রবিউল আউয়াল মাস – মহানবীর আদর্শ ও মানুষের প্রকৃত বিকাশ

আমাদের মাঝে বছর ঘুরে আবার এসে উপস্থিত হয়েছে পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস, যে মাসে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জন্ম ও ওফাত হয়েছে। সাধারনত, রাসূলুল্লাহ (সা) এর জন্ম ও ওফাত এর কারণেই এ মাসটি সুপরিচিত। কিন্তু, এ মাসের আরো অন্যান্য তাৎপর্যও রয়েছে। এই মাসেই রাসূলুল্লাহ (সা) মদিনায় হিজরত করে এসে পৌছান এবং তার উপর নাযিলকৃত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ইসলাম-এর আলোকে যুদ্ধবিদ্ধস্ত মদিনা শহরটিকে তিনি নতুন করে গড়ে তোলেন। শুরু হয় ইসলামের পদযাত্রা। এবং পরবর্তীতে এই হিজরতের তাৎপর্যকে কেন্দ্র করেই ইসলামী হিজরী সালের গননা শুরু হয়। এছাড়াও এই রবিউল আউয়াল মাসেই রাসূলুল্লাহ সর্বাপেক্ষা প্রিয় সাহাবী হযরত আবু বকর (রা) মুসলিমদের দ্বারা খলীফা নির্বাচিত হন এবং রাসূলের বিদায়ে শোকাহত মুসলিম জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যান। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ইসলামের ইতিহাসে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।

রাসূলুল্লাহ (সা) এমন এক সময়ে পৃথিবীতে আসেন যখন সমগ্র পৃথিবী ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। গোটা পৃথিবী জুড়ে ছিল নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা। পৌত্তলিকতার অভিশাপে আক্রান্ত ছিল সমগ্র আরব সমাজ। মানুষে মানুষে বিভক্তি, হানাহানি, গোত্রীয়বাদ, সাম্প্রদায়িকতাতে পরিপূর্ণ ছিল পুরো বিশ্ব। সে ছিল এমন এক সময় যখন মানুষ দাস বা পন্য হিসেবে বাজারে বিক্রী হতো, কন্যাসন্তানদের দেয়া হতো জীবন্ত কবর। নারীদের ছিল না সম্পত্তিতে কোনো অধিকার বরং নারীদেরকে মানুষ হিসেবেই গন্য করা হতো না। সে সময়ের সমাজে ধনী গরীবের ব্যবধান বেড়েই চলেছিল, বাজার ছিল প্রতারনা ও হঠকারিতার স্বর্গরাজ্য এবং সমাজ ছিল মদ ও জুয়ায় সয়লাব। সমগ্র পৃথিবী ছিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আকাশ থেকে এক ফোটা রহমতের বৃষ্টির জন্য গোটা মানবকুল যেন তৃষ্ণার্ত ও ব্যকুল হয়ে ছিল। ঠিক এমন সময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা পৃথিবীতে তার রহমতের নবীকে প্রেরণ করলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন:

(হে নবী), আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজাহানের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া ২১:১০৭)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে আরো বলেন:

হে নবী, নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে। এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে একজন আহ্বায়ক এবং এক উজ্জল প্রদীপ রুপে। (সূরা আহযাব ৩৩:৪৫-৪৬)

রাসূলুল্লাহ (সা) পৃথিবীতে এলেন এবং মানুষকে জানালেন যে, তাদের একমাত্র উপাস্য হচ্ছে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা। সেই আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। নবীজী ঘোষনা করলেন: প্রত্যেকটি মানুষ সমান যেরকম চিরুনির দাতগুলো সমান। বংশ বা গায়ের রঙ এর কারণে কেউ শ্রেষ্ঠ নয়। নবীজী আরো ঘোষনা করলেন যে, কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া বন্ধ করতে হবে। তিনি ব্যবসায় প্রতারণা ও হঠকারিতার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানালেন। তিনি পৃথিবীকে আরো জানালেন যে একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা যেন সমগ্র মানবজাতিকেই হত্যার শামিল। তিনি উপদেশ দিলেন যে সে প্রকৃত ঈমানদার নয় যে নিজে পেটপুরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে। এবং তিনি এসকল সমস্যার মূল উৎস তৎকালীন সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। নব্যুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে সেই ব্যক্তি সমাজে আল-আমিন বা বিশ্বাসভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন সেই ব্যক্তিই সমাজের অনেক স্বার্থান্বেষী মহলের চোখের কাটায় পরিণত হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের প্রিয় নবী মানুষকে শোষণ অত্যাচার থেকে মুক্ত করবার এ সংগ্রাম চালিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সা) ও তার সাহাবাদের ১৩ বছরের অক্লান্ত দাওয়াত ও পরিশ্রমের পরে তারা ইসলামের সাহায্যার্থে পার্শ্ববর্তী শহর ইয়াসরিব হতে সাড়া পান যা পরবর্তীতে মদিনা নাম লাভ করে। ৬২২ খৃষ্টাব্দে হিজরত করে এই রবিউল আউয়াল মাসেই তিনি মদিনায় প্রবেশ করেন। মদিনার আনসারগণ আকাবার দ্বিতীয় বায়াতে কৃত ওয়াদা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা) কে তাদের শাসক হিসেবে বরন করে নেয়। নব্য গঠিত ইসলামী রাষ্ট্র মদিনাকে তিনি সোনার মদিনায় রূপান্ত্মরিত করেন। তিনি মদিনা সনদ লিপিবদ্ধ করেন এবং মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল জনগণকে মদিনার ‘নাগরিক’ হিসেবে ঘোষনা দেন এবং ঘোষনা দেন যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাহায্যে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসবে। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করেন নবীজী এবং নারীদের দেন তাদের ন্যায্য অধিকার।

পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গোটা আরবে ইসলামের দাওয়াত পৌছে যায়। নবী মুহাম্মদ (সা) সমগ্র আরব জাতিকে ইসলামের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং আরবের বাইরেও ইসলামের দাওয়াত পৌছানোর পদক্ষেপ নেন। অবশেষে পালা আসে মহানবীর বিদায়ের। এই রবিউল আউয়াল মাসেই বিদায় নেন নবীজী। কিন্তু প্রিয় সাহাবীগণ বিষয়টি যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এমন একজন অসাধারন মানুষের বিচ্ছেদ তারা কল্পনা করতে পারছিলেন না। কোনো কোনো সাহাবী বাস্ত্মবতার মুখোমুখি হবার ভয়ে ঘরে লুকিয়ে ছিলেন, কোনো কোনো সাহাবীর মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। আর ওমরের মতো সাহাবী পাগলপাড়া হয়ে তলোয়ার উচিয়ে সবাইকে সাবধান করে বলছিলেন যে, যে বলবে মুহাম্মদ (সা) মারা গেছে তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। এমন সময় সর্বশ্রেষ্ট সাহাবী হযরত আবু বকর (রা) সবাইকে জড়ো করে এক সংক্ষিপ্ত ভাষন দেন এবং বলেন: যারা মুহাম্মদ (সা) এর পূজা করতো তারা জেনে রাখুক, মুহাম্মদ (সা) পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতো তারা জানুক যে আল্লাহ চিরজীবি এবং কখনো মৃত্যুবরন করেন না। এরপর তিনি কুরআন এর একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন যেখানে বলা হচ্ছে:

মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল ব্যতিত আর কিছু নন, তার পূর্বে অনেক রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন তবে কি তোমরা পেছনের দিকে ফিরে যাবে? আর যারাই পেছনের দিকে ফিরে যাবে তারা আল্লাহর কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরষ্কৃত করবেন। (সূরা আলে ইমরান ৩:১৪৪)

এভাবেই সাহাবীগণ কঠিন বাস্তবতায় ফিরে আসেন। তারা বুঝে ওঠেন যে নবীজী আসলেই তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। পুরো মদিনা জুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায় এবং নেমে আসে শোকের ছায়া।

কিন্তু তারপরও রাসূলের এ বিদায়ে ইসলামের পদযাত্রা থেমে থাকেনি। তাঁর বিদায়ের পর সাহাবা (রা) গণ ও পরবর্তী যুগের ইসলামী ব্যক্তিবর্গ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যান ইসলাম-এর শাশ্বত বানী পৌছিয়ে দেবার নিমিত্তে। প্রায় পুরোটা পৃথিবী ইসলামের শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে শুরু করে এবং যার ফলশ্রুতিতে আজ আমরা মুসলমান। শুরু হয় মানুষের প্রকৃত বিকাশের যুগ, শুরু হয় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগ। ইসলাম-এর ইতিহাসে যার উদাহরন সুস্পষ্ট। পুরো পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় জাগরন, সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করবার জন্য সংকল্পাবদ্ধ হয় মুসলমানগণ। বিশ্বজুড়ে উদ্ভব ঘটে আলোকিত চিন্তুায় গঠিত নতুন এক সভ্যতার। যার ব্যপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন:

তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠতম জাতি। মানবকুলের কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। যাতে তোমরা সৎ কাজের আদেশ করো এবং অসৎ কাজের নিষেধ করো এবং আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখো। (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৪)

কিন্তু আজ ১৪শ বছর পর এই রবিউল মাসে দাড়িয়ে আমরা আজ নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলতে পারছিনা। পারছিনা পৃথিবীকে আলো দেখাতে বরং আমরা নিজেরাই ডুবে আছি অন্ধকারে। আজ সেই শ্রেষ্ঠ জাতি বিশ্বে তাদের যথাযথ ভুমিকা রাখতে পারছেনা, দিতে পারছেনা পৃথিবীকে সঠিক নেতৃত্ব। নজরুল তার ভাষায় যেভাবে বর্ণনা করেছেন:

                                 ভিখারির সাজে খলিফা যাদের শাসন করিল আধা জাহান,
                                 তারা আজ পড়ে ঘুমায় বেহুশ, বাহিরে বইছে ঝড় তুফান

এর কারণ আমরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হতে দূরে সরে এসেছি। ভূলে গেছি আমাদের দায়িত্বের কথা। বছর ঘুরে রবিউল আউয়াল মাস এলে আমরা নবীর জীবন নিয়ে আলোচনা করি কিন্তু তা আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়না। আজ যখন সারা পৃথিবী জুড়ে শোষণ, হানাহানি এবং রক্তপাত চলছে তখন মহানবীর আদর্শ ছাড়া আমাদের আর কোনো সমাধান নেই। বস্তুগত উন্নতির দিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আজ সমগ্র পৃথিবী যেন মক্কার সেই জাহেলী যুগের রূপ লাভ করেছে। যেখানে গর্ভপাতের মাধ্যমে কন্যাসন্তানদের মায়ের পেটে কবর দেয়া হচ্ছে, নারী মুক্তির নামে নারীর দেহ পন্য হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে, আকাশ সংস্কৃতির নামে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অশ্লীলতা এবং পুজিবাদের কষাঘাত ও অনন্ত ভোগবাদী চিন্তার মাধ্যমে ধনী গরীবের ব্যবধান আরো বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এইসব সমস্যায় জর্জরিত আজকের বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে যখন থমকে দাড়িয়েছে মানুষের প্রকৃত বিকাশ এবং যখন হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বশান্তি ও মানুষের মৌলিক অধিকার অর্জনের প্রত্যাশা তখন আবার যেন গোটা পৃথিবী ব্যকুল হয়ে উঠেছে মহানবীর আদর্শের জন্য।

সুতরাং আজ সময় এসেছে পরিবর্তনের। আজ আবার সময় এসেছে ইসলামের – পুরো পৃথিবীকে আলো দেখাবার, পুরো পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবার। সেই নিমিত্তে আজ সময় এসেছে নবীজীর আদর্শ ইসলামকে তথা কুরআন-সুন্নাহকে আরো গভীরভাবে অধ্যয়ন করবার। সময় এসেছে নিজেদেরকে হেদায়েতের আলোয় আলোকিত করে পুরো সমাজকে আলোকিত করবার। এবং এর জন্য শুধু রবিউল আউয়াল মাস নয়, বরং প্রতিটি মাসই হতে হবে আমাদের পুনর্জাগরণের মাস। এবং এটাই রবিউল আউয়াল মাসের প্রকৃত শিক্ষা। আসুন আমরা এই চেষ্টায় শরীক হই এবং নিজেদের জীবন আল্লাহর রহমতে ধন্য করি। আমি পবিত্র কুরআনের সূরা ইবরাহিমের একটি আয়াতের তরজমা বলে শেষ করবো, যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন:

আলিফ লাম রা, (এটি) এক কিতাব আমি আপনার উপর নাযিল করেছি (হে নবী), যাতে আপনি সমগ্র মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসতে পারেন তাদের রবের ইচ্ছা অনুযায়ী, পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য (রব)-এর পথের দিকে … (সূরা ইবরাহিম ১৪:১)

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply