সত্য বলা কখনই মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে না এবং রিজিককেও সংকুচিত করে না

আবু আদ-দারদা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, 

«العلماء ورثة الأنبياء» 
আলেমগণ নবীগণের উত্তরসূরী।” [আবু দাউদ, তিরমিযি] 

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র পক্ষ থেকে আপনাদের উপর অর্পিত উচ্চ মর্যাদা ও দায়িত্বের কারণে আমরা আপনাদের প্রতি নিম্নোক্ত আহ্বানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই প্রত্যাশায় যেন আমরা সকলেই তাদের কাতারে শামিল হতে পারি যারা সত্যের পক্ষে অবস্থানকারী এবং আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে ভয় করেনা।

প্রিয় ভাইয়েরা ও কর্তব্যপরায়ণ আলেমগণ :

আলেমগণ তাদের ঈমান, জ্ঞান, কর্ম এবং সত্যের পক্ষে অবস্থান নেয়ার সাহসিকতার কারণে নবীগণের উত্তরসূরী হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু আজকের সেই আলেমগণ কোথায়? নবীগণের এই যুগের উত্তরসূরীরা কোথায়? যেখানে আমাদের পূর্বের বড় বড় আলেমগণ তাদের অপরিসীম জ্ঞান ও দ্বীনকে সঠিকভাবে বোঝার সক্ষমতার কারণে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। যা তাদেরকে সত্যের পক্ষে সাহসী অবস্থানকারী ও তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান ভুলগুলিকে দৃঢ়ভাবে চ্যালেঞ্জকারী মহৎ ও সুপরিচিত আলেম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যার কিছু উদাহরণ হলো:

– আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা), যিনি খাওয়ারিজদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।

– সাইদ বিন জুবায়ের (রা), যিনি আল হাজ্জাজ বিন ইউসুফ-এর যুলুমের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সহিত অবস্থান নিয়েছিলেন।

– সুফিয়ান আল-ছাওরি (রহ), যিনি হারুন আল-রশিদ-এর পাঠানো চিঠিকে স্পর্শও করেননি, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এটা একজন যালিম শাসকের নিকট থেকে এসেছে। তিনি তার এক অনুসারীকে এই চিঠিকে উল্টিয়ে তার পিছনের দিকে লিখতে আদেশ করলেন:  “হারুনের প্রতি” এবং “আমির-উল-মু’মিনি’ন” সম্মোধন করে নয়, এবং বললেন (যার সার সংক্ষেপ): “মুসলিমদের সম্পদকে যথেচ্ছা ব্যবহার করতে তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছো, তাই তুমি একজন যালিম, এবং আমি তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবো।”

– আবু হানিফা (রহ.), যিনি আল-মনসুর-এর নেতৃত্বে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি যখন কারাগারে, তখন তার মা তাকে একদিন বললেন: “হে নু’মান, এই জ্ঞান তোমার জন্য শারীরিক শাস্তি আর কারাবাস ছাড়া আর কোন কল্যাণ বয়ে আনেনি, এবং এই জ্ঞানকে পরিত্যাগ করার জন্য এটাই যথেষ্ট।” উত্তরে তিনি বললেন: “হে আম্মা, যদি আমি দুনিয়া আকাঙ্খা করতাম তবে তা পেতাম, কিন্তু আমি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’কে চেয়েছি যাতে আমি নিশ্চিত হতে পারি যে, আমাকে যে জ্ঞান দান করা হয়েছে আমি তা সুরক্ষা করতে পেরেছি এবং এর দ্বারা নিজেকে অন্ধকারে ঠেলে দেইনি।”

– আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) কারাগারে থাকা অবস্থায় তার চাচার সাথে তার এই বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হয় যাতে তিনি জনসম্মুখে আল-মুতাসিম কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন: “যদি আলেমগণ হক্ কথা না বলেন, এবং ফলশ্রুতিতে জনগণের নিকট তা উপেক্ষিত হয়, তবে কিভাবে তখন সত্য সবার নিকট প্রকাশিত হবে?”

এগুলো ছিল পূর্ববর্তী মুসলিম আলেমদের কর্তৃক হকের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের সামান্য কিছু নমূনা, সুতরাং আজকের সেই মুসলিম আলেমগণ কোথায়? উম্মাহ্’র বর্তমান সংকটাপন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে আপনাদের অবস্থান কী? ইমাম আল-গাজ্জালি (রহ.) কর্তৃক প্রদত্ত এই উক্তির ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কোথায় যেখানে তিনি বলেছেন: “শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়”, “এবং আলেমগণ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়”? আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত নির্দেশের ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কোথায় :
 

﴿وَإِذ أَخَذَ اللَّهُ ميثاقَ الَّذينَ أوتُوا الكِتابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنّاسِ وَلا تَكتُمونَهُ﴾ 
…(সত্য ও মহান বাণী) মানুষের নিকট বর্ণনা (ব্যক্ত ও সুস্পষ্ট) কর, এবং তা গোপন করো না।” [সূরা আলি ইমরান : ১৮৭]

আলেমগণ ছাড়া জনগণ অন্ধকারে দিকভ্রান্ত এবং শয়তানের সহজ শিকার। তাই আলেমগণ হলেন এই জমীনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত বিশেষ রহমতস্বরূপ, এবং অন্ধকারে আলোকবর্তিকা, সঠিক পথে পরিচালনার নেতৃত্ব, এবং এই জমীনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র নিদর্শন; যাদের মাধ্যমে ভ্রান্ত চিন্তাসমূহকে প্রতিহত করা হয় এবং মানুষের হৃদয় ও মনে বিদ্যমান সন্দেহসমূহ দূর করা হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে তারকারাজির সাথে তুলনা করে বলেছেন :

«إِنَّ مَثَلَ الْعُلَمَاءِ فِي الأَرْضِ كَمَثَلِ نُجُومِ السَّمَاءِ ، يُهْتَدَى بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْر، فَإِذَا انْطَمَسَتِ النُّجُومُ يُوشِكُ أَنْ تَضِلَّ الْهُدَاةُ»

নিশ্চয়ই, আলেমগণ হচ্ছেন আকাশের নক্ষত্রের মত; যাদের মাধ্যমে জনগণ ভূ-পৃষ্ঠে ও মহাসমুদ্রে অন্ধকারে আলোর পথ দেখতে পায়, এবং যদি তারা দৃশ্যমান না থাকে, তবে জনগণ পথ হারাবে যেভাবে পথিক অন্ধকারে পথ হারায়।” [আহমাদ]

আমরা আপনাদের ভাই হিসেবে আপনাদেরকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কর্তৃক প্রদত্ত এই দায়িত্বের কথা স্মরণ করাতে চাই যেন আপনারা সেইসব সম্মানিত আলেমদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারেন :

– মুসলিম বিশ্বের শাসকদের জবাবদিহি করুন: উম্মাহ্’র বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত আল-আসাদ কিংবা আল-সিসি থেকে শুরু করে ইয়েমেনে আমাদের মুসলিম ভাইবোনদের উপর সৌদী সরকারের নৃশংস বোমাবর্ষণ – আলেমগণকে সকল বিশ্বাসঘাতক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করতে হবে।

– উম্মাহ্ ও মানবতার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের চক্রান্তের মুখোশ উন্মোচন করুন: প্রাক্তন রিয়ালিটি শো’ তারকা ডোনাল্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায়, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র ইচ্ছায় উদার ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী ও তাদের নীতিসমূহের ভ্রান্তির মুখোশ উন্মোচনের কাজ সহজ করে দিয়েছে। আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ – আমেরিকা, বৃটেন ও রাশিয়া – মানবতার বিরুদ্ধে বিশেষ করে উম্মাহ্’র বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত; হোক সেটা দক্ষিণ ডাকোটার অধিবাসীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, অথবা সিরিয়া ও ইরাকে অব্যাহত আক্রমণ। তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক নীতিসমূহ শুধু মানবজাতির জন্যই ক্ষতি বয়ে আনেনি, বরং পশুকুল ও পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আলেমগণ এ সকল নীতিসমূহের বিরুদ্ধে কথা না বলেন তাহলে কে আছে যারা উম্মাহ্ ও মানবজাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিবেন?

আমাদের প্রাণ প্রিয় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একটি হাদীস দিয়ে এই আহ্বান শেষ করতে চাই

«أَلاَ لاَ يَمْنَعَنَّ أَحَدَكُمْ هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍ إِذَا رَآهُ أَوْ شَهِدَهُ، فَإِنَّهُ لاَ يُقَرِّبُ مِنْ أَجَلٍ وَلاَ يُبَاعِدُ مِنْ رِزْقٍ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ أَوْ يُذَكِّرَ بِعَظِيمٍ»

“মানুষের ভয় যেন তোমাদেরকে হক্ কথা বলা হতে বিরত না রাখে যখন তা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়; সত্য বলা এবং সৎকর্ম করা কখনই মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে না এবং রিজিককেও সংকুচিত করে না।” [আহমদ, ইবনে হিব্বান, ইবনে মাজাহ্]

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে দৃঢ়পদ করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে ভাই-ভাই হিসাবে পুনরুত্থিত করুন। আমিন!

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply