আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ

প্রশ্ন:

বিগত ২৪/৫/২০১৮ তারিখে বিশ্বব্যাপী তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ব্রেন্ট ক্রুড ব্যারেল প্রতি ৭৯ মার্কিন ডলার এবং টেক্সাস ক্রুড ব্যারেল প্রতি ৭১ মার্কিন ডলার মূল্যে বিক্রয় হচ্ছে। ২০১৪ সালের ক্রমাগত দরপতনের পর এই মূল্য বৃদ্ধি কী আবারও তেলের উচ্চ মূল্যের যুগের সূচনার লক্ষণ? আমরা কি অতীতের মত আবারও ব্যারেল প্রতি ১৫০ মার্কিন ডলার মূল্যের দিকে যাচ্ছি? এই উচ্চমূল্য বৃদ্ধির কারণ কী?

উত্তর:

অন্য যে কোন পণ্যের মত তেলের মূল্য চাহিদা এবং যোগানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু অন্য সকল পণ্য থেকে তেলের মূল্য অতি মাত্রায় অস্থিতিশীল। আন্যভাবে বলা যায় চাহিদা বা যোগানের যে কোন উপাদানের সমান্যতম পরিবর্তন তেলের মূল্যকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। জ্বালানী তেলের বাজারের প্রকৃতির কারণেই তেলের মূল্যের এই উঠানামা। এছাড়াও রয়েছে ফটকা কারবারের প্রভাব বিশেষ করে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন বা এর সম্ভবনা তেলের বাজারকে করে আরও অস্থিতিশীল। বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য নিচের আলোচনাটি উপস্থাপন করা হল:

১. বিশ্ব বাজারে তেলের যোগান 

ক. পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশসমূহের সংগঠন ওপেক এবং নন-ওপেকভুক্ত দেশ সমূহ বিশ্ববাজারে তেলের যোগনকে সীমিত করার বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে রাশিয়া এবং ওপেকভুক্ত দেশসমূহ তেলের অতিরিক্ত যোগনকে সীমিত করা এবং মূল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিদিনে তেলের উৎপাদনকে ১.৮ মিলিয়ন ব্যারেলে সীমিত রাখার জন্য চুক্তি সম্পাদন করেছিল। গবেষণায় উঠে এসেছে যে গত এপ্রিল মাসে টানা তৃতীয়বারের মত তেলের উৎপাদন ছিল সর্বনিম্ন প্রতিদিন মাত্র ৩২ মিলিয়ন ব্যারেল যা গত মার্চ মাসের প্রতিদিনের উৎপাদন থেকে ১৪০,০০০ ব্যারেল কম। আজকে তেলের উৎপাদন প্রতিদিন মাত্র ৩২.৭৩ মিলিয়ন ব্যারেল যা ওপেকের প্রতিদিনের জন্য নির্ধারিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৭৩০,০০০ ব্যারেল কম। ওপেকের চুক্তিটি আগামী এক বছর কার্যকর থাকবে। যদি বর্তমান অবস্থা আব্যাহত থাকে তবে তেলের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এনার্জি আসপেক্টসের দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা দলের প্রধান পরামর্শক ম্যাথি ব্যারি বলেন, “বর্তমানে যোগান স্বল্পতার কারণে যে মূল্য বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যতে এর তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে ” (marketwatch.com)

খ. ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির তেলের উৎপাদনের লক্ষ্যকে পূরণে বাধা সৃষ্টি করছে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে দেশটি প্রতি দিন মাত্র ১.৪১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে যা ছিল ২০১৮ সালের মার্চ মাস থেকে ৮০,০০০ ব্যারেল কম, এবং ২০১৭ সালের প্রতি দিনের গড় উৎপাদন থেকে ৫,৪০,০০০ ব্যারেল কম। ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন কমার জন্য মূলত দায়ী দেশটির সরকারের নীতি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল এবং গ্যাস কোম্পানী পিডিভিএসএর অদক্ষতা। এছাড়াও সাম্প্রতি ২ টি তেল ক্ষেত্র নিয়ে বিরোধের বিচারাধীন মামলায় আদালত পিডিভিএসএকে কনকো-ফিলিপসকে ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদানের রায় প্রদান করে। এখন পর্যন্ত পডিভিএসএ ক্ষতিপূরণের ২.৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধে ব্যার্থ হয়েছে। এই সকল ঘটনাগুলো ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করে যার ফলে বিশ্ববাজারে দেশটির তেলের যোগান যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়। 

গ. প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণায় ইরনের তেল শিল্পের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০১২ সালে ওবামা ইরানের উপর এই ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। উক্ত নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের উৎপাদন ক্ষমতা ২০% বা দিনে ৫০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ ব্যারেলে হ্রাস পেতে পারে যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (foreignpolicy.com). যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইরানের উপর কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে নাই, ইরানের তেল শিল্পকে টার্গেট করে ব্যবস্থা নেয়ার আশংকা করা হচ্ছে। 

উপরোক্ত তিনটি ঘটনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী তেলের যোগান সীমিত হচ্ছে এবং এর প্রভাবে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

২. চাহিদা 

ক. আর্ন্তজাতিক শক্তি সংস্থার মতে বিশ্বব্যাপী প্রতি দিনের তেলের চাহিদা ৯৯.৩ মিলিয়ন ব্যারেল যা ২০১৭ সালে ছিল ৯৭.৮ মিলিয়ন ব্যারেল। সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী তেলের প্রতিদিনের চাহিদার প্রবৃদ্ধি ১.৩ থেকে ১.৪ মিলিয়ন হবে বলে প্রাক্কলন করে। আর্ন্তজাতিক শক্তি সংস্থা তাদের মাসিক মার্কেট রিপোর্টে ২০১৭ সালে প্রতি দিন তেলের ব্যাবহার ১.৬ মিলিয়ন ব্যারেল করে বৃদ্ধি পায় বলে প্রকাশ করে (reuters.com)। 

খ. চাহিদা বৃদ্ধির আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে চীনের তেলের চাহিদার উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি। চীন ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে দিনে ৯ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ব্যবহার করেছিল যা ছিল সমগ্র বিশ্বের তেলের ব্যাবহারের ১০% এবং এশিয়ার মোট চাহিদার ১/৩ এরও বেশী। যদি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৭৫ ডলার হয়, তবে চীনের এক মাসের তেল আমদানীর খরচ হবে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেও বেশী। ধারণা করা হয় চীনের প্রকৃত চাহিদা আরও অনেক বেশী। গোল্ডম্যান সাসেস ব্যাংক তাদের একজন গ্রাহককে এক নোটে বলেন, “চীনের চাহিদা দেশটির উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির বহিঃপ্রকাশ, প্রকৃত চাহিদা বর্তমান প্রাক্কলন থেকে আনেক বেশী বলে ধারনা করা হয়” (reuters.com)

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, তেলের ব্যাবহারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে যার ফলে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

৩. ফটকা কারবার 

জ্বালানী তেলের চাহিদা এবং যোগানের নাটকীয় পরিবর্তন ফটকা কারবারীদের তেলের বাজারে আকৃষ্টি করে। বাজারের স্বাভাবিক চাহিদা ও যোগানের কারণেই যে তেলের মূল্যের ব্যাপক উত্থান-পতনর কারণ বলে প্রতিয়মান হচ্ছে না। ইহা থেকে সহজে অনুমেয় যে তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে ফটকা কারবারের প্রভাব। বড় হেজ ফান্ডগুলো ক্রয় এবং বিপুল পরিমাণ চুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে তেলের বাজারকে প্রভাবিত করে। সুতরাং, বলা যায় ফটকা কারবারের তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও হ্রাসের দ্বৈত ভূমিকা রাখে। এই কারবারিরা কখনও চাহিদা বৃদ্ধি করে তেলের মূল্য বাড়ায় আবার কখনও চাহিদা হ্রাস করে তেলের মূল্য কমায়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ফটকা বাজারের প্রভাব খুব বেশি নয় বরং চাহিদা যোগানই তেলের মূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ বলে প্রতীয়মান হয়। 

বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তেলের মূল্য ব্যারেল ১৫০ মার্কিন ডলার বা তার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি দেখা যাচ্ছেনা। ধারনা কার যাচ্ছে তেলের মূল্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে ব্যারেল প্রতি প্রায় ১০০ মার্কিন ডলারে পর্যন্ত হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আসন্ন বাণিজ্যযুদ্ধ তেলের চাহিদাকে হ্রাস করতে পারে যার ফলে তেলের মূল্য হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা যায়। এছাড়াও, তেলের মূল্য যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বাহিরে বৃদ্ধি পায় তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাউদি আরবকে দিয়ে ওপেকভুক্ত দেশগুলোকে চাপ দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করবে যা তেলের মূল্যকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসবে।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply