ইসলামি জ্ঞান ও চিন্তার প্রক্রিয়া

কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিছক ইসলামি জ্ঞান নাকি সঠিক চিন্তার প্রক্রিয়া? নাকি এ দু’টো পরিপূরক? জ্ঞান মানে হল প্রয়োজনের নিরীখে যা জানি না তা জানা এবং যা চিনি না তা চেনা। জ্ঞান অর্জন করলে মানুষ অজ্ঞানতা বা মূর্খতা থেকে বের হয়ে আসে। ইসলামে জ্ঞান অর্জন করার বিষয়টিকে ফরজ করা হয়েছে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

পড়, তোমার প্রভূর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন……তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না….।’
(সূরা আলাক)

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরয।’

তবে চিন্তার সঠিক প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে কেবলমাত্র নিছক জ্ঞান ব্যক্তি বা জাতির পূর্ণজাগরণ সুনিশ্চিত করতে পারে না। যদি ইসলামের ভিত্তিতে মুসলিম জাতির পূর্ণজাগরণ সুনিশ্চিত করতে হয় তাহলে এর সন্তানদেরকে সঠিক চিন্তার প্রক্রিয়াও শিক্ষা দিতে হবে। যদিও এই চিন্তার প্রক্রিয়া এক ধরনের বিশেষ জ্ঞান।

ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদীনদের পর আসে উমাইয়াদের শাসন এবং তারপর আসে আব্বাসিয় শাসন। আব্বাসিয় শাসনামলে গ্রীক চিন্তা প্রক্রিয়া (logical way of thinking) দ্বারা মুসলিম আলেমগন প্রভাবিত হন এবং ক্বাদা এর মত আক্বীদার বিষয় থেকে শুরু করে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়সমূহ যুক্তি দ্বারা ব্যখ্যা করার চেষ্টা করেন। আলেমগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যান। মুতাজিলা, জাবারিয়্যাহ এবং আহলুস সুন্নাহদের উদ্ভব হয়। অথচ ক্বাদা এর মত গুরুত্বপূর্ণ আক্বীদার বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উপলদ্ধি করা উচিত ছিল। তদ্রুপ আক্বীদার অন্যান্য মৌলিক বিষয় যেমন: আল্লাহ’র অস্তিত্বে বিশ্বাস, মুহাম্মদ (সা) আল্লাহ’র নবী এবং কুরআন আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এসেছে-এগুলো বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই (rational way of thinking) বুঝতে হবে। তবেই সঠিকভাবে আক্বীদা উপলদ্ধি করা যাবে। কিন্তু এখানে অন্য কোন চিন্তা প্রক্রিয়া, যেমন যৌক্তিক (logical way of thinking) বা বৈজ্ঞানিক (scientific way of thinking) প্রক্রিয়া কাজ করবে না। যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রক্রিয়ার স্ব-স্ব ক্ষেত্র রয়েছে। সেগুলোকে সেখানেই ব্যবহার করতে হবে। অন্যত্র ব্যবহার করলে একজন মুসলিম ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। যদিও এখনও অনেক আলেম এবং ইসলামি দলসমূহ যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত এবং ইসলামকে সেভাবে ব্যাখ্যা করা বা উপলদ্ধি করার চেষ্টা করেন। জীবনে প্রয়োগের জন্য ইসলামের হুকুমসমূহ বুঝা বা বের করে নিয়ে আসার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আইনী প্রক্রিয়া (legislative process) রয়েছে। যেখানে যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রক্রিয়ার কোন স্থান নেই। হয়ত আলোচিত বিষয়ের মানাত বা বাস্তবতা বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। আবার এটাও বুঝতে হবে আইন বা হুকুম জানার বা প্রণয়ন করার জন্য তিনটি ব্যবস্থাতে (পুজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ইসলাম) তিনটি ভিন্ন প্রক্রিয়া রয়েছে। পুঁজিবাদে আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল বাস্তবতা। কিন্তু ইসলামে কখনওই বাস্তবতা থেকে হুকুম আসে না। কিন্তু পশ্চিমা ধ্যান ধারণার অনুপ্রবেশ ও অজ্ঞানতার দরুণ কোন কোন মুসলিম আলেম বাস্তবতাকে ইসলামি হুকুমের উৎস হিসেবে এখন গ্রহণ করছেন। ইজতিহাদি প্রক্রিয়া শতকের পর শতক বন্ধ থাকার কারণে আলেমগণের জন্য মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলাম প্রয়োগ করার কথা চিন্তা করা দূরুহ হয়ে পড়ছে যদিও ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হিসেবে আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এসেছে এবং এটি কিয়ামতের আগ পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

বর্তমানে ইসলামি বিদ্যাপীঠসমূহ থেকে সাধারণভাবে জ্ঞান আহরণ করা হয় নেহায়েত আলেম বা ফকীহ হওয়ার জন্য। অর্থাৎ এখানে Academic Approach দেখা যায়। জ্ঞান অর্জন করে আলেম বা ফকীহ হওয়া দোষণীয় নয় যদি না তা হয়ে থাকে জীবনে প্রয়োগের জন্য। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে গ্রীক ও ইসলামি চিন্তা প্রক্রিয়ায় পার্থক্য রয়েছে। ইসলামি জ্ঞান আহরণের লক্ষ্যই হল জীবনে প্রয়োগ করা। এটি কোন প্রয়োগশূন্য পুথিগত বিদ্যা নয়। আজকের পৃথিবীতে রয়েছে শত শত ইসলামি বিদ্যাপীঠ। যেগুলো থেকে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত স্নাতক বের হচ্ছে। কিন্তু এই শত শত বিদ্যাপীঠ এবং লক্ষ লক্ষ স্নাতক সমাজ এবং রাষ্ট্রে যে ধরনের ইসলামি প্রভাব তৈরি করার কথা ছিল তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর একটাই কারণ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে Academic Approach এর উপস্থিতি। প্রতি বছর ভারতের দারুল উলুম দেওবন্ধ, আরবের মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় মাপের পুথিগত ইসলামি পন্ডিত বা আলেম বের হয়ে আসছেন। কিন্ত সঠিক চিন্তার পদ্ধতি তাদের মধ্যে না থাকার কারণে সালফে সালেহীন বা পূর্ববর্তী হক্বপন্থী আলেমদের মত মুসলিম সমাজ বা রাষ্ট্রে এসব আলেম নবীগনের উত্তরসূরীর (ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া) হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। বরং কেউ কেউ ইসলাম ও মুসলিমদের দুশমন কুফরদের কাজকে সচেতনভাবে অথবা অবচেতনভাবে সমর্থন করছেন। তাদের কেউ কেউ মুসলিম বিশ্বের জালিম ও উপনিবেশবাদীদের তাবেদার শাসকদের গর্হিত কাজগুলোকে ইসলাম দ্বারা জায়েয করে ফতওয়া দিচ্ছেন। যেমন: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য বিন বাজ (প্রাক্তন গ্র্যান্ড মুফতি) সৌদি আরবের পবিত্র ভূমিতে মার্কিন সেনা উপস্থিতি এবং মুসলিম উম্মাহ’র হৃদয়ের মধ্যে বিষফোড়ার মত বসে থাকা ইসরাইলের প্রতি সৌদি শাসকদের নগ্ন সমর্থনকে বৈধতা দিয়েছে। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী মিশরের এক সময়ের গ্রান্ড মুফতি তানতাওয়ির মৃত্যুতে তার প্রশংসা করে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রধান দুশমন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট শোক বার্তা পাঠিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ আবার নিজেদের সালাফি (পূর্ববর্তী হক্বপন্থী আলেমদের অনুসারী) বলে পরিচয় দেন। অথচ পূর্ববর্তী হক্বপন্থী আলেমদের অনেকে (ইমাম আবু হানিফা রহ:, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ:, ইমাম তাইমিয়্যাহ রহ:) কোন একটি ইস্যুতে হক্বের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে তৎকালীণ শাসকদের দ্বারা কারাবরণ করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শাসকদের অন্যায় আনুকূল্য নিতে চাননি। তবে আশার কথা হচ্ছে সব আলেম নিজেদের ভুল চিন্তা পদ্ধতির কাছে বিকিয়ে দেননি। কেউ কেউ নিকট অতীতে সত্যিকার অর্থেই পূর্ববর্তী হক্বপন্থী আলেমদের অনুসরণ করে ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার মত জুলুম ও জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা বা ইস্তিকামাত দেখিয়েছেন, তাদের জ্ঞানকে যথাযথভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগ করেছেন। যেমন: ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী আন্দোলন ও তুরষ্কের খিলাফতের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় শায়খুল ইসলাম মাওলানা মাহমুদুল হাসান কারাবরণ করেছিলেন, মিশরে সাইয়্যেদ কুতুব রহ: ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জালিম শাসক কতৃক শাহাদাত বরণ করেন, মধ্যপ্রাচ্যে শায়খ তাকিউদ্দীন আন নাবাহানি রহ: খিলাফতের পক্ষে এবং উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার কারণে তাবেদার মুসলিম শাসকদের দ্বারা চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) এর বিরোধিতাকারী মক্কার কাফের শাসকশ্রেণী জানত যে, তিনি (সা) একজন সত্য নবী। কিন্তু ভুল চিন্তার পদ্ধতি (pragmatism or superiority complex) বা দৃষ্টিভঙ্গি (Mindset) তাদের হিদায়াতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মদীনার ইহুদী আলেমদের কাছে পূর্ববর্তী নবীদের উপর নাযিলকৃত কিতাবের জ্ঞান ছিল- যেগুলো মুহাম্মদ (সা) এর নবুয়্যতকে সত্যায়িত করে। কিন্তু ভুল চিন্তা পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি (Mindset) এর কারণে এই জ্ঞান তাদের কোন কাজে আসেনি। অপরদিকে সঠিক চিন্তা পদ্ধতির কারণে আবু বকর (রা) মেরাজের ঘটনা শোনামাত্র এতে বিশ্বাস স্থাপন করে সিদ্দিক উপাধি লাভ করেন।

সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম উম্মাহকে সঠিক চিন্তা পদ্ধতিসহ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তবেই এটি ফলদায়ক হবে। তবেই জ্ঞান অর্জন মুসলিম উম্মাহ’র জন্য দুনিয়া এবং আখেরাতে কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কেউ এক পা ও এগোতে পারবে না…….যা জেনেছ সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছ? (৫টির মধ্যে একটি প্রশ্ন)…….’’ ।

অন্যথায় এ জ্ঞান দুনিয়া এবং আখেরাতে মুসলিমদের জন্য দায় হিসেবে দেখা দিবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সবাইকে সঠিক চিন্তা পদ্ধতিসহ ইসলামি জ্ঞান অর্জন করার তৌফিক দান করুক। আমীন। 

রাফীম আহমেদ

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply