কুদামাহ ইবন মাজউন (রা)

নাম কুদামাহ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু উমার। পিতা মাজউন ইবন হাবীব এবং মা সুখাইলা বিনতুল আনবাস। (টীকা : সীরাতু ইবন হিশাম-১/২৫৩)।

কুরাইশ বংশের বনী জুমাহ শাখার সন্তান। হযরত উমারের বোন সাফিয়্যা বিনতুল খাত্তাব তার স্ত্রী।

হযরত কুদামাহ ইসলামের সূচনা পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা) আহবানে যে সকল ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন উসমান ইবন মাজউন ও তার অন্য দুই ভাই কুদামাহ ও আবদুল্লাহ অন্যতম। তিনি দুই হিজরাতের অধিকারী। ইসলাম গ্রহণের পর অন্য দুই ভায়ের সাথে প্রথমে তিনি হাবশায় হিজরাত করেন। অত:পর মক্কাবাসীরা সকলে ইসলামের দীক্ষা নিয়েছে এমন একটি মিথ্যা গুজব শুনে অনেকে হাবশা থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। এই প্রত্যাবর্তনকারীদের মধ্যে কুদামাহও ছিলেন। সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৬৭)।

হযরত কুদামাহ হাবশা থেকে ফিরে মক্কায় বসবাস করতে থাকেন। বদর যুদ্ধের পূর্বে আবার মদীনায় হিজরাত করেন এবং বদরে যোগদান করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তারপর উহুদ,খন্দক সহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

খলীফা হযরত উমার (রা) কুদামাহকে বাহরাইনের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকাকালেই তিন মদ পানের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তার ওপর মদ পানের নির্ধারিত শাস্তি বা ‘হদ’ জারি করা হয়। তিনি হযরত উমারের ‍সামনে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন নি এবং বদরী সাহাবী হিসাবে তার আত্মপক্ষ সমর্থন বিশ্বাসযোগ্য হলেও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে হযরত উমারের নিকট তার অপরাধ প্রমাণ হয়ে যায়। এ জন্য খলীফা তার ওপর ‘হদ’ জারী করেন। ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, একবার বনু আবদি কায়সের সরদার ‘জারুদ’ খলীফা উমারের নিকট উপস্থিত হয়ে কুদামাহর বিরুদ্ধে মদ পানের অভিযোগ দায়ের করেন। খলীফা জারুদকে বললেন, তুমি ছাড়া এ ঘটনার আর কোন স্বাক্ষী আছে কি? জারুদ হযরত আবু হুরাইরাকে (রা) সাক্ষী মানলেন। উমার (রা) আবু হুরাইরাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। আবু হুরাইরা বললেন, তিনি কুদামাহকে কখনও মদ পান করতে দেখেননি, তবে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বমি করতে দেখেছেন। উমার (রা) বললেন, শুধু এ সাক্ষ্যে অপরাধ প্রমাণ হয় না। আরও অনুসন্ধানের জন্য তিনি কুদামাহকে বাহরাইন থেকে মদীনায় ডেকে পাঠালেন। কুদামাহ মদীনায় পৌঁছলেন। জারুদ আবারও খলীফার নিকট তার ওপর ‘হদ’ জারী করার দাবী জানালো। উমার (রা) তাকে বললেন তুমি সাক্ষী না বাদী? জারুদ বললো, সাক্ষী। খলীফা বললেন, তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করেছো, এখন চুপ থাক। অত:পর জারুদ আবারও খলীফার নিকট ‘হদ’ জারির ‍তাকিদ দিল। তার এই বাড়াবাড়ির ‍কারণে হযরত উমারের মনে সন্দেহ দেখা দিল। তিনি জারুদকে বললেন: তোমার জিহবা সংযত রাখ, অন্যথায় তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। প্রত্যুত্তরে জারুদ খলীফাকে বললো, উমার, আপনার চাচাতো ভাই মদ পান করেছে আর আপনি উল্টো আমাকে শাসাচ্ছেন- এ তো কোন ইনসাফের কথা নয়। এ পর্যায়ে হযরত আবু হুরাইরা (রা) খলীফাকে বললেন, ইয়া আমীরুল মুমিনীন, আমাদের সাক্ষ্যের ব্যাপারে আপনি সংশয় পোষণ করলে কুদামাহর স্ত্রী তথা ওয়ালীদের মেয়ে হিন্দাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। উমার (রা) তাকে ডেকে পাঠান। তিনিও স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।

এবার উমারের (রা) আদল ও ইনসাফ বা সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতা উথলে উঠলো। তিনি কুদামাহকে বললেন, কুদামাহ, শাস্তি গ্রহণের জন্য তৈরী হয়ে যাও। জবাবে কুদামাহ বললেন, তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী যদি ধরেও নেওয়া যায় আমি মদ পান করেছি, তবুও আমার ওপর ‘হদ’ জারী করার কোন অধিকার আপনার নেই। উমার (রা) প্রশ্ন করলেন, কেন? কুদামাহ পবিত্র কুরআনের সূরা মায়িদাহর ১১ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করে শুনান। আল্লাহ বলছেন: যারা ঈমান এনেছে এবং আমলে সালেহ বা সতকাজ করেছে, তারা যা খেয়েছে তার জন্য তাদের কোন পাপ নেই। যখন তারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, ঈমান এনেছে এবং আমলে সালেহ করেছে। (সূরা মায়িদা-১১)।

উমার (রা) বললেন, কুদামাহ তুমি আয়াতটির অর্থ বিকৃত করছো। তুমি আল্লাহকে ভয় করলে অবশ্যই হারাম জিনিস থেকে বিরত থাকতে। হযরত কুদামাহ তখন অসুস্থ ছিলেন। এ কারণে খলীফা অন্যান্য সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে কিছুদিনের জন্য ‘হদ’ জারি বা শাস্তিদান মূলতবী রাখেন। কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর ‘হদ’ মূলতবী রাখা উমারের জন্য ছিল অসহনীয়। তিনি দ্বিতীয়বার সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। এবারও সকলে ‘হদ’ মূলতবী রাখার পক্ষে মত ব্যক্ত করলেন। কিন্তু খলীফা উমার বললেন: আমি আল্লাহর সাথে মিলিত হই, আর তার বোঝা আমার কাঁধে চাপুক, এ অবস্থার চেয়ে সে চাবুকের নিচে মৃত্যুবরণ করুক- এটাই আমার অধিক কাম্য। তিনি আর দেরী করলেন না। কুদামাহর অসুস্থতার মধ্যেই তার ওপর হদ জারি করেন এবং তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

এ ঘটনার কিছুদিন পর দুজন আবার এক সাথে হজ্জ আদায় করেন। মদীনায় ফেরার পথে উমার (রা) এক স্থানে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে কুদামাহর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার নির্দেশ লাভ করেন। ঘুম থেকে জেগেই তিনি কুদামাহকে ডেকে পাঠান। কিন্তু কুদামাহ আসতে অস্বীকৃতি জানান। উমার (রা) দ্বিতীয়বার লোক পাঠিয়ে বলেন, স্বেচ্ছায় না এলে জোর করে ধরে আনা হবে। কুদামাহ আসলেন। খলীফাই প্রথম আলোচনার সূচনা করলেন। অত:পর দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলে কারীমের সা: ওফাতের পর একমাত্র কুদামাহ ছাড়া আর কোন বদরী সাহাবী মদ পানের অভিযোগে সাজা প্রাপ্ত হননি। (আল ইসাবা-৩/২২৯)।

হযরত কুদামাহর (রা) মৃত্যুসন সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। প্রসিদ্ধমতে তিনি হযরত আলীর (রা) খিলাফতকালে হিজরী ৩৬ সনে ৬৮ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। অন্য একটি মতে তার মৃত্যুসন ৫৬ হিজরী।

হাজ্জাজ ইবন ইলাত (রা)

হিশাম ইবনুল আস (রা)

Leave a Reply