Home

  • আশুরা শুধুমাত্র শোক আর বিশ্লেষণের জন্য নয়

    আশুরা শুধুমাত্র শোক আর বিশ্লেষণের জন্য নয়

    :: আশুরা শুধুমাত্র শোক আর বিশ্লেষণের জন্য নয়; বরং নব্য ফিরাউন (আমেরিকা) ও মুসলিম ভূমিসমূহে তার সহকারী হামান আর কারুনদের উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই দিনের মূল শিক্ষা ::

    মহররম মাস এবং বিশেষ করে আশুরার দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই পবিত্র এবং পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপুর্ন। বেশ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনার অবতারনা এই মাসেই হয়েছিল যা চিরকাল মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আশুরা বলতে আমরা অনেকেই শুধু কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকেই স্মরণ করি কিন্তু এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত নই যে এই মহররমেই আল্লাহ সুবহানাওয়াতা’লা মুসা (আ) কে বিজয় দান করেছিলেন অত্যাচারী যালেম ফিরাউনের বিরুদ্ধে। তাই এটি শুধু শোকের মাস নয়, বরং যুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংকল্পবদ্ধ হওয়ার মাস। ঐতিহাসিক কারণ ছাড়াও কুরআন এবং সুন্নাহতে এই মাসকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন:

    “১২ মাস এর বছরের ভেতর ৪টি হল পবিত্র। ধারাবাহিক তিনটি মাস – যু’ল কা’দা, যু’ল হিজ্জা এবং মহররম, এবং রজব মুদার যেটি জুমাদিল আখির এবং শা’বান এর মাঝখানে অবস্থান করে” [বুখারি # ২৯৫৮] 

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে মহররম সহ উপরোক্ত মাসগুলোকে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করে বলেন:

    “অতএব তোমরা এই মাসগুলোতে (দ্বীনের বিরুদ্ধাচরণ ও এই মাসগুলোর সম্মানহানি করে এমন কাজ করে) নিজেদের ক্ষতিসাধন করো না” [সুরা তওবাহ: ৩৬]

    ইবনে আব্বাস (রা) এই “নিজেদের ক্ষতিসাধন করো না” আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন এই চারটি মাসকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র ঘোষণা করেছেন। তাই এই মাসগুলোতে নিজেদের (আল্লাহর বিরুদ্ধাচার করার মাধ্যমে) ক্ষতি করা হবে খুবই গুরুতর অপরাধ এবং অন্যদিকে ন্যায়ের কাজের সাওয়াবও হবে অনেক বেশী। তাই এই আশুরার দিনে যেমন আমরা রোজা রেখে সাওয়াব হাসিল করার চেষ্টা করছি, ঠিক তেমনি খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরয কাজে গাফিলতি করে আমরা নিজেদের ক্ষতিসাধন করছি। 

    আমরা যখন কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসেইন (রা) এর করুণ ঘটনা নিয়ে মর্মাহত হই, আমাদের এই চিন্তা করা উচিৎ কী কারণে আল্লাহর রাসুলের (সা) কলিজার টুকরা হুসেইন (রা) নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন। যেখানে শুধুমাত্র ভুলভাবে খলীফা নিয়োগ দেয়ার কারণে প্রিয় হুসাইন নিজের জীবন আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে দিলেন সেখানে আমরা আজ ৯০ বছর পার করে দিয়েছি খিলাফত বিহীন অবস্থায়; ভুলভাবে খলীফা নিয়োগ তো পরের বিষয়! খিলাফত যে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর জন্য জীবনমরণ (Life and Death) একটি বিষয় সেটির শিক্ষা আমরা আশুরার দিনে ইমাম হুসেনের আত্মত্যাগ থেকে পাই। খিলাফত যাতে কলুষিত না হতে পারে তার জন্য তিনি শুধু নিজের নয় বরং তার সন্তানকেও আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করেছিলেন কিন্তু তারপরও পিছপা হননি। তাই কারবালা আমাদের শিক্ষা দেয় যালিমের শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে খিলাফতের পক্ষে লড়তে এবং প্রয়োজনে নিজেদের সর্বস্ব উৎসর্গ করতে।

    মহররমের এই মাস আমাদের আরও স্মরণ করিয়ে দেয় মুসা (আ) এর সংগ্রাম ফিরাউন ও তার সহকারী হামান-কারুনদের বিরুদ্ধে। তাদের যুলুমের মাত্রা যখন বেড়ে গিয়েছিল এবং তারা যখন নিজেদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভাবা শুরু করেছিল, ঠিক তখনি মুসা (আ) বনি ইসরায়েলিদের নিয়ে ফিরাউনের শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। ফিরাউন যেভাবে নিজেকে খোদা ভাবতো ঠিক সেভাবে আজকের নব্য-ফেরাউন আমেরিকাও আবির্ভূত হয়েছে যুলুমের খড়গ নিয়ে। আর আমেরিকার হামান-কারুনদের ভেতর রয়েছে মুসলিম ভূমিসমূহের শাসকরা। বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখবো খুনি হাসিনাও আজ দেশকে ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে এবং তার খোদা আমেরিকার বলে বলীয়ান হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাই মহররম ও আশুরার শিক্ষা এই হওয়া উচিৎ যে আমরা সেই একই পথে হাঁটবো যে পথে মুসা (আ) হেঁটেছিলেন এবং বনী ইসরায়েলকে জুলুমের নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছিলেন। নব্য-ফেরাউনি শাসনব্যবস্থা তথা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রকে উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে মহররমের শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন।

  • কুরআন-এর সাত হরফে নাযিল হওয়া

    কুরআন-এর সাত হরফে নাযিল হওয়া

    আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন: “এই কুরআন সাতটি ভিন্ন হরফে নাযিল হয়েছে, সুতরাং কুরআন হতে যা তোমাদের জন্য সহজতর হয় তা পাঠ কর“। [মুত্তাফাকুন আলাইহি] 

    তিনি (সা) আরো বলেছেন: “জিবরাঈল আমাকে একটি পদ্ধতি শিখিয়েছে এবং আমি তা অনুশীলন করতে থাকা অবস্থায় সে আমাকে আরো (পদ্ধতি) শিখিয়েছে। আমি তার কাছে আরো প্রত্যাশা করতে থাকি এবং সেও বাড়াতে থাকে যতক্ষন না (সর্বমোট) সাতটি হরফ হয়“। [বুখারী]

    সাত হরফ-এর অর্থের ব্যাপারে আলেমগণ মতবিভেদ করেছেন, তাদের মধ্যে কেউ উপনীত হয়েছেন, এটি মুতাওয়াতির পঠনে ভাষার প্রাঞ্জলতার মতভিন্নতা এবং সাতটি ভাষ্যে তা সংরক্ষিত হওয়া। (যেমন), ই’রাবের ভিন্নতা, (শব্দের) বেশি কিংবা কম হওয়া, কিংবা দ্রুততা কিংবা বিলম্ব হওয়া, পাক খাওয়া কিংবা পরিবর্তন হওয়া, শব্দের বিভিন্ন রূপ যেমন, সরু হওয়া কিংবা গুরুত্বারোপ করা, প্রবণ হওয়া কিংবা উন্মুক্ত হওয়া। তাদের মধ্যে কেউ কেউ উপনীত হয়েছেন যে এগুলো আরব ভাষ্য যা মুতাওয়াতির পঠন দ্বারা সাব্যস্ত নয়।

    অনেক গভীর পর্যালোচনা করার পর, অধিকতর শক্তির বিবেচনায় আমার উপলব্ধি অনুযায়ী ‘সাত হরফ’ আরবদের বিভিন্ন গোত্রের উপভাষা (লাহাজাত) যা হতে মৌলিকভাবে আরবী ভাষাকে নেওয়া হয়েছে এবং যা কুরআন নাযিল হবার সময়ে আরবীর প্রাঞ্জলতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এর কারণ হচ্ছে কুরআনের পঠন মুতাওয়াতির হওয়া আরবদের গোত্রসমূহ হতে পৃথক কোনো বাস্তবতা ছিল না (অর্থাৎ, বিভিন্ন গোত্রের উপভাষাতেই সেসব গোত্রের ব্যক্তিগণ কর্তৃক কুরআন মুতাওয়াতিরভাবে বর্ণিত হয়েছে)। কুরআন নাযিলের সময় সাতটি সুপরিচিত প্রাঞ্জল আরবী উপভাষা ছিল, যা হলো:

    ১) কুরাইশ

    ২) তামিম

    ৩) কায়েস

    ৪) আসাদ

    ৫) হুযাইল

    ৬) কিনানাহ 

    ৭) তা’ঈ

    সুতরাং, এ বিষয়ে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালি বুঝ বলে আমি মনে করি অর্থাৎ, সাত হরফ হচ্ছে উপরিউক্ত সাতটি গোত্রের উপভাষা। তবে এক্ষেত্রে বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে কুরআন এ সাত গোত্রের ভাষার যেকোন শব্দ দ্বারা পড়া যাবে এমনটি নয়, কেবলমাত্র যেসব বর্ণনা নবী (সা)-এর নিকট হতে মুতাওয়াতিরভাবে আমাদের কাছে এসে পৌছেছে সেগুলোই পাঠ করা যাবে। কারণ মুতাওয়াতির বর্ণনার বাইরের কোনো বর্ণনার পঠন কুরআন বলে বিবেচিত হবে না।

    [Taken from the Q&A of Sheikh ‘Ata ibn Khaleel al-Rashta]

  • খিলাফত একটি স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র একটি কুফরী শাসনব্যবস্থা

    খিলাফত একটি স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র একটি কুফরী শাসনব্যবস্থা

    সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং হিদায়াত দিয়েছেন। দরুদ এবং সালাম পেশ করছি রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রতি, যাকে মহান আল্লাহ পুরো বিশ্ববাসীর নিকট রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আরো সালাম প্রেরণ করছি তাঁর পবিত্র পরিবারের উপর, সাহাবাগণ (রা)-এর উপর এবং পরবর্তীতে যারা তাঁদের অনুসরণ করেছেন।

    আজ আমরা আলোচনা করবো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে, যে বিষয়টি নিয়ে বেশিরভাগ সাধারণ মুসলিম অজ্ঞতার মধ্যে রয়েছেন। সে বিষয়টি হচ্ছে “খিলাফাহ একটি স্বতন্ত্র (Unique) শাসনব্যবস্থা”। এবং আলোচনা শেষে “গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একটী কুফরী শাসনব্যবস্থা” নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। চেষ্টা করবো যতটুকু সহজ, সংক্ষিপ্তভাবে ও দলীল সহকারে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা যায়।

    এই আলোচনার উদ্দেশ্য:

    বর্তমান মুসলিম উম্মাহ ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। ধীরে ধীরে তারা ইসলাম ও রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকার কারণে ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণে এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও মানবরিচত কুফরী ব্যবস্থার মৌলিক কারণগুলো সঠিক চিহ্নিত না করার ফলে তাদের ইসলাম সম্পর্কে আন্তরিক চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। আমার এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পৃথিবীতে বর্তমানে যত মানবরচিত কুফরী শাসনব্যবস্থা আছে তাঁর সাথে ইসলামী শাসনব্যবস্থা তথা খিলাফাহ’র মৌলিক যেসব পার্থক্য আছে তা তুলে ধরে যাতে এই উম্মাহ অন্যান্য শাসনব্যবস্থা দ্বারা বিভ্রান্ত হতে না পারে।

    ইসলামী শাসনব্যবস্থা তথা খিলাফাহ’র সংজ্ঞা:

    শুরুতেই আসা যাক, খিলাফাহ কাকে বলে?

    “ইসলামী শাসনব্যবস্থা বলতে খিলাফাহ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বোঝায়। যা এ মহাবিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক নির্ধারিত এবং রাষ্ট্রের প্রধান খলীফা; যিনি মুসলিমদের বায়াতের মাধ্যমে নিযুক্ত হয়ে থাকেন। এই বিষয়ে অকাট্য দলিল হচ্ছে আল্লাহ’র কিতাব, রাসূল (সা) এর সুন্নাহ এবং সাহাবাদের (রা) ইজমা (ঐক্যমত)”।

    তাহলে উপরোক্ত এই সংজ্ঞা থেকে আমরা পাচ্ছি,

    • এটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক একমাত্র নির্ধারিত শাসনব্যবস্থা।
    • রাষ্ট্রের প্রধান হচ্ছে “খলীফা”
    • খলীফা মুসলিমদের বাইয়াতের মাধ্যমে নিযুক্ত হয়ে থাকেন।
    • খিলাফত থাকার বাধ্যবাধকতা আল্লাহ’র কিতাব, রাসূল (সা) এর সুন্নাহ ও ইজমা আস-সাহাবা (রা) দ্বারা প্রমাণিত।

    সংক্ষেপে বলা যায়, খিলাফাহ শাসনব্যবস্থায় একজন খলীফা শুধুমাত্র ইসলামী শরীয়াহ(কুর’আন, সুন্নাহ, ইজমা আস-সাহাবা, ক্বিয়াস) দিয়েই শাসন করতে পারবেন। মূলতঃ এই কারণেই পৃথিবীতে যত মানবরচিত কুফরী শাসনব্যবস্থা আছে তার থেকে খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা স্বতন্ত্র। যেসব মানবরচিত ব্যবস্থার সাথে আমরা খিলাফাহ ব্যবস্থাকে গুলিয়ে ফেলি তা নিম্নে দেওয়া হল এবং তাঁদের সাথে খিলাফাহ ব্যবস্থার মৌলিক যে পার্থক্য তা আলোচনা করা হল।

    • খিলাফাহ শাসন কাঠামো রাজতান্ত্রিক নয়।
    •  খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অনুরূপ নয়।
    • খিলাফাহ ফেডারেল রাষ্ট্রও নয়।
    • খিলাফাহ প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাও নয়।
    • খিলাফাহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও নয়।
    • খিলাফাহ কোন ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়।
    • খিলাফাহ কোন সর্বব্যাপারে নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্র নয়।
    • খিলাফাহ মন্ত্রী-পরিষদ দ্বারা শাসিত কোন ব্যবস্থা নয়।

      আসুন, সংক্ষেপে এগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
    • খিলাফাহ শাসন কাঠামো রাজতান্ত্রিক নয়:

    রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজা হচ্ছে সকল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাজা যে সিদ্ধান্ত নিবে, সেটাই জনগণের জন্য প্রযোজ্য হয়। রাজার ছেলে রাজার মৃত্যুর পর পরবর্তী রাজা হিসেবে ক্ষমতা ভোগ করে। রাজা যেহেতু নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে তার দরুন সে নিজে আইন প্রণেতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ফলে সে নিজেকে সকল আইনের উর্ধে রাখে। এইভাবে তিনি সকল প্রকার জবাবদিহিতা থেকেও মুক্ত থাকেন, যদিও তিনি জনগণের অধিকারসমূহ প্রদান করেন না।

    এখন আসা যাক, খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা এবং রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কোথায়…

    খিলাফাহ রাজতন্ত্র
    এই ব্যবস্থায় সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক থাকেন একমাত্র আল্লাহ।এই ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে রাজা বা বাদশা নিজেকে দাবি করে।
    এই শাসন ব্যবস্থায় কুর’আন, সুন্নাহ, ইজমা আস-সাহাবা এবং ক্বিয়াস দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়।এই শাসনব্যবস্থায় বাদশা যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে দাবি করে সেহেতু তাঁর বানানো আইন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়।
    খলীফা জবাবদিহিতার উর্ধে নন।বাদশাহ জবাবদিহিতার উর্ধে থাকেন।
    এই ব্যবস্থায় খলীফা নিয়োগের পদ্ধতি হলো জনগণের বাইয়াত।এই ব্যবস্থায় রাজপুত্র উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা পেয়ে থাকেন।
    খলীফা রাষ্ট্রের কোন প্রতীক নন।এই ব্যবস্থায় বাদশাহকে জাতির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

    আশা করা যায়, এই বিষয়টি পরিষ্কার হবে যে, খিলাফাহ শাসন ব্যবস্থা আর রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আলাদা। সুতরাং, খিলাফাহ ব্যবস্থা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুরূপ নয়।

    • খিলাফাহ ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অনুরূপ নয়:

    সাধারণ অর্থে সাম্রাজ্যবাদ হলো সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্খা। অপর রাজ্য গ্রাস করে রাজ্য জয় করে, সেই অঞ্চলের মানুষকে জোর করে বিদেশি শাসনাধীনে আনা এবং তাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা। যেসব রাষ্ট্র তাদের শাসন ব্যবস্থাতে সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিস্থাপন করে, তারাই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র।

    ইতিহাসের পাতায় আলেকজান্ডার, চেংগিস খাঁ বা নেপোলিয়ান ছিল অতীতের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শাসকের উদাহরণ। আর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অতীতে উক্ত ব্যক্তিদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পিছনে ছিল বংশগত বা ব্যক্তিগত আকাঙ্খা ও উচ্চাভিলাষ। আর বর্তমানে রাষ্ট্রগুলো কর্পোরেট স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠে।

    ১৯১৮ সালে ফ্রান্সে লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে খুব ছোট একটি সংজ্ঞায় এনেছেন,

    “সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর”। অর্থ্যাৎ এরা সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের মাধ্যমে পুঁজির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এইসব রাষ্ট্রগুলো তাদের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ঔপনিবেশ স্থাপন করে ক্রমাগত শোষণের মাধ্যমে কেন্দ্রকে শক্তিশালী করে। যা আমরা বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি দেশগুলোর প্রকৃতিতে দেখতে পাই।

    খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। খিলাফাহ ব্যবস্থা বিশ্বের স্থানে, বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের শাসন করা সত্ত্বেও ইতিহাস থেকে আমরা কখনোই পাই না যে, খিলাফাহ সবসময় কেন্দ্রকে সমৃদ্ধ করেছে। যদিও পুরো রাষ্ট্রই একটি কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

    খিলাফাহ রাষ্ট্রের লক্ষ্যই হচ্ছে অধীনস্থ অঞ্চলের জনগণের মাঝে সমতা তৈরি করা। রাষ্ট্রের প্রতিটি জনগণের (মুসলিম ও অমুসলিম) পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়েছে। পাশাপাশি তাঁদের নাগরিক কর্তব্যও নির্ধারণ করেছে। খিলাফাহ রাষ্ট্র কখনোই তাঁর অধীনস্থ এলাকাগুলোকে ঔপনিবেশ হিসেবে দেখে না এবং এলাকাগুলো থেকে এবং এলাকাগুলো থেকে লুটপাট করে কেন্দ্রকে সমৃদ্ধ করে না। সেই অধীনস্ত এলাকাগুলো কেন্দ্র থেকে এলাকাগুলো থেকে যত দূরেই থাকুক না কেন, তারা যে বর্ণেরও থাকুক না কেন, তাদের কখনোই বিভিন্ন হিসেবে মনে করেনা। খিলাফাহ রাষ্ট্র তাঁর প্রতিটি অঞ্চলের নাগরিককে সমান গুরুত্ব এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনে করে। খিলাফাহ’র কেন্দ্রে যে নাগরিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করে একইভাবে প্রান্তিক নাগরিকও একই সুবিধা ভোগ করে। ইতিহাস থেকে এরকম অসংখ্য উদাহরণ পেশ করা যায়।

    • খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা ফেডারেল রাষ্ট্রের অনুরূপ নয়:

    ফেডারেল বা প্রাদেশিক রাষ্ট্র বলতে এমন কিছু রাষ্ট্রকে বুঝায় যেখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলসমূহ স্বায়ত্বশাসন যোগ করে এবং সাধারণ কিছু নিয়মকানুনের দিকে ঐক্যবদ্ধ থাকে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ইত্যাদি। এই সব প্রদেশ থেকে যে পরিমাণ ট্যাক্স সংগ্রহ করা হয়, যা ঐ সব প্রদেশেই উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয়।

    খিলাফাহ রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রদেশ থাকলেও এটা মূলতঃ প্রচলিত ফেডারেল রাষ্ট্র নয়। এটা প্রকৃতপক্ষে ঐক্যবদ্ধ একটি ব্যবস্থা। এই রাষ্ট্রে সব অঞ্চলে প্রয়োজনে তদানুসারে অর্থায়ন করা হয় এবং সে হিসেবে বার্ষিক বাজেট নির্ধারণ করা হয়। সুতরাং, এ ক্ষেত্রেও বলা যায়, খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা ফেডারেল ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র।

    • খিলাফাহ কোন প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়:

    মূলতঃ প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা (Republican State) এর উদ্ভব হয়েছে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা যখন জনগণের কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল, তখন জনগণের সংগ্রাম এর মাধ্যমে বাদশাহ’র নিকট যে সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল তা তারা নিজেরা নিয়ে নিলো। তারপর থেকেই প্রজারাই দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হলো এবং তাঁদের প্রতিনিধিরা আইন প্রণয়ন করতে লাগলো।

    এখানে প্রজা বা জনগণ রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করলেও প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র তারা গঠন করে তা মৌলিকগতভাবে রাজতন্ত্রের সাথে পার্থক্য নেই। সেখানে বাদশাহ ছিল আইন প্রণেতা আর এখানে প্রজারা আইনপ্রণেতা এবং দুটো ব্যবস্থাতেই আইনের উৎস মানুষ।

    খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা যে প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র তা নিম্নের পার্থক্য এর মাধ্যমে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলোঃ

    খিলাফাহ ব্যবস্থা প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা
    এটি আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক একমাত্র বৈধ ব্যবস্থাএটি মানবরচিত শাসনব্যবস্থা।
    রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা তথা আইন প্রনয়ণের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার। খলীফা শুধুমাত্র একজন আল্লাহ’র প্রতিনিধি।প্রজারাই এখানে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তারা তাঁদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করে থাকে।
    খলীফা শুধুমাত্র আল্লাহ’র প্রতিনিধি এবিং তিনি জাতির বিশেষ কোন প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন না।প্রজাদের প্রতিনিধি থাকে প্রধানমন্ত্রী বা কেবিনেট সদস্য বা মন্ত্রী-উপদেষ্টা পরিষদ এবং এখানে পুর্বের রাজা বা রাণীকে নেহায়েত প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমনঃ বৃটেন।

    সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি, খিলাফাহ ব্যবস্থা একটি Unique ব্যবস্থা যার সাথে প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে কোন সাদৃশ্য নেই।

    • খিলাফাহ কোন যাজকতান্ত্রিক বা মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়:

    যাজকতান্ত্রিক বা মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলতে যে শাসনব্যবস্থায় একজন ধর্মীয় গুরু থাকেন এবং তিনি তাদের ধর্মীয় কিতাব বলে রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা ভোগ করেন। তাদের পাদ্রী বা বিশপ বলা হয়। তারা রাষ্ট্রের শাসক নির্ধারণ করতেন জনগণের মতামত ছাড়াই। তাছাড়া তারা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী ঠিক করতেন এবং প্রয়োজনে তাদের ধর্মীয় কিতাবকে সংশোধনী করতেন। এই ধরণের শাসনব্যবস্থা আমরা ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে দেখতে পাই।

    খিলাফাহ ব্যবস্থা কখনো যাজক বা মোল্লাতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুরূপ নয়। খিলাফাহ আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক একমাত্র বৈধ ব্যবস্থা। একজন খলীফা শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর কিতাব ও রাসূল (সা)-এর সুন্নাহ দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। খলীফা কখনোই আল্লাহ’র কিতাবের বাইরে কাজ করবেন না। কিতাব সংশোধন তো প্রশ্নই আসেনা। তাছাড়া, খিলাফাহ ব্যবস্থায় এমন কোন নির্দিষ্ট আলেম বা ধর্মীয় গুরু বা আধ্যাত্মিক গুরু থাকবে না, যে শাসক নির্বাচনে বা নির্ধারণের প্যাটেন্ট পেয়ে থাকে। খলীফা নির্বাচনে পূর্ণ এখতিয়ার থাকবে জনগণের কাছে।

    তাছাড়া, যাজক বা মোল্লাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মীয় গুরু বা নেতা নিজেকে সকল ভুল ও জবাবদিহিতার উপরে রাখতে চান। কারণ, তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলেই পরিচিত। কিন্তু খিলাফাহ ব্যবস্থাইয় খলীফা আল্লাহ’র প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও “আল্লাহ’র প্রতিনিধি” বা এর বিকৃত ব্যাখ্যা দান করার কোন সুযোগ থাকবে না। এইসব বিকৃত যাজক বা মোল্লাদের আল্লাহ পাক “ইলাহ” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পবিত্র কুর’আনে আল্লাহ বলেন,

    “তারা আল্লাহ’র পরিবর্তে তাদের ধর্মযাজক ও সাধুদেরকে নিজেদের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে”। (সূরা আত-তওবা: ৩১)

    কারণ এইসব ধর্মযাজকরা হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন এর ক্ষমতা প্রয়োগ করতো আল্লাহ’র আইনের বিপরীতে। কিন্তু একজন খলীফা এরূপ করার কোন সুযোগই পাবেনা। কারণ,

    “বস্তুত সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য নয়”। (সূরা ইউসুফ: ৪০)

    “তাদের মধ্যে ফয়সালা করুন যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন তা দিয়ে”। (সূরা মায়েদা: ৪৯)

    আরো এমন অসংখ্য আয়াত আছে। উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্ট রাসূল (সা)-কে আল্লাহ দুটো পদে অধিকারী করেছিলেন:

          ১. নবুয়্যত ও রিসালাতের পদ

          ২. মুমিনদের নেতার পদ

    যেহেতু রাসূল (সা) এর মাধ্যমে নবুয়্যত ও রিসালাত সমাপ্ত হয়েছে, তাই এখন শুধু অবশিষ্ট আছে মুমিনদের নেতার পদ বা খলীফার পদ। যেটা সুস্পষ্ট একটী মানবীয় পদ। আর এই এই মানবীয় পদ মানুষই বহন করবে। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, মানুষ ভুল-ভ্রান্তি বা গুনাহের উর্ধে নয়; যা আমরা খলীফাদের ইতিহাসে দেখতে পাই। সুতরাং, খিলাফাহ একটি মানবীয় রাষ্ট্র এবং খলীফাদেরকে ভুল বা জবাবদিহিতার উর্ধে রাখা যাবে না; যেভাবে যাজকতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা দেখেছি। সুতরাং, খিলাফাহ কিছুতেই যাজকতান্ত্রিক বা মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনুরূপ নয়।

    • খিলাফাহ মন্ত্রী পরিষদ দ্বারা পরিচালিত কোন ব্যবস্থা নয়:

    এই ধরণের শাসনব্যবস্থা মূলতঃ প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেশি লক্ষণীয়। প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসঙ্কার্যে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দায়িত্বে বিভিন্ন মন্ত্রীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মিলে মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। কিন্তু এই ধরণের ব্যবস্থার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক বেশি পাওয়া যায়। যার ফলে জনগণের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অএঙ্ক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। যা আমরা আমাদের দেশসহ আরো অন্যান্য দেশে দেখতে পাচ্ছি।

    কিন্তু খিলাফাহ ব্যবস্থা মন্ত্রী পরিষদভিত্তিক ব্যবস্থা না করে সম্মিলিতভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করবে। জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে একটী একক প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় নিয়ে এসে খুব সহজেই সমস্যার সমাধান করা হবে। তাছাড়া খলীফা তাঁর কাজ সহজ করার জন্য প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী নিয়োগ দিতে পারেন।

    সুতরাং, এক্ষেত্রে এটাও নিশ্চিত হওয়া গেল, খিলাফাহ ব্যবস্থা মন্ত্রী পরিষদ দ্বারা পরিচালিত কোন ব্যবস্থা নয়।

    • খিলাফাহ কোন Totalitarian রাষ্ট্র নয়:

    Totalitarian রাষ্ট্র বলতে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ তার অধীনস্থ প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিষ্টান, দল (রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক)-কে নিজের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চায়। তাদের উপর গোয়েন্দাবৃত্তির মাধ্যমে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বর্তমানে আমরা প্রতিটি রাষ্ট্রেই এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে দেখছি; বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ইত্যাদি দেশে Totalitarian তত্ত্ব প্রয়োগ হচ্ছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, তারাই বরং খিলাফাহকে রাষ্ট্র বলে উম্মাহকে বিভ্রান্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছে। খিলাফাহ যে আসলেই এরুপ কিনা তা আমাদের জানা দরকার। আমি সংক্ষেপে বিষয়গুলো তুলে ধরবো।

    ১৯৫৬ সালে দুই মার্কিন ঐতিহাসিক Carl Friedrich এবং Zbigniew Brzezinski তাদের বিখ্যাত বই Totalitarian Dictatorship and Autocracy-তে কমিউনিস্ট নাজিদের রাষ্ট্র যে Totalitarian রাষ্ট্র ছিল তাঁর কিছু ফিচার তুলে ধরেছে। যথাক্রমে,

    •  রাষ্ট্রের আদর্শকে সবার মাঝে চাপিয়ে দেওয়া।
    •  একতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল থাকতে বাধ্য করা।
    • সামরিক বাহিনীতে রাষ্ট্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
    • গণমাধ্যমগুলোতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
    • পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র প্রতিটি বিষয়ে তার অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রতিষ্ঠা।

    সংক্ষেপে আলোচনা করলে, খিলাফাহ ব্যবস্থা কখনো তাঁর আদর্শ বা ইসলামকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দিবেনা, অতীতেও দেয়নি। খিলাফাহ’র অভ্যন্তরে শুধু যে মুসলিম বসবাস করবে এমন কোন কথা নেই। ইসলামী শারী’আহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের আমানত হিসেবে বিবেচনা করেছে। এবং সাবধান করা হয়েছে তার খিয়ানতে না করার জন্য।

    খিলাফাহ কখনো একতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠা করবে না। খিলাফাহ রাষ্ট্রে অবশ্যই একাধিক ইসলামী রাজনৈতিক দল থাকতে পারবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

    তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকবে যারা মানুষকে কল্যানের দিকে (ইসলামের দিকে) আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং (যারা এ কাজ করবে) তারা হবে সফলকাম”। (সূরা আল ইমরানঃ ১০৪)

    খিলাফাহ সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও করবে না। কারণ ইসলামী ব্যবস্থায় কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। দলগুলো শুধু আল্লাহ সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে।

    খিলাফাহ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী থাকবে এবং সেখানে আমীর-উল জিহাদ থাকবে। কিন্তু খলীফা তাঁর শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সেনাবাহিনীর ব্যবহার করতে পারবেন না।

    খিলাফাহ ব্যবস্থা তার রাষ্ট্রের media বা গণব্যবস্থার প্রতি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে না। রাষ্ট্রে সরকারি বা বেসরকারি গণমাধ্যম থাকতে পারে। বেসরকারি গণমাধ্যমকে অবশ্যই ইসলামী আক্বীদার মৌলিক নীতিমালা পূরণের শর্তে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে রাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন নেই, শুধু রাষ্ট্রকে অবহিত করলেই চলবে।

    খিলাফাহ কখনো পুলিশি রাষ্ট্র হবে না, অতীতেও ছিল না। খিলাফাহ মূলতঃ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে সমাজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। খলীফাহ নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য বর্তমান সরকারগুলোর মতো পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করবে না। তাছাড়া বর্তমানে পুলিশি হেফাজতে যেভাবে নির্যাতন করা হয়, ইসলাম কখনোই তা অনুমোদন দেয় না। এছাড়াও বর্তমানে যেভাবে নাগরিকদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা হয়, তা খিলাফাহ কখনোই করবে না; কারণ ইসলামে তা হারাম।

    খিলাফাহ কখনোই রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ করবে না। রাষ্ট্র শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে তাঁর অধিকার খাটাবে। তাছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি ইসলামী আক্বীদাহ’র সাথে সাংঘর্ষিক কিছু না করে, তাহলে রাষ্ট্র সেখানে হাত দিবে না।

    সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন নীতিনির্ধারকদের দেওয়া Totalitarian রাষ্টের বৈশিষ্ট্য দিয়েও যদি আমরা খিলাফাহ ব্যবস্থাকে মিলিয়ে দেখি তাহলে দেখবো, খিলাফাহ অত্যন্ত স্বতন্ত্র একটি শাসনব্যবস্থা যা অন্যান্য মানবরচিত ব্যবস্থার সাথে তুলনা করা অমূলক।

    • খিলাফাহ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুরূপ নয়:

    গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ সকল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। এর মাধ্যমে সেই প্রতিনিধিরা সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হয়ে যায়। এরপর তারা সংসদে গিয়ে আইন প্রণয়ন করে। 

    সুতরাং, মৌলিকগত দিক থেকে খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। খিলাফাহ শাসন ব্যবস্থায় সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। তাই, শরীয়ার বাইরে গিয়ে খলীফা একটি আইনও প্রণয়ন করতে পারেনা। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকরা হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল হিসেবে সাব্যস্ত করতে চায়, যা আমরা বর্তমানে অহরহ দেখতে পাই। সুতরাং, এই প্রেক্ষিতে বলতে গেলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটি কুফরী ব্যবস্থা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

    “এবং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারাই কাফের” (সূরা আল মায়েদা: ৪৪)

    “বস্তুত সার্বভৌম ও শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো নয়”। (সূরা ইউসুফ: ৪০)

    “কিন্তু না, তোমার রবের শপথ! তারা কিছুতেই মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের পারস্পরিক বিচার বিসম্বাদের ভার তোমার(হে মুহাম্মদ) উপর ন্যস্ত করে। আর তুমি যা-ই ফয়সালা করবে, সে সম্পর্কে তারা নিজেদের মনে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধও করবে না। বরং এর সামনে নিজদেরকে পূর্ণরূপে সোর্পদ করে দেবে”। (আন-নিসা: ৬৫)

    এইরকম আরো বহু দলিল আছে যা নিশ্চিত করে যে, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আল্লাহ তা’আলার।

    এছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়, যেখানে কোন নারী বা পুরুষ হালাল হারামের প্রতি লক্ষ্য না করেই যা খুশি তাই করতে পারে। গণতন্ত্র ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে ধর্ম ত্যাগের অধিকার প্রদান করে এবং ধর্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাঁধা আরোপ করে না। এছাড়া মালিকানার স্বাধীনতা মূলত ধনীকে অসৎ ও প্রতারণাপূর্ণ উপায়র দূর্বলকে শোষণ করার অধিকার দেয়। ফলে, ধণীর সম্পদ আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দরিদ্র আরো বেশি দরিদ্র হতে থাকে। গণতন্ত্র যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় তা মূলতঃ সত্য বলাকে উৎসাহিত করেনা, বরং উম্মাহ’র পবিত্র আবেগ-অনুভূতিকে নির্মম আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতেই ব্যবহার হয়ে থাকে।

    পরিশেষে একথা বলা যায় যে, গণতন্ত্র একটি কুফরী শাসনব্যবস্থা। এটি এ কারণে নয় যে, এটি মানুষকে শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়। কারণ এটি প্রকৃত অর্থে মূল আলোচ্য বিষয়ও নয়। বরং, এটি এ কারণে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হলো মানুষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা (Freedom)।

    উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা তথা খিলাফাহ রাজতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদী, ফেডারেল, প্রজাতান্ত্রিক, মন্ত্রী পরিষদভিত্তিক, Totalitarian রাষ্ট্র কিংবা গণতান্ত্রিক বা যাজকতান্ত্রিক কোনটিই নয়। খিলাফাহ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি শাসনব্যবস্থা যা মহান আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক নির্ধারিত। সুতরাং, আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন যেন আমরা তাঁর দ্বীন ইসলামকে খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জমীনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, আমীন।

  • প্রশ্ন-উত্তর: মোটাতাজা বাছুর কুরবানি করা

    প্রশ্ন-উত্তর: মোটাতাজা বাছুর কুরবানি করা

    আমজাদ আল-তামরির প্রশ্ন: আমাদের প্রিয় আমীর, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ। আমি আল্লাহর কাছে আপনাকে সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করছি। আমার প্রশ্ন: মোটাতাজা বাছুর দুই বছরের কম বয়সী হলে কি কোরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য?

    হাইথাম আবু শিখাইদিম প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম। দুই বছরের কম বয়সী মোটাতাজা বাছুর কোরবানি করা কি জায়েজ?

    উত্তর:

    আপনাদের উভয়ের প্রশ্ন একই বিষয়ে, এবং এর উত্তর হচ্ছে:

    ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ

    ১) কুরবানী একটি ইবাদত এবং রাসূল (সা:) এর শর্তাবলী ব্যাখ্যা করেছেন। কোরবানির শর্তের মধ্যে রয়েছে এর বয়স।

    রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:

    «لَا تَذْبَحُوا إِلَّا مُسِنَّةً، إِلَّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ، فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضَّأْنِ»

    “শুধুমাত্র একটি পূর্ণ বয়স্ক পশু কোরবানি কর যদি না এটি তোমাদের পক্ষে কঠিন হয়, সেক্ষেত্রে একটি মেষশাবক কোরবানি দাও।” [মুসলিম বর্ণনা করেছেন]। গরুর বড় প্রাণী হওয়ার অর্থ দুই বছর বা তার বেশি বয়স হওয়া। মোটাতাজা এবং প্রচুর গোশত থাকলে যাদের বয়স দুই বছরের কম তাদের জন্য কুরবানী বৈধ বলে আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে যে বক্তব্য রয়েছে তা একটি ভুল বক্তব্য। এই যুগে কয়েকজন ফতোয়াদাতা ছাড়া যদি দুই বছরের কম বয়সী গরুর প্রচুর গোশত থাকে তবে তা কুরবানী করা জায়েজ বলে কেউ বলেনি, এবং তাদের ফতোয়া দলীল-প্রমাণের বিপরীত এবং যা সালফে সালেহীন আলেমদের বক্তব্যের খেলাপ।

    শরীয়তে বৈধ শেয়ার ও পরিমাণের কোন ‘ইল্লাহ নেই, তাই শেয়ার বা পরিমাণ ‘ইল্লাহ’ প্রয়োগ ছাড়াই বিবেচনা করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীসটি স্পষ্ট:

    «لَا تَذْبَحُوا إِلَّا مُسِنَّةً»

    “শুধুমাত্র একটি পূর্ণ বয়স্ক পশু কোরবানি কর”, বয়স্ক গরু বলতে বোঝায় যা দুই বছর বয়স অতিক্রম করেছে এবং তৃতীয় বছরে প্রবেশ করেছে। এখানে নিষেধাজ্ঞা একটি কঠোর নিষেধাজ্ঞা, এবং টেক্সট-এর মধ্যে চুড়ান্ত ইঙ্গিত (কারীনা) স্পষ্ট, এবং এটি দরিদ্রদের জন্য একটি ব্যতিক্রম যাদেরকে ভেড়ার বাচ্চা তথা জাযা’আর কোরবানি করা জায়েয করা হয়েছে। আর তা হলো ভেড়ার বাচ্চা যা ছয় মাস পূর্ণ করেছে।

    কুরবানী করা একটি ইবাদত, এটি একটি নির্ধারিত (তাওকীফিয়াহ) ইবাদত, অন্যান্য ইবাদতের মতো। এটি তার শর্ত ও কারণ অনুযায়ী সম্পাদিত হয়, যা শরীয়ত দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। এসব শর্তে ‘ইল্লাহ’ নেই এবং এসব (শর্ত) ছাড়া কুরবানী বৈধ নয়।

    2- “মাফাহিম” (কনসেপ্টস)-এর আরবি পৃষ্ঠা ৩৪-এ বলা হয়েছে: (ইসলামী ব্যবস্থাগুলি ‘ইবাদত, নৈতিকতা, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, মুআমালাত (লেনদেন) এবং দণ্ডবিধি সম্পর্কিত আহকাম শরীয়াহ দ্বারা গঠিত।

    ইবাদত, নৈতিকতা, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-আশাক সম্পর্কিত খোদায়ী বিধি-বিধানকে ‘ইল্লাহ’ (আইনগত কারণ) দ্বারা যুক্তিযুক্ত করা যায় না।

    রাসূল (সা) বললেন:

    «حُرِّمَتِ الْخَمْرَةُ لِعَيْنِهَا»

    “মদ (খামর) নিজের (বৈশিষ্ট্যের) জন্যই হারাম।”

    তবে লেনদেন এবং দণ্ডবিধি সম্পর্কিত আহকাম শরাহ ‘ইল্লাহ’ দ্বারা যুক্তিযুক্ত। কারণ এসব বিষয়ে হুকম শারঈ একটি ‘ইল্লাহ’র ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা বিধি-বিধান প্রণয়নের কারণ। অনেকেই শরীয়াহর সকল বিধি-বিধানকে সুবিধা (মাসলাহাহ) অনুসারে ন্যায্যতা দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, কারণ তারা পশ্চিমা মতাদর্শ এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, যা শুধুমাত্র উপযোগকেই কর্মের মাপকাঠি হিসাবে দেখে।

    এই ধরনের বুঝ ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের সাথে সাংঘর্ষিক, যা রূহকে সকল কর্মের ভিত্তি বলে মনে করে; এবং বস্তুর সাথে রূহের মিশ্রণকে সমস্ত কর্মের নিয়ন্ত্রক করে তোলে। ইবাদত, নৈতিকতা, খাদ্যসামগ্রী ও পোশাকের সাথে সম্পর্কিত আহকাম শরীয়াহ একেবারেই যুক্তিনির্ভর নয়, কারণ এই নিয়মগুলির জন্য কোনো ‘ইল্লাহ’ নেই। সেগুলোকে সেভাবে নেওয়া উচিত যেমন ভাবে সেগুলো টেক্সটে এসেছে এবং ‘ইল্লাহ’র উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত নয়। নামাজ (সালাত), রোজা (সাওম), হজ, যাকাত, নামাজ পড়ার পদ্ধতি এবং এর রাকাতের সংখ্যা, হজের আচার এবং যাকাত প্রদানের জন্য ন্যূনতম সম্পত্তির পরিমাণ (যাকাতের নিসাব) এবং অনুরূপ, এসবকিছু নিতে হবে, গ্রহণ করতে হবে এবং এ ব্যপারে অনুগত হতে হবে যেমনভাবে তারা (তাওকিফি) টেক্সটে এসেছে এবং তাদের জন্য কোন ‘ইল্লাহ খোঁজা হবে না…)

    সুতরাং কোরবানির বয়স অতিক্রম করা জায়েজ নয়, বাছুরটি মোটাতাজা হোক বা বয়স্ক না হোক না কেন, যেহেতু টেক্সটে কোনো ‘ইল্লাহ ছাড়া বয়স উল্লেখ করা হয়েছে, তাই এটি (অনুসরণ) বাধ্যতামূলক।

  • যুল হিজ্জার প্রথম ১০ দিন – তাৎপর্য ও পুরস্কার

    যুল হিজ্জার প্রথম ১০ দিন – তাৎপর্য ও পুরস্কার

    যুল হিজ্জার প্রথম দশ দিন কী? এই দিনগুলো আসে এবং মুসলমানদের সাথে তাদের গুরুত্ব অজানা রেখে চলে যায়, অনেকেই গাফেল থেকে যায়। কখনো কখনো এই দিনগুলোকে ঈদের কাউন্টডাউন ছাড়া আর কিছুই মনে করা হয় না।

    আলেমদের মতামত

    ইবনুল কাইম ব্যাখ্যা করেছেন যে বছরের শ্রেষ্ঠ রাত হল রমজানের শেষ দশ রাত এবং বছরের শ্রেষ্ঠ দিন হল যুল হিজ্জার প্রথম দশ দিন।

    ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং তার উত্তর ছিল, “রমজানের শেষ দশ রাত রাতের দিক থেকে উত্তম এবং যিলহজ্জের প্রথম দশ দিন দিনগুলির দিক থেকে উত্তম”।

    ইবনুল কাইয়্যিম এটি নিশ্চিত করেছেন এবং ইবনে কাছীর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

    কুরআনে তাৎপর্য

    যিলহজ্জের প্রথম দশ দিন এতই পবিত্র যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের দ্বারা শপথ করেন যখন তিনি কুরআনে বলেন: “ভোরের শপথ; এবং দশ রাতের” [৮৯:১-২]। কোনো কিছুর শপথ করা তার গুরুত্ব ও বড় উপকারের ইঙ্গিত দেয়।

    ভোর আসলেই আল্লাহর এক মহৎ নিদর্শন। এটি অন্ধকারের সমাপ্তি এবং রাত পেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় এবং একটি নতুন দিনের সূচনা করে। তাই অনেক ইবাদত এই সময়ের সাথে যুক্ত, যেমন তাহাজ্জুদ নামাযের সমাপ্তি, ফজরের নামাযের শুরু এবং রোযার শুরু।

    অনুরূপভাবে এ দশটি রাত আল্লাহর একটি বড় নিদর্শন। কিছু এত তাৎপর্যপূর্ণ যে, আল্লাহ তাদের দ্বারা শপথ গ্রহণ করতে বেছে নিয়েছেন। কিছু এত গুরুত্বপূর্ণ যে আল্লাহ নিজেই এটিকে ভোরের সাথে সংযুক্ত করেছেন।

    ইবনে আব্বাস (রা.) ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই দশটি রাত প্রকৃতপক্ষে যুল হিজ্জার প্রথম দশ দিন।

    হাদীসের গুরুত্ব

    জাবির ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত একটি সুস্পষ্ট হাদীস রয়েছে যেখানে নবী (সা.) বলেছেন: “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দিন হল দশটি দিন (অর্থাৎ যুল-হিজ্জার দশ দিন)।”

    হাদিসটি আল-বাজ্জার দ্বারা রিপোর্ট করা হয়েছিল এবং অনেক ঐতিহ্যবাদীরা এটিকে প্রামাণিক বলে মনে করেন।

    ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “এই দশ দিনের (যুল হিজ্জার প্রথম দশ দিন) চেয়ে কোন দিন নেই যেদিন কোন ভাল কাজ আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়”। সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) জিজ্ঞাসা করলেন: “এমনকি আল্লাহর পথে জিহাদও?” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “এমনকি আল্লাহর পথে জিহাদ করাও নয়, সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে নিজের জীবন ও সম্পদ (আল্লাহর পথে) ত্যাগ করেছে এবং এর কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি (অর্থাৎ তিনি শহীদ)”। (বুখারী)

    নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এই বাণীর পর আমাদের জন্য আর কোন প্রেরণার প্রয়োজন হবে না। জিহাদ ইসলামের সর্বোচ্চ চুড়া। ইবাদতের মহৎ কাজ যেখানে একজন বান্দা আল্লাহর বাণীকে সর্বোচ্চ করে তোলার জন্য তার কাছে প্রিয় সবকিছুকে লাইনে রাখে।

    তথাপি এই হাদীস ইঙ্গিত করে যে, এর চেয়েও উত্তম হল যিলহজ্জের প্রথম দশ দিনে আল্লাহর ইবাদত করা! এই দশ দিনে আল্লাহ আমাদের জন্য কল্যাণের প্রতিটি দরজা খুলে দিয়েছেন, তাই আল্লাহর রহমত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে ক্লান্ত হবেন না, পাছে সেই দরজাটি আবার আপনার জন্য খোলা না হয়।

    ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যুল-হিজ্জার প্রথম দশদিনের তুলনায় কোন দিনই আল্লাহর কাছে নেক আমলের জন্য এত ভারী এবং পছন্দনীয় নয়”। তাই এই দিনগুলিতে ক্রমবর্ধমানভাবে পাঠ করুন: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল-হামদু-লিল্লাহ, সুব-হানাল্লাহ।” (তাবরানী)

    এই বরকতময় দিনগুলিতে উৎসাহিত আমল

    সাধারণভাবে বলতে গেলে যে কোনো আমল করা উচিত যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এই দিনগুলোতে। যে কাজগুলো বেশি বেশি করা উচিত তা হল তাহলীল, তাকবীর এবং তাহমীদ কারণ ইবন উমর (রা.) এর বর্ণনায় এগুলি সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহর কাছে এই দশদিনের চেয়ে বড় কোনো দিন নেই বা যেগুলোতে নেক আমল তাঁর কাছে বেশি প্রিয়, তাই বেশি বেশি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা), তাকবীর (আল্লাহু আকবার বলা) এবং তাদের সময় তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ) বলা।

    কথিত আছে যে, একবার দশ দিন শুরু হলে দ্বিতীয় প্রজন্মের বিখ্যাত আলেম সাঈদ বিন জুবায়ের আল্লাহর অতিরিক্ত ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত করতেন।

    যিকির [আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার স্মরণ]

    আল্লাহর জিকির (স্মরণ) দিয়ে শুরু করুন যেমনটি আল্লাহ কুরআনে বলেছেন “[হে মুহাম্মদ], আপনার প্রতি কিতাব থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পাঠ করুন এবং সালাত কায়েম করুন। নিঃসন্দেহে নামায অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণ সবচেয়ে বড়। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন” [২৯:৪৫]

    এটি আল্লাহর রহমত থেকে যে তিনি আমাদেরকে এমন ইবাদতের আদেশ দিয়েছেন যা আমাদের অন্তরে শান্তি ও তৃপ্তি নিয়ে আসে এবং যার একটি অন্তর্নিহিত আনন্দ রয়েছে, যেমনটি আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, “যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর স্মরণে আশ্বস্ত হয়। আল্লাহর। নিঃসন্দেহে, আল্লাহর স্মরণে অন্তরসমূহ আশ্বস্ত হয়” [১৩:২৮]

    আল্লাহর জিকিরে প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি করুন। ইবনু উমর ও আবু হুরায়রা যিলহজ্জে প্রবেশের পর বাজারে প্রবেশ করতেন এবং আল্লাহর তাকবীর উচ্চারণ করতেন। এতটাই যে সমগ্র বাজারটি আল্লাহর তাসবীহ ও প্রশংসায় মুখরিত হয়ে উঠত।

    ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “এমন কোন দিন নেই যেদিনে এই দশ দিনের চেয়ে নেক আমল আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। তাই বেশি করে তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ পাঠ করুন।” [ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত]

    সিয়াম

    রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “এই দিনগুলোতে একটি রোজা পূর্ণ এক বছরের রোযার সমান এবং এই সময়ের একটি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের সমান। (তিরমিযী)

    আবু কাতাদাহ (রা.) বর্ণনা করেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, আরাফাতের রোযা বিগত ও আগামী বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। (তিরমিযী)

    আবু কাতাদাহ (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে বলেছেন, “এটি বিগত এক বছরের ও আগামী বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়। [সহীহ মুসলিম]

    প্রকৃতপক্ষে হুনাইদা ইবনে খালিদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে নবীর স্ত্রীদের মধ্যে একজন বলেছেন যে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুল হিজ্জার প্রথম নয় দিন রোজা রাখতেন [আল-নাসায়ী ও আবু দাউদ]

    আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন আল্লাহর বান্দার জন্য দু’টি সুপারিশকারী। রোজা বলবে: ‘হে প্রভু, আমি তাকে দিনের বেলায় তার খাবার ও কামনা থেকে বিরত রেখেছিলাম। আমাকে তার জন্য সুপারিশ করতে দিন।’ কুরআন বলবে: ‘আমি তাকে রাতে ঘুমাতে বাধা দিয়েছিলাম। আমাকে তার জন্য সুপারিশ করতে দিন।’ এবং তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে।

    কুরবানি

    কুরবানি করুন, কারণ এটি আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম (আ)-এর প্রাচীন রীতি এবং আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য আদেশ করা হয়েছিল যখন আল্লাহ বলেছিলেন “সুতরাং আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করুন এবং [একমাত্র তাঁর উদ্দেশ্যে] কুরবানী করুন” [১০৮:২]

    রাসুল (সা) বলেছেন: “আদম সন্তান কুরবানীর দিনে এমন কোন আমল করে না যা রক্তপাতের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয়। কুরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, চুল ও খুরসহ উপস্থিত হবে। রক্ত মাটিতে পৌঁছানোর আগেই কোরবানি আল্লাহ কবুল করেন…” [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ]

    দু’আ

    সাঈদ ইবন জুবায়ের (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এই দশ দিনে রাতের নামায ও নেক আমল এত বেশি বৃদ্ধি করতেন যে, লোকেরা তার যে দৃষ্টান্তের সাথে তাল মেলাতে পারছিল না এবং তাকে কিছুটা বিশ্রাম নেবার কথা বলছিল।

    তিলাওয়াত

    কুরআন তিলাওয়াত করুন কারণ এটি যিকিরের সর্বোত্তম রূপ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সবচেয়ে ছোট পথ। এই দিনগুলির জন্য নিজেকে একটি উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্য নির্ধারণ করুন যেমন আপনি রমজানের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন।

    দানশীলতা

    দান করুন কারণ দান করাকে বীরত্বের সাথে তুলনা করা হয়েছে আর কৃপণতাকে ভীরুতার সাথে তুলনা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডাকতেন, “হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”

    তাকবীর

    তাকবীর আত-তাশরীক পুরুষদের জন্য ওয়াজিব এবং মহিলাদের জন্য মুস্তাহাব, প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর ৯ই জুলহিজ্জার ফজর থেকে ১৩ই জুলহিজ্জাহর আসর পর্যন্ত।

    তা হল: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; ওয়া আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল-হামদ (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই; আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং প্রশংসা আল্লাহরই)।

    পুরুষদের জোরে এবং মহিলাদের শান্তভাবে এই বাক্যাংশগুলি উচ্চারন করতে উত্সাহিত করা হয়।

    এই দশ দিনে দুই প্রকার তাকবীর দিতে হবে। সাধারণ তাকবীর যা প্রথম যুল হিজ্জার মাগরিব থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত করা হয়। আর নির্দিষ্ট তাকবীর যা নবম যুল হিজ্জার (আরাফার দিন) ফজর থেকে যুল হিজ্জার তেরো তারিখের আসর পর্যন্ত করা হয়। শব্দগুলো সহজ, যেমন ইবনে মাসউদ দ্বারা বর্ণিত, “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল-হামদ।”

    উপসংহার

    এই দশটি দিনকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রতিটি মুসলিম, নর-নারী, বৃদ্ধ ও যুবকের দায়িত্ব, যতক্ষণ না তারা আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য রমজানের শেষ দশ রাতের মতো হয়ে ওঠে।

    আমাদের জীবন ছোট এবং আমাদের জবাবদিহিতা অনেক বড়। আমরা আল্লাহর ইবাদতে নিজেদের ব্যয় না করে এই ধরনের সোনালী মুহূর্তগুলোকে পার হতে দিতে পারি না।

    আল্লাহ আমাদের জন্য এই কাজটি সহজ করে দিন এবং এই মহান কয়েক দিনে আমাদের আমলগুলো কবুল করুন।

  • প্রশ্ন-উত্তর: বাই’আহ শব্দের কোন শর’ঈ অর্থ আছে কি?

    প্রশ্ন-উত্তর: বাই’আহ শব্দের কোন শর’ঈ অর্থ আছে কি?

    হাদীসে উল্লিখিত “আল-বাইয়াহ” শব্দের অর্থ ‘খলীফাহ ও উম্মাহর মধ্যে চুক্তি’। “আল-বাইআহ” শব্দটি কি একটি ভাষাগত (হাকীকি) অর্থ নাকি আইনগত (শরঈ) অর্থ?

    “বাইয়াহ” শব্দটি একটি আইনগত (শরঈ) অর্থ, এটি প্রথাগত (শাব্দিক) অর্থ বা একটি নির্দিষ্ট প্রথাগত (ইসতিলাহি) অর্থ নয়। কারণ এর সংজ্ঞা আইনপ্রণেতা (আল্লাহ) দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, ঐতিহ্য (উরফ) দ্বারা নয়।

    এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, আরবি ভাষায় “বাইয়াহ” বিক্রি (আল-বাই’) এবং ক্রয় (আল-শিরা’) থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

    ب ي ع (অক্ষর): Ba ya ‘Aa: একটি জিনিস “সে বিক্রি করেছে”; “সে এটি বিক্রি করে” “এটি বিক্রি করছে” … [মুখতার আল-সিহাহ]

    বা’আহু: বিক্রি করা, ক্রয় করা…[আল-কামুস আল-মুহীত, অভিধান]

    বাই’য়: বিক্রি করা: ক্রয়ের বিপরীত। বিক্রয়: এছাড়াও বিক্রি, যে এছাড়াও বিপরীত শব্দ; জিনিস বিক্রি, ক্রয় ইত্যাদি… [সাধারণ ভাষা]

    ইসলামী আইন (শর’ঈ) বাই’আহ শব্দের একটি ভিন্ন অর্থ নির্দেশ করে যা হল: খলীফা নিয়োগের পদ্ধতি (তারীকা) এবং এই পদ্ধতিটি কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমতে স্থির করা হয়েছে, যা বাইয়াতের মাধ্যমে করা হয়েছে। সুতরাং খলীফা সেই মুসলমানদের দ্বারা নিযুক্ত হন যারা আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ দ্বারা শাসন করার জন্য তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন। মুসলমান বলতে যা বোঝায় তা হল পূর্ববর্তী খলীফার অধীনস্থ মুসলিম নাগরিকরা যদি খিলাফাহ বিদ্যমান থাকে, অথবা যে অঞ্চলে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠিত হয় (যদি তা অস্তিত্বহীন হয়) সেই অঞ্চলের মুসলমানরা। কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবাদের ঐক্যমতের দলীল দ্বারা বা’ইয়াহ শব্দের একটি শর’ঈ অর্থ দেওয়া হয়েছে:

    আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

    إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ

    “যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে।” (আল-ফাতহ: ১০)

    উবাদা ইবনুস সামিত থেকে বুখারি বর্ণনা করেন,

    «بايعْنا رسولَ الله على السمع والطاعة، في المنشط والمكره، وأن لا ننازع الأمر أهله، وأن نقوم أو نقول بالحق حيثما كنا، لا نخاف في الله لومة لائم».

    “আমরা আল্লাহর রসূলকে বা’ইয়াত দিয়েছিলাম যে আমরা যখন সক্রিয় ছিলাম এবং যখন আমরা ক্লান্ত ছিলাম উভয় সময়েই আমরা তাঁর কথা শুনব এবং মানব এবং শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না বা তাঁর অবাধ্য হব না। আমরা যেখানেই থাকি না কেন সত্য বলবো বা সত্যের জন্য দাড়াবো এবং আল্লাহর পথে আমরা দোষারোপকারীদের দোষে ভয় পাই না।”

    কুরআন ও সুন্নাহর টেক্সট থেকে স্পষ্ট যে একজন খলীফা নিয়োগের পদ্ধতি বাই’য়াহর মাধ্যমে। এটা সমগ্র সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পেরেছিলেন যেমনটি খুলাফায়ে রাশেদীনের বাই’আতে স্পষ্ট।

    অতএব, ‘বাই’য়াহ’ শব্দটির একটি শর’ঈ অর্থ রয়েছে।

    ০১ শা’বান ১৪৩৩ হিজরি

    ২০/০৬/২০১২

    শায়খ আতা ইবনু খলীল আবু আল-রাশতা

    আরবী থেকে ইংরেজি খসড়া অনুবাদের উপর ভিত্তি করে লেখা

  • প্রশ্ন-উত্তর: শয়তান কিংবা জ্বিন কি মানুষের উপর নিয়ন্ত্রন নিতে পারে?

    প্রশ্ন-উত্তর: শয়তান কিংবা জ্বিন কি মানুষের উপর নিয়ন্ত্রন নিতে পারে?

    কিছু রোগ আছে যা মানুষকে আক্রান্ত করে এবং তারা জ্বীনকে দায়ী করে। এমন লোকও আছে যারা জ্বিনদের দেখার ও শোনার দাবি করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে বা তাদের মাধ্যমে মানুষকে আদেশ ও অনেক কাজ সম্পাদন করিয়ে নেয়। এর বাস্তবতা কী? মানুষ ও জ্বিনের মধ্যে কি কোন বস্তুগত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সম্পর্ক আছে?

    ১. জ্বিন অদৃশ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত; আমরা তাদের দেখতে পারি না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

    «يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ»

    “সে তোমাদের দেখে, সে ও তার গোত্র, যে অবস্থা থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাও না” (আল আরাফ: ২৭), অর্থাৎ ইবলীস এবং তার সম্প্রদায় বা অন্য কথায়, জ্বীন, এই কারণে যে ইবলীস জ্বিনদের থেকে।

    «إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ»

    “ইবলীস ব্যতীত – সে জ্বিনদের অন্তর্ভুক্ত” (আল-কাহফ: ৫০)

    ২. তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি বা উৎস হল যে তারা আমাদের কাছে ফিসফিস করতে এবং আমাদের প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হয় [ওয়াসওয়াসা]। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

    «فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ»

    “অতএব শয়তান তাদের উভয়কে ফিসফিস করে বলল” (আল-আরাফ : ২০);

    এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেন,

    «فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ»

    “অতএব শয়তান তাকে ফিসফিস করে বলল” (তোয়া-হা: ১২০), আর শয়তান এখানে ইবলিস এবং সে জ্বিনদের অন্তর্ভুক্ত।

    ৩. শয়তানের মানুষের উপর তাকে বাধ্য করার কোনো কর্তৃত্ব নেই, যদি না মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় শয়তানকে অনুসরণ করা বেছে নেয়। মহান আল্লাহ বলেন,

    «وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدْتُكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي»

    “যখন সব কাজের ফায়সলা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছি, অতঃপর তা ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু এতটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছি, অতঃপর তোমরা আমার কথা মেনে নিয়েছ।” (ইবরাহীম: ২২)

    এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেন,

    «إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ»

    “যারা আমার বান্দা, তাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই; কিন্তু পথভ্রান্তদের মধ্য থেকে যারা তোমার পথে চলে।” (হিজর: ৪২)

    এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেন,

    «فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ • إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ • إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ»

    “অতএব, যখন আপনি কোরআন পাঠ করেন তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করুন। তার আধিপত্য চলে না তাদের উপর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আপন পালন কর্তার উপর ভরসা রাখে। তার আধিপত্য তো তাদের উপরই চলে, যারা তাকে বন্ধু মনে করে এবং যারা তাকে অংশীদার মানে।” (নাহল: ৯৮-১০০)

    ৪. এই মৌলিক সম্পর্ক যা আল্লাহ সুস্পষ্ট করেছেন তা ব্যতীত অন্য যে কোন বস্তুগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্দিষ্ট দলীল প্রয়োজন। যদি এমন কোনো সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে কোনো টেক্সট বিদ্যমান থাকে তবে আমরা সেই টেক্সট এর দলীল অনুসারে এটি নিশ্চিত করতে পারবো। যেমন জ্বীনদের উপর সুলায়মান (আ)-এর কর্তৃত্ব এবং তাদের আদেশ ও নিষেধ করার ক্ষমতা এমন একটি বিষয় যা সম্পর্কে টেক্সট এসেছে, সুতরাং আমরা এটি নিশ্চিত করতে পারছি। সুলায়মান (আ) সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূরা আন-নামলে বলেন,

    «قَالَ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ أَيُّكُمْ يَأْتِينِي بِعَرْشِهَا قَبْلَ أَنْ يَأْتُونِي مُسْلِمِينَ • قَالَ عِفْرِيتٌ مِنَ الْجِنِّ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ تَقُومَ مِنْ مَقَامِكَ وَإِنِّي عَلَيْهِ لَقَوِيٌّ أَمِينٌ»

    “সুলায়মান বললেন, হে পরিষদবর্গ, তারা আত্নসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে বিলকীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে? জনৈক দৈত্য-জ্বিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান, বিশ্বস্ত।” (নামল: ৩৮-৩৯)

    এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেন,

    «وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ غُدُوُّهَا شَهْرٌ وَرَوَاحُهَا شَهْرٌ وَأَسَلْنَا لَهُ عَيْنَ الْقِطْرِ وَمِنَ الْجِنِّ مَنْ يَعْمَلُ بَيْنَ يَدَيْهِ بِإِذْنِ رَبِّهِ وَمَنْ يَزِغْ مِنْهُمْ عَنْ أَمْرِنَا نُذِقْهُ مِنْ عَذَابِ السَّعِيرِ • يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاءُ مِنْ مَحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَاسِيَاتٍ اعْمَلُوا آلَ دَاوُودَ شُكْرًا وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ»

    “আর আমি সুলায়মানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্যে গলিত তামার এক ঝরণা প্রবাহিত করেছিলাম। কিছু জিন তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, আমি জ্বলন্ত অগ্নির-শাস্তি আস্বাদন করাব।” (সাবা: ১২)

    ৫. আল্লাহর রাসূল (সা) যে কোনো বস্তুগত ঘটনাকে মানবীয় বিষয় হিসাবে বিবেচনা করতেন, যতক্ষণ না কোনো ওহী এসে নিশ্চিত করে যে বিষয়টির সাথে জিনের সম্পর্ক রয়েছে। সমস্ত বিষয়ই মৌলিকভাবে মানবীয় বিষয় হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ যদি কোনো মৃত মানুষকে পাওয়া যায় তাহলে মনে করা যেত না যে জ্বীন তাকে হত্যা করেছে যদি না এরকম কোন টেক্সট পাওয়া যায়। খায়বারে পাওয়া মৃত ব্যক্তির ঘটনার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছিল যেখানে অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল যে তাদের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছে এবং এমনকি এক্ষেত্রে জ্বীনের এটি করার সম্ভাবনাও আনা হয়নি।

    মুসলিম তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন যে আবদুল্লাহ ইবনে সাহল এবং মুহায়িসা প্রচণ্ড ক্লান্তিতে খায়বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। যখন মুহায়িসাহ জানতে পারলেন যে আবদুল্লাহ ইবনে সাহলকে হত্যা করে একটি কূপে ফেলে দেওয়া হয়েছে তিনি ইহুদিদের কাছে গিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম, তোমরা তাকে হত্যা করেছ!” তারা বলল, “আল্লাহর কসম, আমরা তাকে হত্যা করিনি।” বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন, “হয় তারা তোমার সঙ্গীর রক্তের টাকা পরিশোধ করবে অথবা তারা যুদ্ধ ঘোষণা করবে (শরীয়াহ বিধি মেনে চলতে অস্বীকার করার দরূন)।” তাই তিনি (সা) তাদের কাছে চিঠি প্রেরণ করে লিখেছিলেন এবং তারা আবার জবাবে বলেছিল, “আল্লাহর কসম, আমরা তাকে হত্যা করিনি।”…ঘটনাটি সর্বজনবিদিত। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, জ্বীনের কোনো ভূমিকার প্রশ্ন কোনোভাবেই আলোচনায় আসেনি।

    ৬. তাই যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ঘটনা সম্পর্কিত বস্তুগত সম্পর্কের উল্লেখ করে কোনো টেক্সট পাওয়া না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত জ্বীন ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ফিসফিস ও প্ররোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অধিকন্তু, যেহেতু রসূল (সা) এর বাণী হল ওহীর সীলমোহর, তারপরে ওহী বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং নতুন কোনও টেক্সট আসবে না, তাই জ্বিন ও মানুষের মধ্যে কোনো বৈষয়িক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। শুধু ফিসফিস ও প্ররোচনার সম্ভাবনাই অবশিষ্ট থাকে এবং আমরা যেমন বলেছি মানুষের উপর জ্বীনের ফিসফিস করে কর্তৃত্ব নেয়ার শক্তি নেই যদি না মানুষ তার নিজের ইচ্ছামত সেই ফিসফিসানির ডাকে সাড়া দেয়।

    খুলাফা আল-রাশিদীনের সময়ে বস্তুগত বিষয়গুলো এভাবেই দেখা হতো, কোনো বস্তুগত ঘটনা ঘটলে, তা হত্যা, চুরি, প্রতারণা কিংবা প্রতারণাই হোক না কেন, মন জ্বীনের দিকে চলে যেত না। এটি সর্বদা মানুষের দিকে যেত, কারণ জ্বীনের সাথে সম্পর্ক হল ফিসফিস ও প্ররোচনার, যদি না অন্যথা বলার জন্য টেক্সট বিদ্যমান থাকে। যেহেতু রাসূল (সা) এর পরে কোনো নির্দিষ্ট গ্রন্থ আসতে পারে না, তাই সমস্ত বস্তুগত ঘটনা মানুষের থেকে, জিন থেকে নয়, কারণ তাদের জগৎ আমাদের থেকে আলাদা, এবং আমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক নিভৃতে ফিসফিস করার সাথে সম্পর্কিত।

    তাই কেউ অসুস্থ হলে জ্বীনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। অসুস্থতার চিকিৎসা ইসলামী হুকুম অনুযায়ী অর্থাৎ থেরাপির মাধ্যমে করতে হবে। এই চিকিৎসা হতে পারে বস্তুগত (ঔষধ) অথবা দুআ ও রুকিয়ার মাধ্যমে।

    প্রথমটির উদাহরণ, যেমন উসামা ইবনে শারীক থেকে হাদীসে এসেছে যে তিনি বলেছেন, “আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবিদের কাছে এসেছিলাম এমন যেন তাদের মাথায় পাখি ছিল। আমি তাদের সালাম দিয়ে বসলাম। অতঃপর বিভিন্ন এলাকা থেকে বেদুইনরা এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি ওষুধ খাব? তিনি উত্তরে বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যে তিনি তার প্রতিষেধক সৃষ্টি না করেছেন, একমাত্র অসুস্থতা, মৃত্যু ব্যতীত।’ (আবু দাউদ)

    এর পরের উদাহরণ, মুমিনদের মা আয়েশা (রা.) থেকে মুসলিম দ্বারা বর্ণিত হাদিসে যা এসেছে, “আল্লাহর রসূল এই মন্ত্রটি (রুকিয়াহ) পাঠ করতেন, ‘প্রভু। মানুষ, কষ্ট দূর করো তোমার হাতেই নিরাময়; আপনি ছাড়া তাকে উপশম করার আর কেউ নেই।’” এটি এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুরূপ প্রার্থনা বা তাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যা ব্যবহার করা যেতে পারে।

    যারা অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য জ্বীনের সাথে বস্তুগত সম্পর্ক থাকার দাবি করে এবং তাদের আশ্রয় নেয়ার দাবি করে, সেকল বিষয় প্রতারকদের প্রতারণা এবং যারা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে।

    ১১/০৬/২০০৯

  • ধার্মিকতা একটি প্রবৃত্তি

    ধার্মিকতা একটি প্রবৃত্তি

    মানুষের মধ্যে জীবনী শক্তি আছে যা তাকে কাজের ক্ষেত্রে চালিত করে এবং তুষ্টি কামনা করে। এই জীবন শক্তির দুটি দিক রয়েছে: তাদের মধ্যে একটির অনিবার্য তুষ্টি প্রয়োজন, এবং এটি তুষ্ট না হলে মানুষ মারা যাবে। এটি জৈবিক চাহিদা, যেমন খাওয়া, পান করা এবং প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া। দ্বিতীয়টিরও তুষ্টি প্রয়োজন, কিন্তু তা তুষ্ট না হওয়ার কারণে মানুষ মরে না, যদিও তা তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত সে তাড়িত থাকবে; আর এটি হল প্রবৃত্তি, যা স্বাভাবিক অনুভূতির মাধ্যমে ক্রিয়াশীল থাকে এবং উদগীরণের তুষ্টি অন্বেষন করে। যাইহোক, তাড়নাভেদে প্রবৃত্তি জৈবিক চাহিদার থেকে ভিন্ন। এর কারণ হল জৈবিক চাহিদা ভিতর থেকে তাড়িত হয়, আর প্রবৃত্তিকে তাড়িত করে কিংবা এর তুষ্টির প্রয়োজন অনুভূত হয় এমন চিন্তা অথবা ভৌত বাস্তবতা দ্বারা যা তুষ্টির জন্য আবেগকে উদ্দীপিত করে। প্রজনন প্রবৃত্তি (গারীজাত-আল-নাও’) উদাহরণস্বরূপ, একটি সুন্দর মেয়ের কথা বা যৌন সম্পর্কিত কিছু চিন্তা করে কিংবা একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে বা যৌন সম্পর্কিত কিছু দেখে উত্তেজিত হয়। যদি এরূপ কিছু না ঘটে থাকে, তাহলে প্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করার মতো কিছুই ঘটবে না। একইভাবে ধার্মিকতার প্রবৃত্তি (গারীজাত আল-তাদাউয়্যুন) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আয়াত, কেয়ামত বা এর সাথে সম্পর্কিত কিছু, আসমান ও জমিনে আল্লাহর নিখুঁত সৃষ্টি অথবা এর সাথে সম্পর্কিত কিছু সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে আন্দোলিত হয়। এভাবে, প্রবৃত্তির প্রভাব দেখা দেয় যখন এমন কিছু থাকে যা একে তাড়িত করে। যা একে তাড়িত করে তার অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে, কিংবা যা একে উত্তেজিত করে সে বিষয়টি এমনভাবে ব্যাখ্যা করলে তথা যা ব্যক্তির প্রবৃত্তিকে উদ্দীপিত করে তার মূল বৈশিষ্ট্যের ধারণাটি হারিয়ে ফেললে আমরা এর প্রভাব আর দেখতে পাই না।

    ধর্মীয় প্রবৃত্তি প্রাকৃতিক এবং অপরিবর্তনীয়, এটি স্রষ্টা ও পালনকর্তার প্রতি চাহিদার অনুভূতি থেকে আগত, তা সে স্রষ্টা ও পালনকর্তার ব্যাপারে ধারণা যা-ই হোক না কেন।

    এই অনুভূতি মানুষ হিসাবে তার মধ্যে সহজাত, সে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করুক কিংবা তাকে অবিশ্বাস করুক, কিংবা সে বস্তু বা প্রকৃতিতে বিশ্বাস করুক। মানুষের মধ্যে এই অনুভূতির উপস্থিতি অনিবার্য, কারণ এটি একটি মানুষের মধ্যে তার সৃষ্টির অংশ হিসাবে সৃষ্ট; এবং তার থেকে একে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। এটাই ধার্মিকতা।

    এই ধার্মিকতার বহিঃপ্রকাশ হল স্রষ্টা ও পালনকর্তা বলে যাকে বিশ্বাস করা হয় কিংবা স্রষ্টা ও পালনকর্তাকে অবতার হিসেবে যার মধ্যে কল্পনা করা হয় তার প্রতি চুড়ান্ত ভক্তি প্রদর্শন (তাকদীস)। এই তাকদীস তার প্রকৃত রূপে আবির্ভূত হতে পারে, তখন একে বলা হয় উপাসনা (’ইবাদাহ)। এটি হতে পারে কোনো নিম্নতর রূপে প্রদর্শিত হতে পারে, যেমন শ্রদ্ধা ও বন্দনা।

    তাকদীস হলো মানুষের অন্তরের চূড়ান্ত ভক্তির বহিঃপ্রকাশ। এটা ভীতি থেকে নয়, বরং ধার্মিকতা থেকে। কারণ ভয়ের প্রকাশ তাকদীস নয়, বরং চাটুকারি, সুরক্ষার রেহাইপ্রাপ্তি; এসব তাকদীস-এর বাস্তবতার বিরোধী। সুতরাং, তাকদীস ধার্মিকতার প্রকাশ, ভয়ের নয়। অতএব, ধার্মিকতা বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি থেকে স্বাধীন একটি প্রবৃত্তি, আর ভয় হচ্ছে (বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির) প্রকাশগুলোর মধ্যে একটি। এই কারণেই মানুষ ধার্মিক হয়, এবং আমরা তাকে কিছু না কিছু উপাসনা করতে দেখি যখন থেকে আল্লাহ তাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন। সে সূর্য, গ্রহ, আগুন ও মূর্তি পূজা করেছে। সে আল্লাহর ইবাদতও করেছে। আমরা কোনো যুগে, কোনো জাতি বা সম্প্রদায়কে কোনো না কোনো কিছুর উপাসনা করা ছাড়া দেখি না। এমনকি জনগণ, যখন কর্তৃপক্ষ তাদের ধার্মিকতা ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, তা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তারা ধার্মিক ছিল এবং কিছু না কিছুর উপাসনা করেছে। ইবাদত-বন্দেগি করার প্রয়াসে তাদের অনেক দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। এমন কোন শক্তি নেই যা মানুষের কাছ থেকে ধার্মিকতাকে ছিনিয়ে নিতে পারে, তার থেকে সৃষ্টিকর্তার তাকদীস (তথা চুড়ান্ত ভক্তি প্রদর্শন) দূর করতে পারে এবং তাকে উপাসনা থেকে বিরত রাখতে পারে। এটি একটি সময়ের জন্য (বড়জোড়) দমন করতে পারবে। এর কারণ হল উপাসনা (’ইবাদাত) হল ধার্মিকতার একটি স্বাভাবিক প্রকাশ, যা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।

    উপাসনার অনুপস্থিতি বা উপাসনাকে উপহাস করার যে বিষয়টি কিছু নাস্তিকদের মধ্যে দেখা যায়, এ ধরনের লোকেদের মধ্যে ধার্মিকতার প্রবৃত্তি আল্লাহর উপাসনা থেকে সৃষ্টির উপাসনার দিকে সরে গেছে। প্রকৃতি, বীরত্বপূর্ণ মহান বিষয়াদি এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে তাদের তাকদীস (তথা চুড়ান্ত ভক্তি প্রদর্শন)-এর প্রকাশ ঘটেছে। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিক্ষিপ্ততা, বিকৃতি এবং বিষয়াদির ভুল ব্যাখ্যাকে ব্যবহার করা হয়েছে।

    অতএব, কুফর (কুফর) ঈমানের (বিশ্বাস) চেয়েও কঠিন, কারণ এটি মানুষকে তার সহজাত স্বভাব (ফিতরাহ) থেকে বিক্ষিপ্ত করে এবং এর প্রকৃত প্রকাশ থেকে সরিয়ে রাখে। এর জন্য অনেক বড় প্রচেষ্টা প্রয়োজন হয়। তার সহজাত প্রকৃতির (ফিতরাহ) জন্য যা প্রয়োজনীয় তা থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষের পক্ষে কতইনা কঠিন!

    অতএব, আমরা দেখি নাস্তিকদের কাছে সত্য (হক্ক) প্রকাশ পেলে, এবং যখন তারা আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা দ্বারা যখন তাঁর অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করে, দেখবেন তারা সাচ্ছন্দ্য ও প্রশান্তি সহকারে ঈমানের দিকে ছুটে যায়; এবং একটি ভারী দুঃস্বপ্ন যা তাদের বোঝা আকারে চেপে ছিল, তা অদৃশ্য হয়ে যায়। এ ধরনের লোকদের ঈমান শক্তিশালী এবং অবিচল হয়, কারণ তা সংবেদনশীলতা এবং নিশ্চিত হবার মাধ্যমে আসে। এর কারণ হল তাদের চিন্তা তাদের আবেগের সাথে সংযুক্ত থাকে, তাই তারা যখন নিশ্চিতভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করে, তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের একটি অনুভূতি তৈরি হয়। এভাবে তাদের সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাহ) তাদের চিন্তার সাথে মিলিত হয়, তাই শক্তিশালী ঈমান তৈরি হয়।

    Taken from the book “Islamic Thought”

  • ম্যাকার্থিজমের পুনঃঅনুমোদন

    ম্যাকার্থিজমের পুনঃঅনুমোদন

    ফরেন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিলেন্স অ্যাক্ট (FISA) এর ৭০২ ধারা পুনঃঅনুমোদিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের সাম্প্রতিক অনুমোদন নাগরিক স্বাধীনতা ও জাতীয় নিরাপত্তাকে ঘিরে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই বিতর্কিত নজরদারি কর্মসূচি দীর্ঘদিন ধরে নাগরিক স্বাধীনতা সংস্থাগুলির মধ্যে উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে বিচারিক ওয়ারেন্ট ছাড়াই ইলেকট্রনিক নজরদারি পরিচালনা করতে সুযোগ করে দেয় ৷ ৬০-৩৪ ভোটে বিলটির পাস, জাতীয় নিরাপত্তা এবং মার্কিন নাগরিক স্বাধীনতার মধ্যে চলমান উত্তেজনাকে তুলে ধরছে।

    ম্যাককার্থিজম, যা Second Red Scare নামেও পরিচিত, যা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৪০-৫০ সাল মধ্যকার রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ন এবং ৫০এর দশকের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের উপর কথিত কমিউনিস্ট ও সোভিয়েত প্রভাব এবং সোভিয়েত গুপ্তচরবৃত্তির ভয় ছড়ানোর একটি প্রচারণা। অসংখ্য শিক্ষক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, প্রযোজক ও পরিচালকদের এই উইচহান্ট এর শিকার হতে হয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝির পরে, মার্কিন সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থি, যিনি প্রচারণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ধীরে ধীরে সে তার জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় যখন তার বেশ কয়েকটি অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেনের অধীনে ইউএস সুপ্রিম কোর্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের উপর একাধিক রায় দেয় যা বেশ কয়েকটি মূল আইন এবং আইন প্রণয়ন নির্দেশকে বাতিল করে এবং Second Red Scare এর অবসান ঘটাতে সাহায্য করে। পরবর্তীতে অন্যান্য মার্কিন সরকারও একই ধরণের গুপ্তচরবৃত্তির প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতা Section 702 এর আলোচনা এসেছে।

    বর্তমানে, ধারা ৭০২ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে মার্কিন ভূখণ্ডের বাইরে মার্কিন নাগরিকরা বিদেশিদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করে তার উপর নজরদারির কর্তৃত্ব দেয়। মূলত, এই বিধানটি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে মার্কিন নাগরিক এবং অ-নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ আটকাতে এবং সংগ্রহ করতে সুযোগ করে দেয়, সেক্ষেত্রে মার্কিন নাগরিক নজরদারির লক্ষ্য হোক বা না হোক। এর মধ্যে ফোন কল, ইমেল, টেক্সট মেসেজ বা অন্য যেকোনো ধরনের যোগাযোগ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

    অনিয়ন্ত্রিত নজরদারি, অপব্যবহার এবং গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একেবারেই নতুন নয়; বরং, এটাই মূল ধারা। “নিরাপত্তার উদ্বেগ” দেখিয়ে ৭০২ ধারা পুনঃঅনুমোদিত করার সিদ্ধান্তটি মার্কিন নাগরিকদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ন্যাশনাল কাউন্টার টেরোরিজম সেন্টারের ডিরেক্টর ক্রিস্টিন আবিজাইদ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিষয়ক সিনেট কমিটিকে সম্বোধন করে বলেন, “গত মাসের ঘটনাগুলো থেকে প্রমাণিত যে, সন্ত্রাসবাদের হুমকির পরিধি অত্যন্ত ডাইনামিক এবং আমাদের দেশকে [সন্ত্রাস এর বিরুদ্ধে] অবশ্যই মৌলিক বিষয়গুলো রক্ষা করতে হবে।” তিনি ‘ইসরায়েল’-এর উপর হামাসের আক্রমণের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন এবং কংগ্রেসকে “এই গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃপক্ষকে পুনঃঅনুমোদিত করার” আহ্বান জানিয়েছেন।

    অতএব, ৭০২ ধারা তাদের ধর্ম, জাতিগত কিংবা রাজনৈতিক অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলির নজরদারী করার জন্য প্রয়োজনীয় অজুহাত প্রদান করা অব্যাহত রাখবে, এবং এটি  ব্যক্তি স্বাধীনতাকে যে পদদলিত করে তার ব্যপারে তারা উদ্বিগ্ন নয়। যখন নির্বাচিত কর্মকর্তারা প্যালেস্টাইনপন্থী গোষ্ঠীগুলির ব্যাপারে তদন্তের আহ্বান জানান তখন সরকারের নজরদারি ক্ষমতা বাড়ানোর চাপ আরো বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে ভার্জিনিয়ায়, অ্যাটর্নি জেনারেল ফিলিস্তিনের তহবিল সংগ্রহের কার্যক্রমের তদন্ত শুরু করেছেন, এতে অভিযোগ রয়েছে যে এটি হামাসকে সমর্থন করে। স্পষ্টতই, পুনঃঅনুমোদনের পিছনে রয়েছে ভিন্নমতকে চুপ করিয়ে দেওয়া এবং বিরোধিতাকে দমন করার প্রচেষ্টা, বিশেষ করে গাজায় চলমান ঘটনাগুলির বিষয়ে। মার্কিন প্রশাসনের প্রতি ক্রমবর্ধমান হতাশা এবং গাজায় গণহত্যায় তার ভূমিকার মধ্যে সাম্প্রতিক ভোটটি আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনিয়ন্ত্রিত সরকারী নজরদারি বজায় রাখতে হবে এবং এটি তারা যেকোনো মূল্যে করবে। এটি হল আমেরিকার নীতি এবং ইসলামের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে মুসলমানদের বশীভূত করার একটি উপায়। মুসলিম হিসেবে, আমরা এই কঠোর পদক্ষেপগুলোকে আমাদের ভীত করবার অনুমতি দিতে পারি না এবং আমাদের অবশ্যই হক কথা বলতে হবে। ইসলামের আলো অবশ্যই বিরাজ করবে।

    আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

    [إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّواْ عَن سَبِيلِ اللّهِ فَسَيُنفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُونَ]

    নিঃসন্দেহ যারা কুফরী করে তারা তাদের ধনসম্পত্তি খরচ করে আল্লাহ্‌র পথ থেকে বাধা দেবার জন্যে। তারা এটা খরচ করবেই, তারপর এটি হবে তাদের জন্য মনস্তাপের কারণ, তারপর তাদের পরাজিত করা হবে। আর যারা কুফরী করে তাদের জাহান্নামের দিকে একত্রিত করা হবে [আনফাল: ৩৬]

    উৎস: হাইছাম বিন ছাবিত কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধ

  • এডেন উপসাগরের জলদস্যু, ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার!

    এডেন উপসাগরের জলদস্যু, ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার!

    বৃটেন-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে এডেন উপসাগর। এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথের মধ্যে একটি।  আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যবর্তী স্থানে সংকীর্ণভাবে এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরের অবস্থান যেটি ভারত মহাসাগরকে সুয়েজ খাল এবং ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে।  এডেন উপসাগরের একপাশে আছে সোমালিয়া ও অপর পাশে আছে ইয়েমেন। এই বাণিজ্য পথেই পৃথিবীর ১৫ শতাংশ সামুদ্রিক বাণিজ্য সংঘটিত হয়। প্রতিবছর গড়ে চব্বিশ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। পৃথিবীর ২০% পণ্যবাহী কন্টেইনার, ১০% সমুদ্রজাত তেল ও ৮% তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পরিহবন হয়ে এই পথে। তাই ভৌগলিকভাবে এই সামুদ্রিক পথ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, কোন রাষ্ট্র যদি এই সামুদ্রিক পথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে তাহলে পূরো পৃথিবীর আমদানী ও রপ্তানির বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই থাকবে।

    ইয়েমেনে ব্যপক অত্যাচার ও লুটপাটের পর ১৯৬৭ সালে বৃটিশরা ইয়েমেন থেকে তাদের সামরিক সরঞ্জাম ও বাহিনী তুলে নিলেও এখনো সেখানে রাশেদ আল আলিমির মত বৃটেনপন্থী দালাল শাসক বলবৎ রয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকা চাচ্ছে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের মাধ্যমে বৃটেনপন্থী সরকারকে উৎখাত করে তার নিজের নিয়ন্ত্রিত সরকারকে প্রতিষ্ঠা করতে যেন এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরে তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃটিশভিক্তিক প্রতিষ্ঠান চ্যাটহাম ইন্সটিটিউটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়েমেনের পশ্চিম উপকূলের জায়ান্ট ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তারিক সালেহ বলেন- “যা ঘটছে অর্থাৎ হুথিদের দ্বারা বাণিজ্যিক জাহাজ ছিন্তাই করা, তার সাথে গাজার ঘটনার কোন যোগসূত্র নেই,” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যা ঘটছে তা ইরান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালীর মতো বাব আল-মান্দাব প্রণালীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সম্পূর্ণরূপে ইরানী পদক্ষেপ।” তিনি ইরানকে হুথিদের অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, ইয়েমেন সরকারকে উৎখাত করতে একদিকে যেমন হুথি বিদ্রোহীদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে, অপরদিকে হুথিদের দ্বারা বাণিজ্যিক জাহাজ ছিন্তাই এর ঘটনা বৃটেনের মিত্রদেশগুলো অর্থাৎ ইউরোপ ইউনিয়নের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। যা মূলত এডেন উপসাগরে আমেরিকার ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে বাস্তবায়নে ত্বরান্বিত করছে। ইউরোপ ইউনিয়নের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো লোহিত সাগরের নৌপথকে ব্যবহার করতে না পারলে তাদেরকে দীর্থ ১১ দিনের অতিরিক্ত পথ ভ্রমন করে পণ্য পরিবহন করতে হবে। যা জায়ান্ট ব্র্যান্ডগুলোকে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বাড়িয়ে দিবে। ফলে ব্রিটেনের মিত্রদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর সম্ভাবনা থাকবে। ইসলামের রাজনৈতিক উত্থান ঠেকানো ও চীনকে নিয়ন্ত্রনে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকা তার IPS (INDO PACIFIC STRATEGY) প্রকল্পের অংশ হিসেবে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। সোমালিয়ার জলদস্যুদের কর্তৃক ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ বুলগেরিয়ার ও বাংলাদেশের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ছিন্তাই হবার পর আমেরিকা ভারতকে দিয়ে বুলগেরিয়ার জাহাজটি উদ্ধার করিয়েছে। ভারত জ্বালানী তেল আমদানীর জন্য এডেন উপসাগরের নৌপথের উপর নির্ভরশীল। তাই নিজের বাণিজ্যিক নিরাপত্তার জন্য হলেও আমেরিকার ইন্টারেস্টে তাকে যুক্ত হতেই হবে। ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকা ভারতের নৌবাহিনীকে ব্যবহার করছে এবং নিশ্চিত করছে ভারত যেন আমেরিকার স্বার্থে আঞ্চলিক চৌকিদার হয়ে কাজ করে। এভাবে আমেরিকা লোহিত সাগর হতে শুরু করে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত তার ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের জাল বিস্তার করেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বীমা, নিরাপত্তার অজুহাতে সিকিউরিটি টাস্কফোর্স সেবা ও  সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির মাধ্যমে সে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে নিচ্ছে। ইতোঃমধ্যেই বাইডেন প্রশাসন ৩.৯৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ও ড্রোন ভারতের কাছে বিক্রি করতে সম্মতি দিয়েছে। অর্থাৎ “মরার উপর খাঁড়ার ঘা।” 

    এই সকল সমস্যার উদ্ভব ঘটছে পশ্চিমা সম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের নব্য উপনিবেশ স্থাপন ও আধিপত্যবাদী তাড়না থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক সামুদ্রিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। মানব ইতিহাসের নিয়ম হিসাবে সর্বদাই ক্ষমতাবানরা নিজের স্বার্থমত আইন তৈরি করে যাকে তারা তখন “আন্তর্জাতিক আইন” বলে। ১৯৪৫ সালে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস. ট্রুম্যান তার প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও জাতির অধিকারের কথা বলে আন্তর্জাতিক নীতির বুলি ব্যবহার করে তার মহাদেশীয় সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করেছিলেন। অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো দ্রুত এই কৌশলটি গ্রহণ করেছিল, কিছু রাষ্ট্র তাদের মাছ ধরার জল ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রসারিত করেছিল, অন্যরা তাদের জাতীয় সমুদ্রকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রসারিত করেছিল। এর পরে, এই ধারণাগুলি তিনটি কনভেনশনের মাধ্যমে বৈধ করা হয়েছিল যেখানে বলা হয় রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরের সমস্ত জলকে আন্তর্জাতিক জল হিসাবে বিবেচনা করা হবে, যা সমস্ত জাতির জন্য বৈধ হবে এবং কারও কাছে কোনও অধিকার বা দাবি থাকবে না। আমরা দেখতে পাই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং অন্যান্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি একই তথাকথিত আন্তর্জাতিক জলসীমায় দাঁড়িয়ে তাদের বিমানবাহী জাহাজ থেকে মুসলিম দেশগুলিতে বোমা মেরে আমাদের রক্তাক্ত করে, এমনকি তাদের নৌবাহিনীও সুয়েজ খাল, হরমুজ প্রণালী এবং মালাক্কা প্রণালীর মতো মুসলিম দেশগুলির আঞ্চলিক জলসীমার মধ্য দিয়ে যায় এবং এই সমস্ত কিছু আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে শাসন করে।

    দক্ষিণ চীন সাগরে চীন তার অধিকার দাবি করে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করছে, যাতে এটি তার সমুদ্রসীমা প্রসারিত করতে পারে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা এটিকে আন্তর্জাতিক জলসীমা লঙ্ঘন বলে অভিহিত করছে। আমেরিকা তার স্বার্থ হাসিলে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের রাষ্ট্রেসমূহের সামরিক বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের মত করে আকসা ও জিসোমিয়ার মত সামরিক সহায়তার চুক্তি করতে তৎপর হয়েছে যাতে করে অন্য রাষ্ট্রের সামরিক সহায়তায় সে তার নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা এভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের নামে সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রেখেছে। এই বিষয়টিই স্পষ্ট করে, আমেরিকার মত শক্তিশালী রাষ্ট্রের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে সামরিক সহায়তা দাবি করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্ষমতা আছে এই অঞ্চলে সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।

    মুসলমানরা খিলাফতে রাশিদার সময় থেকে তাদের নৌবাহিনী শুরু করেছিল, যেখানে উমাইয়া খিলাফতই রোমান সাম্রাজ্যের নৌ শক্তির অবসান ঘটিয়েছিল যার ফলে মুসলমানরা বিশ্বের একমাত্র নৌ শক্তি ছিল যার নিয়ন্ত্রণ সমুদ্রের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল যা ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর এবং আরব সাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।উসমানীয়দের আগমন পর্যন্ত আব্বাসীয় খিলাফতে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। পূর্ব-পশ্চিম বাণিজ্য পথ মুসলমানদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল অর্থাৎ ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের ভারত ও চীনে পৌঁছানোর জন্য খিলাফতের সমূদ্রসীমার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। ইউরোপের জন্য একটি বিকল্প অবশিষ্ট ছিল, যেখানে তারা খিলাফতের সীমানা এড়িয়ে ভারত ও চীনে পৌঁছাতে পারে এবং সেটি হল কনস্টান্টিনোপল। কিন্তু ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর এই পথটিও ইউরোপের হাত ছাড়া হয়ে যায়।

    সোমালিয়ার বা হুতির বিদ্রোহীরা যারা এই জলদস্যুতা করছে মুসলিমদের ইতিহাস তা নয়। মুসলিমরা এই অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্যিক পথকে নিরাপদ করেছিল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারসাম্য স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু আজকে মার্কিন-বৃটিশ-ফ্রান্স এর প্রভাবে সোমালিয়া এবং ইয়েমেনের মুসলিমরা জলদস্যুতে পরিণত হয়েছে। মুসলিমরা যেখানেই ভূমি জয় করেছিলো, সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে সম্রাজ্যবাদীদের মত লুটপাট করেনি বরং ন্যায় ও ইনসাফের শাসন কায়েম করেছিলো যার ফলে দলে দলে মানুষ মুসলিম হয়েছিল এবং সেখানকার সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশ যার উৎকৃষ্ট উদাহরন যেখানে বৃটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে উপনিবেশ গড়ার পর ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। প্রথম শতাব্দীর মুসলিমরা যেভাবে সমুদ্রপথে দূরবর্তী দেশগুলোতে ইসলামী দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিল এবং জিহাদের মাধ্যমে পশ্চিমে স্পেন জয় করেছিল, তাদের উদাহরণগুলি আজ আমাদের জন্য একটি মাপকাঠি যে আমাদেরও উচিত সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে দাওয়াহ ও জিহাদের মাধ্যমে ইসলামকে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া এবং এটি কেবলমাত্র খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেই সম্ভব হতে পারে। আসন্ন খিলাফত রাষ্ট্র সোমালিয়া, ইয়েমেনসহ সমস্ত মুসলিম ভূমিকে ইসলামের ছায়াতলে একত্রিত করবে।

    রাসুল (সা) বলেন,

    একটি গাযওয়াহ (সামুদ্রিক অভিযান) ভূমিতে দশটি গাজাওয়াতের (যুদ্ধের অভিযান) চেয়ে উত্তম। আর যে ব্যক্তি সমুদ্রকে অনুমতি দিল, সে যেন সমস্ত উপত্যকাকে অনুমতি দিল। । (আল-হাকিম নং ২৬৩৪ এবং আল-মুজাম আল-কবীরে আল-তাবরানি)

    সমুদ্রকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সকল মানুষের জন্য সর্বজনীন সম্পত্তি ঘোষণা করেছেন, তাই খিলাফত রাষ্ট্র কাউকে এর থেকে উপকৃত হতে বাধা দেবে না।  এমনকি মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত রাষ্ট্রের দরিদ্র জেলেদেরকেও সমুদ্র থেকে রিজিক পেতে বাধা দেওয়া হবে না। তবে তারা পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাসের মতো খনিজ সম্পদ উত্তরণ করতে পারবে না।

    “আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন এর প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা চিনো না কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। ।” [সূরা আল-আনফাল:  ৬০]।

    অতএব, খিলাফতের নৌ-নীতি এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে মুসলমানদেরকে পূর্ণ শক্তি অর্জনের জন্য একটি সাধারণ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  এ জন্য আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, ড্রোন, সাবমেরিন ও বিমানবাহী রণতরী প্রস্তুত করতে হবে যাতে করে স্থলে ইসলামের আধিপত্য যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেভাবে সমুদ্রে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

  • লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য

    লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য

    মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন:

    إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ * وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ * لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ * تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ * سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

    আমি একে নাযিল করেছি কদর রাত্রি। কী আপনাকে জানাবে কদর রাত্রি কী? কদর রাত্রি এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। একটি নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। [সূরা আল-কদর]

    আমরা এখন রমজানের শেষ তৃতীয়াংশে প্রবেশ করেছি এবং আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শেষ ১০ দিন সম্পর্কে বলেছেন,

    «تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ»

    “রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত তালাশ করো।”

    সূরা আল কদরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এবং অনেক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লায়লাতুল কদরের মহিমা, ‘শক্তির রাত’ সম্পর্কে কথা বলেছেন। এটি আমাদের রবের পক্ষ থেকে মহান রহমত, পুরস্কার এবং আশীর্বাদের একটি রাত; এমন একটি রাত যেখানে উপাসনা এবং সম্পাদিত সৎকাজ এক হাজার মাসের (তথা ৮৩ বছর) ইবাদতের চেয়েও বেশি মূল্যবান – যা কিনা সারা জীবন ইবাদত করার সমতুল্য; এবং আমাদের গুনাহের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মহান ক্ষমার একটি রাত এটি, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِ»

    “যে ব্যক্তি (খাঁটি) ঈমানের সাথে এবং (আত্মপর্যালোচনাসহ) আল্লাহর কাছে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাজের জন্য দাঁড়ায়, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়…”

    তাই মুসলিম হিসেবে আমরা লাইলাতুল কদরের সন্ধান করি, বেশি বেশি নামায, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির, দুআ, তওবা চাওয়া, ইসলামের আলোচনা এবং আমাদের রব, আল্লাহ আজ্জা ওয়াজ্জালকে সন্তুষ্ট করার মতো অন্যান্য কাজ করার চেষ্টা করি। তবে, রমজানের এই শেষ ১০ দিনে, আমাদের কিছু সময় ব্যয় করা উচিত যে মহান আল্লাহ তায়ালা ‘লাইলাতুল কদর’ কে কত গুরুত্ব ও ওজন দিয়েছেন তা অনুধাবণ করা এবং আমাদের দ্বীনের জন্য এই রাতের তাৎপর্যের কারণ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা।

    প্রথমত, এই রাতটির জন্য যে নামটি উল্লেখ করা হয়েছে – “শক্তির রাত” আল্লাহর দৃষ্টিতে এই রাত কতটুক মহিমাময় তা প্রতিফলিত করে। সূরাতুল কদরে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

    وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ

    কী আপনাকে জানাবে (বোঝাবে/ব্যখ্যা করবে) কদর রাত্রি কী?

    মূলত আমাদের বলছেন, “এই শক্তির রাত কী তা পৃথিবীর কোন জিনিস আপনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে? আপনি কীভাবে এই রাতের ওজনের প্রশংসা বা কল্পনা করতে পারেন?”, এর মহিমা এবং গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে।

    তারপর তিনি আমাদের জানান যে ফেরেশতারা এই রাতে প্রচুর পরিমাণে রহমত ও বরকতের  সাথে অবতরণ করেন – যারা ফজর পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে তাদেরকে সালামের জবাবে সালাম প্রদান করে। মুফাসসিরীনরা তাদের সূরা আল-কদরের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন, এই রাতের এত বরকত যে পৃথিবী ফেরেশতা দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের জানিয়ে রাতটিকে আরও বেশি বরকতময়  করেন যে ‘রুহ’ তথা জিবরাঈল (আ.) – এর মত সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতাও এই রাতে অবতরণ করেন – যিনি নবীদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন; যিনি আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কুরআনের বাণী নিয়ে এসেছিলেন, যার ব্যপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে তার ৬০০টি ডানা রয়েছে, যার প্রতিটি ডানা পুরো দিগন্তকে পূর্ণ করে (অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত যতদূর চোখ যায়) – এটি এই রাতের মর্যাদাকে আরও বৃদ্ধি  করে।

    কিন্তু কোন জিনিসটি এই রাতের এত বেশি  মর্যাদা, ওজন ও গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়? কারণ এটিই সেই রাত যা আল্লাহ তায়ালা মহান কুরআন নাযিলের জন্য বেছে নিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

    إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ * فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ * أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ * رَحْمَةً مِّن رَّبِّكَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

    আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [সূরা আদ-দুখান ৩-৬]

    সুতরাং লাইলাতুল কদরের মহান মর্যাদা সরাসরি সেই মহান মর্যাদার সাথে জড়িত যা আল্লাহ তায়ালা কুরআন ও এর মধ্যে থাকা বাণীকে দান করেছেন। এবং এই রাতের মহিমা একটি নতুন জীবনধারার মহিমার সাথে যুক্ত যা সেই রাতে বিশ্বের জন্য জন্ম হয়েছিল যা মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাবে। তাই শক্তির রাতকে সত্যিকার উপলব্ধি করার অর্থ হচ্ছে কুরআনের বিষয়বস্তুর প্রকৃত মূল্যকে উপলব্ধি করা।

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই কুরআন সম্পর্কে বলেন,

    وَلَوْ أَنَّ قُرْآنًا سُيِّرَتْ بِهِ الْجِبَالُ أَوْ قُطِّعَتْ بِهِ الأَرْضُ أَوْ كُلِّمَ بِهِ الْمَوْتَى بَل لِّلّهِ الأَمْرُ جَمِيعًا

    যদি কোন কুরআন এমন হত, যার সাহায্যে পাহাড় চলমান হয় অথবা জমিন খণ্ডিত হয় অথবা মৃতরা কথা বলে, তবে কী হত? বরং সব কাজ তো আল্লাহর হাতে। [আর-রা’দ: ৩১]

    এই আয়াতে, বিশ্বজগতের পালনকর্তা আমাদের কুরআনে বর্ণিত বাণীর সেই গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানাচ্ছেন – যে এত বিশাল কাঠামো হওয়া  সত্ত্বেও এই পাহাড়গুলো এই মহিমান্বিত গ্রন্থটিতে থাকা বানী, এর সমাধানের ভারে চলমান হয়ে যেত।

    আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

    وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِن شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِن بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

    পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং সমুদ্রের সাথেও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও তাঁর বাক্যাবলী লিখে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [লুকমান: ২৭]

    এই সুন্দর আয়াতে, তিনি আমাদেরকে শক্তিশালীভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে পৃথিবীর সমস্ত গাছ কলম হলেও এবং সমস্ত সমুদ্র তাদের মতো আরও সাতটি দিয়ে কালি হয়ে গেলেও – তারা এর বিষয়বস্তুর সাথে তাল মেলাতে সক্ষম হবে না, অর্থাৎ জীবন ও মানবতার জন্য সমাধান যা আল্লাহর বাণী কুরআনে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, সমাজবিজ্ঞান এবং পারিবারিক জীবনের মতো বিষয়ের সমস্ত বই যদি গ্রন্থাগার, বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান হতে একত্রিত করা হয় তবে কুরআনের তুলনায় তা ম্লান হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে, এটি সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করার মতো হবে – একেবারেই কোন তুলনা নেই।

    অতএব, এই কুদরতি রাতের তাৎপর্য হল যে এতে মহিমান্বিত কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং একটি ব্যাপক দ্বীনের উত্থান ঘটেছে যা মানবজাতির ব্যক্তি হিসাবে, সমাজ হিসাবে কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তার সমাধান নিয়ে এসেছে। হোক তা আধ্যাত্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, আইন বা রাজনৈতিক – এমন সমাধান যা মানবজাতি যা তৈরি করতে পারে তার সাথে তুলনাহীন; এবং মানুষের আইনের বিপরীতে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই এটি সমস্ত প্রজন্ম, স্থান, কাল ও পাত্রের জন্য প্রযোজ্য। এটি একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবস্থার উত্থানকে চিহ্নিত করে যা একজন ব্যক্তির হৃদয় ও মনে প্রশান্তি আনবে এবং যা দুর্নীতিগ্রস্ত ও অন্যায় ধারণা, ঐতিহ্য ও আইনকে উপড়ে ফেলবে, মানুষকে বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি এবং দুর্দশা থেকে মুক্ত করবে। একটি ব্যবস্থা যা সকল মানুষের জন্য তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে ঐশী মূল্যবোধ দ্বারা ন্যায়পরায়ণতা ও ভারসাম্য নিশ্চিত করে, মানবতার জন্য এটি সত্যিকারের রহমত ও আলো।

    এবং এটি এমন একটি ব্যবস্থা ছিল যা ১৩০০ বছর ধরে প্রয়োগ করা হয়েছিল – মদীনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে শুরু করে এবং তাঁর পরে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত খিলাফাহ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল – – ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও চিকিৎসায় শ্রেষ্ঠত্বের বিস্তার, নিরাপত্তা, মহিলাদের জন্য মর্যাদা, এবং স্পেন থেকে চীন পর্যন্ত মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি।

    কিন্তু আজ, এই খিলাফাহ রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে, মহিমান্বিত কুরআনের আইনগুলি আর আমাদের মুসলিম ভূমিতে সামগ্রিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না, ইসলাম এই পৃথিবীর মানবতার জন্য যে আলো ও করুণার ব্যবস্থা এনেছিল তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এর অতুলনীয় সমাধানগুলো – যা বিশ্বের সমস্ত গ্রন্থের বিষয়বস্তুর চেয়ে উচ্চতর – যার অনুপস্থিতি এই উম্মাহ ও মানবজাতিকে অন্ধকার, ব্যাপক দারিদ্র্য, অসম্মান, নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্ভোগে নিমজ্জিত করেছে।

    দারিদ্র্য দূরীকরণ:

    আজ মানবতার মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দরিদ্রতার আত্মা-ধ্বংসকারী পঙ্গু জ্বরে ভুগছে এবং এমনকি আমরা মানুষকে অনাহারে মারা যেতে দেখছি যদিও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য এবং এর বাইরেও একটি ভাল জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট সম্পদ তৈরি করেছেন। তিনি বলেন,

    وَبَارَكَ فِيهَا وَقَدَّرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ

    তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন…। [ফুস্সিলাত: ১০]

    আর আজ আমরা দেখছি আমাদের ভাই-বোনরা রুটি ও নোংরা পানির উপর বেঁচে আছে এবং রোগে আক্রান্ত বস্তিতে বসবাস করছে, আমাদের মায়েরা তাদের পরিবারের খাওয়ানোর জন্য আবর্জনা থেকে খাবার তুলেছে, এবং আমাদের দাদিরা রাস্তায় ভিক্ষা করছে যদিও আল্লাহ আমাদের মুসলিম ভূমিগুলোকে তার নিয়ামতে পরিপূর্ণ করেছেন। আমাদের রয়েছে বিশ্বের সিংহভাগ তেল, গ্যাস, স্বর্ণের মজুদ এবং কোটি কোটি একর পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর ভূমি – যাতে আমাদের উম্মাহকে একটি দিনও আর্থিক কষ্ট করতে না হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি মুসলিম বিশ্বের একটি নমুনা দেখি যে, পাকিস্তানের মাত্র ২০ জন ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে যদি যাকাত সংগ্রহ করা হয় তবে এটি $৬০০ মিলিয়নেরও বেশি উপার্জন হবে এবং পাকিস্তানের কয়লা ক্ষেত্রগুলির মাত্র ২% মজুদ আগামী ৪০ বছরের জন্য দেশটির জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে, জনগণকে এক সেকেন্ড ব্ল্যাকআউটের শিকার হতে হবে না; বাংলাদেশে কুইক রেন্টালের জন্য যে পরিমান অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয় তা দিয়ে একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছানো সম্ভব এবং যদি এককভাবে নাইজেরিয়ায় সঠিকভাবে চাষ করা হয় তবে এটি সমগ্র আফ্রিকাকে খাওয়াতে পারে। সুবহানাল্লাহ!

    আমাদের উম্মাহর আজ যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবস্থা, তা হল কুরআনে  বর্ণিত আইনের রহমত এবং কিভাবে আমাদের দেশের সম্পদকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী সংগঠিত করা যায় তা পরিত্যাগ করার ফল। কিন্তু যখন এই আইনগুলো তাঁর سبحانه وتعالى-এর ব্যবস্থা তথা খিলাফতের অধীনে বাস্তবায়িত হয়েছিল, তখন তা ছিল একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতা। এই রাজ্যের অধীনে, ৮ম শতাব্দীতে, যখন উমর বিন আবদুল আজিজ মুসলমানদের খলিফা ছিলেন, তিনি একবার ইরাকে তার এক কর্মকর্তা আবদুল-হামিদ ইবনে আবদুর-রহমানকে চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তিনি তাকে জনগণের পাওনা পরিশোধ করতে বলেছিলেন। ‘আব্দুল-হামিদ জবাবে  তাঁকে লিখেছিলেন, “আমি জনগণের পাওনা পরিশোধ করেছি এবং বায়তুল-মাল (কেন্দ্রীয় কোষাগার)-এ এখনও অর্থ রয়েছে।” অতঃপর উমর (রা.) তাকে লিখেছিলেন যে যারা টাকা ধার করেছে এবং তার ঋণ পরিশোধ করেছে তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করতে। আবদুল-হামিদ তাকে আবার লিখেছিলেন, “আমি তাদের ঋণ পরিশোধ করেছি, এবং বায়তুল-মালে এখনও টাকা আছে”। উমর তাকে আবার লিখেছিলেন যে প্রত্যেক সেই পুরুষকে খুঁজতে যার কাছে টাকা নেই কিন্তু বিয়ে করতে চায় এবং তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে এবং তার জন্য মাহর পরিশোধ করতে। আবদুল-হামিদ তাকে আবার লিখেছিলেন, “আমি যাদের খুঁজে পেয়েছি তাদের প্রত্যেককে বিয়ে করিয়েছি এবং মুসলমানদের বায়তুল-মালে এখনও অর্থ রয়েছে।” উমর তখন তাকে চিঠি লিখে বলেছিলেন যে যাদের খারাজ (জমি কর) পাওনা ছিল এবং জমি চাষের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন ছিল তাদের সন্ধান করতে এবং তাদের এটি করতে সাহায্য করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা তাদের ধার দিতে।

    সুবহানাল্লাহ! এটা কোন স্বপ্ন নয়। এটি একটি ভূমিতে কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে থাকা ইসলামী অর্থনৈতিক আইন বাস্তবায়নের করুণা ও ফল – যা সমৃদ্ধি তৈরি করতে পারে এবং প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা নিশ্চিত করতে পারে।

    রাজনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:

    আজ মুসলিম বিশ্ব রাজনৈতিক দমন-পীড়নে জর্জরিত – তা গণতন্ত্র দ্বারা শাসিত হোক বা একনায়কতন্ত্র দ্বারা। আমাদের এমন নেতৃত্ব আছে যারা ভয় দিয়ে শাসন করে – তাদের নাগরিকদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করে, মিডিয়াকে তাদের দুর্নীতি ও অন্যায্য কাজের জবাবদিহি করতে বাধা দেয় এবং যারা তাদের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের গ্রেফতার, কারাগারে, নির্যাতন এবং এমনকি দায়মুক্তির মাধ্যমে হত্যা করে। তারা এমন শাসক যারা নিজেদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে দেখেন, সংবিধান পরিবর্তন করেন এবং জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করেন, উম্মাহর সম্পদ লুট করেন এবং যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের হিসাব-নিকাশের কাজগুলো হয়ে ওঠে অপরাধমূলক। 

    এটি ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, খিলাফতকে পরিত্যাগ করার এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের এর পরিবর্তে আমাদের ভূমিগুলিকে পরিচালনা করার জন্য অনৈসলামিক ধর্মনিরপেক্ষ বা ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেখানে মানুষ আইন প্রণয়ন করে তার প্রত্যক্ষ ফলাফল। এবং এর ফলস্বরূপ, আমাদের এখন এমন নেতৃত্ব রয়েছে যারা জনগণের চাহিদা এবং ভোগান্তির প্রতি উদাসীন বরং তাদের স্বার্থ ও ক্ষমতার আসন রক্ষা তাদের গ্রাস করে আছে।

    এর সম্পূর্ণ বিপরীতে, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত আইন দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে, খিলাফত, রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা, শাসনে স্বচ্ছতা, আইনের শাসন নিশ্চিত করে এবং এতে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নাগরিকদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা নির্যাতন নিষিদ্ধ। এবং এসব শাসনের অবিচ্ছেদ্য নীতি।  প্রকৃতপক্ষে, ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকওয়াপূর্ণ শাসকদের তৈরি করেছে যারা তাদের নাগরিকদের তাদের দায়িত্বের জন্য তাদের কাছে জবাবদিহি করবে এবং তাদের সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধের ইসলামী দায়িত্ব পালনে তাদের উৎসাহিত ও সহায়তা করবে।

    উদাহরণস্বরূপ, উমর বিন আল-খাত্তাব (রা.), খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর জনগণকে একত্রিত করেন এবং তাদের দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হলে তাকে তাদের শাসক হিসেবে জবাবদিহী করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আমার দায়িত্ব পালনে আমি পবিত্র গ্রন্থ থেকে নির্দেশনা নেব এবং মহানবী (সা.) ও আবু বকর (রা.) এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করব। এ কাজে আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছি। যদি আমি সঠিক পথে চলি তবে আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হই তবে আমাকে সংশোধন করবেন যাতে আমরা বিপথগামী না হই। একবার জনসভায় জনৈক ব্যক্তি তাকে চিৎকার করে বলল, “হে উমর! আল্লাহকে ভয় কর!” শ্রোতারা তাকে নীরব করতে চেয়েছিলেন কিন্তু উমর এটিকে বাধা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন: “যদি লোকেদের দ্বারা এই ধরনের অকপটতা দেখানো না হয়, তাহলে তারা কোন কিছুর জন্যই ভালো নয় এবং, যদি আমরা তাদের কথা না শুনি, তাহলে আমরা তাদের মতই হব (অর্থাৎ কিছুই ভালো হবে না)।” এটা শুধু মুখের কথাই ছিল না, প্রতি বছর হজের সময় তিনি রাষ্ট্রের সকল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তার কাছে রিপোর্ট করতে বলতেন এবং এই সময়ে যে কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের যে কোনো অভিযোগ তুলে ধরতে পারতেন। একবার একজন ব্যক্তি অভিযোগ করলেন যে একজন গভর্নর তার কোন দোষ না থাকায় তাকে বেত্রাঘাত করেছেন। তদন্তের পর, গভর্নরকেও প্রকাশ্যে একই সংখ্যক বেত্রাঘাত করা হয়েছিল।

    রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রতি এই গুরুত্ব দেওয়া এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনে জনগণকে সমর্থন করা এবং শাসকের জবাবদিহিতা ইসলামী শাসনের শতাব্দী জুড়ে অব্যাহত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মামুন আর-রশিদ, আব্বাসীয় খলিফদের একজন, বিশেষভাবে তার জনসাধারণের শ্রোতাদের অভিযোগ শোনার জন্য রবিবার আলাদা করে রাখতেন। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত, প্রত্যেকেই – নারী-পুরুষ – খলিফার কাছে তাদের অভিযোগ পেশ করতে পারত, যা তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেওয়া হতো। একদিন এক দরিদ্র বৃদ্ধা অভিযোগ করলেন যে একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তি তার সম্পত্তি হস্তগত করেছে। “কে সেই ব্যক্তি?” খলিফাকে জিজ্ঞেস করলেন। “তিনি আপনার পাশে বসে আছেন,” খলিফার ছেলে আব্বাসের দিকে ইশারা করে বৃদ্ধ মহিলা উত্তর দিলেন। আব্বাস দ্বিধাগ্রস্ত সুরে তার পদক্ষেপকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল যখন বুড়ি তার যুক্তিতে আরও জোরালো হচ্ছিল। খলিফা বলেন যে এটি তার মামলার সততা যা তাকে সাহসী করে তুলেছিল এবং পরবর্তীতে তিনি তার পক্ষে এবং তার নিজের ছেলের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন।

    এগুলো কুরআন ও সুন্নাহর আইন দ্বারা পরিচালিত সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিদ্বন্দ্বী ন্যায়বিচারের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।

    মুসলমানদের জীবন ও ইজ্জত রক্ষা:

    আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের উম্মাহর রক্ত, জীবন ও সম্মানের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি – তা সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মায়ানমার, আফগানিস্তান, মধ্য আফ্রিকা, চীন এবং তার বাইরে যেখানেই হোক। আমাদের ভাই-বোনদের রক্ত পানির চেয়েও সস্তা হয়ে গেছে এবং এমন কোনো রাষ্ট্র বা ব্যবস্থা নেই যা তাদের রক্তকে রক্ষা করতে পারে কিংবা তাদের জন্য অভয়ারণ্যের ব্যবস্থা করতে পারে যেখানে তারা মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে, নাগরিকত্বের পূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারে।

    এটি আজ আমাদের দেশে সেসব নেতৃত্ব থাকার ফলাফল যারা কুরআনে থাকা আইন ও সমাধানের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা অনুসারে শাসন করে। এইসব অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী উম্মাহ ও দ্বীনের স্বার্থে তাদেরকে একত্রিত করার পরিবর্তে উম্মাহর সৈন্যবাহিনীকে তাদের স্বার্থপর জাতীয় স্বার্থ বা ক্ষমতার সিংহাসন রক্ষার জন্য ব্যবহার করে। এইসব নেতৃত্ব কুরআনের আয়াতের চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, যেখানে বলা হয়েছে,

    إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

    মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও। [সরা আল-হুজুরাত: ১০]

    এবং যেমনটি বলা হচ্ছে,

    إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ

    নিঃসন্দেহ তোমাদের এই সম্প্রদায় একই সম্প্রদায়, আর আমিই তোমাদের প্রভু, সুতরাং আমাকেই তোমরা উপাসনা করো। [আল-আনবিয়া: ৯২]

    এবং যেমনটি বলা হচ্ছে,

    وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقُواْ وَاذْكُرُواْ نِعْمَةَ اللّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاء فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىَ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا

    আর তোমরা সবে মিলে আল্লাহ্‌র রশি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, আর বিচ্ছিন্ন হয়ো না, আর স্মরণ করো তোমাদের উপরে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ, — যথা তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু, তারপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে সম্প্রীতি ঘটালেন, কাজেই তাঁর অনুগ্রহে তোমরা হলে ভাই-ভাই। আর তোমরা ছিলে এক আগুনের গর্তের কিনারে, তারপর তিনি তোমাদের তা থেকে বাঁচালেন। এইভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর নির্দেশাবলী সুস্পষ্ট করেন যেন তোমরা পথের দিশা পাও। [সূরা আলে ইমরান: ১০৩]

    যাইহোক, যখন কুরআন সেই ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল যা আমাদের জমিন শাসন করেছিল, তখন এই উম্মাহ তার অগণিত আশীর্বাদগুলির মধ্যে একটি হিসাবে এই সত্যিকারের ইসলামী ব্যবস্থা তথা খিলাফতের নেতৃত্বে পূর্ণ সুরক্ষা, সুরক্ষা এবং অভিভাবকত্ব উপভোগ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ৯ম শতাব্দীতে খলিফাহ আল-মুতাসিম বিল্লাহর শাসনামলে, একজন মুসলিম নারী একজন রোমান সৈন্য দ্বারা বন্দী এবং লাঞ্ছিত হয়েছিল। ভীত ও অসহায় সেই নারী দুঃখে সাহায্যের জন্য খলিফার নাম ডাকলেন; “[ওয়া মু’তাসিমা] হায় মু’তাসিম (কোথায় তুমি?)।” ঘটনার খবর মুতাসিমের কাছে পৌঁছালে তিনি জবাব দেন, “লাব্বাইক [আমি আপনার ডাকে সাড়া দিচ্ছি]।” এবং তিনি বললেন, “ওয়াল্লাহি (আল্লাহর শপথ), আমি এমন একটি বাহিনী পাঠাব যেটি এত বড় যে যখন এটি তাদের কাছে পৌঁছাবে তখনও তারা আমাদের ঘাঁটি ছেড়ে যেতে থাকবে। এবং আমাকে এই রোমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী শহরটি বলুন এবং আমি সেই শহরে সেনাবাহিনী পাঠাব।” রমজান মাস হলেও তিনি এ কাজে দেরি করেননি। বরং তিনি অবিলম্বে মহিলাটিকে উদ্ধার করার জন্য রোমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ আমুরিয়া শহরে ৯০,০০০ শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। শহরটি তার অত্যাচারীদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল এবং ইসলামের শাসনের অধীনে এসেছিল, এবং আল-মু’তাসিম তার নিজের হাতে মহিলাটিকে মুক্ত করেছিলেন, এমনকি তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, “প্রিয় বোন, আমি আরো আগে আসতে পারলাম না, কারণ বাগদাদ থেকে তোমার পথ অনেক দূর ছিল।” তাই, শুধুমাত্র একজন নারীকে উদ্ধার করার জন্য একটি সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছিল কারণ ইসলামী শাসন তার রাষ্ট্রের নাগরিকদের সম্মান ও সুরক্ষা প্রদান করে; এবং খিলাফতের দায়িত্ব ও সামর্থ্য এরূপই ছিল যে সে তার উম্মাহকে রক্ষা করতে তার বিশাল ভূখণ্ড থেকে সম্পদ ও সৈন্যদের একত্রিত করতো, বিনা দ্বিধায়।

    তাই আবার বলছি, এটি কোনো স্বপ্ন নয়। এটি মহিমান্বিত কুরআনে থাকা আইন ও সমাধান অনুসারে আমাদের ভুমি শাসন করার মাধ্যমে এই উম্মাহর জন্য রহমত ও সুরক্ষা।

    সুতরাং, আমরা রমজানের এই শেষ ১০ দিনে লাইলাতুল কদরের সন্ধান করার জন্য, আমাদের প্রভুর কাছে তাঁর ক্ষমা, রহমত ও পুরস্কারের জন্য প্রার্থনা করছি এবং মহিমান্বিত কুরআনের তেলাওয়াত সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করছি, আসুন আমরা চিন্তা করি যে এই ক্ষমতার রাতটি কেন তাৎপর্যপূর্ণ – অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তার অবতীর্ণ হওয়া। এবং এর সাথে, আসুন আমরা নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করি যে আমরা এই কুরআনকে আমাদের জীবনে এবং পৃথিবীতে এমন মর্যাদা দিয়েছি কিনা যা এর প্রাপ্য – এমন এক মর্যাদা যা বিশ্বপালনকর্তা سبحانه وتعالى কর্তৃক বর্ণিত যা তা প্রতিফলিত করে এই কুরআন যে রাতে অবতীর্ণ হয়েছিল সেই রাত ১০০০ মাসের চেয়েও উত্তম! কারণ এই মহিমান্বিত কুরআন নিছক তেলাওয়াতের জন্য একটি আধ্যাত্মিক গ্রন্থ নয়, বা এমন কিছু নয় যা কেবল কিছু নিয়ম-কানুন সংজ্ঞায়িত করে যা আমরা অনুসরণ করি। না! বরং এটি মানবজাতির স্রষ্টা سبحانه وتعالى কর্তৃক তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অবতীর্ণ একটি গ্রন্থ যা আমাদের সমগ্র জীবনকে গঠন করতে এবং আমাদের সমস্ত বিষয়গুলিকে পরিচালনা করে – রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, বিচারিক, সামাজিক এবং এর বাইরে যা কিছু রয়েছে – এবং এমনভাবে পরিচালনা শেখায় যা আল্লাহর রহমত নিয়ে আসে। মানবতার জন্য তার দ্বীনের আলো নিয়ে আসে এই পৃথিবীতে। এই গ্রন্থকে অন্যথায় মনে করা বা এর চেয়ে কম কিছু মনে করা আমাদের হাতে থাকা এই রত্নটির মূল্যকে অবমূল্যায়ন করা, অথচ এর নিদর্শন তাদের কাছে প্রকাশিত হলে পাহাড়গুলোও সরে যেত!

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «إِنَّ اللَّهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا، وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ»

    আল্লাহ্ এই কিতাবের মাধ্যমে কিছু জাতিকে উন্নীত করেন এবং অন্যদেরকে এর দ্বারা অধঃপতন করবেন” [মুসলিম]

    মূল: ডা. নাজরিন নওয়াজ কর্তৃক প্রবন্ধ, ঈষৎ পরিমার্জিত

  • আইন জালুতের যুদ্ধ

    আইন জালুতের যুদ্ধ

    আইন জালুতের যুদ্ধ (৬৫৮ হিজরি) ছিল তাতারদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের অন্যতম সেরা বিজয়গুলোর মধ্যে একটি । ৬৫৬ হিজরিতে তাতাররা ইসলামি খিলাফতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরু করে, যার ফলে তারা খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ দখল করে নেয়, খলিফা মুসতা’সিম বিল্লাহকে হত্যা করে, মুসলিমদের তিন চতুর্থাংশ ভূমি দখল করে নেয়। তারা মুসলিমদের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ মিশরের আমিরকে দূত মারফত চিঠি প্রেরণ করে বলে “আমরা খিলাফতের এই ভূমিকে ধংস করে দিয়েছি, শিশুদের এতিম বানিয়েছি, মুসলিমদের নির্যাতন করেছি আর হত্যা করেছি, সম্মানিতদের অমর্যাদা করেছি আর বন্দি করে রেখেছি”। তুমি কি মনে কর তোমরা আমাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে? একটু পর তুমিও জানতে পারবে তোমাদের উপর কী আসছে…। তাতারদের এমন হুমকিতে মুসলিমদের দুর্বলতা ও নৈতিক স্খলনের  সময়টাতে তাদের প্রতিরোধের মানসিকতাই হারিয়ে ফেলবে বলে মনে করা হয়েছিল। পরাজিত মানসিকতা তাদের অন্তরে প্রচণ্ডভাবে কাজ করছিল। সবাই প্রায় আশাই হারিয়ে ফেলছিল। ঠিক সে সময় সাইফুদ্দিন কুতুজ সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তাদের জবাব দেন। তিনি তাতার দূতকে হত্যা করে তাঁর রাজধানীর কেন্দ্রে ঝুলিয়ে রাখেন, যার ফলে একদিকে যেমন মুসলিমদের মধ্যকার পরাজিত মানসিকতা দূর হয়ে প্রতিশোধের মানসিকতা জেগে উঠে অন্যদিকে এর মাধ্যমে তিনি তাতারদেরসহ গোয়েন্দা ও দালালদের মানসিকতায় কুটারাঘাত করেন।

    সাইফুদ্দিন কুতুজের এমন সাহসিকতাপূর্ণ কাজে মুসলিমদের ঈমানী স্পৃহা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, শত্রুরা শংকিত হয়ে পড়ে এবং বুঝতে পারে, তারা একজন সাহসী নেতার মোকাবেলা করতে যাচ্ছে। কুতুজ অনিবার্য এই যুদ্ধের জন্য মুসলিমদের প্রস্তুত করতে থাকেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিমরা শত্রুর মোকাবেলায় ঈমানের সাথে ঐক্যবদ্ধ হন এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রসস্ত্র জোগাড় করতে থাকেন। তিনি অন্যান্য মুসলিম শাসক ও আলেমদের ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানান এবং ইসলামের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মুসলিমদের হারানো ভূমিগুলো পুনরূদ্ধারে এগিয়ে যান। অবশেষে ২৫শে রমজান ৬৫৮ হিজরি সনে আকাঙ্ক্ষিত আইন জালুতের যুদ্ধ শুরু হয়। শুরুতে সাইফুদ্দিন কুতজ পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে তাঁর শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলে মুসলিম সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন “ওয়া ইসলামাহ, ওয়া ইসলামাহ” তিনি শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকে দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে আহ্বান করেন। সাইফুদ্দিন কুতজের এমন বক্তব্য ও তাঁর আলোকিত চেহারা দেখে দুর্বল হয়ে পড়া মুসলিম সেনা অফিসারগণ প্রচণ্ডভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। কুতুজের এমন সাহসিকতায় মুসলিম সেনাবাহিনীর ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তাঁদের নেতৃত্ব সুদৃঢ় হতে থাকে। যার ফলে মুসলিমদের আক্রমণে অল্প সময়ের মধ্যে তাতার সেনাবাহিনী ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পরাজয় বরণ করে এবং যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে থাকে।

    পুনরায় ইসলাম ও মুসলিমরা  বিজয় লাভ করেন। ফলে, তাতাররা পরাজিত হয়, তাদের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে আসে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিমরা একে একে (সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন ইত্যাদি) হারানো ভূমিগুলো পুনরুদ্ধার করে। আমাদের এখনকার অবস্থার মতো শত্রুবেষ্টিত দুর্বলতার সময়েও মুসলিমরা শুধুমাত্র আন্তরিক নেতৃত্বের কারণে জয়লাভ করেন।

    কিভাবে বিজয়লাভ হবে?

    ইসলামের ইতিহাসে রমজান মাস ছিল রোজা, ইবাদত ও জিহাদের জন্য বিখ্যাত। রাসুল (সা) এবং পরবর্তী মুসলিমদের সময়ও অনুরূপ ছিল।

    বর্তমান সময়েও রমজান মাসে মুসলিমরা যুদ্ধে জড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালের এই মাসে ইসরাইলের বিরুদ্ধে, ৯ই রমজান  মুসলিমরা  ইয়েমেন গৃহযুদ্ধে (১৯৬২-১৯৭০), মিশরীয় মুসলিমরা সুয়েজখাল পার হয়ে ১০ই রমজান ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে, ১৯৭৫-১৯৯০ সালের ১৭ই রমজান লেবানন যুদ্ধ শুরু হয়।। সম্প্রতি আফগান, ইরাক যুদ্ধেও যেখানে মুসলিমরা বারবার পরাজিত। আর বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজার মর্মান্তিক নজিরতো রয়েছেই।

    কিন্তু খিলাফতের সময়কালের সাথে এইসব যুদ্ধ বিবেচনা করলে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। মুসলিমদের বারবার পরাজয় বরণের মুল কারণ হল ঐক্যবদ্ধতা ও খিলাফত রাষ্ট্রের একক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি। সালাউদ্দিন আইয়ুবী এটি বুঝতে পেরিছিলেন, তাই তিনি ঐতিহাসিক জেরুজালেম বিজয়ের পূর্বে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

    ইমাম মুসলিম হতে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেন-

    “ইমাম হচ্ছে ঢাল স্বরূপ, যার পিছনে থেকে জনগণ যুদ্ধ করে ও নিরাপত্তা লাভ করে”

    ইতিহাস বলে খিলাফত ছাড়া মুসলিমরা সবসময় পরাজিত। মুসলিমদের এইসব পরাজয় মূল কারণ  খিলাফত রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অভাব। আমরা তাকালেই দেখতে পাই খিলাফতের সাময়িক দুর্বলতার সময় ক্রুসেডাররা আল কুদস দখল করে নেয়। কিন্তু অল্প সময়ে মধ্যে মুসলিমরা দুর্বলতা কাঠিয়ে উঠে এবং তাঁদের হারানো ভূমি আল কুদস পুনর্দখল করার চেষ্ঠা করা শুরু করে এবং তাতে সফল হয়। সর্বোপরি এটাই ছিল রাষ্ট্রের অবস্থা। খিলাফত রাষ্ট্র সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধে করেন এবং মুসলিমদের ভুমি পুনরুদ্ধার করেন। সেই খিলাফতের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এখন কোথায় যা মুসলিমদের ভূমিগুলো পুনরুদ্ধার করবে? ফিলিস্তিনকে মুক্ত করবে? চেচনিয়া অথবা কাশ্মীরকে মুক্ত করবে?

    কোথায় সেই খিলাফত যা মধ্যপ্রাচ্যকে মুক্ত করবে? জোট বাহিনী থেকে মধ্য এশিয়াকে মুক্ত করবে? বর্তমান অবৈধ মুসলিম শাসকরা শুধু মুসলিমদের পরাজয়কে বর্ধিত করবে, তারা শুধু তাদের পশ্চিমা প্রভুদের স্বার্থ রক্ষার্থে যুদ্ধে জড়াবে। উপরন্তু খিলাফত ছাড়া মুসলিমরা কখনো তাদের ভুমি মুক্ত করতে পারবেনা।

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

    হে মুমিনগণ! তোমাদের কি হল যে, যখন তোমাদের বলা হয়, বের হও আল্লাহর পথে, তখন তোমরা মাটিতে লেগে থাক (অলসভাবে বসে থাক)। তাহলে কি তোমরা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবনের উপর পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? বস্তুতঃ পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসতো আখিরাতের তুলনায় কিছুই নয়, অতি সামান্য। (আত-তাওবা: ৩৮)

    নিশ্চয়ই আমি আমার রাসুলদেরকে ও মুমিনদের সাহায্য করব পার্থিব জীবনে এবং সেদিন সাক্ষীগণ দণ্ডায়মান হবে। (গাফির: ৫১)

    আবার রমজান মাসকে বিজয়ের মাস করি

    আলহামদুলিল্লাহ, মুসলিমদের কাছে সোভাগ্যশালী রমজান মাস আবারও ফিরে এসেছে। এই মাসে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা লাওহে মাহফুজ থেকে কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। এই মাসে ইবাদতকারীদের জন্য আল্লাহ লাইলাতুল কদর নামে এমন একটি রজনী রেখেছেন যা হাজার মাস থেকে উত্তম। রমজান মাসে আল্লাহ মুসলিমদের রোজা রাখতে আদেশ করেছেন, শয়তানকে শৃঙ্খলিত করেছেন, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন এবং জান্নাতের দরজাসমুহ খুলে দিয়েছেন, সর্বোপরি মুসলিমদের আল্লাহর নৈকট্যে যাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট।

    পূর্ব প্রজন্মের মুসলিমগণ, আল্লাহর প্রদত্ত কুরআন দিয়ে শাসন করেছেন, রমজান দ্বারা সৌভাগ্যশালী হয়েছেন, এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন। রমজান মাসেই রাসূল (সা) এর নেতৃত্বে মুসলিমরা সংখ্যায় কম ও দুর্বল অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বে আরবদের নেতৃত্বশীল গোত্র কোরাইশদের বিরুদ্ধে বদরের যুদ্ধে জয়লাভ করেন।

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

    আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে বদরে সাহায্য করেছিলেন এবং তোমরা দুর্বল ছিলে, অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হও। (আলে ইমরান: ১২৩)

    এছাড়া রমজান মাসে মক্কা বিজয় সূচিত হয়, কুরাইশরা ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে। তাদের জুলুমের শাসনের অবসান ঘটে এবং পুরো আরব ভূমি ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে। মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নাযিল করেন-

    যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, তখন তুমি দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে মানুষকে প্রবেশ করতে দেখবে। (আন নাসর: ১-২)

    রাসুল (সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদার পরও শতশত বছরের খিলাফত রাষ্ট্রের ইতিহাসে রমজান মাসেই ভয়ানক সব শত্রুদের পরাজিত করে মুসলিমরা বিজয় অর্জন করেছে। মুসলিমরা সফলভাবে আস-শাম থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করেছে যদিও তারা ক্ষুদ্র একটি ভূমি শত বছর দখল করে রাখতে পেরেছিল। মুসলিমদের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও বর্বর তাতারদের বিরুদ্ধে আইন জালুতের যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করে।

    সুতরাং, যখনই মুসলিমরা ইসলাম দ্বারা শাসিত হয়েছেন, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা তাদের বৈষয়িক বিষয়াদি নির্ধারিত হয়েছে শুধুমাত্র তখনই মুসলিমরা রমজান মাসে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছে। অথচ, এই রমজান মাসেই ইসলামি রাষ্ট্র খিলাফত ছাড়া এই উম্মাহর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শত্রুদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়ে রয়েছে।

    এই রমজানে আমরা যদি মুসলিমদের বাস্তবতা দেখি, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো মুসলিম ভূমি ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনের উপর জোর করে দখলদারিত্ব স্থাপন করেছে। এই রমজানে মুসলিম সেনাবাহিনীগুলো মুসলিমদের উদ্ধারে ইতস্তত বোধ করছে অন্যদিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে। এই রমজানে পশ্চিমাদের লিবারেল দষিত চিন্তাগুলো শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবেশ, মিডিয়া ও নানা উপায়ে মুসলিমরা সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আকীদা ও দ্বীনের উপর আক্রমণ করছে। এই রমজানেই মুসলিমদের বিশাল সম্পদ সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনের ফলে উম্মাহর চরম কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে।

    বিশাল ভূমি, খনিজ সম্পদ, জনসংখ্যা, সেনাবাহিনী, সর্বোত্তম সম্পদ একমাত্র সঠিক দীন ইসলাম থাকা সত্ত্বেও উম্মাহ কাফিরদের কাছে অপদস্থ। ইসলামি রাষ্ট্র খিলাফত, রাজনীতি ও শাসন, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ছাড়া এমন হওয়াই অনিবার্য। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী রাজনীতি ও শাসনকে সাম্রজ্যবাদীদের ইচ্ছায় যা আদেশ করে ও যা তারা ঘৃণা করে তাই বাস্তবায়ন করছে। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, মুসলিমদের বিজয় অর্জন করতে রাজনীতি করা হচ্ছেনা। উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের সন্তুষ্ট রাখতে বর্তমান শাসক ও তাদের পরিবর্তে যারা আসতে চাইছে তারা সস্তা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে রাজনীতিকে কলঙ্কিত করছে।

    হে মুসলিম ভাইয়েরা, এই রমজানে শুধু ইবাদত ও রোজা রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টির চেষ্টা করে আপনি সন্তুষ্ট থাকলে হবে না কারণ কাফিরদের যড়যন্ত্রের কারণে উম্মাহ চরমভাবে নির্যাতিত। বরং খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে, যাতে আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়িত হয়, এবং সকল দীনের উপর ইসলাম বিজয় লাভ করে। যাতে রমজান আবারও বিজয়ের পর বিজয়ের সাক্ষী হয়ে থাকে। বর্তমান শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন এবং খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্টায় কাজ করা এটি শুধুমাত্র জীবন মৃত্যুর বিষয় নয়। এটি আল্লাহ প্রদত্ত একটি ফরজ দায়িত্ব। যদি মুসলিমরা এই দায়িত্ব পালনে বিরত থাকে তবে শাসকদের পাপসমূহ তাদের উপরও আরোপিত হবে। দুনিয়ায় তাদের অবস্থা আরো খারাপ হবে এবং আখিরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে। রাসূল (সা) বলেছেন,

    আল্লাহ কিছু ব্যাক্তির পাপের কারণে সাধারণ মানুষকে শাস্তি দেন না। যতক্ষন পর্যন্ত তারা ঐ ব্যক্তিগুলোর মুনকার দেখে এবং তা প্রতিরোধ করে, যদি তারা প্রতিরোধ না কর, তবে আল্লাহ ঐ পাপী ব্যক্তিগুলোসহ সবাইকে শাস্তি প্রদান করেন। (আহমেদ)

    সুতরাং চলুন রমজান মাসের সুফল ভোগ করি। আল্লাহর দিকে ফিরে আসি। এই দূর্নীতিগ্রস্থ শাসকদের অপসারণ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কারণ একমাত্র খিলাফতই ইসলামের কর্তৃত্ব স্থাপন করবে, মুসলিমদের নিরাপত্তা দিবে, তাদের দ্বীনের নিরাপত্তা দিবে এবং শত্রুর অন্তরে ভীতির সঞ্চার করবে। আমরা একমাত্র আল্লাহর ব্যপারে সত্যনিষ্ঠ হলে তিনি আমেদেরকে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

    আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

    আর তোমরা নিরাশ হয়োনা ও বিষন্ন হয়োনা এবং যদি তোমরা বিশ্বাসী হও তাহলে তোমরাই বিজয়ী হবে। (সুরা আলে ইমরান: ১৩৯)

  • দক্ষিণ বিশ্বের উত্থান

    দক্ষিণ বিশ্বের উত্থান

    বৈশ্বিক দক্ষিণ বা দক্ষিণ বিশ্ব একটি নতুন ট্রেন্ড, সবাই এ নিয়ে কথা বলছে। চীন ও রাশিয়া বলছে তারাই বিশ্বের ভবিষ্যত এবং পশ্চিমারা যারা এদের দীর্ঘ সময় ধরে অবহেলা করেছে তারাও একটি উদার ভবিষ্যত বজায় রাখার জন্য এদের অপরিহার্য হিসেবে দেখে। গোটা পৃথিবীর ক্ষমতার ভারসাম্যের যখন টালমাতাল অবস্থা তখন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কাঠামোকে অবশ্যই গ্লোবাল সাউথ তথা বৈশ্বিক দক্ষিণকে বিবেচনায় নিতে হবে।

    এ পর্যন্ত ভূরাজনীতি পৃথিবীকে দেখে এসেছে পূর্ব পশ্চিম দৃষ্টিকোণ থেকে। বিশ্বের ধনী দেশ, বৃহত্তম সামরিক বাহিনী ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলি সেখানে উপস্থিত রয়েছে। এটি বাণিজ্য ও যোগাযোগের অনুমোদন দেয় এমন জলপথে তাদের পদচারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে ছিল। বৈশ্বিক উত্তরে বসবাসকারী জাতিগুলি উত্তরেই তাদের মূল সম্পর্ক ও প্রতিযোগিতাকে দেখেছে এবং এই কারণেই তাদের মধ্যে  পূর্ব-পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান ছিল।

    তাই গ্লোবাল নর্থ তথা বৈশ্বিক উত্তর বলতে শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোকে বোঝায় (ঐতিহাসিকভাবে যাদের ১ম বিশ্ব বলা হতো) যেখানে দক্ষিণ বলতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বোঝায় (ঐতিহাসিকভাবে যাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্ব বলা হতো) যাদের উত্তরের বিপরীতে শিল্পোন্নত এবং পরিষেবা ভিত্তিক অর্থনীতির পরিবর্তে পণ্য-ভিত্তিক অর্থনীতি রয়েছে। গত ৫০০ বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতি উত্তরের পক্ষে ছিল এবং তাদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, আর ঐতিহাসিকভাবে গ্লোবাল সাউথকে উচ্চ মাত্রার অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।

    গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোকে দীর্ঘকাল ধরে ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রান্তিক সদস্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে এসেছে। তারা বৈশ্বিক ঘটনাগুলোকে পরিচালিত করার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়া দেখাতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন দ্বি-মেরুর বিশ্বের আবির্ভাব ঘটে তখন বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, যারা উভয়ই তাদের প্রভাব বিস্তার করতে এবং বিশ্বকে তাদের বলয় কিংবা জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। বিশ্বের অনেক জাতি এই যুদ্ধকে তাদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে এসেছিল। যদিও তারা উভয় শক্তিকে অর্থ ও অস্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখেছিল, কিন্তু তারা বৈশ্বিক ব্যবস্থার বাইরে কিছু করতে পারেনি, এমনকি নিরপেক্ষও থাকতে পারেনি।

    এই প্রেক্ষাপটে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় G-77 এর আবির্ভাব ঘটে। উভয়ই খুব বেশি অর্জন করতে পারেনি কারণ বিশ্বের ঘটনাবলীর উপর তাদের সামান্যই প্রভাব ছিল। ১৯৭০-এর দশকে স্থবিরতা, বেকারত্ব ও তারল্য সংকট এর কারণে অনেককে ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছিল এবং যখন স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয় তখন গ্লোবাল সাউথ স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রান্তিক সদস্য হিসেবেই রয়ে যায়।

    বৈশ্বিক লিবারেল ব্যবস্থা যখন বেকায়দায় পড়েছে তখন গ্লোবাল সাউথ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র গ্লোবাল নর্থকে তাদের পণ্য ও সেবা দিয়ে পরিবেশন করার প্রেক্ষাপটে তারা তাদের অর্থনীতির ব্যাপারে একটি ভিন্ন পথ নিতে চায়। ব্রাজিল ও ভারত ময়দানে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার জন্য এবং রাজনৈতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিলের পণ্যভিত্তিক অর্থনীতি চীনের পাশাপাশি ইউরোপের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদিকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে রাশিয়া, তুরস্ক, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করছে।

    বৈশ্বিক উত্তরের দেশগুলোর মধ্যে উদীয়মান প্রতিযোগিতা গ্লোবাল সাউথ তাদের নিজেদের পক্ষে দেখছে। গত ৫০০ বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে গ্লোবাল নর্থ বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে এবং বৈশ্বিক দক্ষিণকে এর সঙ্গে তাল মেলানোর নিয়মনীতি ঠিক করে দিয়ে এসেছে। আগামীতে বৈশ্বিক উত্তরকে জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে অনেকাংশেই বৈশ্বিক দক্ষিণের উপর নির্ভর করতে হবে। এই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে ফ্রান্স ২০২৩ সালের আগস্টে BRICS সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য একটি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু শি জিন পিং সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।

    জাপান ২০২৩ সালে একটি নথি প্রকাশ করেছে যা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় গ্লোবাল সাউথের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব তুলে ধরেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য সম্পর্কিত এই শ্বেতপত্র বিশ্ব অর্থনীতিকে তিনটি বলয়ে বিভক্ত করেছে: পশ্চিম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে; পূর্ব, চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে এবং নিরপেক্ষ দেশ। এতে বলা হয়েছে যে গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে তোলা এবং জোরদার করা একটি অগ্রাধিকার ছিল, ভারতের উপর বিশেষ জোর দিয়ে।

    গ্লোবাল সাউথ কি বিশ্বের নতুন মেরুতে পরিণত হতে পারবে? এটি অর্জনে বৈশ্বিক দক্ষিনকে অবশ্য বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ‘গ্লোবাল সাউথ’ এর কোনো আইনি বা রাজনৈতিক বাস্তবতা নেই, এটি সুবিধার জন্য উঠে আসা একটি শব্দ। গ্লোবাল সাউথের বেশিরভাগ আলাপ-আলোচনা দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে ঘটে। বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক দেশ দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতায় ভুগছে, যা উদীয়মান সম্ভাবনাময় সুবিধাগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। গ্লোবাল সাউথ যদি উত্তরের করুণায় বেঁচে থাকার পরিবর্তে বিশ্বের উপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তবে এটি ২১ শতকে একটি বড় পরিবর্তনকে চিহ্নিত করবে।

    আবদুর রহমান খান