সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরযে ক্বিফায়া

যেমন ধরা যাক: যখন আমরা ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটিকে ফরযে ক্বিফায়ার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি, তখন কুরআন ও সুন্নাহের ভিত্তিতেই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।

’যেসব লোক আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।’ (সূরা মায়েদাহ:৪৪)

’যেসব লোক আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।’ (সূরা মায়েদাহ:৪৫)

’যারা আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই ফাসেক (মিথ্যাবাদী)।’ (সূরা মায়েদাহ:৪৭)

‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মনে না করে।….’ (সূরা নিসা:৬৫)

‘আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না….’ (সূরা মায়েদাহ:৪৯)

‘তারা কি জাহেলি যুগের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ্ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?’
(সূরা মায়েদাহ: ৫০)

উপরোক্ত আয়াতসমূহ ও কোরআনের এ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আয়াত ও হাদীসসমূহ প্রমাণ করে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা-যা আল্লাহ নাজিলকৃত বাণী দিয়ে শাসন করবে ।

যেসব আয়াতের মাধ্যমে হুদুদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে তাদের সংখ্যা অনেক।

‘যে পূরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে তাদের হাত কেটে দাও…………..।’ (সূরা মায়েদাহ: ৩৮)

‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর।’ (সূরা আন নূর: ২)

‘যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতঃপর স্বপক্ষে সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে…’ (সূরা আন নূর: ৪)

‘সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ্ হারাম করেছেন; কিন্তূ ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি….’ (সূরা বনী ইসরাইল: ৩৩)

‘যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচেছ এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে।’ (সূরা মায়েদাহ: ৩৩)

যারা মদ্য পান করে তাদের চাবুক দ্বারা আঘাত করা, বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা, দাঁতের বদলা দাঁত, আঘাতের জন্য ক্বিসাস (অনুরূপ শাস্তি), ক্বিসাসের বদলে অর্থের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ (আরস) এবং শরীয়া’তে যেসব অপরাধের ব্যাপারে নির্ধারিত শাস্তির বিধান নেই সেক্ষেত্রে তা’জীর বাস্তবায়ন করার ব্যাপারেও অসংখ্য হাদীস রয়েছে। এইসব আইন ও হুদুদ-যাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা রয়েছে সেসব নির্ভর করছে আল্লাহ আইন দ্বারা পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর। 

জিহাদ সম্বলিত কোরআনের আয়াতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যেমন:

‘তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জেহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে, ….’
(সূরা তাওবাহ: ৪১)

‘তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ্ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে।’
(সূরা তাওবাহ:২৯)

‘আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচেছ সমবেতভাবে।’
(সূরা তাওবাহ: ৩৬)

‘আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিন্ঠিত হয়ে যায়।’
(সূরা আনফাল: ৩৯)

‘আর প্রস্তূত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যরে মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না…’ (সূরা তাওবাহ: ৬০)

উপরোক্ত আয়াত ও জিহাদের সাথে সংশিষ্ট অসংখ্য হাদীস অনুসারে জিহাদ করতে হলে আল্লাহর বিধান দ্বারা পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরিহার্য। এরকম অনেক হাদীস রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে জিহাদ ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং ন্যায়নিষ্ঠ লোকের ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায়হীন লোকের অন্যায় এটাকে বন্ধ করতে পারবে না। অন্য কথায় মুসলমানদেরকে তখনই জিহাদে ঝাপিয়ে পড়তে হবে যখন এ ব্যাপারে আহ্বান করা হবে-তখন ইসলামী রাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুক এবং জিহাদে আহ্বানকারী আমীর পাপিষ্ঠ বা ত্বাকওয়াসম্পন্ন যাই হোক। তবে এখনকার শাসকগন জিহাদে রত নেই এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবার জন্য তারা কোন নির্দেশও প্রদান করে না। বরং তারা মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করবার জন্য নির্দেশ দেয়। তারা ততক্ষণ পর্যন্ত এটা করতে থাকবে যতক্ষণ না আল্লাহ ও বিচার দিবসে বিশ্বাসীরা জেগে উঠতে পারবে ও কুফরী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎপাটন করে আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে।

বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া ও মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে:

‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উ¤মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে …।’ (সূরা আল ইমরান: ১১০)

‘শক্তি ও সম্মান তো আল্লাহ্ তাঁর রসূল ও মুমিনদেরই কিন্তূ ……।’ (সূরা আল মুনাফিকুন: ৮)

‘….. কিছুতেই আল্লাহ্ কাফেরদেরকে মুসলমানদের উপর বিজয় দান করবেন না…।’ (সূরা আননিসা: ১৪১)

‘এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও…।’ (সূরা বাক্বারা: ১৪৩)

কীভাবে বিশ্বাসীরা সম্মানিত হবে এবং কাফেররা কোন পথ পাবে না, যখন মুসলিমদের কোন রাষ্ট্র নেই? কীভাবে তারা অন্যজাতিকে সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে যখন তারা নিজের ঘরে তা করতে অক্ষম। এসব কাজ আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়।

মুসলমানদের একজন ইমাম থাকার ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে-যাকে তারা আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাহের উপর বায়াত দেবে:

“যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল যে, তার কাঁধে (কোন খলীফার) বাই‘আত নেই, সে যেন জাহেলী মরণ মরল।” (মুসলিম শরীফ)

‘ইমাম হচ্ছে ঢালস্বরূপ, যার পেছনে থেকে মুসলিমগন জিহাদ করে ও আত্বরক্ষা করে।’ (মুসলিম শরীফ)

‘যদি কোন ব্যক্তি তার আমীরের মধ্যে এমন কিছু দেখে যা ঘৃণ্য, তাহলে সে যাতে এ ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করে। এটা একারণে যে, যদি কোন ব্যক্তি জামায়াত বা দল থেকে নিজেকে এক হাত পরিমাণও সরিয়ে নিল এবং এ অবস্থায় মারা গেল, সে যেন জাহেলিয়াতের সময়কার মৃত্যু বরণ করল।’ (মুসলিম শরীফ)

সাহাবী (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) এর মৃত্যুর পর একজন উত্তরসুরী খলিফা নির্বাচনের ফরযিয়াতের ব্যাপারে ইজমা বা ঐকমত্যে পৌছেছিলেন। তারা আবু বকর, উমর, উসমান ও আলীকে পর্যায়ক্রমে পূর্ববর্তী খলিফার মৃত্যুর পর তার (রা) স্থলাভিষিক্ত করবার ব্যাপারে একমত ছিলেন। প্রত্যেক সাহাবা তার পুরো জীবন ধরে একজন খলিফা নিয়োগের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে সুনিশ্চিত ছিলেন। কে খলিফা হবেন এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে অনৈক্য থাকলেও একজন খলিফা নিয়োগের ব্যাপারে একমত ছিলেন।

একইভাবে মুসলিমদের জীবনের জন্য ইসলামি সমাজে অত্যাবশ্যকীয়, যেমন: শিল্পকারখানা, ঔষধ, হাসপাতাল, গবেষণাগার, জ্বালানী উৎপাদন এবং অন্যান্য সামষ্টিক অপরিহার্যতা অর্জনের ক্ষেত্রেও সব মুসলিম সমান দায়িত্ব পালন করবে। যা হোক এ সমস্ত বিষয়সমূহ একটি পূর্ণাঙ্গ উপায়ে নিশ্চিতকরন যা সমৃদ্ধ ইসলামী জীবনের জন্য অপরিহার্য – যার একদিক নির্ভর করে আল্লাহ্ (সুব) তায়ালার দাসত্ব অন্যদিক নির্ভর করে মুসলিমদের শক্তি সামর্থ ও দাওয়া প্রচারের উপর,  তা রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছাড়া পালন সম্ভবপর নয়, যে কাঠামো এ সমস্থ বিষয়াদি ইসলাম এবং তার উদ্দ্যেশ্যের সাথে মিল রেখে কার্যকরভাবে তত্তাবধান করবে।

একইভাবে জনগন যাতে শরীয়াগত বাধ্যবাধকতা পালনে সচেষ্ট থাকে-এ ব্যাপারে ইসলাম শাসকদের দায়িত্ব প্রদান করেছে। ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া শাসকের সাথে বিজড়িত হুকুমসমূহ অকার্যকর হয়ে পড়ে। আবার জনগন যখন এইসব হুকুমসমূহ পালন করতে যাবে তখন তাদের বাধ্য করবার জন্য রাষ্ট্র ছাড়া তারা কোন শাসক পাবে না। তখন জনগনের দায়িত্বের সাথে সম্পৃক্ত সব হুকুম অকার্যকর হয়ে পড়ে। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মানবজীবনের উপর ইসলামের বাস্তব প্রয়োগের জন্য অন্যতম একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যখন এ ভিত্তি থাকে না তখন অনেক হুকুমসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ইসলামের অনেক বাণী বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। মুসলিমরা তখন তাদের সম্মান হারিয়ে ফেলে, ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাদের ভূমি বেদখল হয় ও শত্রুগণ আধিপত্য বিস্তার করে ও মুনকারাত বিস্তৃতি লাভ করে-যা আজকে হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply