বাইতুল-মাল ও এর বিভাগ সমূহ

নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ আবদুল কাদীম যাল্লুম (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আল-আমওয়াল ফী দাওলাতিল খিলাফাহ’ বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে গৃহীত

বাইতুল-মাল বা ট্রেজারি (State Treasury) বলতে এমন সক্ষম কর্তৃপক্ষকে বুঝানো হয় যা মুসলিমদের ন্যায্য অধিকার পূরণার্থে রাষ্ট্রের সমস্ত আয় ও ব্যয়ের জন্য দায়িত্বশীল। অতএব ভূমি, দালানকোঠা, খনিজ, অর্থ বা ব্যবসায়িক পণ্য প্রভৃতি যেসব সম্পদের উপর মুসলিমগণ শর’ঈ হুকুম অনুযায়ী অধিকারপ্রাপ্ত, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য তা নির্ধারিত নয়, তবে কোন খাতে এগুলো ব্যয় করা হবে সেটা নির্ধারিত, সেগুলোই হচ্ছে মুসলিমদের ট্রেজারির মালিকানাধীন সম্পদ, এক্ষেত্রে এটা বিবেচনার বিষয় নয় যে এই সম্পদগুলো ইতিমধ্যে ট্রেজারির সংরক্ষণের আওতায় চলে এসেছে নাকি আসেনি। অনুরূপভাবে, অধিকারপ্রাপ্ত মালিক ও ব্যবহারকারীদের জন্য অথবা মুসলিমগণ ও তাদের দেখাশোনার জন্য অথবা ইসলামের দাওয়াহ বহন করবার জন্য যেসব সম্পদ ব্যয় করতে হবে – একসকল তহবিলের ক্ষেত্র ট্রেজারির দায়িত্ব- এক্ষেত্রে এসব তহবিল খরচ হলো কি হলো না – তা বিবেচ্য নয়। অতএব এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ট্রেজারি হচ্ছে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ।

অন্য এক অর্থে, ট্রেজারি বলতে এমন স্থানকে বুঝানো হয় যেখানে রাষ্ট্রের আয় জমা রাখা হয় এবং যেখান থেকে তা ব্যয় করা হয়।

উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অর্থে প্রথম ট্রেজারি প্রতিষ্ঠিত হয় নিম্নোক্ত আয়াতখানি নাযিলের পর:

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

“তারা আপনার কাছে আনফাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে। বলে দিন, আনফাল হল আল্লাহর ও রাসূলের। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম মান্য কর, যদি ঈমানদার হয়ে থাক।” [আল-আনফাল ১]

এই আয়াতখানি মূলত নাযিল হয় বদরের যুদ্ধ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে, যখন মুসলিমরা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। সাঈদ ইবনু জুবায়ের কর্তৃক বর্ণিত: আমি সূরা আনফাল সম্পর্কে ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন “এটা বদরের সময় নাযিল হয়েছে।” আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ অভিযানের পর বদরই প্রথম যুদ্ধ যেখানে মুসলিমরা অনুরূপভাবে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্জন করেছিল, যার বণ্টন সম্পর্কে আল্লাহ তখন হুকুম বর্ণনা করলেন। তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে মুসলিমদের সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং রাসূল (সা) কে নির্দেশ দিলেন যাতে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এ সম্পদকে তিনি মুসলিমদের সর্বোত্তম স্বার্থে ব্যবহার করেন। অতএব, ট্রেজারির এসব সম্পদকে মুসলিমদের অভিভাবক নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এমনভাবে ব্যয় করার ব্যাপারে দায়িত্বশীল যাতে তারা সর্বাধিক উপকৃত হতে পারে।

রাষ্ট্রের আয় জমা রাখা এবং ব্যয় করার স্থান অর্থে যদি আমরা ট্রেজারিকে চিন্তা করি তাহলে রাসূল (সা) জীবদ্দশায় এরূপ কোন স্থান ছিলনা; কারণ এসময় আয় ছিল স্বল্প এবং মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন ও মুসলিমদের দেখাশোনার কাজে ব্যয়ের পর আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট থাকতনা। প্রত্যেক যুদ্ধের শেষে রাসূল (সা) সমস্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও পঞ্চমাংশ (খুমুস) বণ্টন করে দিতেন। সম্পদ বণ্টন করা অথবা উপযুক্ত খাতসমূহে ব্যয় করার ক্ষেত্রে তিনি (সা) দেরি করতেননা। রাসূল (সা) এর একজন হিসাবরক্ষক হানযালা ইবনু সাইফি কর্তৃক বর্ণিত: “রাসূল (সা) আমাকে বললেন: (الزمني وأذكرني بكل شيء لثالثه) আমার সাথে থাক এবং সবকিছু স্মরণ করিয়ে দাও এর তিন দিনের মধ্যেই। তিনি বলেন: এজন্য যেকোনো সম্পদ অথবা খাবার অথবা অর্থ আমি গ্রহণ করতাম তা তিন দিনের মধ্যেই স্মরণ করিয়ে দিতাম।ফলে সবকিছু ব্যয় না করে রাসূল (সা) রাত্রি যাপন করতেননা।” অধিকাংশ ক্ষেত্রে একদিনের মধ্যেই সমস্ত সম্পদ বণ্টিত হয়ে যেত। আল-হাসান ইবনু মুহাম্মাদ কর্তৃক বর্ণিত যে, রাসূল (সা) কখনোই দুপুর বা রাত পর্যন্ত সম্পদ জমা রাখতেননা, “অর্থাৎ, সকালে হাতে পেলে তিনি দুপুরের মধ্যেই বণ্টন করে দিতেন এবং বিকালে পেলে তা রাতের মধ্যেই ব্যয় করে ফেলতেন।” ফলে কখনোই এমন কোন সম্পদ অবশিষ্ট থাকতোনা যার জন্য কোন জায়গা বা রেকর্ডবুকের প্রয়োজন ছিল।

রাসূল (সা) এর জীবদ্দশায় এ কাজটি এভাবেই সম্পাদিত হতো। খলীফা নিযুক্ত হবার পর আবু বকর (রা) তার খিলাফতের প্রথম বছর একইভাবে এ কাজ সম্পাদন করলেন। যেকোনো অঞ্চল থেকে কোন সম্পদ আসলে তিনি তা মসজিদে নববীতে নিয়ে আসতেন এবং অধিকারপ্রাপ্তদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। একাজে তিনি তার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিলেন আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহকে। একাজে নিযুক্ত হওয়ার পর আবু উবাইদাহ তাকে বললেন: আমি আপনার পক্ষ থেকে সম্পদের দেখাশোনা করব। যাই হোক, খিলাফতের দ্বিতীয়বর্ষে আবু বকর (রা) নিজের ঘরে একটি জায়গা নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে ট্রেজারির সূচনা করলেন, যেখানে তিনি মদীনায় আগত সমস্ত সম্পদ জমা করতেন এবং এর সবকিছুই মুসলিমদের দেখাশোনার কাজে ব্যয় করতেন। আবু বকর (রা) এর ইন্তেকালের পর যখন উমর (রা) খলীফা নিযুক্ত হলেন, তিনি দায়িত্বশীলদের জড়ো করলেন এবং আবু বকর (রা) এর বাসগৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি ট্রেজারি খুলে একটি ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া কেবল একটি দিনার পেলেন। উমর (রা) এর সময়ে যখন প্রচুর এলাকা বিজয় হচ্ছিল এবং মুসলিমরা কিসরা (পারস্য) ও কায়সার (রোমান) এর ভূখণ্ডে বিজয় লাভ করতে লাগল তখন মদীনায় আগত সম্পদের পরিমাণও প্রচুর বৃদ্ধি পেল, ফলে উমর (রা) তখন এগুলোর জন্য একটি ঘরকে নির্দিষ্ট করে দিলেন। এগুলোর জন্য তিনি একটি অ্যাকাউন্ট বুক খুললেন এবং অ্যাকাউন্ট্যান্টদের নিয়োগ দিলেন, এখান থেকে ভাতা নির্ধারণ করলেন এবং সশস্ত্র বাহিনীকে অস্ত্রে সজ্জিত করলেন। অবশ্য মাঝেমধ্যে তিনি তার হাতে আসা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের পঞ্চমাংশ মসজিদে নিয়ে আসতেন এবং বিলম্ব না করে সেগুলো বণ্টন করে দিতেন। ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত: “একদিন উমর আমাকে ডাকলেন। আমি তার কাছে গিয়ে দেখলাম যে তিনি একখণ্ড কাপড়ের পাশে বসে আছেন যার উপরে প্রচুর স্বর্ণের টুকরা ছড়িয়ে আছে। তিনি বললেন: আসো এবং এগুলো নিয়ে নিজেদের লোকজনের মধ্যে বণ্টন করে দাও, আর আল্লাহই ভাল জানেন কেন তিনি রাসূল (সা) ও আবু বকরকে না দিয়ে এর পরে আমাকে এই দায়িত্ব অর্পণ করলেন? এর মাধ্যমে তিনি আমার কাছ থেকে কল্যাণ কামনা করেন নাকি অকল্যাণ? আবদুর রহমান ইবনে আউফ থেকে বর্ণিত: একদিন দুপুরে উমর আমাকে ডাকলেন, তাই আমি তার কাছে গেলাম। তিনি আমার হাত ধরে একটি ঘরে নিয়ে গেলেন যেখানে কিছু বস্তার স্তূপ জমা ছিল। তিনি বললেন: “এখন আল-খাত্তাবের পরিবার আল্লাহর চোখে অনেক ছোট হয়ে গেল, কসম আল্লাহর, এতে যদি আমাদের সম্মানিত হওয়ার মত কিছু থাকত তাহলে আল্লাহ আমার দুই সঙ্গীকেও এভাবে দিতেন এবং তারা একাজে আমাকে একজন উত্তরসূরি হিসেবে রেখে যেতেন।” আবদুর রহমান বলেন: “তিনি যা নিয়ে এসেছেন তা দেখে আমি বললাম ‘হে আমিরুল মু’মিনীন, আপনি বসুন, আমরা (এ ব্যাপারে) চিন্তা করি।’ তিনি বলেন: ‘আমরা বসলাম এবং মদীনার সমস্ত লোকের নাম লিখলাম, আমরা যারা আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ ছিলাম তাদের নাম, রাসূল (সা) এর স্ত্রীগণের নাম এবং তারপরে অন্যদের নাম লিখলাম।’ ”

এভাবেই মুসলিমরা গোড়াপত্তন করলেন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ট্রেজারির যেখানে সম্পদ জমা করা হতো এবং রেকর্ডবুক রাখা হতো, যেখান থেকে ভাতা প্রদান করা হতো এবং অধিকারপ্রাপ্তদের তাদের তহবিল পৌঁছিয়ে দেওয়া হতো।

Please note that this is a draft translation. It is likely to go through further edits. So, please check back often for any newer version.
Link for English translation of the book “Funds in the Khilafah State

Posted by Visionary 

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply