উসূল আল ফিকহ

শাব্দিকভাবে, ‘আসল’ হলো এমন কিছু যার উপর কিছু নির্মাণ করা যায়, সেই নির্মাণ বস্তুগত হতে পারে, উদাহরনসরূপ, একটি ভবন, অথবা সেই নির্মাণ চিন্তাগতও হতে পারে যেমন, শরয়ী ইল্লাহ (কারণ) এর উপরে মা’লুল (ফলাফল) এর নির্মান কিংবা শরয়ী কোনো দলীলের ভিত্তির উপর একটি সিদ্ধান্ত নির্মাণ বা প্রতিষ্ঠা করা। ‘আসল’ শব্দটির বহুবচন হল ‘উসূল’। আর উসূল আল ফিকহ হল সে সকল নীতিমালা (কাওয়াঈদ) যার উপর ফিকহ প্রতিষ্ঠিত। আর ফিকহ-এর শাব্দিক অর্থ হল, কোনো কিছু বোঝা (ফাহম)।

ফিকহ অর্জনের পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন নীতিমালার সমষ্টিকে উসূল আল ফিকহ বলে। ইবন আল হাজিব এর সংজ্ঞায় বলেন, (উসূল আল ফিকহ হচ্ছে) সেইসব নীতিমালা যার মাধ্যমে মুজতাহিদ নির্দিষ্ট প্রমাণাদি হতে শর’য়ী আহকাম আহরন করেন।

উসূল আল ফিকহ-এর আলোচ্য বিষয় হল শরীয়তের উৎস তথা আহকামের বিস্তারিত দলিলাদির ভিত্তি। কাজেই উসূল আল ফিকহে কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস কেন শরীয়তের দলীল হবে, হাদীসের কোন বক্তব্য হতে কোন ধরনের হুকুম পাওয়া যাবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। উদাহরনসরূপ বলা যায় আল কোরআন হলো ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধানের প্রথম উৎস। বস্তুত কোরআন মজিদের সব ধরনের বক্তব্য এক ধরনের নয়। বরং তার কোনো কোনো বক্তব্য আদেশ হিসেবে আর কোনো কোনো নিষেধ হিসেবে, আবার কোনো বক্তব্য শর্ত সাপেক্ষ, কোনো বক্তব্য শর্তহীনভাবেও এসেছে। এসকল বিচার-বিশ্লেষনসমূহ মূলত উসূলী আলেমগণ করে থাকেন। উসূল আল ফিকহের লক্ষ্য হল, শরীয়তের বিধি-বিধান জানার জন্য তার তফসিলী দলিলের উপর উসূল আল ফিকহের মূলনীতি সমূহ বাস্তôবায়ন করা। এসব মূলনীতির আলোকে শরীয়তের বিধানসমূহ বোঝার চেষ্ঠা করা। নস (text) এর মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা থাকলে তা দূর করার উপায় জানা এবং কোনো নস অপর কোনো নস এর সাথে সাংঘর্ষিক হলে তার নিরসন বা অগ্রাধিকার দানের উপায় বের করা। অথবা কোনো বিষয় সম্পর্কে কোনো নস না পাওয়া গেলে সে ব্যাপারে শরীয়তের অন্য কোনো উৎস (উদাহরনসরূপ, কিয়াস) হতে হুকুম বের করা।

উসূল আল ফিকহের আলোচ্য বিষয়সমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘কায়েদা’ (মূলনীতি)। যেমনঃ

১. প্রতিটিই বস্তুই মূলত হালাল, যদি না তার বিপরীতে কিছু বলা থাকে।
২· কাজ মূলত হালালও নয় বা হারামও নয় বরং প্রত্যেক কাজের জন্য দলীল প্রয়োজন।
৩· যা ওয়াজিব তার জন্য যা যা দরকার তাও ওয়াজিব।

একটি কায়েদার ব্যাখ্যা: “প্রতিটিই বস্তুই মূলত হালাল, যদি না তার বিপরীতে কিছু বলা থাকে”

এটি একটি বৈধ কায়েদা যা বিভিন্ন দলীলাদি হতে আহরিত।

আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الأرْضِ جَمِيعًا

“তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত।” [সূরা বাকারা ২:২৯]

الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ

“যে পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদসরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে···” [সূরা বাকারা ২:২২]

أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً

“তোমরা কি দেখ না আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে সবই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।” [সূরা লুকমান ৩১:২০]

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ

“তিনিই আল্লাহ যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে অতঃপর তা দ্বারা তোমাদের জন্য ফলের রিযিক উৎপন্ন করেছেন···” [সূরা ইবরাহীম ১৪:৩২]

এ সকল আয়াত এই দিক নির্দেশনাই দেয় যে আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা সকল কিছু (বস্তু)-কে হালাল করেছেন। এ সকল হালাল বস্তুর মধ্যে কিছু আবার হারাম করা হয়েছে যা বিভিন্ন নস-এর দ্বারা সাব্যস্ত, যেমনঃ

قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

“বল: কে হারাম করেছে আল্লাহ-র সাজ-সজ্জা যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র রিযকসমূহকে? বলঃ এসব নিয়ামত আসলে দুনিয়ার জীবনে মুমিনদের জন্য···” [সূরা আ’রাফ ৭:৩২]

এ সকল আয়াত এই দিক নির্দেশনাই দেয় যে আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা সকল কিছু (বস্তু)-কে হালাল করেছেন। এ সকল হালাল বস্তুর মধ্যে কিছু আবার হারাম করা হয়েছে যা বিভিন্ন নস-এর দ্বারা সাব্যস্ত, যেমনঃ


حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالأزْلامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ

“তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের মাংস, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য উৎসর্গিত করা হয়েছে, যা কণ্ঠরোধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়, যা উচ্চস্থান হতে পতনের ফলে মারা যায়, যা শিং এর আঘাতে মারা যায় এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষন করেছে, কিন্তু যাকে তোমরা জবেহ করেছ। যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে জবেহ করা হয় এবং যাকে ভাগ্য নির্ধারক শর দ্বারা বণ্টন করা হয়। এসব ফাসেকী ···” [সূরা মায়েদা ৫:৩]

এই আয়াত ও আরো অন্যান্য আয়াতসমূহ পূর্বে বর্ণিত যে আয়াতগুলোর মাধ্যমে সকল বস্তুকে হালাল ঘোষনা দেয়া হয়েছে তার থেকে কিছু জিনিস বাদ দিচ্ছে। এসকল আয়াতের উপর ভিত্তি করে একজন মুজতাহিদ সেসকল বস্তুর বৈধতা দিতে পারেন যে সকল বস্তুর ব্যবহার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। উদাহরণসরূপ, বিভিন্ন ফলফলাদি যেমন, আম। অপরদিকে, যখন কোনো মুজতাহিদ মদ সম্পর্কে ইসলামের কী হুকুম, তা নিয়ে আলোচনা করেন তখন তিনি সেসব আয়াত ও হাদীস নিয়ে আসেন যেখানে মদকে হারাম ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

A Notice

Ideology (মতাদর্শ)

Leave a Reply