশাম বলেন, আমি তার সামনে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরি। তখন তার ও সভাষদবৃন্দের পরিধানে ছিল কালো পোশাক। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের পরিধানে এ পোশাক কেন? তিনি বললেন: আমরা এ পোশাক পরেছি এবং শপথ করেছি, শাম থেকে তোমাদের তাড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত এগুলি খুলবো না। আমি বললাম: আল্লাহর কসম! আপনার এই সিংহাসন এবং আপনাদের সম্রাটের সাম্রাজ্য ইনশা আল্লাহ আমরা ছিনিয়ে নেব। আমাদের নবী মুহাম্মাদ সা: এমনই ভবিষ্যত বাণী করেছেন। জাবালা বললেন: আপনারা নন; বরং তারাই এর উপযুক্ত যারা দিনে সিয়াম সাধনা করে এবং রাতে ইবাদাতে দন্ডায়মান থাকে। আপনাদের সিয়াম কেমন? আমি আমাদের সিয়ামের পরিচিতি তুলে ধরলাম। তখন জাবালার চেহারা কালো হয়ে গেল। অত:পর তিনি একজন দূত সহ আমাদেরকে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠিয়ে দিলেন।

হিশাম বলেন: আমরা দূতের সাথে চলতে লাগলাম। যখন আমরা নগরের নিকটবর্তী হলাম, আমাদের সাথের দূতটি বললো: আপনাদের এই সওয়ারী পশু সম্রাটের নগরে প্রবেশ করতে পারবে না। ‍আপনারা চাইলে আমি আপনাদের জন্য তুর্কী ঘোড়া ও খচ্চরের ব্যবস্থা করতে পারবো। আমরা বললাম: আমাদের এই পশুর ওপর সওয়ার হওয়া ছাড়া অন্য কোন অবস্থায় আমরা শহরে প্রবেশ করবো না। আমাদের অনমনীয়তার কথা সম্রাটকে জানানো হলে তিনি আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আমরা তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে সম্রাটের কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম।

 এভাবে হিশাম ইবনুল আস ও তার সঙ্গীরা যখন রাজ দরবারের বাইরে নিজ নিজ পশুর পিঠ থেকে নামছিলেন তখন সম্রাট তাদেরকে তাকিয়ে দেখছিলেন। তারা যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করছিলেন, বাতাসে আন্দোলিত খেজুর গাছের পাতার মত তারা কাঁপছিল। সম্রাট লোক মারফত তাদের জানিয়ে দেন যে, এভাবে জোরে জোরে দ্বীন প্রচারের অধিকার তাদের নেই। তারা সম্রাটের কাছে গেলেন।

সম্রাট সিংহাসনে এবং রোমান সমরবিশারদরা নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট। সম্রাট হাসিমুখে তাদের বললেন: আপনারা নিজেদের মধ্যে যেভাবে সালাম ও সম্ভাষণ বিনিময় করেন, সেইভাবে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন না কেন? সম্রাটের পাশেই বসা ছিল একজন প্রাঞ্জল আরবী ভাষী। তারা বললেন: আমাদের সম্ভাষণ আপনার জন্য বৈধ নয়; আর আপনাদের সম্ভাষণও আমাদের মুখে উচ্চারণ আমাদের জন্য উচিত নয়। সম্রাট প্রশ্ন করলেন: আপনারা নিজেদের মধ্যে এবং আপনাদের বাদশাহকে কিভাবে সম্ভাষণ জানান? তারা বললেন: আসসালামু আলাইকা। সম্রাট আবার প্রশ্ন করেন: আপনাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য কি? তারা বলেন: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুওয়া আল্লাহু আকবার- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। অত:পর তারা সম্রাটের নিকট দ্বীন ইসলামের বিভিন্ন বিষয় যথা-সালাত, সাওম, হজ্জ,যাকাত ইত্যাদির পরিচয় তুলে ধরেন। এই প্রতিনিধি দল সম্রাটের অতিথি হিসাবে তিন দিন তার নিকট অবস্থান করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে এই দাওয়াতী মিশনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। (আল ইসাবা-২/ ৪৭১)। হায়াতুস সাহাবা-১/২০৪, ৪০৫, ৩/৫৫৭-৫৬২) অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে তাবলীগী মিশন নিয়ে যিনি গিয়েছিলেন তিনি এ হিশাম নন, তিনি অন্য আর এক হিশাম।(‍আল ইসাবা-৩/৭০৪)।

খলীফা হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে দু একটি সংঘর্ষের পর রোমানরা আজনাদাইনে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। হিজরী ১৩ সনের জুমাদা আল উলা মাসে সংঘর্ষ শুরু হয়। ওয়াকিদী উম্মু বকর বিনতুল মিসওয়ারের সূত্রে উল্লেখ করেছেন: এ যুদ্ধে হিশাম যখন কিছু মুসলিম সৈনিকের মধ্যে পলায়নী মনোবৃত্তি লক্ষ্য করলেন, স্বীয় মুখাবরণ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শত্রু ব্যুহের মাঝ বরাবর এগিয়ে গেলেন এবং চিতকার করে বলতে থাকলেন: ওহে মুসলিম সৈনিকবৃন্দ, আমি হিশাম ইবনুল আস। তোমরা আমার সাথে এসো। তোমরা জান্নাত থেকে পালাচ্ছ?

এই খতনাবিহীন লোকেরা তোমাদের তরবারির সামনে টিকে থাকতে পারে না। হিশামের সাথে যোগ দিয়ে মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। রোমান বাহিনী একটি সংকীর্ণ পথের মুখে জমা হয়। পথের বিপরীত দিক থেকে হিশাম আক্রমণ চালান। রোমানরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করে এবং তার লাশের ওপর দিয়ে পালিয়ে যায়। মুসলিম সৈন্যরা সেখানে পৌঁছে তার পেষা লাশটি পদদলিত হওয়ার ভয়ে শত্রু বাহিনীর পিছু ধাওয়া করতে ইতস্তত: করতে লাগলো। তখন তার বড় ভাই আমর (রা) এসে বললেন: ওহে লোক সকল, আল্লাহ তাকে শাহাদাত দান করেছেন, তার রুহটি উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তার দেহটি এখানে পড়ে আছে। অত:পর মুসলিম সৈন্যরা তার লাশের ওপর দিয়ে সংকীর্ণ পথটি অতিক্রম করে শত্রু বাহিনীর পিছু ধাওয়া করে। আমর ইবনুল আস (রা) সেই ছড়ানো ছিটানো লাশ একত্রিত করে দাফন করেন। (আল ইসাবা-৩/৬০৪)।

তবে ইবনুল মোবারকের মতে তিনি খলীফা ‍উমারের যুগে ইয়ারমুক যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। (আল ইসতীয়াব, টীকা আল ইসাবা-৩/৫৯৩-৫৯৫)

হিশাম ইবনুল আস তার ভাই আমর ইবনুল আস অপেক্ষা বয়সে ছোট হলেও বড় ভাইয়ের চেয়ে বেশি নেককার ছিলেন। হিশামের শাহাদাতের পর একবার কতিপয় কুরাইশ ব্যক্তি খানায়ে কাবার পেছনে বসে তাদের দুই ভাইয়ের সম্পর্কে আলোচনা করছিল। এমন সময় তারা আমরকে তাওয়াফরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাকে প্রশ্ন করলো: আপনাদের দুজনের মধ্যে কে উত্তম- আপনি না আপনার ভাই হিশাম? তিনি বললেন: আমার ও তার পক্ষ থেকে আমি বলছি। তার মা হাশেম ইবনুল মুগীরার মেয়ে, আর আমার মা একজন দাসী। আমাদের পিতা আমার চেয়ে ‍তাকে বেশী ভালোবাসতেন। আর প্রত্যেক পিতার তার সন্তানের ব্যাপারে দুরদৃষ্টির কথা তো তোমাদের জানা আছে। আমরা দুজন ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করেছি, সব সময় সে আমাকে পরাজিত করেছে। আমি ও সে দুজনেই যুদ্ধে যোগদান করি এবং সারারাত দুজনই শাহাদাত লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করি। আল্লাহ তার দুআ কবুল করলেন এবং ‍আমার দুআ ব্যর্থ হলো। (আল ইসাবা-১/৬০৪)

হযরত রাসূলে কারীম সা: তাদের দুই ভাইয়ের ঈমানী দৃঢ়তার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন: আসের দুই পুত্র হিশাম ও আমর মুমিন।।

হিশামের শাহাদতের খবর শুনে হযরত উমার ফারুক (রা) মন্তব্য করেছিলেন: আল্লাহ তার ওপর রহমত নাযিল করুন। তিনি ইসলামের একজন উত্তম সেব ছিলেন।

যূ-শিমালাইন উমাইন ইবন আবদি আমর (রা)।

আসল নাম উমাইর, ডাক নাম আবু মুহাম্মাদ, লকব বা উপাধি যূ -শিমালাইন। পিতার নাম আবদু আমর। খুযায়া গোত্রের সন্তান। তিনি সকল কাজ দু হাত দিয়ে করতেন বলে যূ -শিমালাইন দুখানি দক্ষিণ হস্তের অধিকারী তার উপাধিতে পরিণত হন। তার পিতা আবদু আমর ইবন নাদলা মক্কায় এসে আবদ ইবন হারেস ইবন নাদলা ইবন যাহবার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্থায়ীভাবে থেকে যান। আবদ নিজ কন্যা নুম বিনতু আবদকে তার সাথে বিয়ে দেন। তারই গর্ভে পুত্র যূ-শিমালাইন ও কন্যা রায়তা জন্ম গ্রহণ করেন। (তাবাকাত ইবন সাদ-৩/১৬৭)।

উল্লেখ্য যে, সীরাত গ্রন্থ সমূহে যূ-শিমালাইন অর্থাত দুখানি ডান হাতের অধিকারী এবং যুল ইয়াদাইন বা দুখানি হাতের অধিকারী এ দুটি লকব বা উপাধি বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদ্বয়ের কথা পাওয়া যায়। এ দুটি উপাধি কি একই ব্যক্তির না ভিন্ন দু ব্যক্তির এ সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতের অমিল দেখা যায়। অধিকাংশের মতে উপাধি দুটি একই ব্যক্তির যেমন: ইবন সা’দ তার তাবাকাতে শিরোনাম দিয়েছেন- যূল ইয়াদাইন ওয়া ইউকালু যূ আশ শিমালাইন অর্থাত যুল ইয়াদাইন এবং তাকেই যু আশ শিমালাইন বলা হয়। (তাবাকাত-৩/১৬৭)।

কিন্তু তাদের এ মত অনেকের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মতে মূলত: তারা ভিন্ন দু ব্যক্তি। হাদীদের দ্বারাও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যুল ইয়াদাইন নামক ব্যক্তির একটি ঘটনা বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। একবার রাসুল সা: চার রাকয়াতের স্থলে দুই রাকয়াত নামায আদায় করে সালাম ফিরান। সাহাবীরা তো সবাই হতভম্ব। কিন্তু কেউ কোন প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না। যুল ইয়াদাইন ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! নামায কি কম করে দেওয়া হয়েছে না কি আপনি ভুল করেছেন? রাসুল সা: সাহাবীদের নিকট তার কথার সত্যতা যাচাই করলেন। সবাই যুল ইয়াদাইনকে সমর্থন করে বললেন: আপনি দুই রাকয়াতই আদায় করছেন। সত্যতা যাচাইর পর তিনি বাকী দু রাকায়াত আদায়ের শেষে সহু সিজদাহ করেন। (বুখারী: আযান অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ইমামের সন্দেহ হলে তিনি কি মুকতাদিদের কথা গ্রহণ করবেন?)

উপরোক্ত হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরাইরা (রা)। তিনি হিজরী সপ্তম সনে খাইবার যুদ্ধের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। অন্যদিকে যু শিমালাইন তারপ পাঁচ বছর পূর্বে বদর যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। সুতরাং যুল ইয়াদাইনও যু শিমালাইন একই ব্যক্তি হতে পারেন না। তাছাড়া দুজনের নামেও পার্থক্য আছে। একজনের নাম খিরবাক ও অন্যজনের নাম উমাইর। (সিয়ারুস সাহাব, মুহাজিরিন-২/৩২৭)। আবু উমার বলেন: বদরে যূ শিমালাইন শহীদ হন তিনি যুল ইয়াদাইন নন। (আল ইসাবা-৩/৩৩)।

হযরত যু-শিমালাইন কখন এবং কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ইসলাম গ্রহণের পর মদীনায় হিজরাত করে হযরত সাদ ইবন খাইসামার অতিথি হন। রাসূল সা: ইয়াযীদ ইবন ‍হারেসের সাথে তার মুওয়াখাত বা ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্টা করে দেন। ইসলাম গ্রহণের পর খুব বেশি দিন তিনি বাঁচেননি। মদীনায় আসার পর তিনি ও তার দ্বীনি ভাই ইয়াযীদ মহান বদর যুদ্ধে যোগদান করেন। এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম ও শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তিনি কাফির আবু উসামা যুহাইর ইবন মুআবিয়া আল জুশামীর হাতে শহীদ হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ত্রিশ বছর। তার দ্বীনী ভাই ইয়াযীদ ও এ যুদ্ধে শহীদ হন। (তাবাকাত: ৩/১৬৮, আনসাবুল আশরাফ-১/২৯৫)।

কুদামাহ ইবন মাজউন (রা)

মুআইকিব ইবন আবী ফাতিমা (রা)

Leave a Comment