কিছুদিন আগে পল্টন গিয়েছিলাম। আজাদ প্রডাক্টস এর থেকে খানিকটা সামনে এগোতেই দেখা গেলো সমাবেশ হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে নারীনীতি ও আনুসাঙ্গিক বিষয়ে ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে। নোয়াখালী টাওয়ারের নিচ থেকে শুরু করে বেশ অনেকদূর পর্যন্ত নেত-কর্মীদের ভীর লক্ষ্য করার মতো। এখানে সমাবেশের কারণ জিজ্ঞেস করলে জানা গেলো, অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিলো মুক্তাঙ্গনে। কিন্তু সরকার মুক্তাঙ্গনে ১৪৪ ধারা জারি করার কারণে বাধ্য হয়ে এখানে সমাবেশ করতে হচ্ছে। এর কয়েকদিন আগে মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করতে অনেকে পুলিশের লাঠিচার্জ ও গণগ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। তাই বাধ্য হয়েই এখানে সমাবেশ করতে হচ্ছে।
গত ০৪ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী পালনের জন্য আসতে চাইলে মুফতী ফজলুল হক আমিনীকে লালবাগে নিজ বাসার নিচেই তাকে বাঁধা দেয়া হয়। বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে মুফতী আমিনী অভিযোগ করেন তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। তবে মুফতী আমিনীকে অবরুদ্ধ করার কথা অস্বীকার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিন দিন আগে আমিনীর মেয়ের জামাই জনাব জুবায়ের আহমাদ পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্ত চেয়ে লালবাগ থানায় জিডি করেছেন। সুতরাং আমিনীর নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন তাদের উপর। তাই তারা আমিনীর নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে বের হতে দিচ্ছেন না।
উপরোক্ত বাস্তবতা বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং শীর্ষ ইসলামী রাজনৈতিক দলের। যারা বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ইসলামিক ইস্যুতে কিছুটা সক্রিয় আন্দোলন করার চেষ্টা করছেন তাদেরই এই অবস্থা। এর বাইরে বাকি যেই ইসলামী দল আছে তাদের অবস্থাও এর চেয়ে ভালো নয়।
ইসলামী আন্দোলনের যেই উত্তাল ঢেউ এক সময় মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে পল্টন ময়দান পর্যন্ত লাখো জনতাকে আলোড়িত করতো, লংমার্চের ঘোষণায় সারা দেশ জুড়ে ইসলামী রাজনীতির যেই সুবাতাস বয়ে যেতো, বর্তমান আমলে সেটি বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট তারপর মুক্তাঙ্গন হয়ে এখন নিজ দলের অফিসের সিঁড়িতে এসে ঠেকেছে। এটি কি ইসলামী দল, নেতৃবৃন্দ আর ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী লাখো লাখো তৌহিদী জনতার জন্য সুখবর না দু:সংবাদ, তা আজ ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইসলামী দল গুলো এবং তাদের আন্দোলন যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে ইসলামী দল গুলো যে প্রেসরিলিজ সর্বস্ব দলে পরিণত হবে না, তার কি গ্যারান্টি কে দিবে?
ইসলামী দল ও তাদের জনসম্পৃক্ততা : বয়স্ক মুরুব্বীদের অনেক সময় গল্প করতে শোনা যায় যে, আমাদের ছোট বেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিষ এতো এতো সস্তা ছিলো। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, আর গোয়াল ভরা গরু ছিলো… ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ যখন ইসলামী দলের অতীত ও বর্তমান আন্দোলন সম্পর্কে আমার নিজের অল্প কয়েক বছরের দেখা প্রেক্ষাপট গুলোর পর্যালোচনা করছি তখন নিজেকে নিজের কাছেই সেই বৃদ্ধের মতো মনে হচ্ছে। লাখো লাখো মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশ গ্রহণে পল্টন ময়দানের সেই জোয়ার কিংবা মানিক মিয়া এভিনিউতে কাদিয়ানী বিরোধী উত্তাল সেই আন্দোলন গুলো আজ যেন স্বপ্নের মতো। প্রশ্ন জাগছে, ইসলামী আন্দোলনের প্রতি গণ মানুষের সেই সমর্থন ও সহমর্মিতা কি আজও আছে? ইসলাম দল গুলোর প্রতি ধর্মপ্রাণ দেশবাসীর আকাঙ্খা কি ইসলামী নেতৃবৃন্দ অনুভব করতে পারেন? তাহলে কেন তারা দিন দিন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হচ্ছেন। কেন তারা জাতির আন্তরিক কামনা একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে সুনির্দিষ্ট কর্ম পদ্ধতি ও কর্মসূচি দিতে পারছেন না? কেন তাদের আন্দোলনে জনগণের গণসম্পৃক্ততা দিন দিন কমে যাচ্ছে?
একথা অনস্বীকার্য যে আগে এদেশে যেভাবে এবং যেই ব্যাপক সংখ্যক গণমানুষের সম্পৃক্ততা নিয়ে ইসলামী আন্দোলন গড়ে উঠতো, ইসলামী নেতৃবৃন্দের ডাকে লাখো লাখো মানুষ ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসতো, অনেক ক্ষেত্রেই আজ আর তেমনটি দেখা যায় না। বর্তমান সময়ে ইসলামী দল গুলোর কর্মসূচীতে নেতৃবৃন্দের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক কিংবা সামান্য ভক্ত-মুরীদই মূল দর্শক স্রোতা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। কেন এমনটি হচ্ছে? দিন দিন কেন ইসলামী দলগুলো তাদের আন্দোলনে গণমানুষের ব্যাপক অংশকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না। দিন দিন তাদের সক্রিয় অনুসারীদের সংখ্যা কমার পরিবর্তে বাড়ছে না?
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর পেছনে যে সকল কারণ দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:
১. সুনির্দিষ্ট চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণে অপারগতা।
২. গণমানুষের দৈনন্দিন সমস্যার ইস্যু গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া।
৩. আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ভাঙ্গন।
৪. বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তাল আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে হঠাৎ খেই হারানো।
৫. নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার পরিবর্তে কখনো বিএনপি বা কখনো আওয়ামীলীগের শরণাপন্ন হওয়া।
৬. অনেক ক্ষেত্রে অনেকের বিরুদ্ধে আঁতাতের অভিযোগ।
আমাদেরকে অবশ্যই বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। নিজেদের মূল সমস্যা চিহ্নিত করে তাকে দূর করার জন্য আন্তরিক হতে হবে। বাংলাদেশের ইসলামী দলসমূহের জন্ম এবং তাদের আন্দোলনের ইতিহাস বলে, এদেশে ইসলামী সংগঠনের সৃষ্টি হয় কেবলমাত্র এক দু’জন বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক আর তাদের আন্দোলন হয় ছোট খাটো ইস্যু ভিত্তিক। সেই ইস্যু শেষ হয়ে গেলে বা বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় সেই ব্যাক্তি ইন্তেকাল করলে বিলুপ্তি ঘটে সেই দলের ও তাদের ইস্যুভিত্তিক রাজনীতির।
অনেক সময় সেই বরেণ্য ব্যক্তির ইন্তেকাল বা তার বার্ধক্যেই সংগঠনে সৃষ্টি হয় বিভক্তি ও সীমাহীন মতপার্থক্যের। একটি দল ভেঙ্গে একই নামে সৃষ্টি হয় ২, ৩, ৪ টি দলের। অনেক সময় এই সংখ্যা গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রত্যেকটি দলই পূর্বের সেই একটি নামই ব্যবহার করে এবং প্রত্যেকেই তাদেরকে মূল দল ও সংগঠনের লোক বলে দাবী করতে থাকে।
এর মূল কারণ হচ্ছে, এদেশের ইসলামী দলগুলো ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠার মহান ও চূড়ান্ত ইস্যূ নিয়ে মাঠে নামে না। জনগণের সামনে তারা জনগণের প্রত্যাহিক সমস্যার ইসলাম সম্মত সমাধান তুলে ধরতে পারে না। প্রচলিত গণতান্ত্রিক পুজিবাদী শাসনব্যবস্থার বাইরে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি মডেল জাতির সামনে তুলে ধরতে তারা অক্ষমতার পরিচয় দেন। কখোনো এ দলে কখনো বা ও দলে কেবলমাত্র কয়েকটি আসন লাভের জন্য ভীড় জমান। ফলে জনগণ তাদেরকে আওয়ামীলীগ বা বিএনপির বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করার কোন কারণ খুঁজে পায় না। অনেকেই হয়তো আমার সাথে এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেন, তবুও সত্যের জন্য বলতে হচ্ছে যে, রাজনীতির ময়দানে ইসলামী দলগুলো যেই সকল ইস্যু নিয়ে সরব হয়, জনগণ তাদের প্রত্যাহিক কাজের ক্ষেত্রে সেই ইস্যুর কোন প্রয়োজন মনে করে না বা অনুভব করতে পারে না। উদাহরণত: ইসলামী দলগুলো যখন ফতোয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলো তখন এই আন্দোলনে কওমী মাদ্রাসাসমূহের ছাত্র, ইমাম-খতীব ও আলেম-উলামা ছাড়া ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খুব সামান্য অংশই অংশগ্রহণ করেছিল।
একইভাবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের বিতর্কিত খতীব নিয়োগের পর সারাদেশের সকল হক্কানী উলামায়ে কিরাম যেভাবে এর প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন আমার জ্ঞাতসারে নিকট অতীতে আর কোন ইস্যুতে তারা সকলে এমন সরব ও সক্রিয় হননি। কিন্তু ফলাফল কি?
অবশ্যই শূন্য। কারণ আলেম-উলামা ও ইসলামী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা একেবারে ছিলো না বললেই চলে। দেশের আপামর জনসাধারণের বড় একটি অংশ ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং ইসলামী শরীয়া সম্পর্কেই অবগত নয়। আর বায়তুল মোকাররমের ইমাম পরিবর্তন নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। কারণ এটি তাদের প্রত্যাহিক সমস্যার কোন অংশ নয়।
এক্ষেত্রে ইসলামী দলসমূহের ব্যর্থতা হলো তারা এই সকল ইস্যুকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও খিলাফত রাষ্ট্রের শাসন তথা কুরআন-সুন্নাহর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে জনগণকে আহ্বান করে তার সাথে এই ফতোয়া বা খতীব সমস্যার লিঙ্ক করতে পারেন নি। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অতীতের বাংলাদেশ আর বর্তমানের বাংলাদেশ এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে এদেশের গণমানুষের কাছে ইসলামের দাবী ও দরদ যতটা প্রকট ছিলো, দিন দিন কিন্তু তার পরিমাণ কমছে। অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে অপসংস্কৃতি আর অশ্লীলতার ছয়লাবে যুব-তরুণ সমাজের এক বিশাল অংশ আজ ইসলামী আদর্শ থেকে অনেক দূরে। টিভি-সিনেমা আর নাটক-গান খুবই সহজলভ্য হওয়ার কারণে ধর্ম-কর্মের প্রতি তাদের আকর্ষণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার কারণে আগের মতো এখন আর তাদেরকে খুব সহজেই ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করা সহজ নয়। বর্তমান সময়ের আধুনিক তরুণ সমাজের কাছে এবং শিক্ষিত পরিবারকে ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করতে হলে অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতে হবে। মানব জীবনের প্রতিটি সমস্য বিশেষত: বর্তমান জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলীর ইসলাম সম্মত সহজ সমাধান এবং ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে কত সহজে যে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব তার যৌক্তিক বাস্তবতা তুলে ধরতে হবে। বর্তমান সময়ে ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।
ইসলামী দলগুলোকে ভাবতে হবে নিজেদের বাস্তবতা নিয়ে। তাদের আন্দোলনের ভবিষ্যত ও বর্তমান কর্মপন্থা নিয়ে। ইসলামী নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে নিজেদের মধ্যকার কোন্দল আর আভ্যন্তরীন সমস্যা গুলো নিয়ে। পুরো জাতীর সামনে আজকে ইসলামী দলসমূহের যেই ভবিষ্যত পরিকল্পনা দেয়া প্রয়োজন, তাহলো ইসলামিক জীবন ব্যবস্থার জন্য, ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ বা বোমা হামলা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কুরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত পদ্ধতি নয়। এক্ষেত্রে ইসলাম সমর্থিত একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে ব্যাপক গণদাওয়াত, খিলাফতের লক্ষ্যে গণসচেতনতা তৈরী, সমাজের নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নুসরাহ বা সাহায্য প্রার্থনা এবং এই দুটি অর্থাৎ গণসম্পৃক্ততা ও নেতৃস্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে এক আদর্শিক গণবিপ্লব। যেই বিপ্লব গণতান্ত্রিক পুজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে এদেশে ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খিলাফত পদ্ধতির শাসন কায়েম করবে। মহান আল্লাহ আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসলামী দল সমূহকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার তাওফীক দিন। আমীন।
ইসহাক খান