“যারা আল্লাহ’কে ছেড়ে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তাদের দৃষ্টান্ত ঐ মাকড়সার ন্যায়, যেটি একটি ঘর বানিয়েছে; এবং নিঃসন্দেহে সব ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই অধিক দুর্বল। যদি তারা জানত।” [সূরা আনকাবুত : ৪১]
আমরা সকলেই মুসলিম দেশসমূহের এবং অন্যান্য দেশের জনগণের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছি। বর্তমানে পুরো বিশ্বজুড়ে মুসলিম, অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই যে অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছে তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আর এই অবিচারের ব্যাপকতা অর্থনীতি, শিক্ষা এবং অধিকার হতে শুরু করে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেও পরিব্যপ্ত হয়েছে।
সমগ্র বিশ্বেই এই ভয়াবহ অবস্থার মাত্রা একইরকম।
জনগণের জীবনযাত্রাকে সহজ করে তোলার কাজে এই গণতান্ত্রিক ব্যবসা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মুসলিম হিসেবে আমার এবং আমাদের সকলের আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) যা বলেছেন তা উপলব্ধি করা উচিত:
“এবং আমি আপনার প্রতি কিতাব (কুর’আন) নাযিল করেছি যা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা; যা হেদায়েত, রহমত ও সুসংবাদ মুসলিমদের জন্য।” [সূরা নাহ্ল : ৮৯]
বর্তমানে যখন পশ্চিমা গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদরা ইসলামকে দমনমূলক, হিংস্র এবং সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা হিসেবে ক্রমাগত আক্রমণ করে যাচ্ছে, তখন এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা ইসলামকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করব এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করে দেব। এবং, স্পষ্টভাবে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য এই সমস্যার ইসলামী সমাধান, কিংবা এই পরিস্থিতির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা আবশ্যক।
এসব সমস্যার জন্য প্রদত্ত ইসলামী সমাধানকে আমি সুনির্দিষ্ট মানদন্ডের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করব যা যেকোন সভ্য সমাজের থাকা উচিত:
১. যেকোন সমাজে নেতৃবৃন্দ অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে এবং তারা তাদের সকল কাজের জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখীন হবে।
২. সংবিধানের আনুগত্যকারী সকল রাজনৈতিক দলকে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার আওতার মধ্যে কর্মকান্ড পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে।
৩. শুধুমাত্র ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব না করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত সকল মানুষের স্বার্থ দেখাশোনা করা।
৪. শাসনকার্যে নিয়োজিত নির্বাহী হতে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হতে হবে যা তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারবে।
৫. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ – সক্ষম কিংবা অক্ষম – নির্বিশেষে সকল নাগরিক রাষ্ট্রের অধীনে সমান অধিকার ভোগ করবে।
৬. কোন ব্যক্তি কিংবা দল আইনের উর্দ্ধে নয়।
৭. বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার, অন্তরীণ, নির্যাতন এবং অস্বাভাবিক শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
পশ্চিমা রাজনৈতিক মূল্যবোধসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ সার্বজনীন নয় এবং সুশাসনের মানদন্ড পূরণে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। নিজেদের নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতার দম্ভোক্তি করা সাজে না, কারণ বর্তমান বাস্ত্মবতায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই অধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক সব ঘটনাসমূহ ঘটছে, যার মধ্যে রয়েছে নির্যাতন অনুমোদন, হুমকি ও নজরদারির মধ্যে সমাজের মানুষের দিনাতিপাত এবং ভূলুন্ঠিত অধিকার। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকারসমূহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জালিম শাসকগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
আসুন, এবার আমরা ইসলামী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করি।
সর্বপ্রথমে আমি বলতে চাই যে: “সুশাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ সুনির্ধারিত ও বিস্ত্মারিত এবং ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অধীনে সেগুলো এককভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।”
সুতরাং, ইসলামী ব্যবস্থায় সুশাসন বলতে কী বোঝায়? “এটা সরকারের সুনির্ধারিত কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে খলিফা (শাসক) জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামী শারী’আহ্ অনুসারে তাদের বিষয়াদি দেখাশোনা করার জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন”।
“যে কারও জন্য এরূপ চিন্তা শুরু করা ভুল হবে যে খিলাফত, কিংবা এখানে আমি যা আলোচনা করছি তা আই.এস.আই.এস-এর মতো দলসমূহ ইসলামী রাষ্ট্র বা দৌলাহ্ ইসলামিয়াহ্’র নামে যা দাবী করছে তা একই বিষয়”, তারা শুধুমাত্র খিলাফত নামটি হাইজ্যাক করেছে এবং তাদের নিজস্ব প্রকল্পের গায়ে সেঁটে দিয়েছে। আর এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।
ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কয়েকটি মৌলিক মূলনীতি রয়েছে; এগুলোর মধ্য হতে দুটি মূলনীতি নিম্নরূপ:
১. শুধুমাত্র ঐশ্বরিক উৎসসমূহ, অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ, ইজ্মা আস্-সাহাবা (সাহাবীদের ঐক্যমত্য) এবং ক্বিয়াস (তুলনীয় সাদৃশ্য) হতে আইন উদ্ভত হয়ে থাকে।
২. কর্তৃত্ব জনগণের হাতে থাকে।
প্রথম মূলনীতিটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বিপরীত, আর দ্বিতীয় মূলনীতিটি স্বৈরতন্ত্রের বুনিয়াদী বৈশিষ্ট্যের মূলে আঘাত হানে।
এর অর্থ হচ্ছে যে, জনগণই শাসনের কর্তৃত্ব ধারণ করে এবং তারা শাসকের (খলিফার) সাথে এরূপ চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে শাসক তাদেরকে কুর’আন ও ‘র ভিত্তিতে শাসন করবে, এই চুক্তি বা বাই’আহ্ এটা নির্দেশ করে যে – শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী জনগণকে শাসন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে শাসন করতে পারবে। সুতরাং, জনগণের পক্ষ হতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে শাসক নিয়োগ করা হয়।
জনগণের পক্ষ হতে শাসকের প্রতি অবশ্যই সমর্থন থাকতে হবে, নতুবা সে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং, সে নিজেকে জনগণের উপর শাসক হিসেবে চাপিয়ে দিতে পারবে না। খিলাফত রাষ্ট কোন ধরনের ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্র নয় যা ধর্মীয় ক্ষমতাবলে জনসাধারণের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়।
নিম্নোক্ত সাতটি আলোচ্য বিষয়ের ভিত্তিতে ইসলামী ব্যবস্থার সুশাসনকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে :
১. যেকোন সমাজে নেতৃবৃন্দ অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে এবং তারা তাদের সকল কাজের জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখীন হবে
ইসলামী রাষ্ট্রে একটি উম্মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয় এবং তিনি তার সকল কাজের জন্য সরাসরি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন।
কিভাবে এই জবাবদিহিতা বজায় থাকবে?
একটি স্পন্দনশীল জাগ্রত সমাজ ও রাজনৈতিক দল, স্বাধীন আদালতসহ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানসমূহের উপস্থিতি এবং সুদৃঢ় মূল্যবোধসমূহের মাধ্যমে এই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের (আমর বিল্ মা’রুফ্ ওয়া নাহি আনিল মুন্কার) বিষয়ে অনেকগুলো প্রসিদ্ধ ইসলামী দলিল রয়েছে যেগুলোতে শাসককে জবাবদিহি করার বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তাঁর কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, হয় তুমি সৎকাজের আদেশ কর এবং অসৎকাজের নিষেধ কর, নতুবা শীঘ্রই আল্লাহ (সুব্হানাহু ওয়া তা’আলা) নিশ্চিতভাবেই তোমার উপর শাস্তি পাঠাবেন। তখন তুমি মিনতি করবে, কিন্তু তা গ্রহণ করা হবে না।” (আত-তিরমিযী)
খিলাফত রাষ্ট্রে ‘অন্যায় কাজের আদালত (মাহ্কামাত্ উল্ মাযালিম)’ নামে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থাকবে, যেটি রাষ্ট্রের প্রধান, তার সহকারী কিংবা প্রাদেশিক গভর্ণরদের বিরুদ্ধে আনীত যেকোন অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা রাখে। এমনকি, এই আদালত শাসনকার্য নির্বাহীদের যেকোন সিদ্ধান্ত নিজ উদ্যোগে তদন্ত করে দেখার অধিকার সংরক্ষণ করে, যদিওবা কোন ব্যক্তি সে বিষয়ে কোন অভিযোগ দাখিল না করে থাকে।
২. সংবিধানের আনুগত্যকারী সকল রাজনৈতিক দলকে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার আওতার মধ্যে কর্মকান্ড পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে
অনেক মানুষই সৌদি ও ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করে। কিন্তু, আমাদের বুঝতে হবে যে এই দুটি দেশ ইসলামী রাষ্ট্র নয়, শুধুমাত্র তাদের জনগণ হচ্ছে মুসলিম। সৌদিতে রাজতন্ত্র এবং ইরানে সমন্বিতভাবে কপট-ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও দিব্যতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বিদ্যমান।
বেশিরভাগ রাষ্ট্রের মতো ইসলামী শাসন কাঠামোও নির্দেশ করে যে, রাষ্ট্রের একটি লিখিত সংবিধান থাকা উচিত যা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করবে এবং সেটার আলোকেই ব্যক্তিদেরকে এবং রাজনৈতিক দলসমূহকে সাংবিধানিক গঠনপ্রণালী অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হবে। কিন্তু, ইসলামী সংবিধান অবশ্যই মুক্তবাজার পুঁজিবাদ ও সামাজিক উদারনীতি প্রচারকারী অন্যান্য সংবিধান হতে ভিন্ন হবে। যাহোক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সংবিধানসমূহও (লিখিত কিংবা উহ্য) প্রতিটি ব্যক্তি ও দলকে একই রাজনৈতিক নিয়ম ও ব্যবস্থার মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য করে থাকে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী ব্যবস্থা ভিন্ন নয়।
কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে যে- পশ্চিমা দেশসমূহে কি রাজনৈতিক দলসমূহ ও জনগণ তাদের সরকারকে জবাবদিহি করতে পারে না? এর উত্তর একইসঙ্গে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুটোই। পশ্চিমা দেশসমূহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যাবে যে, ৯/১১-এর ঘটনার পরে যেসব ব্যক্তি তাদের মৌলিক চিন্ত্মাসমূহকে চ্যালেঞ্জ করা শুরম্ন করেছে সেসব মানুষের প্রতি বৃহত্তর পরিসরে অসহনশীলতা প্রদর্শন করা হচ্ছে। এডওয়াড স্নোডেন ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ-এর মতো কেউ যখনই দমনমূলক আইনের বিপক্ষে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে তখন তার প্রতি আমেরিকার সরকার কিরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা লক্ষ্য করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।
ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসকদেরকে এবং তাদের নেয়া সিদ্ধান্তের জবাবদিহি করাকে শুধুমাত্র উৎসাহ প্রদান করা হয়নি, বরং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
কুর’আনে আল্লাহ (সুব্হানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:
“তোমাদের মাঝে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দিবে আর অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং এরাই সফলকাম।” [সূরা আলি ইমরান : ১০৪],
এর অর্থ হচ্ছে যে – উম্মাহ্’র মধ্যে এমন দল থাকতে হবে যেটি শাসককে জবাবদিহি করবে। আমরা এটাও জানি যে, ইসলামের ইতিহাসে শাসককে জবাবদিহিতার, বিতর্কের এবং আলোচনার দীর্ঘ বিবরণী রয়েছে।
সুলাইমান বিন্ আব্দুল মালিক-এর শিবিরে একজন আরব বেদুঈন প্রবেশ করেছিল এবং বলেছিল: “হে আমীরুল মু’মিনিন, আমি আপনার সাথে এমনভাবে কথা বলতে যাচ্ছি যা আপনি অপছন্দ করা সত্ত্বেও সহ্য করুন, কারণ যদি আপনি এটা গ্রহণ করেন তবে আমার এই কথার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আপনি পছন্দ করবেন। তখন তিনি বলেছিলেন:। অতঃপর সে বলেছিল: “বল”
“হে বিশ্বাসীদের আমির, এমন সব ব্যক্তি দ্বারা আপনি পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়াকে ক্রয় করেছে এবং তাদের রব ক্রোধের বিনিময়ে আপনার সন্তুষ্টি কিনেছে, তারা আল্লাহ্র (সুব্হানাহু ওয়া তা’আলা) চেয়ে আপনাকে বেশি ভয় করে, তারা তাদের আখিরাতকে ধ্বংস করেছে ও দুনিয়াকে সাজিয়েছে এবং তারা আখিরাতের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং দুনিয়ার সাথে শান্তি স্থাপন করেছে। সুতরাং, আল্লাহ্ (সুব্হানাহু ওয়া তা’আলা) আপনার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা দিয়ে তাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবেন না, কারণ তারা বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে এবং উম্মাহ্কে অধঃপতিত না করে থামবে না। এর কারণ হল, তাদের অপরাধের জন্য আপনি দায়ী এবং তারা আপনার অপরাধের জন্য দায়ী নয়। সুতরাং, আপনার নিজের আখিরাত ধ্বংস করে তাদের দুনিয়াকে সুন্দর বানাবেন না, কারণ মানুষের মধ্য হতে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে অন্যায় কাজ করে যে অপরের দুনিয়ার জন্য নিজের আখিরাতকে বিক্রি করে।”
সুলায়মান বলেছিলেন: “তোমাকে আমি বলতে চাই যে, তুমি তোমার জবানকে মুক্ত করে দিয়েছ এবং তোমার জবান তোমার তলোয়ারের চেয়ে অধিক ধারালো”। সে উত্তরে বলেছিল: “জ্বী আমিরুল মু’মিনিন, কিন্তু আমার এই জবান আপনার পক্ষে, বিপক্ষে নয়।” অতঃপর সুলায়মান জিজ্ঞেস করেছিলেন: “এ বিষয়ে তোমার নিজের জন্য চাওয়ার মতো কোন কিছু আছে কি?” সে উত্তরে বলেছিল: “সকলের জন্য বরাদ্দকৃত সাধারণ সুযোগ-সুবিধা ব্যতিরেকে আমি নিজের জন্য আলাদা করে কিছুই চাই না।” এরপর সে উঠে দাঁড়ালো এবং চলে গেল।
অতঃপর সুলাইমান বলেছিলেন: “এই ব্যক্তির পছন্দের জন্য সকল মহিমা আল্লাহ্’র (সুব্হানাহু ওয়া তা’আলা), তার প্রকৃতি কতই না সম্মানজনক এবং তার হৃদয় কতই না পরিপূর্ণ, তার জবান কতই না তীক্ষ্ন এবং তার উদ্দেশ্য কতই না পবিত্র, এবং তার আত্মা কতই না চমৎকার!!”
৩. শুধুমাত্র ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব না করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত সকল মানুষের স্বার্থ দেখাশোনা করা
দুনীতি সৃষ্টিতে, সামাজিক মূল্যবোধসমূহের অধঃপতনে এবং বৈশিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতায় পশ্চিমা অথ ও রাজনীতির মিশণ বিশাল ভূমিকা রেখেছে, কারণ সমগ্র বিশ্বজুড়েই সম্পদের দখল নিয়ে অব্যাহতভাবে যুদ্ধ চলছে।
ইসলামী ব্যবস্থা রাজনীতি হতে অর্থকে অপসারণ করে।
এবার নির্বাচনসমূহের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতি চার বা পাঁচ বছরে (যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি দুই বছরে ‘হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ’ নির্বাচনে) রাজনীতিতে অর্থের অধিকতর ব্যবহারকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের বিপুল পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করতে বাধ্য করে, যাতে করে তারা পুনঃনির্বাচিত হতে পারে কিংবা ক্ষমতা হারানোর পূর্বে নিজেদের সম্পদ যত বেশি সম্ভব বাড়িয়ে নিতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১২ সালের নির্বাচনে ওবামার নির্বাচনী প্রচারণায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছিল, যার অধিকাংশই কর্পোরেট হাউজ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ জুগিয়েছিল। ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার একটি বিশাল অংকের অর্থ। বিশ্বে দশটি দেশ রয়েছে যাদের বার্ষিক জিডিপি ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার চেয়ে কম।
অন্যদিকে, যদিওবা ইসলামী ব্যবস্থার অধীনে প্রত্যেকটি মানুষই যে সকল ধরনের প্রলোভন হতে মুক্ত হবে তা নয়, তবে এধরনের পুনঃপুনঃ নির্বাচনী রঙ্গভূমি এড়ানোর মাধ্যমে রাজনীতি হতে অর্থ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সক্রিয়ভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
এছাড়াও, প্রগতিপন্থী পশ্চিমা দেশসমূহে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র একীভূত হয়ে আছে এবং রাজনীতিবিদদের একটি শ্রেণী তৈরী হয়েছে, যারা হয় ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ কিংবা ব্যবসায়িক শ্রেণীর সাথে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। আর, ইসলামের রাজনৈতিক আদর্শে এ ধরনের কোন প্রভাব অনুমোদিত নয় এবং এতে সম্পর্কসমূহ ও প্রভাবের চারপাশে শক্ত বিধিনিষেধ আরোপিত হয়।
ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বৃহৎ ব্যবসার চেয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
এর পাশাপাশি, শাসন করার চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনকারী যেকোন ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে খলিফাকে তার পদে দায়িত্ব পালনের জন্য অনুমতি দেয়া হবে না, কিংবা তাকে তার পদ হতে অপসারণ করা হবে।
৪. শাসনকার্যে নিয়োজিত নির্বাহী হতে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হতে হবে যা নির্বাহীগণকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারবে
বিচারকবৃন্দ ও আদালতসমূহ রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসনকার্যে নিয়োজিত নির্বাহীগণ হতে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হবে এবং তারা খিলাফত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। সেইসাথে, কোন নির্বাহীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলাকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট বিচারককে ততক্ষণ পর্যন্ত বরখাস্ত করা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তদন্ত সমাপ্ত হয়।
৫. কোন ব্যক্তি কিংবা দল আইনের উর্দ্ধে নয়
রাষ্ট্রপ্রধান, তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ কিংবা কোন ধর্মীয় পন্ডিত – কেউই আইনের উর্দ্ধে নয়। কেউ দায়মুক্ত নয়, এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যেখানে ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানদের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার অন্ধ, সেখানে ঐতিহাসিকভাবে ইসলামী আদালতসমূহ দুর্বল, সংখ্যালঘু ও কম বিত্তবানদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
এর কারণ ছিল মুসলিম ও বোখারী শরীফে উলেখিত রাসূলুলাহ (সাঃ)-এর হাদিস, যেখানে চুরির অপরাধে অভিযুক্ত একজন অভিজাত মহিলার মামলায় মধ্যস্থতা করে দেয়ার জন্য তাঁর (সা.) নিকট আবেদন জানানো হয়েছিল, তিনি (সা.) বলেছিলেন:
“তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, কারণ যখন কোন অভিজাত ব্যক্তি চুরি করত তখন তারা তাকে মুক্ত করে দিত, কিন্তু যদি কোন দুর্বল ব্যক্তি চুরি করত তবে তারা তার উপর আইনসঙ্গত শাস্তি কার্যকর করতো। আল্লাহ্’র শপথ, যদি মুহাম্মদের (সা.) কন্যা ফাতিমাও চুরি করতো তবে মুহাম্মদ (সা.) তার হস্ত কর্তন করতো!”
৬. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ – সক্ষম কিংবা অক্ষম – নির্বিশেষে সকল নাগরিক রাষ্ট্রের অধীনে সমান অধিকার ভোগ করবে
ইসলাম কোন নাগরিককে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা অক্ষমতার ভিত্তিতে কোন ধরনের বৈষম্য করে না এবং মুসলিমরা কোন ধরনের বিশেষ সুবিধা ভোগ করে না। এক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ অভিযোগ যার কোন ভিত্তি নেই। খিলাফত রাষ্ট্র ঐশ্বরিক বিধান অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে সকল অমুসলিম নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে থাকে। খিলাফত রাষ্ট্র তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসমূহের এবং তাদের উপসনালয়সমূহের সুরক্ষা দিয়ে থাকে। আইন, বিচার এবং বিভিন্ন বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা, কিংবা এ ধরনের কোন কিছুর ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে কোন ধরনের বৈষম্য করা রাষ্ট্রের জন্য নিষিদ্ধ। বরং, প্রত্যেক নাগরিকের সাথে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমান আচরণ করা হয়।
আলাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন:
“আর যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক বিচার করবে” (সূরা নিসা: ৫৮),
এবং তিনি (সুব্হানাহু ওয়া তা’আলা) আরও বলেন:
“এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রম্নতা যেন তোমাদের কখনও ন্যায়বিচার বর্জন করতে প্ররোচিত না করে। ন্যায়বিচার কর, এটাই তাক্বওয়ার নিকটতর।” (সূরা মায়িদাহ: ৮)
এছাড়াও, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন:
“যে অন্যায়ভাবে একজন চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে হত্যা করে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না; আর জান্নাতের সুগন্ধ একশত বৎসর হাঁটার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।” (তিরমিযি)
ইহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে সুরক্ষা প্রদানের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এবং এর উদাহরণ হচ্ছে ইসলামী স্পেন; এছাড়াও ইস্তাম্বুল কর্তৃক ইহুদীদেরকে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল, যা তদন্ত চলাকালীন সময়ে লিখিত নথি হিসেবে সংরক্ষিত আছে।
ইসলামী শাসনামলের প্রাথমিক যুগের একটি বিখ্যাত মামলায় একজন অমুসলিম তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানকে একটি সম্পত্তির ব্যাপারে আদালতে নিয়ে যায় এবং সে মামলাটিতে জয়লাভ করে।
যেকোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী অমুসলিমদের (কিংবা অবিশ্বাসী) জন্য ইসলামী ব্যবস্থার মধ্যে ভীতিকর কিছু নেই, বরং অনেক ব্যক্তিই প্রত্যক্ষ করছে যে পশ্চিমা সমাজসমূহ ক্রমবর্ধমান হারে বস্তুবাদ ও রাজনৈতিক দুর্নীতির পঙ্কিলতায় ডুবে যাচ্ছে, আর এসব ব্যক্তিরা এর বিকল্প হিসেবে ইসলামী আদশ সম্পকে জেনে অবাক হতে পারে।
৭. বিধিবহির্ভুত গ্রেফতার, অন্তরীণ, নির্যাতন এবং অস্বাভাবিক শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ
ইসলাম বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার কিংবা নির্যাতন করায়, অথবা অস্বাভাবাবিক শাস্তি প্রদান বা অন্তরীণ রাখায় বিশ্বাস করে না। প্রত্যেক ব্যক্তির এই অধিকার রয়েছে যে তাকে নিরপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং এর সাথে সাথে তার নিজস্ব গোপনীয়তা রক্ষার ও ন্যায়বিচার পাবার অধিকার রয়েছে। জনসাধারণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের একক কোন আধিপত্য নেই।
দ্বিতীয় খলিফা সাইয়্যিদিনা উমর (রা.)-এর একটি ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়: “একদিন হোমস্ শহরের আমিল (শহরের মেয়র) উমায়ের ইবনু সাদ্ সম্পর্কে একটি খবর তাঁর (রা.) নিকট পৌঁছায়। উমায়ের ইবনু সাদ্ হোমস্ শহরের অধিবাসীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: “যতদিন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ শক্তিশালী থাকবে ততদিন পর্যন্ত্ম ইসলাম শক্তিশালী থাকবে এবং কর্তৃপক্ষের শক্তি তলোয়ার দিয়ে হত্যা কিংবা চাবুকের আঘাতের মাধ্যমে আসে না, বরং সততার সহিত বিচারের মাধ্যমে ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ শক্তিশালী হয়ে থাকে”। এটা শুনে উমর (রা.) বলেছিলেন:
“মুসলিমদের বিষয়াদি দেখাশোনা করার কাজে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য উমায়ের ইবনু সাদ্-এর মতো একজন মানুষ যদি আমার সাথে থাকত”।
মুসলিম বিশ্বে এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে গুপ্তচরবৃত্তি মহামারির আকার ধারন করেছে।
ইসলাম রাষ্টকে তার নাগরিকদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করাকে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা) কর্তৃক নাযিলকৃত আয়াতের মাধ্যমে মুসলিমদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করাকে হারাম করা হয়েছে: “এবং তোমরা একে অপরের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করো না” (সূরা হুজুরাত: ১২)। গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়ে এটি একটি সাধারণ নিষেধাজ্ঞা…… এটা আল-মুকদাদ্ এবং আবু উমামা হতে বর্ণিত হাদিস দ্বারা নিশ্চিত হয়েছে যা আহ্মদ ও আবু দাউদ উভয়ে উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাটিতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: “আমির যদি লোকদের মধ্যে সন্দেহের অনুসন্ধান করে তবে সে তাদের অধঃপতিত করতে পারে” (আবু দাউদ, সুনান #৪৮৮৯ এবং আল-হাইসামি, মাযমা’ আল যাওয়া’ইদ্, খন্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ২১৮)।
এছাড়াও, ইসলামে নির্যাতন ও অবমাননাকর আচরণের উপর সাংবিধানিকভাবেই পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যা সাধারণ জনগণের সাথে সাথে পুলিশ বাহিনী, সামরিক বাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপরেও প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে হুকুমটি হচ্ছে: “প্রাথমিকভাবে প্রতিটি ব্যক্তি নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হবে। আদালতের রায় ব্যতিত কোন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া যাবে না। কাউকে নির্যাতন করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ; এবং যে নির্যাতন করবে তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে।”
সবশেষে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা হচ্ছে অপরিবর্তনীয়, তুলনাহীন, কার্যকর এবং এটাতে এমন একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো বিদ্যমান যাতে সুশাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ঐশ্বরিক উৎসের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে এবং এটাই হচ্ছে একমাত্র ব্যবস্থা যা মানবজাতির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
আবু খালেদ আল-হিজাজী