যখন রাসূলুল্লাহ (সা) এর চাচা আবু তালিব ও বিবি খাদিজা (রা) একই বছরে ইন্তেকাল করলেন তখন তাদের মৃত্যুর কারণে তার ভাগ্যাকাশে দূর্যোগের মেঘ আরও ঘনীভূত হল। চাচার মৃত্যুর পর কুরাইশগন রাসূলুল্লাহ (সা) এর উপর নির্যাতনের খড়গহস্ত আরও কঠিনভাবে চালাতে উদ্যত হল। এ ব্যাপারে তিনি (সা) বলতেন,
‘আবু তালিবের মৃত্যুর পর কুরাইশগন যত ঘৃণিত কাজ করেছিল ততটা আর কখনওই করেনি।’
(সীরাতে ইবনে হিশাম)
আবু তালিবের মৃত্যুর পর নিজের ও তাঁর লোকদের সুরক্ষা ও নুসরার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) তায়েফ গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বানু সাকিফ গোত্রের কিছু নেতৃস্থানীয় লোকের সাথে দেখা করেছিলেন। তিনি তাদের সাথে ইসলামকে সমর্থন করা ও এর পাশে দাঁড়ানোর জন্য কথা বলেন, তার গোত্রের যে কেউ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার জন্য বললেন। তারা এ আহ্বান প্রত্যাখান করেছিল এবং বারণ করা সত্ত্বেও তাদের সাথে যোগাযোগের বিষয়টি গোপন না রেখে প্রকাশ করে দিয়েছিল। বিশেষ প্রহরা ছাড়া মুহম্মদ (সা) মক্কায় প্রবেশ করতে পারেননি।
রাসূলুল্লাহ (সা) বিভিন্ন গোত্রের দরজায় দাঁড়িয়ে আহ্বান জানিয়ে বলতেন,
‘হে অমুক গোত্র! আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল। তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। এইসব মূর্তি থেকে যে কোন কিছু গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুন ও ঈমান আনুন। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে রক্ষা করুন যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা লোক সামনে তুলে ধরছি।’
(সীরাত ইবনে হিশাম)
রাসূলুল্লাহ (সা) এর চাচা আবু লাহাব ছায়ার মত তাঁর পেছনে লেগে থাকত এবং তিনি যা বলতেন তার জবাব দিত ও প্রত্যাখান করত। কেউ তার কথা গ্রহণ করত না, তারা সাধারণত বলত, ‘তোমার লোকেরা যারা তোমাকে আরও ভাল জানে তারাই তোমাকে অনুসরণ করে না।’
তারা কথা বলত ও তর্ক করত। অন্যদিকে তিনি তাদের সাথে কথা বলতেন এবং আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতেন এই কথা বলে,
”হে আমার প্রভু, যদি তোমার ইচ্ছা থাকত! তারা এটা অপছন্দ করত না। ”
সীরাত ইবনে হিশামে উল্লেখ আছে, আয-জুহরী বর্ণণা করেন যে, মিনাতে রাসূলুল্লাহ (সা) বানু কিন্দা গোত্রের কাছে তাদের আবাসস্থলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন ও প্রত্যাখাত হলেন। তিনি আরও বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বানু কা’ব গোত্রের কাছে যান এবং প্রস্তাব দেন। কিন্তু আগের মতই প্রত্যাখাত হন। তারপর তিনি বানু হানিফা গোত্রের কাছে গিয়ে একইভাবে প্রস্তাব দেন এবং তাদের প্রত্যাখান ছিল আরবদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। তিনি বানু আমির বিন বানু সা’সা’ এর কাছে গিয়েছিলেন এবং তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন ও নিজেকে উপস্থাপন করেন। বহাইরা বিন ফিরাস নামে তাদের মধ্যকার একজন বলল,
‘আল্লাহর কসম, আমি যদি কুরাইশের এই তরুণকে নিতে পারতাম তাহলে পুরো আরবদের পরাজিত করতে পারতাম।’ সে রাসূলুল্লাহ (সা) কে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি মনে কর, যদি আমরা তোমাকে অনুসরণ করি এবং স্রষ্টা তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে তোমাকে বিজয় দান করে তবে তোমার পরে আমাদের হাতে ক্ষমতা আসবে?’ নবী (সা) উত্তর দিলেন,
‘ক্ষমতার মালিক আল্লাহ এবং তিনি যাকে খুশী তাকে তা দান করেন।’
বহাইরা উত্তর দিল, ‘আমরা তোমাকে রক্ষা করবার জন্য আরবদের কাছে আমাদের গলা উন্মুক্ত করে দেব আর যখন তুমি বিজয়ী হবে তখন ক্ষমতা চলে যাবে অন্য কারও হাতে! তাহলে তোমার ক্ষমতার আমাদের প্রয়োজন নেই!’
রাসূলুল্লাহ (সা) এরকমই করে যেতে থাকলেন। যখন হজ্জের মৌসুমে লোকেরা জমায়েত হত, তিনি (সা) সেখানে উপস্থিত হতেন এবং তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতেন। তিনি (সা) নিজেকে উপস্থাপণ করতেন এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা ও রহমত তুলে ধরতেন। যখনই রাসূলুল্লাহ (সা) জানতে পারতেন যে কোন স্বনামধন্য ও সম্মানিত আরব এসেছেন তখনই তিনি কালবিলম্ব না করে তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দিকে আহ্বান জানাতেন ও তাঁর প্রতি নাজিলকৃত বাণীসমূহ উপস্থাপন করতেন।
ইতিবাচক সাড়া না দিলেও রাসূলুল্লাহ (সা) যে সব গোত্রের সাথে দেখা করেছিলেন, ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং নিজেকে তাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন তারা হল: ১) বানু আ’মির বিন সা’সা’ ২) মুহারিব বিন খাসফাহ ৩) ফাজারাহ ৪) ঘাসান ৫) মুরাহ ৬) হানিফাহ ৭) সুলায়েম ৮) আবাস ৯) বানু নাদর ১০) বানু আল বুকা ১১) কিন্দা ১২) কা’ব ১৩) আল হারিস বিন কা’ব ১৪) উজরাহ ১৫) আল হাদারিমাহ
ইবনে সাদ এর ‘আত তাবাকাত’ শীর্ষক বই অনুসারে এই তালিকা উল্লেখ করা হল।