অধ্যায় ৩: মালিকানার প্রকারভেদ (ব্যক্তি মালিকানা)

মানষের স্বাাভাবিক প্রবনতা হচ্ছে, সে তার অভাব পরণের জন্য কাজ করতে চায় ও সম্পদের অধিকারী হতে চায় এবং এই সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে সে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। মানুষের অভাব পূরণ একটি অপরিহার্য বিষয়, যা থেকে নিজেকে সে নিবৃত্ত রাখতে পারে না। এছাড়াও, মানুষের প্রকৃতির অংশ হিসেবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টিও অনিবার্য হয়ে পড়ে। সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ও এর পরিমাণকে সীমাবদ্ধ করে দেয়ার যে কোন প্রচেষ্টা মানুষের প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক হবে। অতএব, মানুষ ও তার সম্পদ অর্জনের স্পৃহায় বাধা সৃষ্টি করা কিংবা ব্যক্তি ও তার সম্পদ সংগ্রহের প্রচেষ্টার মাঝে অবস্থান নেয়া প্রকৃতি বিরুদ্ধ হবে।

যাই হোক, সম্পদ অর্জন, এই উদ্দেশ্যে কঠোরভাবে প্রচেষ্টা করা কিংবা এর বিলিব্যবস্থার বিষয়টি মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া উচিত নয়, কেননা এটি অনিষ্ট ও দুর্নীতির কারণ হতে পারে যা নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে। সক্ষমতা এবং প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ থাকার দরুন এই বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। যদি এ বিষয়টি তাদের নিজেদের উপর ছেড়ে দেয়া হয় তবে শুধুমাত্র ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা সম্পদ অর্জন করতে পারবে এবং দুর্বল ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবে, অসুস্থ ও অসমর্থ্য ব্যক্তিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং লোভীর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাবে। অতএব, সম্পদ অর্জন এবং এই উদ্দেশ্যে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি এমন প্রক্রিয়ায় হতে হবে যাতে করে তা সকল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটির এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে, মানুষের মধ্যে বিলাস-দ্রব্যাদি অর্জনের যে আকাঙ্খা রয়েছে তাও পূরণ করা সম্ভবপর হয়। একারণে এই সম্পদ অর্জনের বিষয়টিকে একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া উচিত যার মাধ্যমে সক্ষমতা ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকা সত্ত্বেও সকলে সহজে সম্পদ অর্জন করতে পারে। এই পদ্ধতিটি মানুষের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে যাতে করে মানুষ তার মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণ করতে পারে এবং মানুষকে তার বিলাস সামগ্রী অর্জনের আকাঙ্খা পূরণেও সক্ষম করে তোলে। সুতরাং, সম্পদের প্রকৃতি অনুসারে মালিকানা নির্ধারণ করা জরুরী এবং মালিকানা রহিতকরণের বিষয়টি প্রতিহত করা অপরিহার্য, কারণ এটি মানুষের প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিকানাই কেবল অর্জন করা যাবে – এ বিষয়টিও রোধ করা জরুরী, কেননা এটা মানুষকে সম্পদ অর্জনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখে যা মানব প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। মালিকানার স্বাধীনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কেননা এর মাধ্যমে পাপ ও দূর্নীতির জন্ম হয় যা মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করে এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্পর্কেরসূত্রপাত করে। ইসলাম ব্যক্তি পর্যায়ের মালিকানাকে অনুমোদন দেয় এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ না করে মানুষের প্রকৃতি অনুসারে এটি অর্জনের প্রক্রিয়াকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়। এটা মানুষের মধ্যকার সম্পর্কগুলোকে সুসংগঠিত করে যাতে করে মানুষ তার অভাবসমূহ পূরণ করতে পারে।

ব্যক্তি মালিকানার সংজ্ঞা

ব্যক্তি মালিকানার বিধান হচ্ছে একটি ঐশী হুকুম যা সম্পদ কিংবা প্রাপ্ত উপযোগের ভিত্তিতে বিবেচিত হয়, সম্পদের মালিককে সম্পদ সদ্ব্যবহারের এবং এর ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার প্রদান করে। উদাহরণস্বরুপ: এটা হতে পারে এক টুকরো রুটি ও একটি বাড়ীর উপর কোন ব্যক্তির মালিকানা। রুটির টুকরোর মালিকানার মাধ্যমে সে এটি খেতে পারে বা বিক্রয় করতে পারে। একইভাবে বাড়ীর মালিকানার মাধ্যমে সে তাতে বসবাস করতে পারে বা বিক্রয় করে দিতে পারে। দু’টি উদাহরণের ক্ষেত্রেই এক টুকরো রুটি ও বাড়ী সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে ঐশী হুকুম হচ্ছে যে, আইনপ্রণেতা এগুলো ভোগ করার মাধ্যমে প্রাপ্ত উপযোগ বা বিনিময়ের মাধ্যমে কাজে লাগানোর অনুমোদন

দিয়েছেন। সদ্ব্যবহারের অনুমোদনের অর্থ হল মালিক রুটির টুকরোটি ভক্ষণ করতে পারে ও বাড়ীতে বসবাস করতে পারে এবং চাইলে বিক্রিও করে দিতে পারে। সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত রুটির টুকরোর ক্ষেত্রে শারী’আহ্ হুকুম হচ্ছে যে এটিকে ভোগ করার অনুমোদন রয়েছে। বাড়ীর ক্ষেত্রে শারী’আহ্ হুকুমটি বিবেচিত হয় বাড়ী হতে প্রাপ্ত উপযোগ দ্বারা, আর তা হচ্ছে এতে বসবাসের অনুমোদন। সুতরাং মালিকানা বলতে বুঝায় সম্পত্তির সদ্ব্যবহার করার জন্য আইনপ্রণেতার অনুমোদন। এই দৃষ্টিকোন অনুযায়ী, যদি আইনপ্রণেতা এটিকে এবং এর উপকরণকে অনুমোদন না দেয় তবে মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে না। সম্পত্তির মালিকানা লাভের অধিকার সম্পত্তি হতে কিংবা এর উপকারী বা ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য হতে উদ্ভুত হয় না। বরং এটি আইনপ্রণেতার অনুমোদন হতে এবং কোন একটি সম্পদ আইনসঙ্গতভাবে অর্জনের পন্থাগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) প্রদত্ত বৈধতা হতে উদ্ভুত হয়। এর মাধ্যমে আইনপ্রণেতা কিছু জিনিসের মালিকানার অধিকার প্রদান করেছেন এবং অন্যান্য জিনিসের মালিকানা অর্জনকে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কিছু চুক্তিকে বৈধতা দিয়েছেন এবং অন্যগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন। একারণে আইনপ্রণেতা মুসলিমদের জন্য মদ ও শূকরের মালিকানা নিষিদ্ধ করেছেন এবং সুদ ও জুয়ার মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকে ইসলামী রাষ্ট্রের যেকোন নাগরিকের জন্য অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বেচাকেনাকে অনুমোদনের মাধ্যমে একে হালাল করেছেন এবং সুদকে নিষিদ্ধ, অর্থাৎ হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি ’আনান (ব্যক্তি ও আর্থিক অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কারবার)-এর অনুমোদন দিয়েছেন এবং সমবায়, যৌথমূলধনী কারবার ও বীমাকে নিষিদ্ধ করেছেন।

বৈধ মালিকানা শর্তসাপেক্ষ এবং এটি হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মালিকানা কোন সম্প্রদায়ের স্বার্থ কিংবা সম্প্রদায়ের অংশ ও সমাজে বসবাসরত কোন ব্যক্তির স্বার্থে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। মালিকানাপ্রাপ্ত কোন সম্পত্তি সদ্ব্যবহারের বিষয়টি কেবলমাত্র আইনপ্রণেতার অনুমোদনের মাধ্যমেই আসতে পারে যা তিনি ওহীর মাধ্যমে মানুষকে দান করেছেন। কোন একটি বস্তুর মালিকানা হল সমাজের কোন ব্যক্তির জন্য আইনপ্রণেতা কর্তৃক প্রদত্ত বরাদ্দ, এবং অনুমোদিত পন্থাগুলো ছাড়া অন্য কোনভাবে তার জন্য এর মালিকানা অর্জন বৈধ নয়।

কোন সম্পদের মালিকানার অর্থ হল সম্পত্তির এবং সেটা থেকে প্রাপ্ত উপযোগের মালিকানা লাভ করা। মালিকানার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল শারী’আহ্ নিধারিত পথে সম্পত্তির সদ্বব্যবহার নিশ্চিত করা।

ব্যক্তি মালিকানার সংজ্ঞার আলোকে এটা বুঝা যায় যে, মালিকানা অর্জনের আইনগত পন্থা রয়েছে। এটাও বুঝা যায় যে, এই মালিকানা হস্তান্তরের জন্য এবং স্বত্বাধিকারে থাকা বস্তুসমূহ সদ্ব্যবহারের জন্যও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে।

অতএব, উপরোক্ত আলোচনা হতে যেসব বিষয় ব্যক্তি মালিকানার অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে বিবেচিত হয় সেগুলো বোঝা যেতে পারে। সুতরাং, আইনপ্রণেতা কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুসারে মালিকানা অর্জিত হওয়ার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- অধিকার লাভ করার জন্য এবং সেই সাথে এর

সদ্ব্যবহারের জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো, আর এটিকেই মালিকানার প্রকৃত সংজ্ঞা হিসেবে গণ্য করা হয়। ভিন্ন শব্দে বলা যায় যে, মালিকানার প্রকৃত সংজ্ঞাই মালিকানার প্রকৃত অর্থ নির্দেশ করে।

মালিকানার অর্থ

ব্যক্তি মালিকানার অধিকার হচ্ছে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানার অধিকারী ব্যক্তির আইনগত অধিকার। আইন প্রয়োগ ও সমাজকে ইসলামী চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে তোলার মাধ্যমে এই অধিকার সংরক্ষিত ও নির্ধারিত হয়। শারী’আহ্ কর্তৃক নির্ধারিত আর্থিক মূল্য বহনের পাশাপাশি মালিকানারঅধিকার এটাও নির্দেশ করে যে, দখলে থাকা অর্জিত সম্পত্তির উপরে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যেভাবে নিজের ঐচ্ছিক কর্মকান্ডের উপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, ঠিক একইভাবে সে চাইলে তার নিজের অধিকারে থাকা সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে। অতএব, মালিকানার অধিকার আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা) প্রদত্ত হুকুম ও নিষেধাজ্ঞার সীমার মধ্যেই নির্ধারিত হয়।

মালিকানার অধিকার নির্ধারনকারী আইনী প্রক্রিয়ায় মালিকানা নির্ধারণের বিষয়টি সুস্পষ্ট এবং এর দ্বারা শাস্তির প্রয়োগ হবে কি হবে না সেই সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। এর উদাহরণ হল চৌর্যবৃত্তি, ডাকাতি ও অবৈধভাবে সম্পত্তি হরণের সংজ্ঞা। এই মালিকানা নির্ধারণের বিষয়টি মালিকানা হস্তান্তরের অধিকারের মধ্যেও সুস্পষ্ট, এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হস্তান্তর অনুমোদিত ও অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ এবং এসব ঘটনার সংজ্ঞায় ও ক্ষেত্রসমূহের প্রকারভেদ ও বহিঃপ্রকাশের মধ্যেও এটি সুস্পষ্ট। যখন ইসলাম মালিকানা নির্ধারণ করে, তখন তা পরিমাণের ভিত্তিতে করা হয় না বরং এর ধরনের বা প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে করা হয়। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে এটা পরিষ্কার হয়েছে:

১. কী পরিমাণ সম্পদ অর্জিত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে নয় বরং ইসলামে মালিকানা নির্ধারিত হয় সম্পদ অর্জন ও বিনিয়োগের পন্থার ভিত্তিতে।
২. এটি সম্পদ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে দিয়েছে।
৩. খারাজী ভূমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, ব্যক্তি মালিকানাধীন নয়।
৪. কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি গণমালিকানাধীন সম্পত্তিতে রূপান্তর হয়ে যেতে পারে।
৫. অভাব পূরণের জন্য যেসব মানুষের যথেষ্ট সম্পদ নেই সেসব মানুষদেরকে রাষ্ট্র প্রয়োজনের নিরিখে অনুদান প্রদান করতে পারে।

এটা অপরিহার্য যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার আইনগত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন। আইন ব্যক্তিপর্যায়ের মালিকানার অধিকারকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করেছে। এটি মালিকানার মর্যাদা, সুরক্ষা ও এর প্রতি আগ্রাসনকে প্রতিহত করার বিষয়গুলোকে সুনিশ্চিত করেছে। আইনের মধ্যে শাস্তির বিধান রেখে অপরাধকে নিরুৎসাহিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে, এবং যারা চুরি, ডাকাতি অথবা অন্য কোনভাবে এই অধিকার লঙ্ঘন করে তাদের উপর এটি পয়োগ করা হয়। সমাজকে ইসলামী চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে এই বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় যাতে মানুষ তার অধিকার বহির্ভূত উপায়ে কোন কিছু অর্জনের বাসনা পোষণ না করে, অর্থাৎ যা অন্যের অধিকারে আছে তার দিকে লালসার দৃষ্টি প্রসারিত না করে। সুতরাং, হালাল বা বৈধ সম্পত্তি হিসেবে সেটাই বিবেচিত হবে যা মালিকানার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে এবং কোন অবৈধ (হারাম) সম্পত্তি মালিকানার অধীনে আসবে না ও এটি মালিকানার সংজ্ঞার মধ্যেও পড়ে না।

সম্পত্তির মালিকানা লাভের পন্থা

যা অধিকারে নেয়া যায় তাই সম্পদ, এক্ষেত্রে এর প্রকৃতি কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। সম্পদ অর্জনের পন্থাগুলোই হচ্ছে সেই কারণ যা প্রারম্ভিক পর্যায়ে ব্যক্তিকে সম্পত্তির মালিকানা প্রদান করে। কোন প্রকারের বিনিময়কে সম্পদের মালিকানা লাভের পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এটি শুধুমাত্র সম্পত্তির অংশবিশেষ হিসেবে কোন পণ্য প্রদানের মাধ্যমে আরেকটি পণ্যের মালিকানা অর্জনের উপায়, আর এক্ষেত্রে সম্পত্তি মূলতঃ অর্জিতই থাকে এবং এর কিছু অংশবিশেষের বিনিময় হয়। সম্পদ বিনিয়োগ, যেমন: ব্যবসার লভ্যাংশ, বাড়ীর ভাড়া, কিংবা ফসল – এগুলোও একইভাবে সম্পদ অর্জনের পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয় না। যদিওবা এই বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন কিছু সম্পদের সৃষ্টি হচ্ছে তথাপি এই সম্পদ অন্য একটি সম্পত্তি থেকে উৎপন্ন হয়েছে, সুতরাং বিনিয়োগ হচ্ছে সম্পদ বৃদ্ধির একটি পন্থা, সম্পদ অর্জনের পন্থা নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সম্পদের প্রারম্ভিক মালিকানা অর্জন, ভিন্ন শব্দে: প্রকৃত সম্পদ অর্জন।

মালিকানা অর্জনের উপায় এবং ইতিমধ্যেই মালিকানাধীন সম্পত্তি বিনিয়োগের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে: প্রকৃত সম্পত্তি আহরণের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে সম্পদ অর্জন বা অধিকার করাই হল মালিকানা অর্জন। অন্যদিকে, মালিকানাধীন সম্পত্তি বিনিয়োগের অর্থ হল অধিকারে বা দখলে থাকা সম্পত্তি বৃদ্ধি পাওয়া। এক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই সম্পত্তি অধিকারে বা দখলে রয়েছে, তবে তা বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্পদ অর্জন এবং মালিকানাধীন সম্পত্তির বিনিয়োগ – উভয়ের ব্যাপারে শারী’আহ্ হুকুম বিদ্যমান। বিক্রয় ও ইজারা চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুমসমূহ বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত এবং শিকার ও নীরব অংশীদারিত্বের মত কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুমসমূহ সম্পত্তির মালিকানা অর্জনের সাথে সম্পর্কিত। একইভাবে, মালিকানা অর্জনের পন্থাগুলোই প্রকৃত সম্পদ অর্জনের মাধ্যম। আর মালিকানায় থাকা সম্পত্তি বিনিয়োগের পন্থাগুলোই সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যম, যা ইতিমধ্যেই মালিকানা লাভের কোন একটি পন্থার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

সম্পদের মালিকানার জন্য ঐশী কারণ বিদ্যমান, যা আইনপ্রণেতা সুনির্দিষ্ট কিছু উপায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। এই কারণসমূহের ক্ষেত্রে সীমালংঘন করা যাবে না। অতএব, সম্পদের মালিকানা অর্জনের পন্থাগুলো শারী’আহ্ প্রদত্ত হুকুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সম্পদ অথবা প্রাপ্ত উপযোগের ভিত্তিতে বিবেচিত সুনির্ধারিত হুকুম বা হুকুম শারী’আহ্ হিসেবে পূর্বে উল্লেখিত সম্পত্তির সংজ্ঞানুসারে সম্পদের মালিকানা লাভের জন্য আইনপ্রণেতার অনুমোদন প্রয়োজন। অন্য কথায়, মালিকানা অর্জনের জন্য অনুমোদিত পন্থাটি শারী’আহ্র মধ্যে উল্লেখ থাকতে হবে। যদি মালিকানা লাভের বৈধ পন্থা অনুসৃত হয়ে থাকে তবে সম্পত্তির মালিকানা বিদ্যমান থাকবে এবং যদি মালিকানা অর্জনের বৈধ পন্থা না থাকে তবে সম্পত্তির মালিকানার অস্তিত্বও থাকবে না, যদিওবা একজন ব্যক্তি সেই সম্পদের মালিক হয়ে থাকে। অতএব, মালিকানা হল আইনপ্রণেতা কর্তৃক অনুমোদিত ঐশী পন্থার মাধ্যমে কোন সম্পত্তি অধীনে থাকা। শারী’আহ্ মালিকানা লাভের উপায়কে অনিয়ন্ত্রিত নয়, বরং সুনির্দিষ্টভাবে পরিষ্কার কিছু পন্থার দ্বারা নিধারিত করে দিয়েছে। শারী’আহ সুস্পষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে এই পন্থাগুলো তুলে ধরেছে। অনেকগুলো অধ্যায়ের সমন্বয়ে এগুলো গঠিত হয়েছে, আর এ অধ্যায়গুলো হচ্ছে এই পন্থাগুলোর শাখা-প্রশাখা ও হুকুমসমূহ সুস্পষ্টকরণের জন্য প্রদত্ত ব্যাখ্যা। শারী’আহ্ এই পন্থাগুলোকে কিছু সাধারণ মানদন্ড দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেনি, সুতরাং অন্য কোন সাধারণ পন্থাকে সাদৃশ্যতার ভিত্তিতে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এটা একারণে যে, নতুন চাহিদা শুধুমাত্র উৎপাদিত সম্পদের উপর, লেনদেনের উপর নয়; অর্থাৎ সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থার মধ্যে এটি অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং এটা সম্পর্কের উপজীব্য বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। অতএব, লেনদেনকে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা জরুরী যা নতুন ও বিভিন্ন ধরনের চাহিদার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, এছাড়াও এটিকে সম্পত্তির ক্ষেত্রে সম্পদ হিসেবে ও কাজের ক্ষেত্রে কাজ হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গী ব্যক্তি মালিকানাকে এমনভাবে নিরূপণ করে যা মানুষের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি এমনভাবে মালিকানাকে সুসংগঠিত করে যাতে মালিকানা অর্জনের পন্থা অনিয়ন্ত্রিত রাখার ফলে উদ্ভুত বিপদ হতে সমাজকে সুরক্ষিত রাখা যায়। বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির একটি দিক হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের আকাঙ্খা, যেমনিভাবে যৌন প্রবৃত্তির একটি দিক হলো বিয়ে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পনের প্রবৃত্তির একটি দিক হলো উপাসনার আচার-আনুষ্ঠানাদি। যদি প্রবৃত্তির এসব দিকগুলোকে যথেচ্ছভাবে পূরণ করতে দেয়া হয় তবে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে এবং মানুষ সেগুলোকে অস্বাভাবিক ও ভুলপথে পূরণ করার দিকে ধাবিত করবে। অতএব, যে পন্থায় মানুষ সম্পদ অর্জন করবে সেটি নির্ধারণ করে দেয়া জরুরী, যাতে করে উম্মাহ্’র ছোট একটি অংশ সম্পত্তির উপকরণ ব্যবহার করে উম্মাহ্’কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে এবং অধিকাংশ জনগণ যেন তাদের চাহিদা পূরণে বঞ্চিত না হয়; এবং সম্পদ যাতে কেবলমাত্র সম্পদ আহরণের নিমিত্তেই উপার্জিত না হয়, অন্যথায় মানুষ সুখকর জীবন হারিয়ে ফেলবে; আর একারণে কেবলমাত্র সঞ্চয় করার জন্য মানুষ সম্পদ অর্জন করলে তা প্রতিহত করা হবে। একইভাবে, সম্পদের মালিকানা লাভের পন্থাগুলোও নির্ধারিত করে দেয়া প্রয়োজন। সম্পদের মালিকানা সংক্রান্ত আহকামে শারী’আহ্ বা ঐশী বাণী পর্যবেক্ষণ করলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মালিকানা অর্জনের পন্থাগুলোকে ৫টি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে:

১. কাজ।
২. উত্তরাধিকার।
৩. জীবন ধারণের জন্য সংগৃহীত সম্পদ।
৪. নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক মঞ্জরিকৃত সম্পদ।
৫. সম্পত্তি বিনিময় বা কাজ ব্যতিরেকে ব্যক্তি কর্তৃক গৃহীত সম্পদ।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply