মুসলিম সেনাবাহিনী, তাগুত, নুসরাহ ও খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা

মুসলিম সেনাবাহিনী, তাগুত, নুসরাহ ও খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা: একটি ফিকহি (আইনী) ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা

ইদানিং খুব শোনা যায় খিলাফাহ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ভূমিসমূহের “ক্ষমতাধর গোষ্ঠী” (আহল উল হাল ওয়াল ‘আকদ) তথা মুসলিম আর্মিদের কাছ থেকে “নুসরাহ” (সহায়তা) চাওয়া নাকি বোকার স্বর্গে বসবাস। যেসব মুসলিম ভাইরা এ ধারনাটি পোষণ করেন, নিম্নে তাদের কিছু যুক্তি তুলে ধরা হল:

– মুসলিম বিশ্বের আর্মি হোল তাগুত (খোদাদ্রোহী শক্তি) যারা সাম্রাজ্যবাদী কুফর শক্তিকে টিকিয়ে রাখার মূল ইন্সট্রুমেন্ট। যেমন, ১৯৯২ সনে আলজেরিয়ায় বিপুল ভোটে বিজয়ী “ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট” (এফ আই এস) কে ক্ষমতাচ্যুত আর্মি করেছিল, এবারো যেমন আমরা দেখলাম মিসরে। তাই কিভাবে আমরা তাগুত এর কাছ থেকে নুসরাহ চাইতে পারি যাদের কাজই হোল খিলাফাতের পুনুরুত্থান ঠেকানো?

– মুসলিম আর্মিরা হল “মুরতাদ” (ধর্মভ্রষ্ট) কারন তারা কুফফার দের দালাল শাসনযন্ত্রেরই অংশ। আর আল্লাহ বলেছেন যারা কুফফার দের সহায়তা করবে তারা তাদেরই একজন বলে বিবেচিত হবে (সূরা মাইদা, ৫১)। এক্ষেত্রে জেনে নেয়া ভাল যারা মুসলিম আর্মিদের মুরতাদ বলছেন তারা “কাফির আসলি” (জন্মগতভাবেই যারা কাফির যেমন, ইহুদি) এবং মুরতাদ এর ভেতর পার্থক্য নিরুপন করেন। তারা বলে থাকেন মুসলিম আর্মি হোল মূলত “মুরতাদ আল-ইস্তিহলাআল” অর্থাৎ আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা তারা না মেনে নিজেরাই মুসলিমদের খুন করা জায়েয করছে।

– মুসলিম আর্মিদের হাতে স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের রক্ত লেগে আছে। পাকিস্তানের লাল মসজিদের জামিয়া হাফসা মাদ্রাসায় বর্বরোচিত হামলা, মিসরে মুরসি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আর্মি দ্বারা সীমান্তে অবস্থানকারী মুজাহিদিনদের নির্বিচারে খুন ইত্যাদি। তাই এরা মুরতাদিন।

– আর্মিদের কাছ থেকে নুসরাহ চাওয়া হোল “বিদআত”

– গত ৫০ বছর যাবতইতো ওদের কাছ থেকে নুসরাহ চাওয়া হোল। এখনো এই স্বপ্ন ভাংছেনা কেন?

এবার একটু এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক: দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে এই আলোচনায় –

১। আকীদা সংক্রান্ত, ২। খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার “মানহাজ” (পদ্ধতি)

প্রথমেই বলব “ব্ল্যাঙ্কেট তাকফীর” বা ঢালাওভাবে কাফের ঘোষণা দেয়া হবে মহা বড় এক গুনাহ যার ব্যাপারে আমাদের খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। থিওলজিকাল বা আকিদা সংক্রান্ত আলোচনার বেশী গভীরে যাব না কারণ ক্লাসিকাল মুজতাহিদিনরা যেসব ক্যাটেগরি বলেছেন একজনের পক্ষে কাফির হওয়ার জন্য তার কোনটির ভেতরই আর্মিদের “ঢালাওভাবে” ফেলা যায় না। যেমন, কুফর আল তাকধিব (সম্পূর্ণরূপে ইসলাম অস্বীকার করা), কুফর আল ইবা’ ওয়াত তাকাব্বুর মা’আত তাসদিক (অহঙ্কারবশত আল্লাহর হুকুম মেনে না নেয়া), কুফর আশ শাক ওয়া আল থান (ঈমানের ৬ টি স্তম্ভের যেকোনো একটিও যদি অস্বীকার করা হয়), কুফর আল ই’রাদ (ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য জানার পরও মুখ ফিরিয়ে নেয়া), এবং কুফর আন নিফাক (মুনাফিকি বিশ্বাস)।

বর্তমান বাস্তবতার আলোকে বলা যায় মুসলিম ভূখণ্ডের সেনাবাহিনীর একেবারে উপরিভাগ আসলেই কুফফারদের দালালি করছে যাতে কোন সন্দেহ নেই। তারা উপরের যেকোনো ক্যাটেগরিতে পরে কিনা এটা নিয়ে আলোচনা করতে চাইনা। আমাদের কাজ হবে খিলাফাহ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে এই সোল্ড আউট সেকশন কেও আল্লাহর দিকে আহ্বান করা ও আযাবের ব্যাপারে ভয় দেখানো, যেমনটি ফিরাউনকে মুসা আলাইহিস সালাম দেখিয়েছিলেন যখন আল্লাহ বললেন “হে মুসা! তুমি ফিরাউন এবং তার দলকে আল্লাহর পথে এখন আহ্বান কর”। ফিরাউন এই আহ্বান মেনে না নিয়ে অহঙ্কারবশত ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে আল্লাহ বলেন ফিরাউনকে আযাবের ভয় দেখাতে।

যদি তাগুতকে সহায়তা করার কারনেই আর্মিদের মুরতাদ বলতে হয়, তাহলে এই একই চিন্তার আলোকে মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মুসলিমদেরও মুরতাদ বলতে হবে কারন তারা নির্বাচনে ভোট দিয়ে তো তাগুত ক্ষমতায় বসাচ্ছে? সচিবালয়ের সকল মুসলিমদের মুরতাদ বলতে হবে কারন তারা তাগুতি সরকারকে সচল রাখতে সাহায্য করছে? সিটি কর্পোরেশনের ঝাড়ুদারও বাদ পরবে না কারন তারাও এই তাগুতি সরকারের অংশ। আরো জিজ্ঞাসা করতে চাই যে হেফাযতে ইসলামের আন্ডারে যতোগুলো ইসলামি রাজনৈতিক দল আছে যার ভেতর অনেক বড় ওলামা আছেন যারা অবশ্যই ভুল উসূলের কারনে নির্বাচনে ভোট দেন, তাদেরকেও কি আমরা মুরতাদ বলব? প্রান্তিক চাষি যারা তাগুতি সরকারের কৃষিনীতি সচল রেখেছে এবং কাস্টমস এর একজন দরিদ্র ৪র্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা যে পণ্যের ওপর সীল ছাপ্পড় মারে তারাও তো এই ব্ল্যাঙ্কেট তাকফীর থেকে মুক্ত হওয়ার কথা না!!!

তাই আমাদের এই ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্থক্য তৈরি করতে হবে – ফাসিক (পাপী) এবং কাফির বা/এবং মুরতাদ এর ভেতরে; হারাম করে গুনাহগার হওয়া এবং কাফের হওয়ার ভেতরকার পার্থক্য বুঝতে হবে। লাল মসজিদ এর অন্যায়ভাবে খুনের জন্য যারা পাকিস্তানি আর্মিদের কাফির/মুরতাদ বলছেন তাদের প্রশ্ন করা যায় ইয়াযিদ যখন মুসলিমদের খুন করল যার ভেতর রাসূলের (সা) দৌহিত্র এবং সাহাবারাও ছিলেন, ম্যাজরিটি ক্লাসিক্যাল উলামারা ইয়াযিদ কে কাফির বলে নাই; ফাসিক বলেছিল। ওনাদের এই মত ইমাম গাযালি (রা) এরুপে তুলে ধরেছিলেন যে হারাম কাজের জন্য কাউকে কাফির ঘোষণা দেয়া যায় না এমন কি এক মুসলিম ওপর মুসলিম কে খুন করলেও (শার বাদ আল-আমালি, মোল্লা আলি আল-কারি)।

এবার আসা যাক খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার “মানহাজ” সঙ্ক্রান্ত বিষটিতে। যেহেতু দারুল ইসলাম ধ্বংস কখনো রাসূলের সময় হয়নি যাতে উনি দেখাতে পারেন কি করে আবার রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়, তাই “মানহাজ” এর আলোচনাটি পুরাই “ইজতিহাদি” (অর্থাৎ অতীতের দলীল থেকে বর্তমান বাস্তবতার যোগ তৈরি করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো)। তাই “তাহকিক উল মানাত” (বর্তমান বাস্তবতার পর্যালোচনা) এটাই বলে বর্তমানে আমরা দারুল কুফরে আছি এবং “তাখরিজুল মানাত” (কুরান/সুন্নাহর দলীল পর্যালোচনা বা “তানকিহ” করে শরী’আহ হুকুম এক্সট্রাক্ট করা) এটাই বলছে রাসূলের মক্কী যুগের কর্মপদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে যদি দারুল ইসলাম (খিলাফত) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাই কারণ মক্কী বাস্তবতায় মানহাজ এর দলীল বিদ্যমান। এইখানে এও বলে রাখা আবশ্যক যে বর্তমান যুগের সাথে মক্কী যুগের তুলনা করা হচ্ছেনা, বরং মক্কী যুগ থেকে শুধুমাত্র মানহাজ এক্সট্র্যাক্ট করা হচ্ছে। তাই সিরাতে দেখতে পাই রাসূল প্রায় ৪০ থেকে ৭০ টি গোত্রের কাছে গিয়েছিলেন “তালাব আন নুসরাহ” (রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য চাওয়া) এর জন্য। তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে জড়িয়েছিলেন কিন্তু কোনভাবেই সশস্ত্র সংগ্রামে জড়াননি।

তাই আমাদের আরও বুঝতে হবে “জিহাদ” যা খিলাফাহ রাষ্ট্রের একটি বৈদেশিক নীতির অংশ (জিহাদুদ-দাফ বা রক্ষণাত্মক জিহাদ ব্যাতিত যা সর্বাবস্থায় ফরয যদি শত্রুর আক্রমণের শিকার হই), এর সাথে খিলাফাহ রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি মৌলিক পার্থক্য আছে; দুটিকে গুলিয়ে ফেললে চলবেনা। তাই জিহাদ কখনই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি হতে পারে না, বরং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আইডিওলজি প্রচারের মূল একটি মাধ্যম। আকাবার দ্বিতীয় শপথের সময় আব্বাস ইবন উবাদা আল-আনসারির প্রস্তাব ছিল “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি আদেশ দেন তবে রাতের অন্ধকারেই আমরা তরবারি নিয়ে মিনায় আক্রমন চালাতে পারি”, প্রত্যুত্তরে রাসূল বলেছিলেন “এখনো আমাদের এই আদেশ দেয়া হয়নি”। হিজরতের পর জিহাদ এর হুকুম নাযিল হয়েছিল সূরা বাকারাতে। তাই আমরা দেখতে পাই রাসূল নুসরাহ তালাব ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেননি দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। বরং নুসরাহ খোজা এজন্যই ফরয কারন তা আল্লাহর নির্দেশ ছিল। আল-হাকিম, বাইহাকি, এবং আবু নাইম হযরত আলী (রা) হতে বর্ণনা করেছেন, “যখন নবী (সা)-কে আল্লাহ নির্দেশ দিলেন গোত্রগুলোর কাছে নুসরাহ চাইতে, তখন রাসূল (সা) ও আমি (আলী) মিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আবু বকর কে সাথে নিয়ে”।

আর যারা গত ৫০ বছরেও তাদের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি তাই কোন লাভ নেই, তাদের শুধু বলব আমাদের রাসুলের সিরাত অনুসরণ করতে হবে। সফলতা আল্লাহর হাতে। আল্লাহর রাসূল যখন আরব গোত্রগুলোর কাছ থেকে নুসরাহ চেয়েছিলেন তখনও কাফের মুশরিকরা হেসেছিল, তখনও ‘তালাব উন নুসরাহ’ অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। এবং রাসূলের মাথায় এটা কোন ভাবেই ছিলনা যে মদীনায় আল্লাহ আওয/খাজরাজদের তৈরি করছিলেন। খিলাফত ধ্বংসের পর মুসলিমদের জাতীয়তাবাদ নামক মহামারী রোগ থেকে বের করে আনাটাও সেরকম অবিশ্বাস্য একটি কাজ এখনো মনে হয়। তাহলে কি আমরা এই কাজ বন্ধ করে দিবো?

পরিশেষে এটিও জেনে নেয়া ভাল সিরিয়ার আসাদ সরকার তাদের পদাতিক ডিভিশন কে এখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে নামাতে ভয় পাচ্ছে কারণ ইতিমধ্যে অনেক আর্মি ডিফ্যাক্ট করে জিহাদ এ যোগদান করেছে এবং সিরিয়ান বিমানবাহিনী যেখানে ৩০% সুন্নি তারাও ডিফ্যাক্ট করার পথে। তাই ঢালাওভাবে তাগুত/মুরতাদ না বলে যারা নিষ্ঠাবান আছে তাদের ঈমান কে জাগ্রত করার চেষ্টা আমাদের করা উচিত ইনশাল্লাহ।

ইমতিয়াজ সালিম

Posted by Visionary 

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply