রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময়ে গণসংযোগ পর্যায়

কুরাইশদের সাথে দাওয়াত নিয়ে সংঘাত ছিল স্বাভাবিক। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) এই দলটিকে সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পদ্ধতিতে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিলেন। দাওয়াতের প্রকৃতির কারণে মক্কার সমাজ ও কুরাইশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এ দাওয়াত এক আল্লাহর উপাসনা ও তাওহীদের প্রতি আহ্বান করেছিল এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বলেছিল ও যে দূনীর্তিগ্রস্ত নষ্ট শাসনব্যবস্থার মধ্যে তারা বসবাস করত তার সমূল উৎপাটন করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। তিনি তাদের স্রষ্টাকে উপহাস করতেন, সস্তা জীবনধারাকে আক্রমণ করতেন এবং তাদের জীবনব্যবস্থার অবৈধ দিকসমূহ উন্মোচন করতেন। তিনি সত্য দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতেন এবং তারাও করত মিথ্যে ও গুজব দ্বারা। তিনি লোকদের সুস্পষ্টভাবে আহ্বান জানাতেন এবং এ আহ্বানে কোন দ্ব্যর্থবোধকতা, নমনীয়তা বা বশ্যতার লেশমাত্রও ছিল না। সব অত্যাচার, প্রত্যাখান, বিতাড়ন, গুজব ও বয়কটকে তোয়াক্কা করে তিনি এসব কিছু করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) লোকদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দিলেন এবং ইসলাম প্রসারিত হওয়া শুরু করল।

যখন তাঁর (সা) স্ত্রী ও চাচা মারা গেলেন এবং কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা আরও ঘনীভূত হল তখন তিনি সমর্থন আদায় ও নিরাপত্তার জন্য তায়েফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন এই ভেবে যে, হয়ত তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। কিন্তু তারা অকল্পনীয়ভাবে মন্দ আচরণ ও শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে প্রত্যাখান করল। তিনি এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হলেন যখন নিরাপত্তা ছাড়া মক্কায় প্রবেশ করতে পারছিলেন না। সেদিন তিনি আল মু’তিম বিন ’আদি এর প্রহরায় মক্কায় প্রবেশ করলেন। কুরাইশ কতৃক রাসূলুল্লাহ (সা) এর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে লাগল এবং প্রত্যাখান এর মাত্রা আরও প্রবল হল। বিরোধীরা তার কথা শুনতে লোকদের বারণ করত এবং এটা খুব বেশী কার্যকর হয়নি। হজ্জের মৌসুমে বিভিন্ন গোত্রের কাছে তিনি যাওয়া শুরু করলেন এবং তাদের ইসলামের দিকে আহ্বান করা শুরু করলেন ও প্রচার করলেন যে, তিনি একজন আল্লাহ প্রেরিত রাসূল ও এতে তাদের বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত। তাঁর চাচা আবু লাহাব সাধারণত তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচারের অভিযোগ আনত এবং লোকদের তাঁর কথা না শুনবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করত। এ প্রচারণার একটা প্রভাব শ্রোতাদের উপর পড়ত, যেমন: তারা মাঝে মাঝে শুনত না। তারপর তিনি গেলেন বানু কিন্দা, বানু কাব, বানু হানিফা, বানু আমি’র বিন সা’সা এর কাছে। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করত না। কেউ কেউ বিতৃষ্ণা নিয়ে খুব বাজেভাবে প্রত্যাখান করত। গোত্রসমূহের কাছ থেকে প্রত্যাখানের মাত্রা বেড়ে যাবার আরেকটি প্রধান কারণ হল কুরাইশরা মুহম্মদ (সা) এবং তার সাহায্যকারীকে তাদের শত্রু  হিসেবে বিবেচনা করত। ব্যক্তি বা গোত্র হিসেবে লোকেরা আরও ক্রমবর্ধমান হারে রাসূলুল্লাহ (সা) কে প্রত্যাখান করা শুরু করল। তিনি ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছিলেন এবং মক্কা ও এর আশেপাশে দাওয়াতের কাজ করা কঠিনতর হয়ে যাচ্ছিল। মক্কার সমাজ কুফরী ব্যবস্থার উপর অটল থাকল এবং কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে দৃঢ় থাকল। যখন অত্যাচারের মাত্রা তীব্রতর হয়ে গেল তখন আবদুর রহমান বিন আউফ (রা) সহ আরও অনেকে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে অস্ত্র ধারণের অনুমতি প্রার্থনা করল। তারা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আগে আমাদের মুশরিক হিসেবে সম্মান ও ক্ষমতা ছিল। আর যখন আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম তখন অপমানিত হচ্ছি।’ রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের নিষেধ করে বললেন, 

‘অবশ্যই, আমাকে ক্ষমা করে দেবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সুতরাং লোকদের সাথে যুদ্ধ করো না।’
(আন নাসায়ী ও আল হাকিমে ইবনে আবি হাতিমের বর্ণণায়)

এইভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় দাওয়াতের দু’টি পর্যায় অতিক্রম করেছেন:

  • শিক্ষণ, গঠন বা চিন্তার বিকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্নিক প্রস্তুতির পর্যায়। এটা হল চিন্তাকে উপলদ্ধি করতে পারা, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সে চিন্তাকে মজ্জাগত করা এবং তাদের সুসংগঠিত করার পর্যায়।
  • দাওয়াতের বিস্তৃতি ও সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার পর্যায়। এটা হল চিন্তাকে সমাজ পরিচালনার শক্তি হিসেবে সরবরাহ করা, চিন্তাকে প্রয়োগ করে জীবনের মূল ধারায় স্থান করা যাতে সাধারণ জনগন এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, বহন করে এবং প্রতিষ্ঠার পথে সর্বাত্নক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।      

প্রথম পর্যায়ের ক্ষেত্রে, এটা হল লোকদের ইসলামের দিকে আহ্বানের পর্যায় এবং এর চিন্তা দিয়ে তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটানো, নিয়মকানুন শিক্ষা দেয়া এবং এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলা যারা ইসলামি আক্বীদার ভিত্তিতে এ কাজগুলো করতে পারবে। এ পর্যায়ে দাওযাতকে গোপনে সংগঠিত করতে হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) দাওয়াত থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। তিনি যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাদেরকে দারুল আরকামে একত্রিত করে একটি সংগঠনের কাঠামোর ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন। এভাবে প্রতিদিন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তাদের মধ্যকার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। তাদের মধ্যে বাস্তবতাকে উপলদ্ধি করা এবং কর্মসূচী গ্রহণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে কারণে দাওয়াতের জন্য তারা নিজেদের উৎসর্গ করবার জন্য প্রস্তত ছিল। দাওয়াত তাদের হৃদয় ও মনে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। ধমনীতে রক্ত যেভাবে প্রবাহিত হয়েছিল সেভাবে ইসলাম তাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল। সেকারণে  লুকোচুরি, গোপন কাঠামো ও গোপন বৈঠকের মধ্যেও তাদের ভেতরে দাওয়াত লুক্কায়িত ছিল না। বিশ্বাসী ও দাওয়াত গ্রহণের জন্য আগ্রহী লোকদের সাথে তারা এ দাওয়াত নিয়ে যেত। এভাবে লোকেরা তাদের উপস্থিতি ও দাওয়াত বুঝতে পারত। এভাবে দাওয়াতের সূচনা হল। অতপর দাওয়ার প্রকাশ অত্যবশ্যকীয় হয়ে উঠল। কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল এর প্রকাশ ও লোকদের সম্বোধন করার জন্য।  এভাবে প্রথম ধাপ অতিক্রান্ত হল যেখানে গোপন কাঠামো তৈরি করা ও শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হয়, যা এই কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করে।     

তারপর আরেকটি পর্যায় শুরু হল, যা ছিল গণসংযোগ ও সর্বাত্নক সংগ্রাম পর্যায়। লোকদের এসময় ইসলাম উপলদ্ধি করবার সুযোগ দেয়া হয়। সেকারণে তখন তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং এবিষয়ে আগ্রহী হয়েছে। আবার অন্যদিকে তারা এটাকে প্রত্যাখান ও পরবতীর্তে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং এভাবে এ চিন্তার সাথে দ্বন্দ শুরু হয়েছে। এ দ্বন্দে কুফর ও কুচিন্তা পরাভূত হয়েছে, ঈমান ও সত্য বিজয় হয়েছে এবং সঠিক চিন্তাই প্রবলতর হয়েছে। এভাবে গনসংযোগ শুরু হল এবং একটি চিন্তা ও আরেকটির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল, অর্থাৎ এ প্রতিযোগিতা ছিল মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে। এর সূত্রপাত হয়েছিল যখন রাসূলুল্লাহ (সা) গণমানুষের কাছে সাহস ও চ্যালেঞ্জের সাথে দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়া শুরু করলেন। তাওহীদের দাওয়াত, মূর্তিপূজা ও শিরকের চিন্তাকে আঘাত এবং কোন চিন্তা ছাড়া পূর্বপুরুষকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার বিষয়গুলোকে সমালোচনা করে রাসূলুল্লাহ (সা) এর উপর আয়াত নাজিল হতে লাগল। আয়াতসমূহতে ত্রুটিপূর্ণ বিনিময় ব্যবস্থা, বাণিজ্য এবং মাপে কম দেয়ার সমালোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) দলে দলে লোকদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন, ইসলামকে গ্রহণ ও সাহায্য করবার জন্য আহ্বান জানালেন। কুরাইশ ও নবী (সা) এর মধ্যকার দ্বন্দ বৃদ্ধি পেল। দাওয়াতের মধ্যে বাড়িতে, পাহাড়ের পাদদেশে, দারুল আরকামে নিবিড় শিক্ষাদান পদ্ধতির পাশাপাশি তখন সামষ্টিক শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ফলে, এটা স্থানান্তরিত হল কিছু সংখ্যক মানুষ যাদের মাঝে কল্যাণ (goodness) ছিল তাদের আহ্বান জানানোর পর্যায় থেকে সমগ্র মানষকে আহবান জানানোর পর্যায়ে। এই সামষ্টিক দাওয়াত ও গনসংযোগ পর্যায় কুরাইশদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করল। সুতরাং তাদের ঘৃণা ঘনীভূত হল এবং তারা ইসলাম নিয়ে ভীত হয়ে পড়ল। দাওয়াতকে বিরোধিতা করবার জন্য তারা ভয়ংকর সব পরিকল্পনা আটতে থাকল; এ পর্যায়ের আগে তারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর দাওয়াতকে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেনি। সুতরাং মানুষিক ক্লেশ ও জুলুম বাড়তে লাগল। তবে এই সামষ্টিক দাওয়াত এর নিজের উপরে অনেক প্রভাব বিস্তার করল। এর কারণে অনেকে ইসলামের কথা শুনবার সুযোগ পেল এবং আল্লাহর দ্বীনের কথা মক্কাবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভবপর হল। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল। সামষ্টিক দাওয়াতের কারণে এর কলেবর বাড়ানোর সুযোগ হল। যদিও এ কারণে দাওয়াত বহনকারীদের দূর্ভোগ, অত্যাচার ও নির্যাতন বাড়িয়ে দিল। যখন রাসূলুল্লাহ (সা) কুরাইশদের অন্যায়, নিষ্ঠুরতা, মক্কার সমাজের দাসত্ব, কাফেরদের করুণ অবস্থা ও কর্মকান্ডের মুখোশ উন্মোচন করছিলেন তখন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সব পর্যায়সমূহের মধ্যে এ পর্যায়টি রাসূলুল্লাহ (সা) ও তার সাহাবীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল।            

চিন্তা বিকাশের পর্যায় থেকে গনযোগাযোগ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর্যায়টি খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়, কারণ এর জন্য প্রজ্ঞা, ধৈর্য, চিন্তার যথার্থতা অপরিহার্য। তবে গনযোগাযোগ পর্যায়টি ছিল সবচেয়ে কঠিন। এর জন্য একজনকে সাহসী, স্পষ্টভাষী এবং ফলাফল বা প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনায় না নিয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে। এ ধাপে মুসলিমদের দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ পর্যায়ে ঈমান ও দূর্ভোগ সহ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি বিকশিত হয় এবং সংঘাতের সময়গুলোতে ঐকান্তিকতা গড়ে উঠে।    

একইভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবাদের (রা) নিয়ে এমনভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন যাতে তারা অত্যাচার, দূর্ভোগ ও নির্যাতন সহ্য করতে পারে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবিসিনিয়াতে হিজরত করেছেন, কেউ দ্বীন নিয়ে পালিয়েছেন, কেউ নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন এবং কেউ কেউ অত্যাচার সহ্য করেছেন। মক্কার সমাজকে পরিবর্তনের জন্য তাঁরা যথেষ্ট সময় নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তবুও অত্যাচারের ভয়াবহতা সফলতার পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল। আরবদের অনেকে দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কারণ তখন তারা ঈমান গ্রহণ করে কুরাইশদের চটাতে চায়নি। তৃতীয় ধাপে অর্থাৎ ইসলামকে বাস্তবায়নের স্তরে দাওয়াত মক্কার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সা) নুসরা ও সুরক্ষা পাবার জন্য গোত্রসমূহের কাছে যাওয়া শুরু করেন, যাতে করে তিনি তার প্রভূ যা নাজিল করেছেন তা লোকদের কাছে স্পষ্ট করতে পারেন।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply