বর্তমানে রাজনীতি একটা অতীব অপছন্দের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। হানাহানি , লুটপাট আর দোষাদোষীর এ রাজনীতিতে মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। এই সেকুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা ৫ বছর পর পর ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করি যেন তারা আমাদের হয়ে সংসদে কথা বলে, এলাকার উন্নয়ন হয়, আমরা একটু শান্তি, স্বস্তিতে, সন্তান-সন্তুতি নিয়ে নিরাপদে ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারি। অথচ রাজনীতির প্রকৃত চর্চা যেটা দেখা যায় তা হলো, জনগণকে এই দিব সেই দিব নামক এক গাল মিথ্যা কথা বলে ক্ষমতায় যাওয়া, আর তারপর ব্যক্তিবিশেষ বা বিশেষ গোষ্ঠী এমনকি বিদেশি শক্তির হাতে জিম্মি করে যেকোনো মুল্যে সেখানে বসে থাকা। এর যেন কোন ব্যাতিক্রম নেই। এখানে সরকারি দলের মূল কাজ – যখন যে থাকে থাকে – তা হল বিরোধী দল ও মত কে দমন করা। এই উদ্দেশ্য হাসিলে তারা রাষ্ট্রের সকল শক্তি যেমন পুলিশ, র্যাব, বিচার বিভাগসহ সকল প্রশাসনিক কাঠামো, এমনকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত ব্যবহারে দ্বিধা করে না।
এই অবস্থায় রাজনীতি ঘৃণা করা, নিজে দূরে থাকা, পরবর্তী প্রজন্মকে দূরে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করা স্বাভাবিক। তাই আমরা অনেক জায়গায় বিশেষ করে মসজিদে লেখা দেখি “এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ”। তাই আমরা দেখি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আহ্বান এবং তা বন্ধের জন্য রীতিমতো আন্দোলন।
কিন্তু আমরা ছাড়তে চাইলেও কি রাজনীতি আমাদের ছাড়ে? বেঁচে থাকতে হলে আমাদের সমাজবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রে বাস করতে হয়, রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মানতে হয়। রাষ্ট্র একটি ব্যবস্থার অধীনে এইসব নিয়ম কানুন বানায় যা আমাদের প্রতিটি নাগরিকের জীবনকে প্রভাবিত করে, তা আমরা রাজনীতি পছন্দ করি বা না করি। যেমন: ভারতকে ঘৃণা করলেও রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে ভারতের কর্তৃত্বর কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হতে হয়, রাজনীতি করি বা না করি, ভারতের বাঁধ ছাড়া পানি সবার বাড়ি তলিয়ে দেয়। রাজনীতি না করলেও প্রতিমাসে গ্যাসের বিল দেয়ার পরও সিলিন্ডার কিনতে টাকা গুনতে হয় হয়, মাসে মাসে স্কুলে বেতন দিয়ে শিশুসন্তানকে LGBTQ বা সম্মতি থাকলে কিভাবে নিরাপদে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায় তা শিখতে পাঠাতে হয়। চোখ বন্ধ করলে তো আর প্রলয় বন্ধ হয় না। তাছাড়া আমাদের রাজনীতি বিমুখতা কিন্তু অযোগ্য ব্যক্তিদের আমাদের নিয়ে যা খুশি তাই করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। রাজনীতি একদল অর্বাচীনের হাতে বন্দি হয়ে গেছে।
তাই আমাদের রাজনীতি বিমুখ নয় বরং রাজনীতি সচেতন জাতি হিসেবে তৈরি হতে হবে। তাহলে আমরা বুঝতে পারব রাজনীতি সমস্যা নয়, বরং সেকুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতি সমস্যা যার একমাত্র সমাধান ইসলামের রাজনীতি।
ইসলামে রাজনীতি কী, কিভাবে করতে হবে তা আল্লাহ তায়ালা পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন আর রাসূল (সা) করে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। আল্লাহভীতি, দায়িত্বশীলতা আর জবাবদিহিতা যে রাজনীতির মূল চিন্তা। আর অন্যদিকে প্রচলিত সেকুলার রাজনীতি আমাদের মত ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ লোভী মানুষের মাথা থেকে এসেছে, যা তাকে “যা খুশি তা করার সার্বভৌম ক্ষমতা” দিয়ে রেখেছে। দিয়েছে নিজের পক্ষে আইন বানানোর দায়হীন-সীমাহীন স্বাধীনতা।
প্রচলিত সেকুলার রাজনীতির নোংরা practice এর কারণে ইসলাম আর রাজনীতির কথা আসলে আমাদের মাথায় click করে – ইসলামের মত পবিত্র জিনিসের সাথে রাজনীতির মত নোংরা জিনিস থাকতে পারে না।
তাছাড়া কাফেরদের continuous effort আর সেকুলার রাষ্ট্রে থাকার কারণে আমাদের শিখতে হয়েছে ইসলাম একটা ধর্ম আর এতে কার্যকরী কোন পলিটিক্যাল সিস্টেম নাই। আমি সংক্ষেপে আপনাদের সামনে ইসলামের রাজনীতির চর্চা উপস্থাপন করার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।
আমরা জানি ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে। (সূরা মায়িদা: ৩)
ইসলাম একটি দীন। অর্থাৎ জীবন পরিচালনার সবকিছুই এতে আছে।
نَزَّلۡنَا عَلَیۡكَ الۡكِتٰبَ تِبۡیَانًا لِّكُلِّ شَیۡءٍ
আমি তোমার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেকটি বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা। (সূরা নাহল: ৮৯)
জীবনের ছোট বড় সব সমস্যার সমাধান যেখানে আছে, রাজনীতির মতো vast একটি বিষয় যা জীবনের সাথে এভাবে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে তা ইসলাম থেকে বাদ যায় কিভাবে?
তাছাড়া আমরা জানি ইসলাম সগৌরবে হাজার বছরের উপরে দুনিয়ার শাসন করেছে, ইসলামের পলিটিক্স ছাড়া পৃথিবীর শাসন করা সম্ভব ছিল কি ?
ইসলামে রাজনীতি অবশ্যই আছে তবে তার পেছনের চিন্তা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ইসলামে যে আরবি শব্দটি ব্যবহার করে পলিটিক্স বোঝানো হয় সেটি হলো সিয়াসা। যা এসেছে মুল শব্দ সা-সা ইয়া সুসু থেকে। শব্দটির অর্থই হলো “উম্মাহর দেখাশোনা করা”। আগে এই বৃহৎ ও মহান কাজ নবী-রাসূলগণের উপর অর্পিত হত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের উম্মতদের শাসন করতেন। যখন কোন একজন নবী মারা যেতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিসিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলীফাহ্ হবে। সাহাবগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ করছেন? তিনি বললেন, তোমরা একের পর এক করে তাদের বায়’আতের হক আদায় করবে। তোমাদের উপর তাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করবে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে যেসবের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল। [সহিহ বুখারী-হাদীস নং-৩৪৫৫;সহীহ মুসলিম-হাদিস নং ৪৭৫০]
ইতিহাসে আমরা দেখি পরবর্তীতে এই দায়িত্বটি খলীফার মাধ্যমে খিলাফতে ব্যবস্থায় পালিত হত।
Secular democratic system এ রাজনীতির করার ধরণটা হলো এইরকম – রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দল ক্ষমতায় আরোহণ করে দেশ শাসন করার সুযোগ হাতিয়ে বলে – “জনকল্যাণ করবে theoretically” আর practically ছলে বলে কৌশলে নিজেদের আখের গোছাবে। বিনিময়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখা, এমনকি দেশও যদি বিক্রি করতে হয়। ইসলামের রাজনীতিতে “ক্ষমতায় যেতেই হবে” এইকেন্দ্রিক না। কারণ খলীফা একবার নির্বাচিত হওয়ার পর শরীয়াহ নির্ধারিত কারণ, যেমন মারা যাওয়া, পাগল বা deadly diseases এ আক্রান্ত হওয়া বা শত্রু দারা অপহৃত হওয়া যেক্ষেত্রে মুক্তির আশা নাই ইত্যাদি না হলে তিনি যতদিন শরীয়াহ দিয়ে আমাদের পরিচালনা করবে ততদিন দায়িত্বে থাকবেন। কোন মেয়াদ নাই। এটাই তার সাথে আমাদের চুক্তি।
জনগণ কর্তৃক নিযুক্ত খলীফার মৃত্যু হলে পুনরায় নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরবর্তীকালে নির্বাচন এবং জনগণের বায়াত এর মাধ্যমে পরবর্তী খলীফা নির্বাচিত হবে। সে যেকোনো নাগরিক নিজেকে শরীয়াহ নির্ধারিত শর্ত অনুযায়ী যোগ্য মনে করলে নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে পারে। তাছাড়া মাজলিশে উম্মাহতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের প্রয়োজন ও দাবী খলীফাকে জানিয়ে দিবে, তাকে প্রয়োজনীয় উপদেশও দিবে। শরীয়াহর অধীনে থাকা আমাদের জন্য ফরয। আমাদের পক্ষ থেকে খলীফাকে আমরা শরীয়াহ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করব, আর এ কারণে আমরা তাকে দেখে রাখব যে তিনি এ কাজ যথাযথ ভাবে আদায় করছে। আবু বাকর (রা.) তার খলীফা নিযুক্তির পর প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, “আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি আমাকে সহায়তা করবেন। যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, আমাকে সতর্ক করে দেবেন। “(বিদায়াহ ওয়ান – নিহায়াহ ৬/৩০৫,৩০৬)
খিলাফাতে প্রত্যেক ব্যক্তি বা প্রতিটি ইসলামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব হিসাবে তা পালন করবে। এভাবে শাসক সিয়াসাহ বা জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করবে এবং উম্মাহ তাকে দেখে রাখবে। এভাবে শাসক থেকে জনগন, প্রত্যেকে আমরা রাজনীতির এই মহান কাজে অংশগ্রহণ করব । এখন ইতিহাসে দেখি কিভাবে এই রাজনীতির চর্চা অর্থাৎ সকলের অংশগ্রহণে সিয়াসাহ বা জনগণের দেখাশনার দেখার কাজটি হয়েছে।
প্রতিটি জনগণের basic need fulfil করা খিলাফাহ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। খলিফা হযরত ওমর (রা) কে কাবার গিলাব সজ্জিত করার কথা বললে উনি বলেন, কাবার গিলাব সজ্জিত করার চাইতে উম্মার ক্ষুধার্ত পেট গুলি ভরা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এটা শরীয়াহ প্রয়োগ করে, তার পুরো প্রশাসনকে খাটিয়ে এটি বাস্তবে পরিণত করেছেন। তার শাসনামলে যখন খিলাফাহর বয়স মাত্র ১০ বছর, তখন শিশু জন্ম নেয়া মাত্র আর ব্যক্তি বৃদ্ধ হওয়া মাত্র ভাতা পেত। আর সাধারণ মানুষের ভাবনা এমন ছিল না যে- “যাক! আমরা ভাল লোক নিয়োগ দিয়েছি, দেশ – জনগণ সব ভাবনা তার উপর, আমরা কামাই রোজগার করি, খাই দাই ঘুরে বেড়াই, সুবিধা মত দান সাদাকা আর নফল ইবাদতে ডুবে থাকি,” না! বরং অতীতে হাজার বছরের খিলাফতের ইতিহাসে জনগণ খুব ভালভাবে শাসককে দেখে রেখেছে। আমাদের অতি পরিচিত একটা ঘটনা। একবার খলিফা ওমর (রা) এর কাপড় এক টুকরার জায়গায় দুই টুকরা পাওয়ায়, ভরা মজলিশে তার কাছে জবাব চাওয়া হয়। খলিফা ওমর (রা) “আমি এত করি তাও দেখেন না, দিব সব কাপড়ের মিল বন্ধ করে “– এই হুমকি তিনি দেননি। ওমর (রা)’র বিব্রতকর ভাব দেখে তার ছেলে তার হয়ে ব্যাখ্যা দেন যে তিনি তার পিতাকে নিজের কাপড়টি দিয়েছেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন যেন তাকে খলীফা হিসেবে কঠিন জবাবদিহিতায় রাখা হয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে তিনি সবার সামনে এসে পিছনে ঘুরে থাকতেন এবং বলতেন আমার বিরুদ্ধে কার অভিযোগ থাকলে নির্ভয়ে বল, আমি তার চেহারাও দেখব না।
উম্মাহকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন রাখাও রাষ্ট্রের কাজ। প্রখ্যাত ইসলামি scholar রাজনিতিবিদ শেখ তাকিউদ্দিন আন নাবহানি (রহ.) বলেছেন, ” চিন্তা কোন জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ”। তাই রাষ্ট্র উম্মাহ চিন্তা শানিত করতে সম্ভাব্য সকল কিছু করবে। উম্মাহ যেন রাজনৈতিক ভাবে সচেতন থাকে তারজন্য উমার (রা) আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ঘুরে ঘুরে খোঁজ রাখতেন সাধারন মানুষের আলাপ আলোচনায় কি প্রাধান্য পায়? তারা কি জীবনের ছোট ছোট বিষয়, খাওয়া-দাওয়া, জীবিকা নিয়েই কেবল ব্যস্ত হয়ে পরছে নাকি জিহাদ, রাষ্ট্র, নীতিমালা এসব দিকেও খেয়াল রাখছে। একজন সাধারন নারী যখন মজলিসে তার দেন-মোহর নিয়ে ঘোষিত নীতির বিরোধিতা করেন, তখন তার শরীয়াহ গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকায় তিনি আনন্দিত হয়ে যান এবং বলেন একজন নারীও খলীফা উমর থেকে বেশি জানেন, আলহামদুলিল্লাহ। এক জনাকীর্ণ ভাষণে খলিফা উমর (রা) সকলে তার কথায় সায় দিচ্ছে দেখে জন্য চিন্তিত হয়ে পরেন এবং জিজ্ঞেস করেন,”আমি ভুল করলে তোমরা কী করবে? উম্মাহর থেকে একজন যুবক জবাব দিয়েছিল “আপনাকে তীরের মত সোজা করে দেবো।” হযরত উমর (রা) খুশি হয়েছিলেন এরকম সচেতন উম্মাহ পেয়ে। আর আজকে জাতিকে অন্ধকারে রাখা রাষ্ট্রের agenda। ভারতের সাথে কী চুক্তি হয়েছে আমরা জানি না। আমেরিকা, আদানি এদের সাথে চুক্তি হবার বহু পড়ে আমরা জানতে পারি আর এর ঘানি টানি। রাষ্ট্র প্রথমতঃ পরিকল্পিত শিক্ষানীতির মাধ্যমে আমাদের চিন্তাহীন, অনুকরণ প্রিয়, দাস মনোবৃত্তির জেনারেশন হিসেবে গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয়তঃ আমাদের জন্য ফান ফুর্তিকে সহজ আর জীবিকা উপার্জন কে চরম কঠিন করে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে একরকম বাধ্য করে রেখেছে ।
যাই হোক, তার মৃত্যুর পর তিন দিনের মাথায় পরবর্তী খলীফা নির্বাচিত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন আমিরের তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত ছয়জন খলীফা প্রার্থীদের মধ্য থেকে জনগণের বায়াতের মাধ্যমে । এভাবে জনগণ খলিফা নির্বাচন, জবাবাদিহিতা, উপদেশসহ প্রতিটি কাজে অংশগ্রহনের মাধ্যমে রাজনীতিতে শরিক হয়।
শাসক পরিবর্তনের কারণ ও উপায় সম্পর্কেও ইসলামের রাজনীতিতে দিকনির্দেশনা আছে।
শাসক ভাল বা খারাপ হতে পারে। এই ব্যবস্থা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছ থেকে আসা ত্রুটিমুক্ত একটি ব্যবস্থা, কিন্তু এই ব্যবস্থা চালাবে মানুষ যার ভুল হয়। তাহলে কী করতে হবে? প্রথমে আল্লাহ খারাপ শাসক define করেছেন। সেই definition টাও আমাদের হাতে ছাড়েননি। এমন না, আমার ব্যবসাকে সুযোগ কম দিলে বা আমার দলকে ক্ষমতায় বসাতে আমরা শাসক বিরোধী কাজে লিপ্ত হতে পারব, জ্বালাও – পোড়াও আন্দোলন শুরু করতে পারব । হাদীসে আছে,
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ডাকলেন এবং আমরা তাঁকে বাইয়াত দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের থেকে যে বিষয়ে বাইআত নিলেন তা হলো, আমরা আমাদের পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় বিষয়ে, সুখে-দুঃখে এবং আমাদের উপর যদি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া হয় তথাপিও (আমীরের কথা) শুনব ও আনুগত্য করব এবং আমরা শাসকদের সাথে শাসনকার্য নিয়ে বিবাদে জড়াব না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন তবে হ্যাঁ, যদি তোমরা কুফরে বাওয়াহ তথা সুস্পষ্ট কোন কুফর দেখতে পাও, যার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে- তাহলে ভিন্ন কথা।” – সহীহ মুসলিম: ১৭০৯
সুস্পষ্ট কুফর কোনটা?
সুরা মায়িদা র ৪৪,৪৫ ৪৭ আল্লাহ সেটা ও clear করেছেন।
وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡكُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الۡكٰفِرُوۡنَ
আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির। [সূরা মায়িদা ৫: ৪৪]
مَنۡ لَّمۡ یَحۡكُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার ফায়সালা করে না তারাই যালিম। [সূরা মায়িদা ৫: ৪৫]
وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡكُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ
আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক। [সূরা মায়িদা ৫: ৪৭]
এমন হলে কী করতে হবে? তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আমরা জানি শাসকদের কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা, তারা শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে এমনকি দলবদ্ধভাবেও জবাব চাওয়া কঠিন। তাই আল্লাহ রাসূল (সা) এই কাজকে চূড়ান্ত সাহসিকতার কাজ বলেছেন, এই কাজে সর্বোচ্চ সম্মানের কথা বলেছেন। জাবির (রা.) বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন, ‘শহীদদের সর্দার হচ্ছেন হামযা ইবনু আবদুল মুত্তালিব এবং সেই ব্যক্তিও শহীদদের সর্দার যে অত্যাচারী নেতার নিকটে গেল এবং তাকে ভাল কাজের আদেশ করল এবং মন্দ কাজের নিষেধ করল। তখন সে তাকে হত্যা করল’ (তিরমিযী, তারগীব হা/৩৩০২), (ত্বাবারানীর আওসাত্ব ৪০৭৯,হাকেম ৪৮৮৪,স: তারগীব ২৩০৮)
আমরা ইমাম ইবনে হাম্বল (রহ), আবু হানিফা (রহ)-কে এ কাজ করতে যেয়ে কারাবরণ ও নির্যাতিত হতে দেখেছি। ক্ষমতায় যেতে নয়, বরং ফরজ দায়িত্ব থেকে তারা সেটা করেছেন।
ইসলামের ভিত্তিতে রাজনীতি করা হলো সবচাইতে উচ্চ মানের একটি কাজ, উম্মাহর দেখাশোনা করা। নবী-রাসূলগণ এটা আগে করে গেছেন, এখন আমরা করছি। আর এই উঁচু মানের কাজটি আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড। আমাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,
كُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ
তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভুত করা হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ কর ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চল। (সুরা আলে ইমরান : ১১০)
সুতরাং রাজনীতি করা, ইসলাম যেভাবে করতে বলেছে সেভাবে করা – প্রত্যেকের উপর ফরজ এবং সবচাইতে গৌরবের কাজ।
আর যদি আমরা তা না করি- রাসুল (সা) বলেন, ‘‘সে সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমরা অবশ্যই একে অপরকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। তা না হলে আল্লাহ্ তা‘আলা অচিরেই তোমাদের উপর তাঁর পক্ষ থেকে বিশেষ শাস্তি পাঠাবেন। তখন তোমরা তাঁকে ডাকবে; অথচ তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবেন না’’। (তিরমিযী ২১৬৯)
আজ ইসলামের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ইসলামের ভিত্তিতে সৎকাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ থেকে বিরত থেকে আমরা নিজেদের সেই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি যেখানে আমরা দুহাত তুলে আল্লাহকে ডাকছি, কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সাড়া দিচ্ছেন না। ফিলিস্থিনে হত্যা বন্ধ হচ্ছে না, ভারত তার আগ্রাসন বন্ধ করে না, আমরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। রোহিঙ্গা ভাই বোনেরা সমদ্রে, জঙ্গলে পশুদের মত মারা যাচ্ছে, আমরা কিছুই থামাতে পারছি না।
এবার আমরা যদি একটু আমাদের নিজেদের দিকে তাকাই। আমাদের ব্যস্ত রাখা হয়েছে আর আমরাও এই ফাঁদে পড়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আছি। আমরা ব্যস্ত আছি আমাদের ঘর-সংসার, চাকরি-বাকরি, পড়াশোনা আর ব্যক্তিগত ইবাদতে আর পরিস্থিতিকে গালি দিয়ে দুইটা face book post দিয়ে দায়িত্ব সারছি! রাজনীতি বিমুখ হয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। আজকে আমাদের এই তরুণ ছেলেগুলো যদি শুধু মাত্র স্বার্থপরের মত নিজেদের কথাই ভাবত, আমরা কি এই যালিম শাসক থেকে মুক্তি পেতাম? পেতাম না।
এখন যদি আমরা ভাবি, একই ভাবে জীবন চালিয়ে যাব আর অন্তর্বর্তীকালীন একটা সরকার তারা আমাদের হয়ে এই ব্যর্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবে, আর যদি তারা কিছু problem করে তাহলে আবার টেনে নামাই দিবো। এভাবে বারবার error and trial এর চক্করে মুসলমান জাতি আর কত পড়বে? এই পুরা প্রক্রিয়াটা আসছে সেকুলার চিন্তা থেকে। মানুষের মাথা থেকে ভুলে ভরা সমাধান আসবে, কয়দিন তার উপরে আমল করব, ভুল ধরা পড়বে, আবার নতুন সমাধান বের করার গোল বৈঠক করবো। এবার আমরা থামি।
এই process যেহেতু ইসলাম থেকে আসে নাই এটা দিয়ে আমাদের কোন একটা সমস্যার সমাধান হয় নাই, কোনদিন হবেও না। তাই সেকুলার পলিটিক্সের চেহারা দেখে রাজনীতিকে ঘৃণা করলে, এড়িয়ে চললে আমাদের বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না। পরিবর্তন শুধুমাত্র আল্লাহর বলে দেওয়ার রাজনীতির মাধ্যমেই আনা সম্ভব। কারণ ইসলামি রাজনীতি যেমন theoretically perfect তেমনি এই মুহুর্তে practically একমাত্র option। তাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থেকে দেশ রাষ্ট্র সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকলে, আমাদের জন্য রাসূল (সা) ভয়ানক warning রেখে গেছেন –
“ঐ সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অতি সত্বর আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ) কর। অন্যথায় অচিরেই তোমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আরোপিত হবে। অতঃপর তোমরা তাকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবেনা।” (তিরমিযী)
আমরা চাই হানাহানি সেকুলার দলীয় রাজনীতি বন্ধ হয়ে সত্যিকারের রাজনীতি – ইসলামী রাজনীতি চালু হোক। খিলাফত ফিরে আসা না পর্যন্ত এই রাজনীতি সামগ্রিক ভাবে শুরু করা যাচ্ছে না। তাই আমদের সবার উচিত রাসুল (সা) পথ অনুসরণ করে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা শুরু করা, খিলাফাহ ফিরিয়ে আনার রাজনীতি শুরু করা। রাসুল (সা) সে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খিলাফাহ ফিরিয়ে এনেছেন সেই রাজনীতিতে শামিল হওয়া। শত শত মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই সুযোগ আমরা যেন কাফেরদের পক্ষে এবং ব্যর্থ গণতন্ত্র ঘষামাজার পিছনে ব্যয় না করে ফেলি। পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই, ইসলামের রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের সচেতনতাই শুধুমাত্র এই অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ের অর্জিত এই মুভমেন্ট হাইজ্যাক হতে দেবে না। ইনশাআল্লাহ আমরা এই আন্দোলনকে খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবো। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমিন।