Ideology (মতাদর্শ)

আরবি ভাষাগত দিক থেকে বিবেচনা করলে মতাদর্শ (মাবদা’) শব্দটি ‘সূচনাবিন্দু’ বা ‘মৌলিক নীতিমালা’র সমার্থক৷ সাধারণ মানুষ অবশ্য এই শব্দটিকে ব্যবহার করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাকে বুঝাতে যার উপর ভিত্তি করে অন্যান্য চিন্তা প্রতিষ্ঠত হয়; সুতরাং একজন মানুষ বলতে পারে – আমার নীতি হচ্ছে সত্যবাদিতা, আরেকজন বলতে পারে আমার নীতি হচ্ছে বিশ্বস্ততা এবং এর মাধ্যমে সে বোঝাতে চায় যে বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে সে লোকজনের সাথে লেনদেন করে ইত্যাদি৷ প্রকৃতপক্ষে লোকজন কিছু খন্ডিত বা আংশিক চিন্তা যেগুলোর উপর ভিত্তি করে অন্যকিছু চিন্তা গড়ে উঠতে পারে সেগুলোকে মৌলিক চিন্তা বলে থাকে কারণ এগুলো অন্যকিছু চিন্তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে৷ তাই তারা বলে সত্যবাদিতা একটি মৌলিক নীতি, উত্তম প্রতিবেশীসুলভ আচরণ একটি মৌলিক নীতি, সহযোগিতা একটি মৌলিক নীতি প্রভৃতি৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তারা বলে থাকে যে নৈতিকতার নীতি, অর্থনৈতিক নীতি, আইন-কানুন সম্পর্কিত নীতি, সামাজিক নীতি প্রভৃতি; অর্থনীতি সম্পর্কিত কিছু র্নিদিষ্ট চিন্তা এবং আইনশাস্ত্রের কিছু র্নিদিষ্ট চিন্তাকে তারা অর্থনৈতিক নীতি এবং আইনশাস্ত্রীয় নীতি বলে মনে করার কারণ হচ্ছে এগুলোর উপর ভিত্তি করে আরো কিছু চিন্তার জন্ম হয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে এগুলো মৌলিক নীতি নয় বরং কিছু অন্যান্য চিন্তার ভিত্তি৷ কারণ মৌলিক নীতি হচ্ছে একান্তই মৌলিক অথচ এগুলো মৌলিক নয় বরং আংশিক৷ অতএব এসব চিন্তাকে শুধুমাত্র একারণে মৌলিক বলা চলে না যে এরা অন্যকিছু চিন্তার ভিত্তি হিসাবে কাজ করছে বা এদের থেকে অন্যকিছু চিন্তার উদ্ভব হয়েছে কারণ এরা নিজেরা চিন্তা হিসাবে মৌলিক নয় বরং অন্যান্য চিন্তা থেকে এদের উদ্ভব হয়েছে অথবা এরা সবাই একটি চিন্তা থেকে উদ্ভূত হয়েছে৷ এজন্য সত্যবাদিতা, সহযোগিতা এবং এরকম অন্যান্য বিষয়ের কোনটাই মৌলিক নয় বরং আংশিক; কারণ এরা অন্য একটি মৌলিক চিন্তা থেকে এসেছে এবং নিজেরা নিজেদের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেনি৷ উদাহরণস্বরূপ সত্যবাদিতা হচ্ছে এমন একটি বিষয় যাকে একটি শরঈ নিয়ম হিসেবে মুসলিমরা গ্রহণ কবেছে কুরআন থেকে এবং অন্যান্য অমুসলিমরা একে গ্রহণ করেছে পুঁজিবাদী চিন্তার একটি কার্যকর ও সুন্দর উপাদান হিসাবে৷ 

অতএব কোনো চিন্তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মৌলিক চিন্তা (মতাদর্শ) বলা চলেনা যতক্ষণনা এটি এমন একটি মৌলিক চিন্তা হচ্ছে যা থেকে বাকি সব চিন্তার উদ্ভব হবে৷ মৌলিক চিন্তা হবে এমন একটি বিষয় যার পূর্বে অন্যকোনো চিন্তা বিদ্যমান থাকতে পারবেনা৷ মৌলিক চিন্তা সীমাবদ্ধ থাকবে কেবল মহাবিশ্ব, মানুষ ও জীবন সম্পর্কিত বিষয়ে এবং এটি ছাড়া কোনো মৌলিক চিন্তা থাকা সম্ভব নয় কারণ এসব চিন্তাই হচ্ছে জীবনের সমস্ত কর্মকান্ডের মৌলিক ভিত্তি৷ 

অতএব, মহাবিশ্ব, মানুষ ও জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক চিন্তাই হচ্ছে মৌলিক চিন্তা এবং এটিই হচ্ছে আক্বীদাহ৷ কিন্তু এই আক্বীদাহ থেকে কোনো চিন্তার উদ্ভব হবেনা অথবা এর ভিত্তিতে অন্যকোনো চিন্তা উত্‍সারিতও হবেনা যদি এটি নিজে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চিন্তা না হয় অর্থাৎ এটি কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ফসল না হয়৷ এটি যদি কেবলই গ্রহণ ও আত্মসমর্পণের বিষয় হয় তাহলে এটি কোনো চিন্তা হিসাবে গণ্য হবেনা এবং একে কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ চিন্তা হিসেবে গণ্য করা যাবেনা বরং তখন এটি নিছকই একটি আক্বীদাহ হিসেবে গণ্য করতে হবে৷ অতএব স্বয়ংসম্পূর্ণ চিন্তা কেবল বিবেক থেকেই আসতে পারে অর্থাৎ এটি হবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ফসল৷ শুধুমাত্র তখনই এটি হবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ যার উপর ভিত্তি কবে অন্যান্য চিন্তার জন্ম হবে৷ এসব চিন্তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করবে অথ মানুষের যাবতীয় কর্মকান্ডকে সুসংগঠিত করবে৷ মতাদর্শ কেবল তখনই বিদ্যমান থাকে যখন কোন বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ এবং সেই আক্বীদাহ থেকে উত্‍সারিত জীবন পরিচালনাকারী বিভিন্ন আহকাম বিদ্যমান থাকে৷ অতএব, মতাদর্শ হচ্ছে এমন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ যা থেকে কোনো ব্যবস্থা উদ্ভূত হয়৷ এইদিক থেকে বিবেচনা করলে ইসলাম একটি মতাদর্শ, কারণ এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ এবং এ থেকে একটি ব্যবস্থা উদ্ভূত হয়েছে যার মধ্যে সমস্ত আহকাম বিদ্যমান রয়েছে যেগুলো জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে৷ অনুরূপভাবে সাম্যবাদ একটি মতাদর্শ কারণ এর রয়েছে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ যা থেকে একটি ব্যবস্থা উদ্ভূত হয়েছে এবং এগুলো জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে৷ একইভাবে পুঁজিবাদও একটি মতাদর্শ কারণ এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ যা থেকে এমনসব চিন্তা উদ্ভূত হয়েছে যেগুলো জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে৷ 

আলোচনা থেকে এটাও স্পষ্ট যে জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, নাৎসীবাদ বা অস্তিত্ববাদ কোনোটাই মতাদর্শ নয়, কারণ এদের কোনোটাই বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ নয় এবং এগুলো থেকে কোনো ব্যবস্থার উদ্ভব হয়নি অথবা জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধান দিতে পারে এমন কোনো চিন্তারও উদ্ভব হয়নি৷ 

এবার আসা যাক ধর্মের ব্যাপারে৷ কোনো ধর্ম যদি এমন হয় যার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্বীদাহ আছে এবং এ থেকে এমন ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে অথবা এর ভিত্তিতে এমনসব চিন্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেগুলো জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধান করে তাহলে মতাদর্শের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেই ধর্ম একটি মতাদর্শ৷ কিন্তু বারবার শ্রবণ এবং অনুসরণের ফলে যদি কোনো ধর্মের আক্বীদাহর প্রতি আবেগ জন্ম হয় অথচ এর পেছনে কোনো পর্যাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা না থাকে অথবা এ থেকে কোনো ব্যবস্থার জন্ম না হয় অথবা এর ভিত্তিতে অন্যকোনো চিন্তারও উদ্ভব না হয় তাহলে এ ধরনের কোনো ধর্মই মতাদর্শ নয় কারণ এর আক্বীদাহর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি নেই এবং এ থেকে জীবনের জন্য কোনো ব্যবস্থারও উদ্ভব হওয়া সম্ভব নয়৷ 

আমরা যদি বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকাই তবে মূলত তিনটি মতাদর্শ দেখতে পাবো। সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ ও ইসলাম। এর মধ্যে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র Rational মতাদর্শ।  

Print Friendly, PDF & Email

উসূল আল ফিকহ

রমজান ও ঐক্য

Leave a Reply