এডেন উপসাগরের জলদস্যু, ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার!

বৃটেন-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে এডেন উপসাগর। এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথের মধ্যে একটি।  আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যবর্তী স্থানে সংকীর্ণভাবে এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরের অবস্থান যেটি ভারত মহাসাগরকে সুয়েজ খাল এবং ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে।  এডেন উপসাগরের একপাশে আছে সোমালিয়া ও অপর পাশে আছে ইয়েমেন। এই বাণিজ্য পথেই পৃথিবীর ১৫ শতাংশ সামুদ্রিক বাণিজ্য সংঘটিত হয়। প্রতিবছর গড়ে চব্বিশ হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। পৃথিবীর ২০% পণ্যবাহী কন্টেইনার, ১০% সমুদ্রজাত তেল ও ৮% তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পরিহবন হয়ে এই পথে। তাই ভৌগলিকভাবে এই সামুদ্রিক পথ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, কোন রাষ্ট্র যদি এই সামুদ্রিক পথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে তাহলে পূরো পৃথিবীর আমদানী ও রপ্তানির বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই থাকবে।

ইয়েমেনে ব্যপক অত্যাচার ও লুটপাটের পর ১৯৬৭ সালে বৃটিশরা ইয়েমেন থেকে তাদের সামরিক সরঞ্জাম ও বাহিনী তুলে নিলেও এখনো সেখানে রাশেদ আল আলিমির মত বৃটেনপন্থী দালাল শাসক বলবৎ রয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকা চাচ্ছে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের মাধ্যমে বৃটেনপন্থী সরকারকে উৎখাত করে তার নিজের নিয়ন্ত্রিত সরকারকে প্রতিষ্ঠা করতে যেন এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরে তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃটিশভিক্তিক প্রতিষ্ঠান চ্যাটহাম ইন্সটিটিউটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়েমেনের পশ্চিম উপকূলের জায়ান্ট ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তারিক সালেহ বলেন- “যা ঘটছে অর্থাৎ হুথিদের দ্বারা বাণিজ্যিক জাহাজ ছিন্তাই করা, তার সাথে গাজার ঘটনার কোন যোগসূত্র নেই,” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যা ঘটছে তা ইরান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালীর মতো বাব আল-মান্দাব প্রণালীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সম্পূর্ণরূপে ইরানী পদক্ষেপ।” তিনি ইরানকে হুথিদের অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, ইয়েমেন সরকারকে উৎখাত করতে একদিকে যেমন হুথি বিদ্রোহীদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে, অপরদিকে হুথিদের দ্বারা বাণিজ্যিক জাহাজ ছিন্তাই এর ঘটনা বৃটেনের মিত্রদেশগুলো অর্থাৎ ইউরোপ ইউনিয়নের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। যা মূলত এডেন উপসাগরে আমেরিকার ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে বাস্তবায়নে ত্বরান্বিত করছে। ইউরোপ ইউনিয়নের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো লোহিত সাগরের নৌপথকে ব্যবহার করতে না পারলে তাদেরকে দীর্থ ১১ দিনের অতিরিক্ত পথ ভ্রমন করে পণ্য পরিবহন করতে হবে। যা জায়ান্ট ব্র্যান্ডগুলোকে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বাড়িয়ে দিবে। ফলে ব্রিটেনের মিত্রদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর সম্ভাবনা থাকবে। ইসলামের রাজনৈতিক উত্থান ঠেকানো ও চীনকে নিয়ন্ত্রনে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকা তার IPS (INDO PACIFIC STRATEGY) প্রকল্পের অংশ হিসেবে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। সোমালিয়ার জলদস্যুদের কর্তৃক ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ বুলগেরিয়ার ও বাংলাদেশের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ছিন্তাই হবার পর আমেরিকা ভারতকে দিয়ে বুলগেরিয়ার জাহাজটি উদ্ধার করিয়েছে। ভারত জ্বালানী তেল আমদানীর জন্য এডেন উপসাগরের নৌপথের উপর নির্ভরশীল। তাই নিজের বাণিজ্যিক নিরাপত্তার জন্য হলেও আমেরিকার ইন্টারেস্টে তাকে যুক্ত হতেই হবে। ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকা ভারতের নৌবাহিনীকে ব্যবহার করছে এবং নিশ্চিত করছে ভারত যেন আমেরিকার স্বার্থে আঞ্চলিক চৌকিদার হয়ে কাজ করে। এভাবে আমেরিকা লোহিত সাগর হতে শুরু করে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত তার ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের জাল বিস্তার করেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বীমা, নিরাপত্তার অজুহাতে সিকিউরিটি টাস্কফোর্স সেবা ও  সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির মাধ্যমে সে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে নিচ্ছে। ইতোঃমধ্যেই বাইডেন প্রশাসন ৩.৯৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ও ড্রোন ভারতের কাছে বিক্রি করতে সম্মতি দিয়েছে। অর্থাৎ “মরার উপর খাঁড়ার ঘা।” 

এই সকল সমস্যার উদ্ভব ঘটছে পশ্চিমা সম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের নব্য উপনিবেশ স্থাপন ও আধিপত্যবাদী তাড়না থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক সামুদ্রিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। মানব ইতিহাসের নিয়ম হিসাবে সর্বদাই ক্ষমতাবানরা নিজের স্বার্থমত আইন তৈরি করে যাকে তারা তখন “আন্তর্জাতিক আইন” বলে। ১৯৪৫ সালে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস. ট্রুম্যান তার প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও জাতির অধিকারের কথা বলে আন্তর্জাতিক নীতির বুলি ব্যবহার করে তার মহাদেশীয় সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করেছিলেন। অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো দ্রুত এই কৌশলটি গ্রহণ করেছিল, কিছু রাষ্ট্র তাদের মাছ ধরার জল ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রসারিত করেছিল, অন্যরা তাদের জাতীয় সমুদ্রকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রসারিত করেছিল। এর পরে, এই ধারণাগুলি তিনটি কনভেনশনের মাধ্যমে বৈধ করা হয়েছিল যেখানে বলা হয় রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরের সমস্ত জলকে আন্তর্জাতিক জল হিসাবে বিবেচনা করা হবে, যা সমস্ত জাতির জন্য বৈধ হবে এবং কারও কাছে কোনও অধিকার বা দাবি থাকবে না। আমরা দেখতে পাই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং অন্যান্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি একই তথাকথিত আন্তর্জাতিক জলসীমায় দাঁড়িয়ে তাদের বিমানবাহী জাহাজ থেকে মুসলিম দেশগুলিতে বোমা মেরে আমাদের রক্তাক্ত করে, এমনকি তাদের নৌবাহিনীও সুয়েজ খাল, হরমুজ প্রণালী এবং মালাক্কা প্রণালীর মতো মুসলিম দেশগুলির আঞ্চলিক জলসীমার মধ্য দিয়ে যায় এবং এই সমস্ত কিছু আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে শাসন করে।

দক্ষিণ চীন সাগরে চীন তার অধিকার দাবি করে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করছে, যাতে এটি তার সমুদ্রসীমা প্রসারিত করতে পারে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা এটিকে আন্তর্জাতিক জলসীমা লঙ্ঘন বলে অভিহিত করছে। আমেরিকা তার স্বার্থ হাসিলে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের রাষ্ট্রেসমূহের সামরিক বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের মত করে আকসা ও জিসোমিয়ার মত সামরিক সহায়তার চুক্তি করতে তৎপর হয়েছে যাতে করে অন্য রাষ্ট্রের সামরিক সহায়তায় সে তার নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা এভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের নামে সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রেখেছে। এই বিষয়টিই স্পষ্ট করে, আমেরিকার মত শক্তিশালী রাষ্ট্রের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে সামরিক সহায়তা দাবি করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্ষমতা আছে এই অঞ্চলে সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।

মুসলমানরা খিলাফতে রাশিদার সময় থেকে তাদের নৌবাহিনী শুরু করেছিল, যেখানে উমাইয়া খিলাফতই রোমান সাম্রাজ্যের নৌ শক্তির অবসান ঘটিয়েছিল যার ফলে মুসলমানরা বিশ্বের একমাত্র নৌ শক্তি ছিল যার নিয়ন্ত্রণ সমুদ্রের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল যা ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর এবং আরব সাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।উসমানীয়দের আগমন পর্যন্ত আব্বাসীয় খিলাফতে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। পূর্ব-পশ্চিম বাণিজ্য পথ মুসলমানদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল অর্থাৎ ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের ভারত ও চীনে পৌঁছানোর জন্য খিলাফতের সমূদ্রসীমার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। ইউরোপের জন্য একটি বিকল্প অবশিষ্ট ছিল, যেখানে তারা খিলাফতের সীমানা এড়িয়ে ভারত ও চীনে পৌঁছাতে পারে এবং সেটি হল কনস্টান্টিনোপল। কিন্তু ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর এই পথটিও ইউরোপের হাত ছাড়া হয়ে যায়।

সোমালিয়ার বা হুতির বিদ্রোহীরা যারা এই জলদস্যুতা করছে মুসলিমদের ইতিহাস তা নয়। মুসলিমরা এই অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্যিক পথকে নিরাপদ করেছিল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারসাম্য স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু আজকে মার্কিন-বৃটিশ-ফ্রান্স এর প্রভাবে সোমালিয়া এবং ইয়েমেনের মুসলিমরা জলদস্যুতে পরিণত হয়েছে। মুসলিমরা যেখানেই ভূমি জয় করেছিলো, সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে সম্রাজ্যবাদীদের মত লুটপাট করেনি বরং ন্যায় ও ইনসাফের শাসন কায়েম করেছিলো যার ফলে দলে দলে মানুষ মুসলিম হয়েছিল এবং সেখানকার সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশ যার উৎকৃষ্ট উদাহরন যেখানে বৃটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে উপনিবেশ গড়ার পর ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। প্রথম শতাব্দীর মুসলিমরা যেভাবে সমুদ্রপথে দূরবর্তী দেশগুলোতে ইসলামী দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিল এবং জিহাদের মাধ্যমে পশ্চিমে স্পেন জয় করেছিল, তাদের উদাহরণগুলি আজ আমাদের জন্য একটি মাপকাঠি যে আমাদেরও উচিত সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে দাওয়াহ ও জিহাদের মাধ্যমে ইসলামকে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া এবং এটি কেবলমাত্র খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেই সম্ভব হতে পারে। আসন্ন খিলাফত রাষ্ট্র সোমালিয়া, ইয়েমেনসহ সমস্ত মুসলিম ভূমিকে ইসলামের ছায়াতলে একত্রিত করবে।

রাসুল (সা) বলেন,

একটি গাযওয়াহ (সামুদ্রিক অভিযান) ভূমিতে দশটি গাজাওয়াতের (যুদ্ধের অভিযান) চেয়ে উত্তম। আর যে ব্যক্তি সমুদ্রকে অনুমতি দিল, সে যেন সমস্ত উপত্যকাকে অনুমতি দিল। । (আল-হাকিম নং ২৬৩৪ এবং আল-মুজাম আল-কবীরে আল-তাবরানি)

সমুদ্রকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সকল মানুষের জন্য সর্বজনীন সম্পত্তি ঘোষণা করেছেন, তাই খিলাফত রাষ্ট্র কাউকে এর থেকে উপকৃত হতে বাধা দেবে না।  এমনকি মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত রাষ্ট্রের দরিদ্র জেলেদেরকেও সমুদ্র থেকে রিজিক পেতে বাধা দেওয়া হবে না। তবে তারা পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাসের মতো খনিজ সম্পদ উত্তরণ করতে পারবে না।

“আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন এর প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা চিনো না কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। ।” [সূরা আল-আনফাল:  ৬০]।

অতএব, খিলাফতের নৌ-নীতি এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে মুসলমানদেরকে পূর্ণ শক্তি অর্জনের জন্য একটি সাধারণ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  এ জন্য আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, ড্রোন, সাবমেরিন ও বিমানবাহী রণতরী প্রস্তুত করতে হবে যাতে করে স্থলে ইসলামের আধিপত্য যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেভাবে সমুদ্রে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply