রাসূলুল্লাহ (সা)—এর সময়ে ব্যক্তি তৈরির ধাপ

যখন রাসূলুল্লাহ (সা) কে দাওযাতের কাজের দায়িত্ব দেয়া হল তখন তিনি লোকদের সেদিকে আহ্বান জানাতে আরম্ভ করলেন। কেউ কেউ তার আহ্বানের উপর বিশ্বাস স্থাপন করল এবং কেউ কেউ অবিশ্বাস করল। যখন মক্কায় ইসলাম ব্যাপক পরিচিতি লাভ করল তখন সাধারণ জনতা এটা নিয়ে কথা বলা শুরু করল। রাসূলুল্লাহ (সা) শুরুতে তাদের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করতেন। মক্কায় তিনি লোকদের প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতেন আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী,

‘হে চাদরাবৃত, উঠুন, সতর্ক করুন’।
(সূরা মুদ্দাসির: ১-২)

তিনি প্রথমে দলটিকে গোপনে সংঘটিত করেন। সাহাবাগন (রা) তখন লোকালয় থেকে দূরে উপত্যকায় গিয়ে সালাত আদায় করতেন। নতুন কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ (সা) তৎক্ষণাৎ কোরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য কাউকে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি যয়নব বিনতে আল খাত্তাব ও তার স্বামী  সাইদকে কুরআন শিক্ষার জন্য খাব্বাব বিন আরাতকে তাদের বাড়িতে প্রেরণ করেন। এটি সেই হালাকা বা পাঠদানচক্র ছিল, যেখানে সাইয়্যুদনা ওমর (রা) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি (সা) আল আরকামের বাড়িটিকে বিশ্বাসীদের কেন্দ্র ও নতুন দাওয়াতের জন্য বিদ্যায়তন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ বাড়ীতে রাসূলুল্লাহ (সা) কুরআন শিক্ষা দিতেন ও সাহাবীদের মুখস্থ ও উপলদ্ধি করবার পরামর্শ দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ততক্ষণ পর্যন্ত সাহাবীদের গোপনে শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত নিম্নের আয়াতটি নাজিল না হয়:

‘অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না।’
(সূরা আল হিজর: ৯৪)

শুরুতে রাসূলুল্লাহ (সা) বয়স, সামাজিক পদমর্যাদা, নারী-পুরুষ, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশের আগে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ, বয়সের প্রায় চলি­শজন নারী ও পুরুষ এ দলের সাথে যুক্ত হয়। তারা বিভিন্ন বয়সের হলেও অধিকাংশই ছিল তরুণ। ধনী, দরিদ্র, দূর্বল ও শক্তিশালী সব অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিল।

যখন চিন্তা বিকাশের ক্ষেত্রে সাহাবাগন (রা) পরিণত হল, তাদের মনস্বতত্ত (আকলিয়া) সুগঠিত হল অর্থাৎ সেটি ইসলামি হয়ে গেল এবং তাদের নাফসিয়াও ইসলামি হল ও রাসূলুল্লাহ (সা) যখন নিশ্চিত হলেন যে এ দলটি পুরো সমাজকে মোকাবেলা করবার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তখন তিনি আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে আর্বিভূত হলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) কে যেদিন দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল সেদিন থেকে ইসলামের দাওয়াত ছিল প্রকাশ্য। মক্কার লোকেরা জানত মুহম্মদ (সা) নতুন দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন এবং অনেক লোক ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। তারা এটাও জানত যে, নবদীক্ষিত মুসলিমরা এই নতুন দ্বীনের সাথে তাদের সম্পর্ক ও এর প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টি গোপন করছে। এ তথ্য জানার অর্থ হল নতুন দাওয়াত ও দাওয়াত গ্রহণকারী নতুন লোকদের সম্পর্কে মক্কাবাসীর একধরনের অনুভূতি ছিল যদিও তারা জানত না কারা মিলিত হচ্ছে এবং কোথায় মিলিত হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা) এর ইসলামের প্রতি দাওয়াত একেবারে নতুন ছিল না, বরং যা নতুন ছিল তা হল বিশ্বাসীদের নতুন এই দলটির প্রকাশ্যে আর্বিভাব।

যখন রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার এ আয়াতটি নাজিল হল:

‘অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না। বিদ্রূপকারীদের জন্যে আমি আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট। যারা আল্লাহ্‌র সাথে অন্য উপাস্য সাব্যস্ত করে, অতিসত্বর তারা জেনে নেবে।’
(সূরা আল হিজর: ৯৪-৯৬)

রাসূলুল্লাহ (সা) প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতের ঘোষণা দিলেন এবং এর মাধ্যমে দাওয়াত ব্যক্তি পর্যায় থেকে গণপর্যায়ে উন্নীত হল। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা) আগ্রহী লোকদের গোপনে দাওয়াত করবার পর্যায় থেকে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে গনসংযোগ পর্যায়ে নিয়ে আসলেন। এটা ছিল ঈমান ও কুফরের মধ্যকার দ্বন্দের সূত্রপাত এবং সঠিক চিন্তা ও ভুল চিন্তার মধ্যকার সংঘাত। সুতরাং দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হল। এটি হল গনসংযোগ ও সংগ্রাম করবার পর্যায় এবং সব সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভয়াবহ। রাসূলুল্লাহ (সা) এর বাড়ীতে পাথর ছুড়ে মারা হল। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল রাসূলুল্লাহ (সা) এর বাড়ীর পথে ময়লা ফেলে রাখত। নবী (সা) এগুলো পরিষ্কার করে সন্তুষ্ট থাকতেন। আবু জাহেল তাদের দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসগীর্কৃত ভেড়ার নাড়িভূড়ি রাসূলুল্লাহ (সা) এর বরাবর ছুড়ে মারে। কিন্তু এসব রাসূলুল্লাহ (সা) এর ধৈর্য এবং সহ্যক্ষমতাই বৃদ্ধি করছিল কেবল । মুসলমানদের সতর্ক করা হচ্ছিল ও ক্ষতিসাধন করা হচ্ছিল। দ্বীন গ্রহণ করবার কারণে প্রত্যেক গোত্রই মুসলিমদের অত্যাচার ও যন্ত্রনা দিতে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এ অত্যাচারের শিকার হয়েছিল বিলাল, আম্মার, তার মা ও বাবা এবং আরও অনেকে যারা দূর্ভোগ লাভ ও অকথ্য নির্যাতনের পরও দৃঢ়তার উত্তম দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। 

শুরুতে কাফেররা (কুরাইশগণ) রাসূলুল্লাহ (সা) এর কথা একজন নেহায়েত ধর্মপ্রচারক বা জ্ঞানী ব্যক্তির ভাবালুতা মনে করে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তারা মনে করত লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মে অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করবে। সেকারণে তারা মুহম্মদ (সা) কে দোষারোপ করেনি বা তার থেকে পালাতে চেষ্টা করেনি। যখন তাদের আড্ডার সামনে দিয়ে তিনি যেতেন তখন তারা বলত, ‘এই হল আবদুল মুত্তালিবের সন্তান যে আকাশ থেকে আগত বাণী প্রচার করে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের দেবতাদের কথা উল্লেখ করে এগুলোকে অসম্মান করলেন, তাদের চিন্তা ও পূর্বপুরুষদের পথভ্রষ্টতার জন্য দোষারোপ করার মাধ্যমে তিনি বিরোধিতা শুরু করলেন ও দ্বন্দে অবতীর্ণ  হলেন। অতপর তারা তাকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিল এবং বিরোধিতায়, শত্রুতায় এবং সহিংসতায় তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হল।

তার নবুয়্যতের দাবীকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করা হয়েছে। সেকারণে তারা তার আলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্নক উপায়ে অবগত হওয়ার চেষ্টা করল। তারা বলত, ‘তাহলে মুহম্মদ কেন সাফা ও মারওয়া স্বর্ণে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে না?’ ‘কেন আকাশ থেকে একটি কিতাব নাজিল হচ্ছে না?’ “Why does Jibreel not appear in front of them?” “Why does he not give life to the dead?”  ধীরে ধীরে তারা আরও একগুয়ে হতে লাগল। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর প্রভুর নির্দেশের প্রতি লোকদের আহ্বান অব্যাহত রাখল। কুরাইশরা তাঁকে দাওয়াত থেকে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। সাহাবীদের উপর অত্যাচার, প্রপাগান্ডা ও বয়কট এবং এ ধরনের আরও অপচেষ্টা রাসূলুল্লাহ (সা) কে আল্লাহর রজ্জুকে আরও দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে সাহায্য করেছে এবং দাওয়াতের প্রতি প্রবল আগ্রহী করে তুলেছে।  

রাসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর উপর অত্যাচারের খবর বিভিন্ন গোত্রের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এবং দাওয়াতের বিষয়টি সাধারণভাবে সবার জানা ছিল। পুরো উপদ্বীপ ইসলাম সম্পর্কে জানত এবং আরোহীরা বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম নিয়ে কথা বলত। পবিত্র মাসসমূহ ছাড়া মুসলিমদের লোকদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) কাবার কাছে এসে লোকদের আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানাতেন, তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) পক্ষ থেকে পুরষ্কারের সুসংবাদ জানাতেন এবং তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) শাস্তি ও ক্রোধ থেকে সতর্ক করতেন।  

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply