প্রশ্ন: “তোমরা যেমন, তোমাদের উপর সেরূপ শাসকই নিযুক্ত হবে” এই হাদীসটি কি দূর্বল (জায়ীফ), এর বিশুদ্ধতা কতটুকু?
উত্তর:
আদ-দায়লামী তার মুসনাদ আল-ফিরদাউসে হাদীসটি আবু বাকরা হতে মারফূ সনদে বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী শুয়াবুল ঈমানে আবু ইসহাক আল-শাবি’ হতে মুরসাল সনদে বর্ণনা করেছেন।
আল-সুয়ূতী হাদীসটি সম্পর্কে বলেন: এটি দূর্বল (জায়ীফ)
আল-শাওকানী বলেন, হাদীসটি: ইয়াহইয়া বিন হিশাম; ইউনুস বিন ইসহাক > তার পিতা > তার দাদা > আবু বাকরা হতে মারফূ সনদে এসেছে। আল-সাখাউঈ হাদীসটি সম্পর্কে বলেন, ইয়াহইয়ার হাদীসটি জাল হাদীসগুলোর অন্যতম যা ইয়াহইয়া বিন হিশাম > ইউনূস বিন ইসহাক > (আবু ইসহাক) উমর বিন আবদিল্লাহ (আস-সাবি’ঈ) হতে মুরসাল সনদে বর্ণিত। তারপর তিনি বলেন, এই হাদীসটি মুনকাতি’ (কর্তিত সনদবিশিষ্ট) এবং এর বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া বিন হিশাম (একজন) দূর্বল (রাবী)।
ইমাম আল-ফাতানীর তাজকিরাতুল মাওদু’আতে:
“তোমরা যেমন, তোমাদের উপর সেরূপ শাসকই নিযুক্ত হবে” এর সনদে ইনকিতা’ (কর্তন) রয়েছে এবং ওয়াদি হচ্ছে ইয়াহইয়া বিন হিশাম এবং তার একটি সনদের ধারা রয়েছে যাতে মাজহুল (অজ্ঞাত রাবী) রয়েছে।
সুতরাং, হাদীসটি দূর্বল বলে বিবেচিত হবে।
যাইহোক, হাদীসটিতে দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি এমন নয় যে আমরা শাসকদের জুলুম ও শরীআহ’র অনুপস্থিতির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থাকবো। ইমাম আল-মানাউই তার ফাইদুল কাদীর তথা আল-জামি’ আল-কাবীর এর ব্যখ্যায় (এর ৫ খণ্ডে) আলোচ্য হাদীসটির ব্যপারে ইমাম আস-সাখাউই বক্তব্য তুলে ধরেন যেখানে তিনি হাদীসটির দুর্বলতার কথা আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি বলেন, যদি আপনারা তাকওয়া অবলম্বন করেন এবং আল্লাহর শাস্তির ভয় করেন তবে তিনি এমন শাসক নিযুক্ত করে দেবেন যারা আল্লাহকে ভয় করেন এবং বিপরীতক্ষেত্রেও একই জিনিস প্রযোজ্য। তার এ বক্তব্য কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেখানে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তাদের প্রতি আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে তাদের তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে নেতৃত্ব (ইসতিখলাফ) প্রদান করবেন।” [সূরা নূর: ৫৫]
এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে মুসলিমদের মধ্য হতে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যদি ঈমান ও সৎকর্ম করে তবে তাদেরকে অবশ্যই শাসনক্ষমতা দেয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয়, আয়াতটিতে ‘মিনকুম’ বলার মাধ্যমে ‘আংশিকতা’ বা ‘ঈশারাতুত তাব’ঈদ’ রাখা হয়েছে, অর্থাৎ, সমগ্র উম্মাহ ভালোকাজ শুরু করলেই শাসনক্ষমতা আসবে, বরং সকলের উপরই দায়িত্ব বর্তায় সৎকাজে অংশগ্রহণ করবার এবং আল্লাহই বুঝবেন কখন উম্মাহ সে পর্যায়ে পৌছেছে যেখানে যথেষ্ট পরিমান উম্মত আল্লাহ সন্তুষ্টি অন্বেষনে ব্যকুল। তবে অনেকেই এসব হাদীস আয়াত পেশ করেন কাজ করবার জন্য উৎসাহিত করার জন্য নয় বরং কিছু কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখার নিমিত্তে। তারা বলে থাকেন, ব্যক্তিগতভাবে সৎকাজ করলেই আল্লাহ শাসনক্ষমতা বা খিলাফত রাষ্ট্র দিয়ে দিবেন। তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখতে চাই, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কি সৎকাজের মধ্যে পড়ে না? আমর বিল-মা’রূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্য পালনীয় হুকুম শর’ঈ। এবং গুরুত্বের দিক বিবেচনা করলে এই আমলটিই সবার অগ্রে থাকতে হবে অনেক সাধারন আমলের চেয়ে। উপরন্তু কিছু হাদীস অনুযায়ী, শুরুতে এই আমলটি অবহেলা করার কারণেই আমরা আল্লাহর আযাব (এক্ষেত্রে উদাহরসরূপ, খারাপ শাসক) ভাগ্যে পেয়ে থাকি।
আমাদের বুঝতে হবে আমরা ব্যক্তিগতভাবে ভালো কাজ করতে থাকলে সয়ংক্রিয়ভাবে সমাজ পরিবর্তন হয়ে যাবে না, কারণ ব্যক্তি চলে তার অন্তর্নিহিত চিন্তা দ্বারা আর সমাজ চলে একটি ব্যবস্থা দ্বারা যা সকল ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পরিচালিত করে। সুতরাং, যতক্ষন পর্যন্ত সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে পরিবর্তনের দাবি না তুলে তথা পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত না হয়, ততক্ষন পর্যন্ত সমাজ পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাও পবিত্র কুরআনে বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির মধ্যে যা আছে তা পরিবর্তন করেন না যতক্ষন না তারা (সেই জাতি) নিজেদের মধ্যে যা রয়েছে তার মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করে। [সূরা রা’দ: ১১]
এ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা চুড়ান্ত পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করেননি বরং জাতি বা কাওম’কে নির্দিষ্ট করেছেন।
সুতরাং, আমাদের সকলকেই সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ নিতে হবে, পরাজনৈতিক সচেতন হতে হবে, প্রকাশ্যে কথা বলতে হবে, আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিতে হবে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে হবে এবং চুড়ান্ত সাফল্যের আগ পর্যন্ত তা ঐক্যবদ্ধভাবে চালিয়ে যেতে হবে। একাজে ভয়-ভীতি, জেল-জুলুম ও ত্যাগ-তিতিক্ষা থাকবেই, তবে তাতে পিছিয়ে পড়লে চলবে না, নিস্ক্রিয় হয়ে গেলে হবে না। বরং, প্রতিটি বাধা উপেক্ষা করার মানসিকতা পোষন করতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষনে ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় মানসিকতা পোষন করতে হবে। এভাবেই দুনিয়ায় ইসলামের বিজয় ও সাফল্য আসবে, আর আখিরাতের যে সাফল্য মুমিনদের জন্য অপেক্ষা করছে তা অনন্য।
وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
সুতরাং, ঈমানদারদের সুসংবাদ দান করুন.. [সূরা সফ: ১৩]