উপমহাদেশে ইসলামি শাসনের ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম বাঙালী জাতীয়তাবাদ নিয়ে। বাম বুদ্ধিজীবীদের একটি চিন্তা সেকুলার মহলে বেশ জনপ্রিয়ঃ বাঙ্গালী সমাজে ইসলাম ধর্মের প্রভাব হল একটি প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষয়, অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদের দ্বারা অর্থনীতিক নিপীড়ন বাঙালী সমাজে পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ‘মুসলমানিত্ব’-এর দাবীকে জোরালো করে। বাম দার্শনিকদের চোখে ‘ইসলামী শাসন’-এর বিষয়টি বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে গভীরভাবে প্রথিত না। ওনাদের সাথে আলোচনা করলে এও শুনতে হয় ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ কখনই ‘কেন্দ্রিয় খিলাফতের’ আওতাধীনে ছিল না। আরও একটি ভ্রান্ত ধারণা তারা ছড়ানঃ আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশ *মূলত* এই অঞ্চলের মানুষ (Indigenous people) দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছিল যেখানে জাতীয়তাবাদী চেতনাই মুখ্য ছিল, তারা কখনই খিলাফতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে একীভূত হয়নি। এই আলোচনা গুলো এখনো চালু রয়েছে বাম ও কট্টর জাতীয়তাবাদী সেকুলারদের মহলে কারন তারা প্রমাণ করতে চায় খিলাফত এই অঞ্চলের মানুষের ন্যাচারাল ডিমান্ড হতে পারে না। এই আলোচনাও টেনে আনা হয় বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেছে *শুধুমাত্র* সুফিরা, কিন্তু শাসন ব্যবস্থা হিসেবে (শরিয়াহ কোর্ট/কাজি, প্রশাসনিক অবকাঠামো ইত্যাদি) এই অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত ছিল না। এই বিষয়ে জেনুইন গবেষণা করেছিলেন কিছু একাডেমিক যেমন ডঃ মোহর আলি (History of the Muslims of Bengal, Vol 1&2), ডঃ আব্দুল করিম (‘বাংলার ইতিহাস’, ‘বাংলার ইতিহাসঃ সুলতানি আমল’), ডঃ আস্কর ইবন শাইখ (‘বাংলার মুসলিম শাসনকর্তা’)। আমার সংগ্রহে থাকা বইগুলোর আলোকে নীচের তথ্যগুলো তুলে ধরলাম।

এই উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব রাসুলের (সা) মক্কী যুগ থেকেই। এটা হয়তো অনেকেই জানে না ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম ছিল ভারতের বর্তমান কেরালা অঞ্চলের পেরুমাল সাম্রাজ্যের শেষ রাজা ‘চেরামান ভারমা পেরুমাল’। সে রাসুলুল্লাহর (সা) ব্যাপারে আরব বণিকদের কাছ থেকে জানতে পেরে ইসলাম কবুল করেন এবং মক্কায় রাসুলের সাথে দেখা করতে যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম তাবারি ওনার ‘ফিরদাউসুল হিকাম’-এ উল্লেখ করেন পেরুমাল ১৭ দিন রাসুলের সাথে ছিলেন। তিনি ‘তাজউদ্দীন’ উপাধি লাভ করেন রাসুলের কাছ থেকে এবং সাহাবা মালিক ইবন দিনার (রা) কে সাথে করে কেরালা ফেরত আসার পথে তিনি মারা যান। ‘চেরামান-মালিক মসজিদ’ এখনো কেরালায় রয়েছে অরিজিনাল কাঠামোয়। কিন্ত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ইসলাম প্রচার সম্ভব না দেখে সেই যাত্রায় ইসলাম প্রচার/প্রতিষ্ঠা ভারত উপমহাদেশে থেমে যায়।

খলিফা উমার (রা) বাহিনী পাঠিয়েছিলেন হিন্দুস্থান জয় করার জন্য, কিন্তু সফলতা পাননি। উসমান (রা) চাওয়া সত্ত্বেও কৌশলগত কারনে এগোন নি। ৬৬০ খ্রিঃ আলির (রা) সময় হারিস ইবন মুররা আল-আবদি হিন্দের কাছের কিছু অঞ্চল দখল করেছিলেন। মুয়াবিয়াও (রা) চেষ্টা চালু রেখেছিলেন কিন্তু সফল হননি। শেষমেশ, ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক এর সময় ১৭ বছরের তরুন যোদ্ধা মুহাম্মাদ বিন কাসিম আল-থাকাফি ভারতে ঢোকেন এবং তার মৃত্যুর পরো ৮৭১ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জয় চালু থাকে। সরাসরি আব্বাসিয় খিলাফতের আওতাধীনে হুকুম শরিয়া প্রতিষ্ঠিত ছিল এই অঞ্চলে। খিলাফত তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের বিভিন্ন উপাধি দিয়েছিল যেমন, সুলতান শবুক্তগিন এর জন্য ‘নাসির আদ দাউলা’ এবং সুলতান মাহমুদ এর জন্য ‘ইয়ামিন আদ দাউলা’ এবং ‘আমিন উল মিল্লাত’। ১২১১ থেকে ১২৩৬ খ্রিঃ পর্যন্ত শাসক ছিলেন সুলতান ইলতুতমিশ যিনি আব্বাসি খিলাফাহ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার অনুরধ জানিয়ে খলিফা মুস্তানযির বিল্লাহ এর কাছ থেকে ‘সুলতান-এ-আযম’ উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি মুদ্রা চালু করা শুরু করেছিলেন যেগুলোর এক পাশে থাকতো কলেমা এবং খিলাফতের নাম আর অন্য পাশে থাকতো তার নিজের নাম ‘নাসির-এ-আমির উল মুমিনিন’ (বিশ্বাসীদের নেতার সাহায্যকারী) টাইটেল সহ। খালযি সুলতানাত এর পর তুঘলক সাম্রাজ্যও খিলাফতের সাথে সংযুক্ত ছিল। মুহাম্মাদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১) তার আগের শাসকদের সমালোচনা করে (কারন কেউ কেউ স্বাধীন হতে চেয়েছিল) আব্বাসি খলিফা আল-মুস্তাকফি বিল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে স্বীকৃতি নেন ‘সুলতান আস-সালাতিন’ হিসেবে। ফিরোজ শাহ তুঘলক তার বই “ফুতুহাত-ই-ফিরোজশাহি” তে উল্লেখ করেছিল তৎকালীন খলিফা তাকে ‘খিলাত’ (robes of honor), ব্যানার, রিং ইত্যাদি পাঠিয়েছিল স্বীকৃতি হিসেবে। মোঘল শাসকদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত (মাঝ সময়ের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, যেমন আকবরের শাসন) খিলাফতের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। হুমাইউন বিখ্যাত ওসমানী খলিফা ‘সুলাইমান দা ম্যাগ্নিফিসেন্ট’ কে চিঠি পাঠিয়েছিল “খিলাফতের মর্যাদার রক্ষাকারী হিসেবে”। এমনকি টিপু সুলতান ১৭৮৭ সালে ওসমানী খলিফা তৃতীয় সেলিম কে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিল।

এই প্রেক্ষাপটের ভেতরেই খিলাফতের সাথে বাংলারও গভীর যোগাযোগ ছিল। গজনীর সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরির (যিনি এই উপমহাদেশে কেন্দ্রীয় খিলাফতের স্বীকৃত ওয়ালি ছিলেন) সময় বাংলা বিজয়ের কারনে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি ঘোরির দিল্লীর প্রতিনিধি কুতুবুদ্দিন আইবেক এর কাছ থেকে ‘খিলাত’ (robe of honor) পেয়েছিল। চার বছরের ভেতর ইখতিয়ার উদ্দিন সমগ্র বাংলায় (লাখনাওয়াতি) ইসলামী শাসন কায়েম করেছিলেন কেন্দ্রীয় খিলাফতের স্বীকৃতি নিয়ে। ইখতিয়ারের পরের শাসকরাও মুদ্রা চালু করেছিলেন যার এক সাইডে কালেমা থাকতো আর অন্য সাইডে থাকতো ‘খলিফার সাহায্যকারী’ টাইটেল। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার এর সময় থেকে (১২০৩/৪) পুরো সুলতানি আমল (১৫৩৮) পর্যন্ত বাংলার শাসকরা এরকম মুদ্রা চালু করেছিল যার এক সাইডে লেখা থাকতো কালেমা আর অন্য সাইডে থাকতো টাইটেল ‘খলিফার সাহায্যকারী’ (নাসির আমিরুল মুমিনিন)। প্রখ্যাত ইসলামী ঐতিহাসিক হাফেয ইবন হাজার আসকালানি লিখেছিলেন বাংলার এক স্বাধীন নবাব জালালুদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ (১৪১৫-১৪৩১) আব্বাসি খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় মিশরের মামলুক সুলতান আল-আশরাফ বারসবে কে উপঢৌকন পাঠিয়েছিল যাতে সে স্বীকৃত পাইয়ে দিয়ে সাহায্য করে।

তাই বাম বুদ্ধিজীবীদের এই দাবী ডাহা মিথ্যা। বাংলা এবং ভারত অঞ্চল কেন্দ্রীয় খিলাফতের প্রদেশ ছিল। প্রায় ৫শত বছর খিলাফত এখানে শাসন করে গিয়েছিল, অবশ্যই মাঝে মাঝে কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু শরিয়াহ কোর্ট চালু ছিল, খিলাফতের গভর্নরদের দ্বারা এই অঞ্চল শাসিত হতো। বাঙালী মুসলিম সমাজে ইসলাম ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসেনি, এমনকি শুধু সুফিদের দ্বারাও প্রচার হয়নি, বরং শাসনব্যবস্থা হিসেবে চালু ছিল।

ইমতিয়াজ সেলিম

Leave a Reply