অধ্যায় ৪: মালিকানা লাভের প্রথম উপায়: কাজ (’আমাল)

যেকোন ধরনের সম্পত্তি নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সেগুলো অর্জনের জন্য কাজ করা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে সম্পত্তিসমূহ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যেতে পারে, যেমন: মাশরুম, কিংবা সেগুলো মানুষের শ্রম দ্বারা তৈরী হতে পারে, যেমন: এক টুকরো রুটি বা একটি গাড়ি।

’আমাল (কাজ) শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার অনেকগুলো ধরন ও রূপ এবং ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল বিদ্যমান। সেজন্য শারী’আহ্ ’আমাল বা কাজ শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা ব্যতিরেকে এটির প্রচলিত ধ্রুপদী অর্থের উপর ছেড়ে দেয়নি। এছাড়াও, শারী’আহ্ ’আমাল শব্দটিকে সাধারণভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি, বরং বিশেষ কিছু কাজ হিসেবে এটিকে উপস্থাপিত করেছে। এটি কাজের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং সেগুলোই মালিকানা অর্জনের উপায় হিসেবে অনুমোদিত হয়েছে। কাজ সম্পর্কিত ঐশী হুকুমসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সম্পত্তি অর্জনের উপায় হিসেবে আইনগতভাবে বৈধ কাজসমূহ নিম্নরূপ:

১. অব্যবহৃত (নিষ্ফলা) ভূমির চাষাবাদ
২. ভূ-গর্ভে বা বাতাসের মধ্যে যা পাওয়া যায় তা আহরণ করা
৩. শিকার
৪. দালালি (সামসারা) এবং কমিশন এজেন্ট (দালালা)
৫. শ্রম ও মূলধনের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব (মুদারাবা)
৬. বর্গাচাষ (মুসাকাত)
৭. পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের জন্য কাজ করা

নিষ্ফলা জমিতে চাষাবাদ (ইহ্ইয়া উল-মাওয়াত)

নিষ্ফলা জমি (মাওয়াত) হলো এমন এক ধরনের ভূমি যার কোন মালিক নেই এবং যা থেকে কেউ উপযোগ লাভ করছে না। এতে চাষাবাদের অর্থ হলো বৃক্ষরোপন করা, বনায়ন করা বা এর উপর ইমারত নির্মাণ করা। ভিন্নভাবে বলা যায় যে, জমিটির যে কোন প্রকারের ব্যবহারের অর্থই হলো সেটিকে আবাদ করা (ইহ্ইয়া)। কেউ এ ধরনের ভূমি আবাদ করলে সে এর মালিক হিসেবে পরিগণিত হবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:

“যে ব্যক্তি কোনো নিষ্ফলা জমিতে আবাদ করবে সেটি তার হয়ে যাবে।”

তিনি (সা) আরও বলেছেন:

“যে ব্যক্তি কোন একটি ভূমিকে বেড়া দ্বারা ঘেরাও করে ফেলে সেটি তার।”

এবং, তিনি (সা) বলেছেন:

“অন্য কোন মুসলিমের পূর্বে যে কেউ কোন কিছুর উপর হাত রাখলে সেটা তার হয়ে যাবে।” এক্ষেত্রে একজন মুসলিম ও জিম্মীর (ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিক) মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, কেননা এ হাদিসটি কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা ছাড়া অর্থগত দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ; এবং যেহেতু একজন জিম্মী উপত্যকা, বন এবং পাহাড়ের উপর থেকে যাই গ্রহণ করুক না কেন সেটি তারই, সেহেতু সেগুলো তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অনুমোদিত নয়। নিষ্ফলা জমি তার সম্পত্তি হওয়ার ক্ষেত্রেও হাদিসটি প্রযোজ্য। সব ভূমির ক্ষেত্রেই এই নিয়ম সাধারণভাবে প্রযোজ্য – হোক সেটা দারুল ইসলাম বা দারুল হারব্, কিংবা উশরী বা খারাজী ভূমি। তবে মালিকানা লাভের শর্ত হলো যে, জমিটি অধীনে আসার পর তিনবছরের মধ্যে সেটিতে কাজ করতে হবে এবং ব্যবহারের মাধ্যমে জমিটির আবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। যদি কেউ জমি অধিকারে আসার প্রম তিন বছরের মধ্যে আবাদ না করে, বা পরবর্তীতে টানা তিন বছর ব্যবহার না করে তবে সে সেটির মালিকানার অধিকার হারাবে। উমর বিন আল-খাত্তাব (রা.) বলেছেন: “কোন ব্যক্তি জমিতে বেড়া দিয়ে মালিকানা অর্জন করতে পারে, তিন বছর পর্যন্ত অনাবাদী রাখলে সে জমিটির মালিকানা হারাবে।” অন্যান্য সাহাবাদের (রা.) উপস্থিতিতে উমর (রা.) এই উক্তি করেছিলেন এবং এই আইন প্রয়োগ করেছিলেন, সাহাবীরা (রা.) এ ব্যাপারে কোন আপত্তি করেননি – যা তাদের ইজমাকে সুনিশ্চিত করে।

ভূগর্ভে যা আছে আহরণ

আরেক প্রকারের কাজ হচ্ছে ভূ-গর্ভ হতে এমন ধরনের সম্পদ আহরণ করা যা কোন সম্প্রদায়ের টিকে থাকার নিয়ামক নয়, এগুলো লুক্কায়িত বা গুপ্তধন হিসেবে পরিচিত (রিকায্)। ফিকহ্-এর ব্যবহৃত পরিভাষা অনুসারে এ ধরনের সম্পদে মুসলিমদের সামষ্টিক কোনো অধিকার থাকে না। বরং, যদি কেউ কোন গুপ্তধন খুঁজে পায় তবে সেটার চার-পঞ্চমাংশ ঐ ব্যক্তির এবং অবশিষ্ট এক-পঞ্চমাংশ যাকাত হিসেবে গণ্য হবে।

তবে এটি যদি কোনো সম্প্রদায়ের সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় হয় এবং সামষ্টিকভাবে মুসলিমদের অধিকার হয় তাহলে এটি গণমালিকানাধীন সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। যা এই বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে তা হলো, যদি কোনো সম্পদ মানুষ যমিনে লুকিয়ে রাখে, কিংবা এর পরিমাণ এতো সামান্য যে তা সম্প্রদায়ের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়, তবেই এটি গুপ্তধন হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে যা আদতে ভূ-গর্ভস্থ ছিল এবং সম্প্রদায়ের সকলের প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তা রিকায্ নয় বরং গণমালিকানাধীন সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে, যা সত্যিকারভাবে মাটিতে পাওয়া যায় এবং সকলের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, যেমন: পাথরের খনি, যা থেকে দালান নির্মানের পাথর এবং এজাতীয় কোন কিছু তৈরী হয়, তা রিকায্ বা গণমালিকানাধীন সম্পত্তি কোনটি হিসেবেই বিবেচিত হবে না, বরং তা ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। রিকায্-এর মালিকানা লাভ এবং এর এক-পঞ্চমাংশ যাকাত হিসেবে প্রদানের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, আমর ইবনে শু’য়াইব তার পিতার কাছ থেকে ও তার পিতা তার দাদার কাছ থেকে আল-নিসাইতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্’কে (সাঃ) লুকাতাহ্ (যা মাটি থেকে সংগৃহীত হয়) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি (সাঃ) বলেন:

“যদি এটা কোনো ব্যবহৃত রাস্তা বা মানববসতিপূর্ণ গ্রাম থেকে সংগৃহীত হয়ে থাকে তাহলে তোমাকে এ ব্যাপারে বর্ণনা দিতে হবে এবং ঘোষণা দিয়ে একবছর কাল অপেক্ষা করতে হবে। যদি এর মালিক একে শনাক্ত করতে পারে তাহলে এটি তার জিম্মায় চলে যাবে, অন্যথায় এটি তোমার। আর যদি এটি কোন ব্যবহৃত রাস্তা বা মানববসতিপূর্ণ গ্রাম থেকে সংগৃহীত না হয় তাহলে এটির এক-পঞ্চমাংশ যাকাত হিসেবে দিতে হবে এবং গুপ্তধনের (রিকায্) ক্ষেত্রেও একই বিষয়।”

অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের মতো বাতাসে মিশে থাকা কোন কিছু সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, সেগুলোকে ভূ-গর্ভস্থ হতে উৎপাদিত বস্তুসমূহের মতো একইভাবে বিবেচনা করা হয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক সৃষ্ট যে জিনিসকে শারী’আহ্ মুবাহ্ ঘোষণা করেছে এবং যেটির ব্যবহার সীমাবদ্ধ করে দেয়নি সেটির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

শিকার

শিকার করা হচ্ছে আরেক ধরনের কাজ। মাছ, মুক্তা, প্রবাল, স্পঞ্জ (এক প্রকার সামুদ্রিক প্রাণী) এবং অন্যান্য শিকার হওয়া প্রাণীর মালিকানা লাভ করবে শিকারী; পাখি বা পশু, কিংবা যমিন হতে শিকার করা কোন কিছুর মালিকও হবে শিকারকারী ব্যক্তি। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

“তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও সমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে তোমাদের উপকারার্থে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এহরামরত অবস্থায় থাকততক্ষণ পর্যন্ত হারাম করা হয়েছে স্থল শিকার।”
[সূরা মায়িদাহ্: ৯৬]

এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:

“যখন তোমরা এহরাম ভেঙ্গে ফেল, তখন তোমাদের জন্য শিকার করা অনুমোদিত।”
[সূরা মায়িদাহ্: ২]

এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন:

“তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, কি বস্তু তাদের জন্য হালাল? বলে দিন: তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে। যেসব শিকারী জন্তুকে তোমরা প্রশিক্ষণ দান করো শিকারের প্রতি প্রেরণের জন্যে এবং ওদেরকে ঐ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দাও, যা আল্লাহ্ তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমন শিকারী জন্তু যে শিকারকে তোমাদের জন্যে ধরে রাখে, তা খাও এবং তার উপর আল্লাহ্’র নাম উচ্চারণ করো…”
[সূরা মায়িদাহ্: ৪] ।

এবং আবু সা’লাবা আল-খাসনী বর্ণনা করেছেন যে,

“আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে গেলাম এবং বললাম: ‘হে আল্লাহ্’র নবী! আমরা শিকারের জন্য উপযোগী ভূমিতে বসবাস করি, আমি তীর এবং প্রশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত কুকুরের মাধ্যমে শিকার করি, সুতরাং আপনি আমাকে বলে দিন যে, এদের কোনটি আমার জন্য অনুমোদিত?” তিনি (সা) বলেন: “তোমার দেয়া বর্ণনা অনুসারে, তুমি একটি শিকার উপযোগী ভূমিতে বসবাস করো; সুতরাং তুমি আল্লাহ্’র নামে তোমার তীর দিয়ে যা শিকার করো তা থেকে ভক্ষণ করো, এবং তুমি যদি আল্লাহ্’র নামে তোমার প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে শিকার করো, তাহলে শিকারের সময় ও সেটি খাবারের সময় আল্লাহ্’র নাম উচ্চারণ করো, এবং তুমি যদি তোমার অপ্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে যদি শিকার করো এবং মৃত্যুর পূর্বে শিকারটিকে সংগ্রহ ও জবাই করতে পারো তবে তা থেকে ভক্ষণ করো।” (আন-নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্ কর্তৃক বর্ণিত)

দালালি এবং কমিশন এজেন্সী (সামসারা এবং দালালা)

দালাল হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি যাকে অন্যান্য ব্যক্তি তাদের পক্ষ হয়ে কোন কিছু ক্রয় বা বিক্রয়ের জন্য নিয়োগ করে থাকে। একজন কমিশন এজেন্টকেও এভাবেই নিয়োগ দেয়া হয়। সামসারা (দালালি) হল এমন এক ধরনের কাজ যার মাধ্যমে কোন সম্পত্তি বৈধভাবে অধিকৃত হয়। আবু দাউদ তার সুনানে উল্লেখ করেছেন যে, কায়েস ইবনে আবু ঘুরজা আল-কাননী বলেছেন:

আমরা মদীনাতে আউসাক (বোঝাই করা মালামাল) ক্রয় করতাম এবং নিজেদেরকে দালাল বলে অভিহিত করতাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের কাছে আসলেন এবং আমাদেরকে আগের চেয়ে উত্তম একটি নামে ডাকলেন। তিনি (সা) বলেন: “হে বণিকগণ, সাধারণত ব্যবসা হচ্ছে মূর্খ কথাবার্তা ও শপথের কালিমাযুক্ত, সুতরাং একে সাদাকার সাথে মিশ্রিত করো।” এর অর্থ হলো, ব্যবসায়ীরা তার পণ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে এমনভাবে সীমালঙ্ঘন করে যে, তা মূর্খতার পর্যায়ে পড়ে যায় এবং পণ্যকে বিক্রয় করার জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ফেলে। তাই তার কাজের প্রতিফল থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাদাকা দেয়া অধিকতর পছন্দনীয়। ক্রয়-বিক্রয়ের যে কাজের জন্য লোকটি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সেটি সুনির্দিষ্ট হতে হবে, এটি হতে পারে পণ্যের ভিত্তিতে কিংবা সময়ের ভিত্তিতে। সুতরাং, কেউ যদি একটি বাড়ী বা কোন সম্পত্তি বিক্রয় বা ক্রয় করার জন্য কাউকে একদিনের জন্যও নিয়োগ দেয় তবে সেটি বৈধ হবে। কিন্তু সে যদি অনির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য কাউকে নিয়োগ দেয় তবে তা অবৈধ হবে।

নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির কিছু কাজের ক্ষেত্রে দালালি প্রযোজ্য নয়। যেমন: এক ব্যবসায়ী অন্য আরেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করার জন্য একজন এজেন্ট নিয়োগ দিলো, এবং বিক্রেতা তার কাছ থেকে ক্রয় করার প্রতিদানে এজেন্টকে কিছু অর্থ প্রদান করলো। যদি এজেন্ট এই অর্থ পণ্যের মূল্য থেকে বাদ না দিয়ে নিজের জন্য কমিশন হিসেবে রেখে দেয় তবে শারী’আহ্ এটিকে দালালি হিসেবে অনুমোদন দেয় না, কারণ নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি ব্যবসায়ীর জন্য একজন এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, তাই পণ্যের মূল্য যতটুকু কমানো হয় তা নিয়োগকারী ব্যবসায়ীর জন্য, এজেন্টের জন্য নয়। অতএব, এজেন্টের জন্য এই অর্থ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ, কারণ তা ক্রেতার অধিকারভুক্ত, যদি ক্রেতা তা গ্রহণের অনুমতি প্রদান করে তবেই তা গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে।

একইভাবে, যদি কোনো ব্যক্তি একটি পণ্য ক্রয় করার জন্য তার বন্ধু বা ভৃত্যকে প্রেরণ করে এবং বিক্রেতা তার কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করার জন্য বন্ধু বা ভৃত্যকে কোনো সম্পত্তি প্রদান করে, অর্থাৎ কমিশন প্রদান কওে তবে সে বন্ধু বা ভৃত্যের জন্য তা গ্রহণ করা অনুমোদিত নয়, কারণ সেটা দালালি নয়, বরং সেটা প্রেরণকারী ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে চুরি হিসেবে বিবেচিত হবে। এর কারণ হলো, এ সম্পত্তি তারই যে তাকে ক্রয় করতে পাঠিয়েছে এবং কখনই যাকে পাঠানো হয়েছে তার জন্য নয়।

মুদারাবা

মুদারাবা হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির ব্যবসায় অংশগ্রহণ, যাতে একজন মূলধন এবং অন্যজন শ্রম বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তির শ্রমের সাথে আরেকজন ব্যক্তির সম্পত্তি অংশীদারিত্বে উপনীত হয়। এর অর্থ হচ্ছে যে, একজন কাজ করবে এবং অন্যজন সম্পত্তি বিনিয়োগ করবে। সুনির্দিষ্ট পরিমাণে লাভ ভাগাভাগি করে নেয়ার ব্যাপারে দু’জন অংশীদার একমত হয়। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, যখন একজন ব্যক্তি এক হাজার পাউন্ড বিনিয়োগ করে ও অন্যজন সেটা দিয়ে কাজ করে এবং প্রাপ্ত লাভ তাদের দু’জনের মধ্যে বন্টিত হয়। শ্রম বিনিয়োগকারী অংশীদারকে অর্থ হস্তান্তর করতে হবে এবং অর্থের উপর তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, কারণ মুদারাবাতে শ্রম বিনিয়োগকারী ব্যক্তিকে সম্পত্তি হস্তান্তর করে দিতে হয়। শ্রম বিনিয়োগকারী অংশীদার সম্পদ বিনিয়োগকারী অংশীদারের উপর এমন শর্তারোপ করতে পারে যে, লভ্যাংশের এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক তাকে দিতে হবে, কিংবা লভ্যাংশের সুনির্দিষ্ট অংশ ভাগ করে নেয়ার ব্যাপারে তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। এটি একারণে যে, মুদারিব বা শ্রম বিনিয়োগকারী অংশীদার তার কাজের জন্য লভ্যাংশে অধিকার দাবী করতে পারে। অতএব, অংশীদারদের জন্য এটা অনুমোদিত যে তারা মুদারিবের অল্প অথবা অধিক পরিমাণ লভ্যাংশ প্রাপ্তির বিষয়ে একমত হতে পারে। সুতরাং, মুদারাবা এমন এক ধরনের কারবার যা মালিকানা অর্জনের বৈধ পন্থা। এর ফলে মুদারিব সম্পত্তির মালিকানা লাভ করতে পারে, যা সে পারষ্পরিক ঐক্যমত্য অনুযায়ী কাজ করে মুদারাবার মাধ্যমে লভ্যাংশ হিসেবে অর্জন করে থাকে।

মুদারাবা হচ্ছে একধরনের কোম্পানী, কারণ এটা হচ্ছে শ্রম ও সম্পদেও অংশীদারিত্ব। শারী’আহ্ কর্তৃক অনুমোদিত লেনদেনসমূহের একটি হচ্ছেএধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। আবু হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:

“আল্লাহ্ বলেন: ‘দুইজন অংশীদারের মধ্যে আমি তৃতীয়জন, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন আরেকজনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে। যদি তাদের একজন আরেকজনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে আমি নিজেকে সেখান থেকে অপসারণ করে নেই।”

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:

“আল্লাহ্’র হাত ততক্ষণ পর্যন্ত দুইজন অংশীদারের উপর থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পরস্পরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে।”

আল-আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব বর্ণনা করেছেন যে, যখন তিনি কোনো সম্পত্তি মুদারাবা হিসেবে হস্তান্তর করেন তখন তিনি মুদারিবের উপর শর্তারোপ করতেন যে, এটি নিয়ে সে সমুদ্রে ভ্রমণ করতে পারবে না, কোনো উপত্যকায় অবরোহণ করতে পারবে না, কিংবা জীবন্ত কোনো কিছু নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না, অন্যথায় সে নিশ্চিতভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ ব্যাপারে জানতেন এবং তিনি (সা) এটিকে অনুমোদন দিয়েছেন। সাহাবীগণ (রা.) নিরঙ্কুশভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, মুদারাবা অনুমোদিত। সাধারণত উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা.) এতিমদের সম্পত্তি মুদারাবা হিসেবে হস্তান্তর করতেন। উসমান ইবনে আফফান (রা.) কিছু সম্পত্তি মুদারাবা হিসেবে এক ব্যক্তিকে হস্তান্তর করেন। সুতরাং, মুদারিব অন্য একজনের সম্পত্তিকে ব্যবহার করে সম্পত্তি অর্জন করে থাকে। অতএব, মুদারিব কর্তৃক সম্পাদিত মুদারাবা হচ্ছে একধরনের কাজ এবং মালিকানা অর্জনের একটি বৈধ পন্থা। সম্পদের মালিকের জন্য এটি মালিকানা অর্জনের পন্থা নয়, বরং এটি মালিকানা বিনিয়োগের একটি মাধ্যম।

বর্গাচাষ (মুসাকাত)

কাজের আরেকটি ধরন হচ্ছে মুসাকাত, যাতে একজন ব্যক্তি তার গাছসমূহকে সেচ প্রদান ও তত্ত্বাবধান করার জন্য কারো কাছে সেগুলো হস্তান্তর করে এবং এর বিনিময়ে তাকে গাছগুলো থেকে প্রাপ্ত ফলের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ প্রদান করে। এটাকে বলা হত মুসাকাত (পারিভাষিক অর্থ সেচকার্য), কেননা এটি সেচকার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট; হিজাজের লোকদেও গাছে প্রচুর পরিমাণে সেচ প্রয়োজন হতো, আর তারা তা কূপ থেকে সংগ্রহ করতো। মুসাকাত এমন এক ধরনের কাজ যা শারী’আহ্ কর্তৃক অনুমোদিত।

মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) বলেছেন:

“রাসূলুল্লাহ্ (সা) খায়বারের লোকদের সাথে অর্ধেক ফল ও বৃক্ষের ভিত্তিতে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন।”

মুসাকাত সাধারণত তাল গাছ ও লতাজাতীয় গাছের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য – যার ফসলের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ শ্রমিকদেরকে দেয়া হয়। এটা শুধুমাত্র ফলবান গাছের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেসব গাছে ফল উৎপন্ন হয় না, যেমন: উইলো, কিংবা ফল হলেও তা সংগ্রহ করা হয় না, যেমন: পাইন ও সিডার, সেগুলোর ক্ষেত্রে মুসাকাত প্রযোজ্য নয়, কারণ মুসাকাত ফলের একটি অংশের জন্য প্রযোজ্য এবং এ ধরনের গাছ হতে কোনরূপ ফল অন্বেষন করা হয় না। কিন্তু যেসব গাছ হতে পাতা অন্বেষণ করা হয়, যেমন: তুঁত ও গোলাপ গাছ, সেগুলোর ক্ষেত্রে মুসাকাত প্রযোজ্য, কারণ এগুলোর পাতা ফলের সমপর্যায়ের। এগুলো থেকে বছরান্তে ফসল পাওয়া যায় এবং এগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব, এবং এগুলোর একটি অংশের বিনিময়ে মুসাকাতে প্রবেশ করা যায়, আর একারণে ফলের মতই এক্ষেত্রে একই হুকুম প্রযোজ্য।

একজন কর্মচারী বা শ্রমিককে নিয়োগ প্রদান

ইসলাম একজন ব্যক্তিকে তার হয়ে কাজ করার জন্য কর্মচারী ও শ্রমিক, অর্থাৎ কর্মী নিয়োগ করার অনুমতি প্রদান করেছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

“এই পৃথিবীতে আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বন্টন করেছি এবং একের পদমর্যাদাকে অপরের উপর উন্নীত করেছি, যাতে কিছু ব্যক্তি অপরকে তাদের কাজে নিয়োগ দিতে পারে…”
[সূরা যুখরুফ: ৩২]

ইবনে শিহাব বর্ণনা করেছেন যে, উরওয়াহ্ ইবনে আজ-জুবায়ের বলেছেন যে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন:

“রাসূলুল্লাহ্ (সা) এবং আবুবকর (রা.) বনু আদ-দীল থেকে অভিজ্ঞ পথ নির্দেশক হিসেবে এক ব্যক্তিকে ভাড়া করেছিলেন, যে তখনও কুরাইশদের কুফফার দ্বীনের মধ্যে ছিল। তারা তার কাছে তাদের দু’টি ভারবাহী মাদী উট হস্তান্তর করলেন এবং তিনরাত পর সকালবেলা দু’টি উটসহ সাওর-এর গুহায় তাদের সাথে সাক্ষাতের সময় ধার্য করলেন।”

এছাড়াও, আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:

“যদি তারা তোমাদের সন্তানদেরকে স্তন্যদান করে, তবে তাদেরকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেবে।”
[সূরা ত্বালাক: ৬]

আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, “রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:

“আল্লাহ্ আজ ওয়া যাল্লা বলেন: বিচার দিবসে আমি তিন ধরনের ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হবো: একজন হলো সে ব্যক্তি যে আমার নামে কাউকে কোনো কথা দিলো এবং পরবর্তীতে তা ভঙ্গ করলো, যে একজন আজাদ ব্যক্তিকে বিয়ে করলো এবং এর মূল্য গ্রাস করল এবং যে ব্যক্তি কোনো কাজের জন্য কাউকে ভাড়া করলো এবং পুরো শ্রম দেয়ার পরও তাকে তার পারিশ্রমিক দিলো না।”

নিয়োগ প্রদানের অর্থ হচ্ছে, নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়োগকারীকে কোন সুবিধা প্রদান করে এবং এর বিনিময়ে নিয়োগকারী হতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি সম্পদ লাভ করে। সুতরাং এটিকে এমন একটি চুক্তি হিসেবে বর্ণনা করা যায় যেখানে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিনিময়ে উপযোগ (কাজ হতে প্রাপ্ত সুবিধা) পাওয়া যায়। শ্রমিকের কাজের উপযোগের উপর ভিত্তি করে অথবা শ্রমিকের উপকারিতার কথা বিবেচনা করে একজন শ্রমিককে ভাড়া করার চুক্তি করা হয়। যদি চুক্তিটি কাজের উপযোগের উপর নির্ভর করে সম্পাদন করা হয় তবে চুক্তিকৃত বিয়য়টি হলো কাজ দ্বারা সৃষ্ট উপযোগ, যেমন: কোন বিশেষ কাজের জন্য কারিগর ভাড়া করা, পরিচ্ছনতা কর্মী ভাড়া করা, কামার বা ছুতার ভাড়া করা। তবে চুক্তিটি যদি ব্যক্তির নিজস্ব মানবীয় উপযোগিতার কথা বিবেচনা করে করা হয় তাহলে চুক্তির বিষয়বস্তু হলো ব্যক্তির উপযোগিতা, যেমন: একজন ভৃত্যকে ভাড়া করা এবং এধরনের সকল শ্রমিক। এ ধরনের চুক্তিতে শ্রমিক নিয়োগকারীর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে কাজ করে, যেমন: যে ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে একটি কারখানা বা বাগানে কাজ করে, কিংবা একজন কৃষক। সরকারী কর্মচারীরা এর আওতায় পড়ে। বিকল্পভাবে, একটি সুনির্দিষ্ট কাজের বিষয়ে তার দক্ষতা থাকতে পারে, মজুরির বিনিময়ে যেকোন ব্যক্তির জন্য কাজটি সে করে দিতে পারে। এ ধরনের কাজের উদাহরণ হলো ছুতার, দর্জি ও মুচীর কাজ। প্রম ধরনের কাজ হলো ব্যক্তি পর্যায়ের কাজ এবং দ্বিতীয় ধরনের কাজ হল সাধারণ শ্রম।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply