অর্থনীতি (Economy) শব্দটি একটি পুরনো গ্রীক শব্দ হতে উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ হলো গৃহস্থালীর কাজের জন্য পরিকল্পনা করা যাতে এর কর্মক্ষম সদস্যগণ পণ্য উৎপাদন ও দায়িত্ব পালন করে, এবং এর সব সদস্যগণ তাদের অধীনে থাকা সবকিছু ভোগ করে। সময়ের আবর্তে লোকেরা গৃহের সংজ্ঞাকে রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত একটি সম্প্রদায় পর্যন্ত পরিব্যপ্ত করেছেন।
অর্থনীতি শব্দটি সঞ্চয় কিংবা সম্পদ বোঝানোর মতো ভাষাগত অর্থে প্রয়োগের অভিপ্রায়ে ব্যবহার করা হয়নি। বরং এখানে একে প্রায়োগিক অর্থে অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা একে নিশ্চিত করার মতো সম্পদের ব্যবস্থাপনার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়; অথবা সম্পদের বন্টন ব্যবস্থার অর্থে যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আলোচ্য বিষয়।
যদিও অর্থনৈতিক বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উভয়ই অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করে, তদুপরি এদের স্বকীয় অর্থ রয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পদের পরিমাণের উঠানামা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। সম্পদের পরিমাণের উঠানামা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধরণের উপরও কোন প্রভাব ফেলে না। সুতরাং অর্থনীতিকে একটি মাত্র বিষয় হিসেবে দেখা, এবং একে একটি প্রসঙ্গ হিসেবে আলোচনা করা একটি মারাত্বক ভুল। কেননা তা সমাধানের প্রয়োজন অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে ক্রটিপূর্ণ উপলদ্ধির দিকে ধাবিত করে কিংবা যে নিয়ামকসমূহ দেশের সম্পদ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে সেগুলোকে উপলদ্ধি করার ক্ষেত্রে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। কারণ, সম্পদ বৃদ্ধির দৃষ্টিকোন থেকে জনগণের বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা হলো এক ইস্যু, এবং সম্পদ বন্টনের দৃষ্টিকোন থেকে জনগণের বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ইস্যু। সুতরাং অর্থনৈতিক বস্তুর ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে এর বন্টন ব্যবস্থাপনার বিষয় থেকে আলাদা করে দেখতে হবে। প্রথমটি উপকরণের সাথে জড়িত এবং পরেরটি চিন্তার সাথে সম্পর্কিত। জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী (একটি আদর্শের বিশ্বাস) উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা চিন্তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আলোচিত হতে হবে এবং অর্থনৈতিক বিজ্ঞানকে অবশ্যই বিজ্ঞান হিসেবে আলোচনা করতে হবে যার সাথে জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গীর কোন সম্পর্ক নেই। তাই এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেননা অর্থনৈতিক সমস্যা মানবজাতির চাহিদা, এগুলো পূরণের উপকরণ এবং এই উপকরণসমূহের সদ্ব্যবহারকে ঘিরে আবর্তিত হয়। যেহেতু উপকরণসমূহ এ মহাবিশ্বে অস্তিত্বশীল, সেহেতু এদের উৎপাদন চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না, বরং মানুষের প্রয়োজনই তাকে এই উপকরণসমূহকে উৎপাদনের দিকে তাড়িত করে। তবে প্রকৃত সমস্যা বিদ্যমান মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝে, অর্থাৎ সমাজে, যা এসব উপকরণকে সদ্বব্যবহার করার ব্যাপারে জনগণকে সুযোগ দেয়া কিংবা নিয়ন্ত্রন আরোপ করার কারণে সৃষ্ট হয়। এসব উপকরণের উপর মানুষের মালিকানা সম্পর্কিত বিষয় হতে সৃষ্ট। এটাই হলো অর্থনৈতিক সমস্যার ভিত্তি যার অবশ্যই সমাধান প্রয়োজন। সুতরাং উপযোগের মালিকানা থেকে অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়, উপযোগ প্রদানকারী উপকরণের উৎপাদন থেকে নয়।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি
একটি বস্তু থেকে প্রাপ্ত উপযোগই মানুষের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে সে বস্তুর উপযোগিতাকে উপস্থাপন করে। উপযোগ দু’টি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। একটি হলো ঐ বিশেষ বস্তুর জন্য মানুষ কতটুকু তাগিদ অনুভব করে এবং দ্বিতীয়টি হলো বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান যোগ্যতা ও মানুষের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা যা বিশেষ কোন ব্যক্তির চাহিদার বিপরীত। এ উপযোগ আসতে পারে মানুষের প্রচেষ্টার মাধ্যমে, পণ্যের মাধ্যমে অথবা উভয়ের মাধ্যমে। মানবীয় প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে কায়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম যা সে সম্পদ সৃষ্টি অথবা সম্পত্তি থেকে উপযোগ লাভের জন্য বিনিয়োগ করে।
পণ্য শব্দটি দ্বারা সদ্বব্যবহারের জন্য ক্রয়, ইজারা বা ধার করার মাধ্যমে অধিকারে থাকা যে কোন বস্তুকে বুঝায়, হোক সেটা ভোগের মাধ্যমে, যেমন: কোন আপেল বা ব্যবহারের মাধ্যমে, যেমন: গাড়ি, অথবা ধার করা একটি মেশিনকে সদ্ব্যবহার করা বা একটি বাড়ীকে ইজারা নেয়া। সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে অর্থ, যেমন: সোনা বা রূপা, পণ্য যেমন: পোষাক পরিচ্ছদ ও খাদ্যদ্রব্য এবং স্থাবর সম্পত্তি, যেমন: বাড়ী বা কলকারখানা এবং মানুষের অধিকারে থাকা এরকম অনেক কিছু। যেহেতু সম্পত্তি নিজে থেকেই মানুষের প্রয়োজন মেটায় এবং মানুষের প্রচেষ্টা হলো সম্পত্তি অর্জন বা এর থেকে উপযোগ পাওয়ার মাধ্যম, সেহেতু সম্পদ হলো উপযোগ প্রাপ্তির ভিত্তি ও মানুষের শ্রম হলো সম্পত্তি অর্জনে সমর্থবান করে তুলার একটি উপায় মাত্র। সুতরাং প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অধিকার করার উদ্দেশ্যে সম্পত্তি লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। সুতরাং মানুষের প্রচেষ্টা এবং সম্পত্তি হলো প্রয়োজন মেটাবার উপকরণ। এগুলো হলো সম্পত্তি যা অর্জন করার জন্য মানুষ প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায়। সুতরাং সম্পদ বলতে সম্পত্তি এবং মানুষের প্রচেষ্টাকে একত্রে বুঝায়।
ব্যক্তির সম্পত্তি লাভ ঘটতে পারে অন্যের মাধ্যমে, যেমন: উপহার হিসেবে সম্পত্তি লাভ করা, অথবা প্রত্যক্ষভাবে, যেমন: কাঁচামালের মালিক হওয়া। পণ্য অর্জনের অপরিহার্যতা হতে পারে:
১. ভোগের জন্য, যেমন: একটি আপেল অধিকারে থাকা
২. সদ্বব্যবহার করা, যেমন: একটি বাড়ীর মালিক হওয়া
৩. সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত উপযোগের অধিকারী হওয়া, যেমন: একটি বাড়ী ইজারা করা
৪. অথবা মানুষের শ্রমলদ্ধ উপযোগের অধিকারী হওয়া, যেমন: একজন স্থপতির নকশা
সম্পদের মালিক হওয়ার ধরণ হলো- ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে, যেমন: সম্পত্তি ইজারা বা বিক্রয় করা এবং কর্মচারীদের বেতন, অথবা এটা ক্ষতিপূরণ নয়, হতে পারে সাহায্য, মঞ্জুরী, উপহার, উত্তরাধিকার অথবা ঋণ। তবে অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয় সম্পদের মালিকানা লাভের ক্ষেত্রে, কিন্তু সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নয়। অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয় মালিকানার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে, মালিকানার মন্দ বিন্যাস থেকে এবং লোকদের মাঝে সম্পদের অসম বন্টন থেকে। সমস্যা অন্য কোন বিষয় থেকে উদ্ভুত হয় না এবং এ বিষয়টির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তা তিনটি মূলনীতির সমন্বয়ে গঠিত:
১. মালিকানা
২. মালিকানার হস্তান্তর (Disposal) এবং
৩. লোকদের মাঝে সম্পদের বন্টন
অর্থনীতির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী
সম্পদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী এর সদ্ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর চেয়ে ভিন্নতর। যে উপকরণ উপযোগ (Benefit) উৎপাদন করে তার চেয়ে উপযোগের সত্ত্বাধিকারী হওয়ার বিষয়টিকে ভিন্নতর বিষয় হিসেবে ইসলাম বিবেচনা করে। সুতরাং সম্পত্তি এবং মানুষের শ্রম হলো সম্পদের উপাদান বা উপকরণ, এবং এই উপকরণসমূহ উপযোগ তৈরি করে। ইসলামের দৃষ্টিতে জীবনে এদের অস্তিত্ব ও উৎপাদন এদের ব্যবহার ও উপযোগের মালিকানা লাভ করার প্রশ্ন থেকে ভিন্নতর। সুতরাং কিছু সম্পদের সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে, উদাহরণস্বরূপ এটি কিছু পণ্য যথা: মদ এবং মৃত খাদ্যদ্রব্যকে নিষিদ্ধ করেছে। একইভাবে এটা মানুষের কিছু কাজ থেকে উপযোগ পাওয়াকে নিষিদ্ধ করেছে, যেমন: নাচ এবং বেশ্যাবৃত্তি। তাছাড়া ইসলাম হারাম খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা এবং হারাম কর্মকান্ড সম্পাদনের জন্য কাউকে নিয়োগ প্রদানকে নিষিদ্ধ করেছে। এটি হল সম্পত্তির সদ্ব্যবহার ও মানুষের শ্রমের ক্ষেত্রে। তবে সম্পত্তি ও মানুষের শ্রমের মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম একে নিয়ন্ত্রন করার জন্য অসংখ্য হুকুম দিয়েছে, যেমন: শিকারের হুকুম, ভূমি পুণরুদ্ধার, ইজারা, উৎপাদন, উত্তরাধিকার, দান এবং অসিয়ত সম্পর্কিত হুকুমসমূহ।
এগুলো হলো সম্পদের সদ্ব্যবহার এবং এর প্রাথমিক মালিকানার বিষয়াদি। সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষকে সাধারণভাবে উপার্জনের জন্য প্রণোদিত করার মাধ্যমে উৎসাহ দিয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কারিগরি পদ্ধতির আলোচনা বা উৎপাদনের পরিমাণের ক্ষেত্রে ইসলাম হস্তক্ষেপ করেনি, বরং এটাকে লোকদের ইচ্ছার উপর ন্যস্ত করেছে।
সম্পত্তির অস্তিত্বের ক্ষেত্রে বলা যায়, এটা এ পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে। মানুষের প্রয়োজনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমিনে রয়েছে সে সমস্ত।”
[সূরা বাক্বারা: ২৯]
“তিনি আল্লাহ্ যিনি সমুদ্রকে তোমাদের উপকারার্থে আয়ত্বাধীন করে দিয়েছেন, যাতে তাঁর আদেশক্রমে তাতে জাহাজ চলাচল করে এবং যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ তালাশ করো ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও।”
[সূরা আল-জাসিয়া: ১২]
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,
“এবং আয়াত্বাধীন করে দিয়েছেন তোমাদের, যা আছে নভোমন্ডলে ও যা আছে ভূমন্ডলে; তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।”
[সূরা আল-জাসিয়া: ১৩]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন,
“মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক, আমি আশ্চর্য উপায়ে পানি বর্ষণ করেছি, এরপর আমি ভূমিকে বিদীর্ণ করেছি। অতঃপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙুর ও শাক-সবজি, যয়তুন, খেজুর, ঘন উদ্যান, ফল এবং ঘাস, তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুদের উপকারার্থে।”
[সূরা আবাসা: ২৪-৩২]
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,
“আমি তাঁকে তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে। অতএব তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে?”
[সূরা আম্বিয়া: ৮০]
“আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার।”
[সূরা হাদীদ: ২৫]
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এইসব এবং অন্যান্য আয়াতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনিই সম্পত্তি এবং মানুষের শ্রমকে সৃষ্টি করেছেন, এবং এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে এমন কিছু নিয়ে তিনি আলোচনা করেননি; যা থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সম্পত্তি ও মানুষের পরিশ্রমের সদ্ব্যবহার দেখানো ছাড়া এগুলোর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেননি। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সম্পদ সৃষ্টিতেও হস্তক্ষেপ করেননি; এমন কোন শারী’আহ্ দলিল দেখানো সম্ভবপর নয় যেখানে সম্পদ সৃষ্টির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। উল্টো আমরা দেখতে পাই শারী’আহ্ সম্পদ আহরণ ও মানুষের প্রচেষ্টাকে উন্নততর করার বিষয়টি মানুষের উপর ছেড়ে দিয়েছে। হাতের মাধ্যমে খেজুর গাছের পরাগায়নের ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন,
“তোমরা তোমাদের দৈনন্দিন কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আছো।”
এটাও বর্ণিত আছে যে মুহাম্মদ (সা) অস্ত্র উৎপাদনের কৌশল শেখার জন্য দু’জন মুসলিমকে ইয়ামেনের জুরাসে প্রেরণ করেছিলেন। এই উদাহরণসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, শারী’আহ সম্পদ সৃষ্টির বিষয়টি মানুষের উপর অর্পণ করেছে যা তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে উৎপাদিত হবে।
এসব থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইসলাম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের প্রতি নয়। এটা সম্পদের ব্যবহার, এবং তা হতে উপযোগ প্রাপ্তির পদ্ধতিকে এর আলোচ্য বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এটা সম্পদ উৎপাদন কিংবা উপযোগ লাভের বিভিন্ন উপায়ের উপর মোটেও আলোকপাত করেনি।
ইসলামে অর্থনৈতিক নীতি
অর্থনৈতিক নীতি হলো আইনের লক্ষ্য যা মানুষের বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করে। ইসলামে অর্থনৈতিক নীতি হলো প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সব মৌলিক চাহিদাকে পূর্ণাঙ্গরূপে পূরণ করা, এবং একটি আদর্শিক সমাজে বসবাসরত একজন ব্যক্তির জন্য তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিলাসদ্রব্য অর্জনের সুযোগ করে দেয়া। অর্থাৎ ইসলাম একটি দেশে বসবাসরত মোট জনগোষ্ঠীকে ব্যক্তিসমষ্টি হিসেবে চিন্তা না করে প্রত্যেক ব্যক্তিকে এককভাবে বিবেচনা করে। তাকে প্রথমত একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে যার সকল মৌলিক চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করতে হবে এবং অত:পর বিবেচনা করে ব্যক্তি বিশেষ হিসেবে যাতে সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিলাসদ্রব্য অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। একইসময় ইসলাম তাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখে যে অন্যদের সাথে একটি নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী বিভিন্ন সম্পর্কের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রত্যেক ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ অধিকারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে শুধু দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা ইসলামী অর্থনৈতিক নীতির লক্ষ্য নয়। শুধুমাত্র সমাজে চাহিদাসমূহ পূরণের জন্য বিভিন্ন উপকরণের যোগান দেয়াও নয়, বরং এসব উপকরণ হতে সামর্থ্য অনুযায়ী সুবিধা নেয়ার জন্য মানুষকে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে না দিয়ে প্রত্যেকের জীবনধারণের অধিকারকে নিরাপত্তা প্রদান করে। এটি প্রত্যেক ব্যক্তির সমস্যাকে মানবীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে যারা একটি সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থেকে বসবাস করে। অত:পর একটি নির্দিষ্ট জীবনরীতি অনুসারে তার জীবনমান উন্নত করে এবং স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের জন্য নিজেকে সামর্থ্যবান করে তোলে। এভাবে এটি অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতির চেয়ে আলাদা।
মানুষের জন্য অর্থনৈতিক হুকুমসমূহ প্রণয়নের সময়, ইসলাম হুকুমগুলোকে ব্যক্তির জীবনধারণের অধিকার এবং বিলাসসামগ্রী অর্জনের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছে, এবং একই সময়ে এটা নিশ্চিত করেছে যে, সমাজে একটি বিশেষ জীবনব্যবস্থা বিদ্যমান। সুতরাং, ইসলাম একটি সমাজ কেমন হবে সেটা বিবেচনায় আনে, এবং পাশাপাশি একই সময়ে নিরাপদ জীবিকা এবং বিলাসসামগ্রী প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করে। একটি সমাজ কেমন হবে এ ব্যাপারে গৃহিত দৃষ্টিভঙ্গীকেই সে জীবিকা ও সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তি করেছে। সুতরাং, যেকেউ আহকামে শারী’আহ্-তে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাবে যে তা পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকারসমূহকে (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান) নিশ্চিত করেছে। এটা অর্জিত হয় প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তিকে কাজ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে, যাতে সে নিজের এবং তার উপর নির্ভরশীলদের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণ করতে পারে। ইসলাম কাজ করতে অক্ষম পিতামাতার দায়িত্ব তাদের সন্তান বা উত্তরাধিকারীদের হাতে অর্পণ করেছে, এবং দায়িত্ব নেয়ার মতো কেউ না থাকলে বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে। ইসলাম এমনভাবে তা করেছে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের এবং তার উপর নির্ভরশীলদের মৌলিক চাহিদাসমূহ তথা পর্যাপ্ত খাবার, বস্ত্র এবং বাসস্থান নিশ্চিত করাকে তার ইসলামী দায়িত্ব মনে করে। এবং অতঃপর সামর্থ্য অনুযায়ী বিলাসদ্রব্য অর্জনের প্রতি উৎসাহিত হয়।
কিছু বিশেষ ক্ষেত্র বাদে জনগণের কাছ থেকে করারোপ করে সম্পদ হরণ করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে, যেমন: জিহাদ বা দূর্ভিক্ষের সময় সব মুসলিমের উপর কর দেয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। আর এ করারোপ করা হবে সে সম্পত্তির উপর যা সাধারণত একজন ব্যক্তি তার মৌলিক অধিকার ও বিলাসসামগ্রী পূরণের পর উদ্বৃত্ত থাকে। এভাবে এটা প্রত্যেকের জীবিকা অর্জনের অধিকার পূরণ করে এবং বিলাসসামগ্রী অর্জনের পথকে সুগম করে। এছাড়া ইসলাম তার মৌলিক অধিকার ও বিলাসসামগ্রী উপার্জনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট রীতির মাধ্যমে তার সাথে অন্যদের সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সেকারণে ইসলাম মুসলিমদের জন্য মদ উৎপাদনকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এটিকে অর্থকারী পণ্য হিসেবে গণ্য করে না। ইসলাম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুদকে এবং লেনদেনের সময় এর ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে কারো জন্যই সুদকে অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে গণ্য করে না। সুতরাং অর্থনৈতিক পণ্যের সদ্ব্যবহারের জন্য ইসলাম কোন সম্পত্তি সদ্ব্যবহারের সময় একটি সমাজ কেমন হবে তাকে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে।
ইসলাম একজনের ব্যক্তি সত্ত্বাকে তার মানবীয় সত্ত্বা কিংবা তার মানবীয় সত্ত্বাকে তার ব্যক্তি সত্ত্বা হতে আলাদা করে না। তাছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা পূরণের নিরাপত্তা এবং বিলাসামগ্রী অর্জনের সুযোগ প্রদানকে, একটি সমাজ কেমন হবে তা হতে আলাদা করেনা। বরং, ইসলাম চাহিদা পূরণ এবং সমাজ কেমন হবে, এই দুটি বিষয়কে পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বিষয় মনে করে কিন্তু এক্ষেত্রে সমাজব্যবস্থার ধরণকে মৌলিক চাহিদা পূরণের ভিত্তি বানিয়েছে। সকল মৌলিক চাহিদাগুলোকে পূর্ণাঙ্গভাবে পূরণ এবং বিলাসদ্রব্য অর্জনে সক্ষম করার স্বার্থে, অর্থনৈতিক পণ্য সহজলভ্য করতে হবে, এবং ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলোকে সহজলভ্য করা যাবে না যতক্ষন পর্যন্ত না তারা এগুলো অর্জনে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। সুতরাং, ইসলাম জনগণকে উপার্জন, রিযিক অন্বেষণ এবং প্রতিযোগীতার আহ্বান জানায়। এবং ইসলাম ব্যক্তির নিজের জন্য এবং তার উপর নির্ভরশীল বাকি সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য প্রত্যেক কর্মক্ষম ব্যক্তির জন্য রিযিক অন্বেষণকে ফরয করেছে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“অতএব, তোমরা তাতে বিচরণ করো এবং তাঁর দেয়া রিযিক আহার করো।”
[সূরা মূলক: ১৫]
তবে এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম সম্পদের উৎপাদন কিংবা সম্পদের উৎপাদন ও পরিমাণ বৃদ্ধির কারিগরী কৌশলের দিকে হস্তক্ষেপ করেছে। বরং এটি সম্পত্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে উপার্জনের জন্য উৎসাহিত করেছে। সম্পত্তি অর্জনের ব্যাপারে উৎসাহিত করে অনেক হাদীস এসেছে।
একটি হাদীসে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাদ ইবনে মু’আজ (রা.)-এর সাথে হাত মেলালেন এবং তার হাত রুক্ষ পেলেন। যখন রাসূল (সা) এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি (রা.) বললেন: “আমি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বেলচা দিয়ে খনন করেছি।” রাসূল (সা) তার হাতে চুমু খেলেন এবং বললেন: “এই হাতদ্বয়কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পছন্দ করেন” । যা আল-শারখাশি তার আল-মাবসুত-এ বর্ণনা করেছেন। এবং আল-বুখারী আল-মিকদাম হতে বর্ণনা করেছেন যে রাসূল (সা) বলেছেন: “স্বীয় হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে ভাল খাবার আর কেউ কখনও খায়নি।”
বর্ণিত আছে যে, উমর বিন আল খাত্তাব (রা.) কিছু লোককে অতিক্রম করছিলেন, যারা কুর’আন পাঠকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাদের বসে থাকতে এবং মাথা নোওয়াতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন: “তারা কে?” তাকে বলা হলো: “এরা হচ্ছে সে সমস্ত লোক যারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র উপর ভরসা করে।” প্রত্যুত্তরে উমর (রা.) বললেন: “না, তারা হলো সে সমস্ত লোক যারা লোকেদের সম্পত্তি ভক্ষণ করে। তোমরা কি চাও আমি তাদের কথা বলি যারা সত্যিকারভাবেই আল্লাহ্’র উপর নির্ভর করে?’ তিনি বললেন: “এরা হচ্ছে সে সমস্ত লোক যারা বীজকে ভূমিতে বপন করে এবং সর্বশক্তিমান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার উপর ভরসা করে।”
সুতরাং এসব আয়াত এবং হাদীসসমূহ রিযিক অন্বেষণ, সম্পত্তি অর্জনের জন্য কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহী করে যেমনভাবে এগুলো সম্পত্তির ভোগ এবং ভালো খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহিত করে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“আপনি বলুন: আল্লাহ্’র সাজ-সজ্জাকে যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্রবস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে?”
[আল-আরা’ফ: ৩২]
এবং
“আল্লাহ্ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে, এই কার্পণ্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পণ্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ্ হচেছন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ্ সে সম্পর্কে জানেন।”
[সূরা আলি-ইমরান: ১৮০]
এবং
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ করো না।”
[সুরা আল বাক্বারা: ২৬৭]
এবং
“হে মুমিনগণ, তোমরা ঐসব সুস্বাদু বস্তু হারাম করো না, যেগুলো আল্লাহ্ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন” ।
[সূরা মায়ি’দাহ্: ৮৭]
এবং
“আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যেসব বস্তু তোমাদেরকে দিয়েছেন, তন্মধ্য থেকে হালাল ও পবিত্র বস্তু খাও এবং আল্লাহ্-কে ভয় কর, যার প্রতি তোমরা বিশ্বাসী।”
[সূরা আল-মায়ি’দাহ্: ৮৮]
এ আয়াত ও এজাতীয় অন্যান্য আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, অর্থনৈতিক নীতির সাথে সম্পর্কিত ঐশী বাণী বা আহকামে শারী’আহ্’র লক্ষ্য হল সম্পত্তি অর্জন করা এবং উত্তম বস্তু ভোগ করা। সুতরাং ইসলাম ব্যক্তির উপর উপার্জনকে বাধ্যতামূলক করেছে এবং উপার্জিত সম্পদ থেকে ভোগ করার নির্দেশ দিয়েছে যাতে করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়, প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যায় এবং তার বিলাসদ্রব্যের চাহিদা পূরণ করা যায়।
সম্পদ অর্জনকে সহজতর করার জন্য, আমরা দেখতে পাই যে, ইসলাম কোন জটিলতা ব্যতিরেকে সম্পদের মালিকানা অর্জনের জন্য পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। সেটা সম্পদ অর্জনের পথকে সহজতর করেছে। ইসলাম মালিকানা লাভের বৈধ পথ ও মালিকানা হস্তান্তরের চুক্তিসমূহ সুসংজ্ঞায়িত করেছে এবং মানুষ যেসব রীতি ও উপকরণ প্রয়োগ করে উপার্জন করতে চায় সে ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছে এবং সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেনি।
বৈধ উপায়ে মালিকানা ও চুক্তি সম্পাদনের জন্য ইসলাম বিবিধ নীতিমালা এবং আইন সম্বলিত সাধারণ নির্দেশনা উপস্থাপন করেছে, যা বহু বিষয়ে প্রয়োগ করা যায় এবং যা থেকে কিয়াসের মাধ্যমে বহু হুকুম উৎসারিত করা যায়।
সুতরাং ইসলাম কাজকে বাধ্যতামূলক করেছে, এ বিষয়ে বিস্তারিত আইন প্রণয়ন করেছে, এবং মানুষকে বিভিন্ন পেশা- কাঠমিস্ত্রী, উৎপাদনকারী, কারিগর, ব্যবসায়ী প্রভৃতি হবার সুযোগ দিয়েছে। উপহারকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার সাথে কিয়াসের মাধ্যমে দান বা আর্থিক সাহায্যকে মালিকানা প্রাপ্তির উপায় বলা যায়। কর্মসংস্থানকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার সাথে কিয়াসের মাধ্যমে উকালতিকে তুলনা করা যায় ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির সাথে। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, মালিকানা লাভের উপায় এবং চুক্তিসমূহ সাধারণভাবে শারী’আহ্ বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করেছে এবং এমনভাবে স্থাপন করেছে যাতে করে অনেক সমসাময়িক বিষয়সমূহের সমাধানও এখান থেকে পাওয়া যায়, যদিও এগুলো নতুন কোন ধরনের লেনদেনকে অনুমোদন দেয় না। শারী’আহ্ সংজ্ঞায়িত পদ্ধতিতেই লোকদের লেনদেন করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যা নতুন অনেক ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়।
সুতরাং মুসলিমগণ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে হালাল উপার্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন কোন বাঁধা ছাড়াই দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হবে। এভাবে সব ব্যক্তির জন্য মৌলিক অধিকার পূরণ করা সম্ভব। ইসলাম কেবলমাত্র ব্যক্তিকে উপার্জন করতে বলে না, বরং রাষ্ট্রের সব নাগরিকদের প্রয়োজনে বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে দায়িত্বশীল হতে বলে। সেকারণে এটা শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তির দায়িত্ব নেয়াকে রাষ্ট্রের কর্তব্য মনে করে। উম্মাহ্’র জন্য মৌলিক অধিকারের সংস্থান করা এর অন্যতম একটি দায়িত্ব মনে করে, কেননা রাষ্ট্র উম্মাহ্’র তত্ত্বাবধান করতে বাধ্য।
ইবনে উমর হতে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:
“ইমাম হলেন দায়িত্বশীল (রা’ঈ) এবং তিনি সব নাগরিকের জন্য দায়িত্বশীল।”
রাষ্ট্রের উপর শারী’আহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শারী’আহ্ রাষ্ট্রকে বিশেষ কিছু রাজস্ব আদায় করার দায়িত্ব অর্পণ করেছে, যেমন: জিযিয়া এবং খারাজ (ভূমিকর); যাকাতও রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বায়তুল মাল সংগ্রহ করে থাকে। উম্মাহ্’র উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য রাষ্ট্রের অর্থ সংগ্রহের অধিকার রয়েছে, যেমন: রাস্তা সংস্কার, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা, দরিদ্র লোককে খাদ্য দেয়া এবং এ জাতীয় সবকিছু।
শারী’আহ্ গণমালিকানাধীন সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রকে অর্পণ করেছে। শারী’আহ্ ব্যক্তিকে গণমালিকানাধীন সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। কারণ সামগ্রিক দায়দায়িত্ব ইমামের এবং এ দায়দায়িত্ব ইমাম ছাড়া আর কোন সাধারণ নাগরিকের উপর বর্তায় না যদি না তিনি ইমাম কর্তৃক নিযুক্ত হন। পানি, তেল, লোহা, তামা, এবং এ জাতীয় গণমালিকানাধীন সম্পত্তি উম্মাহ্’র বা জাতির সমৃদ্ধির জন্য সদ্ব্যবহার করতে হবে। কারণ এ সম্পত্তির মালিক হল উম্মাহ্। রাষ্ট্র বরং এগুলোর প্রশাসনিক ও উন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। যখন রাষ্ট্র তহবিল সরবরাহ করে এবং লোকদের বিষয়াদি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে, এবং যখন প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি সম্পদ উপার্জন করে তখন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও বিলাসসামগ্রীর চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাপক সম্পদ সুলভ হয়ে যায়।
তাছাড়া, কাজের জন্য প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা, রাষ্ট্রীয় মালিকানা নির্ধারণ এবং গণমালিকানাধীন সম্পত্তি বিনিয়োগ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়, এবং এসবই হচ্ছে চাহিদা পূরণের উপায়, সম্পত্তি পাওয়ার জন্য পাওয়া কিংবা দাম্ভিকতা কিংবা গুনাহ্’র কাজে ব্যয়ের জন্য কিংবা অহংকার এবং নির্যাতনের জন্য নয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি হালালভাবে এবং যথাযথ উপায়ে রিযিক অন্বেষণ করে, পরিবারের প্রতি উদার, প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল, সে পূর্ণ চাঁদের ন্যায় চেহারা নিয়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র সাথে দেখা করবে; এবং যে ব্যক্তি উদ্ধত্য ও বাহুল্যতার সাথে তা অন্বেষণ করবে সে আল্লাহ্’র সাথে যখন দেখা করবে তখন তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তার প্রতি রাগান্বিত থাকবেন।” আবু হুরায়রা (রা.) হতে ইবনে আবু শায়বা তার মুসান্নাফ-এ বর্ণিত করেছেন।
মুসলিম মুতাররিফ-এর বরাত দিয়ে এবং মুতাররিফ তার পিতার বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:
“হে আদম সস্তান, তুমি যা খাও এবং ব্যয় করো, যা পরিধান করো এবং ফেলে দাও, এবং যা দান করো এবং নিজের জন্য রেখে দাও, তাছাড়া আর কি সম্পদ তোমার থাকতে পারে?”
সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা আল-আ’রাফ: ৩১]
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোই সম্পত্তি অর্জনের উদ্দেশ্য, অহংকার প্রদর্শনের জন্য নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র হুকুম অনুসারে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা করা বাধ্যতামূলক। এটা মানুষকে সে যা আয় করে সেগুলোর মাধ্যমে আখিরাতকে অন্বেষণ করার নির্দেশ দিয়েছে এবং বৈষয়িক বিষয়ে তার হিস্যার কথা ভুলে না যেতে বলেছে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“আল্লাহ্ তোমাকে যা দান করেছেন, তা দ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান করো, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ করো, যেমন আল্লাহ্ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না।”
[সূরা কাসাস: ৭৭]
ইসলামী অর্থনীতির দর্শন অনুসারে, সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে, তাঁর প্রদত্ত নির্দেশ অনুয়ায়ী পরিচালিত হতে হবে। যে ধারণার উপর সমাজে মুসলিমদের বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত, তা হলো- একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা ব্যবস্থা হিসেবে আহকামে শারী’আহ্ বা ঐশী হুকুম অনুসারে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে পরিচালনা করা। রাষ্ট্রের অন্য নাগরিকদের (অমুসলিম) অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যবস্থাপনাও ঐশী হুকুমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটা তাদেরকে এমন কিছুর অনুমোদন দেয় যা ইসলামে অনুমোদিত এবং সেটাকে নিষিদ্ধ করে যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ্ বলেন:
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।”
[সূরা হাশর: ৭]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়।”
[সূরা ইউনুস: ৫৭]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“যারা তাঁর (রাসূল (সা) এর) আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদেরকে ¯পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।”
[সূরা নূর: ৬৩]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“আপনি তাদের পার¯পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী ফয়সালা করুন”
[সূরা মায়ি’দাহ্: ৪৯]
তাক্বওয়ার ভিত্তিতে মুসলিমদের এই অর্থনৈতিক নীতির প্রতি আনুগত্যশীল থাকতে উদ্বুদ্ধ করে, এবং জনগণকে রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ইসলাম শারী’আহ্ প্রণীত এসব হুকুমসমূহের বাস্তবায়নকে নিরাপদ করে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো।”
[সূরা আল-বাক্বারা: ২৭৮]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋণের আদান-প্রদান করো, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও।”
[সূরা বাক্বারা: ২৮২
যতক্ষণ না তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“… কিন্তু যদি কারবার নগদ হয়, পর¯পর হাতে হাতে আদান-প্রদান করো, তবে তা না লিখলে তোমাদের প্রতি কোন অভিযোগ নেই।”
[সূরা বাক্বারা: ২৮২]
ইসলাম কীভাবে এ হুকুমসমূহ বাস্তবায়ন হবে সে পদ্ধতি বর্ণনা করেছে এবং কীভাবে লোকেরা এ হুকুমসমূহ নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করবে তাও বিধৃত করেছে।
এটা প্রমাণ করে যে, ইসলামী অর্থনৈতিক নীতি একটি নির্দিষ্ট সমাজে বসবাসরত মানুষ হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তির চাহিদা পূরণ ও সে চাহিদা পূরণের জন্য সম্পদ উপার্জনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। ইসলামী অর্থনৈতিক নীতিও একটি চিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা হলো সব কাজ ঐশী হুকুম অনুসারে বাস্তবায়ন করা। প্রত্যেক ব্যক্তিকে আল্লাহ্’র ভয় দ্বারা উদ্ধুদ্ধ করে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের বিকাশ প্রক্রিয়া ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হয়।
সাধারণ অর্থনৈতিক মূলনীতি
অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ঐশী হুকুমসমূহ বিশ্লেষণ করলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম লোকদের সম্পদের সদ্ব্যবহার করার লক্ষ্যে সমর্থ করে তোলার বিষয়টিকে নির্দেশ করেছে। সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এটাই হলো ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী। যখন অর্থনীতির কথা আসে তখন প্রাথমিকভাবে তা সম্পদ অর্জন, এর হস্তান্তর ও জনগণের মধ্যে তা বন্টনের কথা বলে।
অর্থনীতির সাথে বিজড়িত হুকুমসমূহ তিনটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত:
১. প্রাথমিক মালিকানা
২. মালিকানার হস্তান্তর (Disposal)
৩. এবং জনগণের মধ্যে সম্পদের বন্টন
মালিকানার ক্ষেত্রে সত্ত্বাধিকারী হলেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। কেননা তিনি হলেন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একচ্ছত্র অধিপতি (মালিক আল মুলক) । বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, সম্পত্তির মালিক হলেন তিনি।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:
“আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে, অর্থ-কড়ি দিয়েছেন, তা থেকে তাদেরকে দান করো।”
[সূরা নূর: ৩৩]
সুতরাং সম্পত্তির একক মালিক হলেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। তবে তিনি মানুষকে এগুলোর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, তাকে এটি দান করেছেন এবং মানুষকে এগুলোর মালিকানা লাভের অধিকার প্রদান করেছেন।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“তিনি তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করেছেন, তা থেকে ব্যয় করো।”
[সূরা হাদীদ: ৭]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন” ।
[সূরা নূহ: ১২]
স্পষ্টতই যখন তিনি সম্পদের উৎস সম্পর্কে বলেন তখন এর মালিকানা নিজের উপরই অর্পণ করেন এবং তিনি বলেন:
“…আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে অর্থ-কড়ি দিয়েছেন…”
[সূরা নূর: ৩৩]
অতঃপর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের কাছে সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন; তিনি তাদেরকে সম্পত্তি প্রদান করেছেন এবং বলেন:
“তাদের হাতে তাদের সম্পদ প্রত্যার্পণ করো।”
[সূরা নিসা: ৬]
এবং
“তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ করো।”
[সূরা তাওবা: ১০৩]
এবং
“তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে।”
[সূরা বাক্বারা: ২৭৯]
এবং
“তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ”
[সূরা তাওবা: ২৪]
এবং
“তখন তার সম্পদ তার কোনই কাজে আসবে না।”
[সূরা আল-লাইল: ১১]
আল্লাহ্’র প্রতিনিধিত্বের দৃষ্টিকোন থেকে সম্পদের প্রতি সকল মানুষের মালিকানার অধিকার রয়েছে। তবে এটা সত্যিকারের মালিকানা নয়, বরং শুধুমাত্র মালিকানার অধিকার। একজন ব্যক্তির সত্যিকারের মালিকানা তখনই নিশ্চিত হয় যখন মালিকানার ইসলামী শর্তাবলী পূরণ হয়, অর্থাৎ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র অনুমোদন। সুতরাং সম্পত্তির সত্যিকারের মালিকানা তখনই সম্ভবপর হয়, যখন একজন ব্যক্তি কোন সম্পত্তি অর্জনের জন্য তার প্রভূর অনুমোদন পায়। এই অনুমোদন হলো একজন ব্যক্তি সম্পত্তির মালিক হতে পারে এ ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট দলিল। সমস্ত মানবজাতিকে মালিকানার স্বত্ব প্রদান করা আ’ম বা সাধারণ দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং এটা মালিকানার অধিকারকে প্রমাণ করে। একজন ব্যক্তিকে কোন সম্পত্তির সত্যিকারের মালিকানা প্রদান করার জন্য সুনির্দিষ্ট অনুমোদন প্রয়োজন যা ব্যক্তিকে আইনপ্রণেতা অর্থাৎ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, প্রদান করেছেন।
আইনপ্রণেতা উল্লেখ করেছেন যে, ব্যক্তিগত মালিকানা সেখানেই কার্যকর যেখানে একজন ব্যক্তি আইনদাতা কর্তৃক অনুমোদিত মালিকানা লাভের পন্থার কোন একটির মাধ্যমে তা অধিকার করে থাকে। আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন:
“যে ব্যক্তি একটি দেয়ালের মাধ্যমে একখন্ড জমিকে ঘিরে ফেলে, এটি তার হয়ে যায়।”
এছাড়া পুরো উম্মাহ্’র মালিকানায় রয়েছে গণমালিকানাধীন সম্পত্তি। আহ্মাদ মুহাজীরদের এক ব্যক্তির কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন:
“জনগণ তিনটি বিষয়ে অংশীদার: পানি, চারণভূমি ও আগুন।”
তাছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাও রয়েছে। যখন কোন ওয়ারিশ ছাড়া একজন মুসলিম মারা যান তখন তার সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বায়তুল মালে চলে যায়। খারাজ ও জিযিয়া থেকে যাই সংগৃহীত হবে, তাই কোষাগারের অংশ। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ব্যবহার রাষ্ট্রের এখতিয়ারভুক্ত।
ব্যক্তিগত, গণমালিকানাধীন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির মালিকানা লাভের প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট ইসলাম শারী’আহ্ হুকুমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করেছে। এর বাইরে যে কোন প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ।
সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র গণমালিকানাধীন সম্পত্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। তবে রাষ্ট্র কর্তৃক গণমালিকানাধীন সম্পত্তির দলিল কিংবা স্বত্বকে বিনিময় (Exchange) অথবা মঞ্জুর (Grant) ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। এ দু’টি বাদে অন্য যেকোন উপায়ে গণমালিকানাধীন সম্পত্তির হস্তান্তর অনুমোদিত এবং তা শারী’আহ্ হুকুমের ভিত্তিতে হতে হবে।
ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির হস্তান্তর বায়তুল মাল ও লেনদেনের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুমের মাধ্যমে করা হয়, যেমন: বিক্রয় করা বা বন্ধক রাখা। ইসলাম ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে শারী’আহ্ হুকুমের ভিত্তিতে বিনিময় (Exchange) অথবা মঞ্জুরের (Grant) মাধ্যমে হস্তান্তরের অনুমোদন দিয়েছে।
মালিকানা এবং চুক্তির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সম্পত্তির বন্টন করা হয়। মানুষের সামর্থ্য এবং তাদের প্রয়োজন মেটানোর প্রবণতার মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্যের দরুণ তাদের মাঝে সম্পত্তির বন্টনের ক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে বৈষম্যপূর্ণ বন্টন হতে পারে এবং সম্পদ
সামান্য কিছু লোকের কাছে কুক্ষিগত হয়ে অন্যরা বঞ্চিত হতে পারে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মজুতের ঘটনাও ঘটতে পারে, যা মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যম। সেকারণে ইসলাম কেবলমাত্র ধনীদের মাঝে সম্পদ আবর্তিত হওয়াকে নিষিদ্ধ করেছে। বরং ইসলাম বাস্তবিকভাবে সম্পদ সবার মধ্যে আবর্তিত হওয়াকে বাধ্যতামূলক করেছে। ইসলাম স্বর্ণ ও রৌপ্য মজুত করাকে নিষিদ্ধ করেছে, এমনকি এর উপর যাকাত প্রদান করা হলেও।