ভর্তি, নাকি আরেক ভোগান্তি?

এবছর ৬ জুন থেকে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। তার দাবি হচ্ছে ছাত্রছাত্রী ও অবিভাবকদের ভোগান্তি কমানো ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশন করা। যার অংশ হিসেবে তিনি টেলিটক সিমের মাধ্যমে এস এম এস ও শিক্ষাবোর্ডের প্রণীত ওয়েবসাইটে রেজিষ্ট্রেশন ও রোল নাম্বার দিয়ে ঢুকে কাঙ্ক্ষিত পাঁচটি কলেজ ও বিষয়ের জন্য আবেদন করার ব্যবস্থা করে দেন।

ডিজিটালাইজেশন শব্দটি শুনতে সুন্দর হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনা বলেও একটি কথা রয়েছে। তাই আসুন বর্তমান সরকারের ভর্তির ব্যাবস্থাপনার উপর একটু চোখ বুলাই-

১. রেজাল্টের ভিক্তিতে ভাল কলেজগুলোতে ভাল ছাত্র-ছাত্রী, মধ্যম মানের কলেজ গুলোতে মধ্যম মানের ছাত্র-ছাত্রী ও নিম্নমানের কলেজগুলোতে নিম্ন মানের ফলাফল করা ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হবে।

২. আবেদনকালে ছাত্রছাত্রীরা পাঁচটি কলেজ তাদের পছন্দের তালিকায় রাখলেও কোটা পুর্ণ হয়ে যাবার পর অনেক গোল্ডেন (A+) ধারী ছাত্রছাত্রীও তাদের পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পারছে না।

৩. কোটা পুর্ণ হয়ে যাবার পর সরকারই নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে, কে কোন কলেজে ভর্তি হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত কলেজে ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে অনেক ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকই বোবা কান্না কাঁদছেন।

৪. যদিও শিক্ষা নীতিমালার ২৮নং অনুচ্ছেদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো নাগরিককে ‘অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীনে’ আনা যাবে না বলেও উল্লেখ করা রয়েছে, কিন্তু সরকার নিজেদের নীতিমালাই মানছেনা।

৫. নতুন নীতিমালায় কোনো কলেজ ভর্তিপরীক্ষা নিতে পারবেনা বলা হলেও তিনটি কলেজের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা কার্যকর হচ্ছেনা। কলেজগুলো হচ্ছে- নটরডেম (অধ্যক্ষ: ফাদার হেমন্ত পিয়াস রোজারিও), হলিক্রস (অধ্যক্ষ: সিস্টার শিখা এল গোমেজ) ও সেন্ট জোসেফ কলেজে (অধ্যক্ষ: ব্রাদার রবি ফিউরিফিকেশন)।

৬. শুধুমাত্র রোল নাম্বার ও রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে আবেদন করার সুযোগ থাকায় একজনের রোল ও রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে শত্রুতাবসত আরেকজন পুরণ করে বিপদে ফেলে দিচ্ছে। পরবর্তীতে তা পরিবর্তনের কোন সুযোগ থাকছেনা।

৭. অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ও অবিভাবকদের কাছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট না থাকায় তারা বিভিন্ন দোকানে ভিড় জমায়, ফলে নিম্নমানের কলেজগুলোর সাথে সেসকল দোকানদারদের আর্থিক চুক্তি থাকায় ভালো ফলাফলকৃত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সুকৌশলে নিম্নমানের কলেজে ফেলা হচ্ছে। মুলত তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছে।

৮. বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থী ও অবিভাবকগণ অভিযোগ করেছেন:- সরকারের প্রণীত নতুন সার্ভার ভিত্তিক ওয়েবসাইট নানান সমস্যায় জর্জরিত। একজন নির্ধারিত পছন্দের পাঁচটি কলেজের জন্য আবেদন করলেও তার কলেজ পড়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত অন্য আরেকটি কলেজে। এমনকি আবার ছাত্র হয়েও কুমিল্লার রিয়াদ নামের এক ছেলের কলেজ দেওয়া হয়েছে সরকারী মহিলা কলেজ! (খবর: কুমিল্লার জমিন, তাং-০২/০৭/২০১৫)।

৯. একই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাশ করলেও অনেকেই ভর্তি হতে পারছেন না সেই প্রতিষ্ঠানের কলেজে। এ কারণে ফল প্রকাশের পর থেকেই ভিকারুন্নিসার অনেক ছাত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া আক্তার গণমাধ্যমকে জানান, ‘আমাদের এখান থেকে ভালো রেজাল্ট করে এসএসসি পাশ করেছে, কিন্তু বোর্ডের প্রকাশিত তালিকায় তাদের নাম নেই। এখন মেয়েরা অনেক কান্নাকাটি করছে।’

১০. এই সমস্যার সমাধান কী তা জিজ্ঞেস করা হলে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইন্দুভ’ষন ভৌমিক শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির প্রসঙ্গে বলেন, করার কিছুই নেই। যার যেখানে নাম এসেছে তাকে সেখানেই ভর্তি হতে হবে। তিনি আরো বলেন, তিনি নাকি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বলেছেন এভাবে সমস্যা হবে, কিন্তু তিনি তার কথা শুনেননি। শিক্ষামন্ত্রীও আশ্বস্থ করে যাচ্ছেন যে, অতি শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান করে দিবেন। যদিও দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি বলতে তিনি শুধুমাত্র (পায়ে এক জোড়া) স্যান্ডেল (থাকাকেই) বুঝেন!

উপরে উল্লেখিত সমাস্যাগুলোর গভীরে প্রবেশ করলে আমরা দেখবো এগুলো হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার ফসল। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে পুঁজিবাদ এরকম নানান সমস্যা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। পুঁজিবাদ মুলত ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, যার ফলে এর শিক্ষাব্যবস্থাও Self Interest এর ভিত্তিতেই প্রণয়ন করা হয়। এর শিক্ষা নীতিমালার মুল বিষয়গুলো একটি আদর্শ হতে উদ্ভুত হয় না। বহুমুখী চিন্তাভাবনার দরুন মানুষের চিন্তাও নানান ধরনের হয়। চিন্তার ঐক্য না থাকায় সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান বিভিন্ন হওয়ায় কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর উপচে পড়া ভিড় থাকে অপরদিকে কিছু প্রতিষ্ঠানে এর উল্টো। এই ব্যবস্থার অধীনে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অন্যান্য বিষয়ে দৃশ্যমান উন্নতি সাধিত হলেও মানুষের মুল যে উন্নতি অর্থাৎ আলোকিত চিন্তার বিকাশ হয়না এবং মানুষে মানুষে ভাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়না। পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার শিক্ষানীতি যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তা হল- স্বার্থের ভিত্তিতে সমাজ গঠন। তাই আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করেই নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তার ব্যক্তিগত মতকেই পুরো দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।

এই ভোগান্তি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে এমন একটি আদর্শ হতে উদ্ভুত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে যেটি কিনা একটি রাষ্ট্রের অধীনস্থ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই মানের কার্যক্রম নিশ্চিত করবে। যেটি মানুষকে সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত না করে আলোকিত চিন্তাধারী হতে সহায়তা করবে। যেটি মানুষে মানুষে ভাতৃত্বের বন্ধন স্থাপিত করবে ও মানুষের আত্মাকে প্রশান্তিতে পরিপুর্ণ করবে।

একটি আদর্শ হতে উদ্ভুত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে পারে শুধুমাত্র সেই ব্যবস্থা যেটি রাসূল (সা) ও তাঁর পরবর্তীতেও হযরত আবু বকর (রা), উমর (রা) দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। সেটি হল মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার মনোনীত খিলাফত ব্যবস্থা।

মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন-

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল-মায়েদা: ০৩)

মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো বলেন-

আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ। (সুরা নাহল: ৮৯)

খিলাফত ব্যবস্থায় ইসলামী আকীদাহ্‌ হবে শিক্ষানীতির মুল ভিত্তি। পাঠ্যসুচী এবং শিক্ষার পদ্ধতি এমনভাবে পরিকল্পিত হবে যাতে এই মুল ভিত্তি থেকে বিচ্যুত হবার কোন সুযোগ না থাকে।

খিলাফত ব্যবস্থায় শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির চিন্তা ও চরিত্রকে ইসলামী ব্যাক্তিত্বে রুপ দান করা। পাঠ্যসুচীর অন্তর্গত সকল বিষয়েরই এ ভিত্তির উপর গভীরভাবে প্রোথিত থাকা আবশ্যক

এভাবেই খিলাফতের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজানো হবে, যেটি তাঁর জনগণকে ভোগান্তি নয় বরং দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্য উপুযুক্ত করে গড়ে তুলতে সংকল্পবদ্ধ থাকবে। হে আল্লাহ! আমাদেরকে খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজটি দৃঢ়ভাবে করার তৌফিক দান করুন (আমীন)।

কুদরত উল্লাহ্‌

Leave a Reply