১৪তম অধ্যায়: মাসলাহা’র (সুবিধা) দোহাই দিয়ে হারামকে অনুমোদন দেয়া

শারীআহ্ কিছু বিষয়কে আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছে আর কিছু বিষয়কে নিষেধ করেছে। কোনভাবেই তার রদবদল, পরিবর্তন ও বিকৃত করা আমাদের জন্য বৈধ নয়। সর্বজ্ঞানী আইনপ্রণেতা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শুধুমাত্র যেখানে প্রয়োজন সেখানেই রুখসাহ্-কে (অব্যহতি) অনুমোদন দিয়েছেন। সুতরাং শয়তান বা মানুষের প্রবৃত্তি সুবিধার দোহাই দিয়ে যতই এতে প্ররোচনা দিক না কেন, যে স্থানে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) রুখসাহ্ (অব্যহতি) প্রদান করেননি সে স্থানে তাঁর হুকুমকে পাশ কাটানোর কোন অনুমোদন নাই। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত রুখসাহ্ ব্যতীত বাধ্যতামূলক হুকুমসমূহ পরিত্যাগ করাকে অনুমোদন দেয় আর নিষেধ অমান্য করাকে বৈধতা দান করে সে কাফির কিংবা অজ্ঞ ফাসিকদের অন্তর্ভূক্ত।

কিছু বিপথগামী ব্যক্তি এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছে যে মাসলাহা হচ্ছে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের দলিল;

তাদের মতে, মাসলাহা হলো সে সমস্ত কর্মকান্ড যা থেকে মুলতঃ অধিকাংশ এমনকি বেশীরভাগ সময়ই ব্যক্তি বা জনগণের কল্যান সাধিত হয়। তাদের মতে ওলেমাগণ শারীআহ্ পর্যবেক্ষন করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন যে শারীআহ্’কে এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে দুনিয়া এবং আখিরাতে বান্দার কল্যান সাধিত হয়।

তারা মাসালিহ্ মুরসালাহ্ (অসজ্ঞায়িত বিষয়সমূহের কল্যাণ) সম্পর্কিত উদাহরণ ও যে ভিত্তির উপর তা প্রতিষ্ঠিত তা উদ্ধৃত করে। তারা বলে যে ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের দলিল মাসালিহ্ মুরসালাহ্’র ভিত্তিতে সম্ভব নয়। কারণ সুস্পষ্ট দলিলাদির মাধ্যমে এটা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত যে, জাহেলী ব্যবস্থায় শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা গুনাহে্র কাজ। বরং এখানে লদ্ধ বিষয়টির ভিত্তি হলো, দু’টি ভাল কাজের মধ্যে উত্তমটি পছন্দ করা এবং দু’টি খারাপ কাজের মধ্যে অপেক্ষাকৃত মন্দটি চিহ্নিত করা; দু’টি সুবিধার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাটি বর্জন করে অধিকতর সুবিধাটি গ্রহণ করা এবং দু’টি ক্ষতিকর বিষয়ের মধ্যে অধিকতর ক্ষতিকর বিষয়টি বর্জন করে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর বিষয়টি গ্রহণ করা ।

তারা বলে, শারীআহ্ প্রদর্শিত এই পথের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন, সামান্য কিছু উপকারীতা সত্ত্বেও ইসলাম মদ ও জুয়াকে নিষিদ্ধ করার কারণ হলো সামান্য উপকারীতার তুলনায় বিরাট ক্ষতি গুরুত্বপূর্ণ। জিহাদের মাধ্যমে বিশ্বাসীদের জান ও মালের ক্ষয়-ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু এর মাধ্যমে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র নৈকট্য লাভের মধ্য দিয়ে বান্দার কল্যান সাধিত হয় তাই জিহাদকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

তাদের ভাষায়, ইসলামের ইতিহাসে শাসক ও আলেমগণ ইসলামের অগ্রযাত্রায় এ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। একারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাবাকে ভেঙে ফেলে তা ইব্রাহীমী ভিত্তির উপর পুনঃনির্মাণ থেকে বিরত থেকেছেন, যদিও এতে ধমীর্য় সুবিধা ছিল। কেননা কাবা পুনঃনির্মাণ করলে যতটা লাভ হবে ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশী।  তিনি (সা) তাঁর বিবি আয়েশা (রা.) কে বলেন,

“যদি কাবা তোমাদের (যারা অতিসম্প্রতি জাহেলিয়াত ত্যাগ করে এসেছে) সম্প্রদায়ের অংশ না হতো তবে আমি তা ভেঁঙ্গে এর দুটো দরজা করে দিতাম।”
[তিরমিযী ও নাসা’ঈর সূত্রে বর্ণিত]

তারা এরূপ আরও অনেক উদাহরণ নিয়ে আসে;

এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তারা বলে যে নিঃসন্দেহে জাহেলী সরকারে অংশগ্রহণ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষয়। এ সরকারগুলো তাগুতের হুকুম বাস্তবায়ন করে এবং তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা) হুকুম থেকে বিচ্যুত হয় ও বিবাদে লিপ্ত হয়।

“হুকুম (বিধান বা আইন) দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ্।”
(সূরা-ইউসুফ: ৪০)

“তিনি কাউকে নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না।”
(সূরা কাহাফ: ২৬)

এতদসত্ত্বেও তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ক্ষমতার ভাগাভাগির কারণে ইসলাম, মুসলিম, ইসলামী দলগুলোর জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক ফায়দা রয়েছে যা তাগুত দূরীকরণে এবং সত্যের প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর সঠিক চিত্রটি তুলে ধরতে তাদের কিছু উক্তি তুলে ধরা যাক। যখন তাদের চিন্তার পদ্ধতি ও মতামতগুলো খন্ডন হয়ে যাবে তখন আমরা সহজেই বুঝতে পারব যে শারীআহ্ পদ্ধতি থেকে তারা কতদূরে অবস্থান করছে। তাদের বক্তব্য নিম্নরূপঃ

— জাহেলী শাসনব্যবস্থায় কোন মুসলিমের অংশগ্রহণ তাকে একটি বড় দ্বন্দের দিকে ঠেলে দেয়। মুসলিমদের তাগুত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত। তাহলে কী করে সে তাগুত প্রতিষ্ঠাকারীদের সাথে থাকতে পারে? যেসব মুসলিম নিজেদের ঈমানদার বলে দাবী করে এবং পরবতীর্তে আইনের জন্য তাগুতের শরণাপন্ন হয় আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদের ব্যাপারে বলেন,

“আপনি কি তাদেরকে প্রত্যক্ষ করেননি যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি নাযিল হয়েছে এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল হয়েছে, সে সমস্ত বিষয়ের উপর আমরা ঈমান এনেছি আর বিরোধপূর্ণ বিষয়ে তারা শয়তানের শরণাপন্ন হয়, অথচ তাকে প্রত্যাখ্যানের জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়।”
(সূরা নিসা: ৬০)

— তাগুতের প্রতি আনুগত্য করা আইনগতভাবে আল্লাহ্’র আদেশের বিরুদ্ধে যায় এবং সেক্ষেত্রে আল্লাহ্’কে ইলাহ্ মানার বদলে তাদেরকে ইলাহ্ মানা বুঝায়। তিনি সুবহানাহু তা’আলা আহলে কিতাবদের সম্পর্কে বলেন,

“তারা তাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদিগকে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে আল্লাহ্ ব্যতীত এবং মরিয়মের পুত্রকেও। অথচ তারা আদিষ্ট ছিল একমাত্র মাবুদের ইবাদতের জন্য।”
(সূরা আত্—তাওবা: ৩১)

রাসূল (সা) আদি বিন হাতিম (রা) এর নিকট এগুলোকে ইলাহ্ হিসেবে গ্রহণের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এমন অবস্থায় তাদেরকে মান্য করা যখন তারা আল্লাহ্ কতৃর্ক নির্দেশিত হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল হিসেবে গণ্য করে।

— আজকাল আমরা দেখতে পাই শাসকগণ সরল প্রকৃতির ও সাধারণ জনগণকে প্রতারিত করতে কিছু সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন মুসলিমকে কিছু পদে নিয়োগ দিয়ে তাদের কুশাসনকে শোভামন্ডিত করার চেষ্টা করে, যাতে তারা যুক্তি দাঁড় করাতে পারে যদি তারা ভ্রান্ত হতো তাহলে অমুক এবং অমুক কোনভাবেই তাদের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আসত না ।

— এবং তারপর অত্যন্ত জগণ্যভাবে এসব শাসকেরা মুসলিম মন্ত্রীদের দিয়ে অন্যায় ও নিষ্ঠুর আইনসমূহ পাস করিয়ে নেয় এবং কার্যসিদ্ধির পর তাদেরকে অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতই ছুড়ে ফেলে দেয়।

— ক্ষমতার ভাগাভাগি প্রতি আসক্তি হলো যালিম শাসকের নিদর্শন। আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআ’লা আমাদের এ ব্যাপারে সাবধান করে বলেছেন যে,

“আর যালিমদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ো না। নতুবা জাহান্নামের আগুণ তোমাদের পাকড়াও করবে।”
(সূরা হুদ: ১১৩)

এছাড়াও ক্ষমতার ভাগাভাগি জাহেল শাসকদের শাসনকালকে প্রলম্বিত করে।

— আমাদের জন্য এতটুকু জানাই যথেষ্ট, যারা এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে তারা এমন সব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুর’আনে বলেন,

“এবং যারা আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারাই কাফের।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৪)

এবং;

“এবং যারা আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারাই যালেম।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৫)

এবং;

“এবং যারা আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারাই ফাসেক।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৭)

উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ের কোনটিই এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব ও দাওয়াহ্ বহনকারীদের কাছে অপরিচিত বিষয় নয়। উল্লেখিত স্পষ্ট আয়াতগুলো হতে দিক নির্দেশনাও গোপন নয়।

এতদসত্ত্বেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে ক্ষমতার ভাগাভাগি ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন এবং মুসলিমদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। এমনকি এর দ্বারা তাগুত অপসারিত হবে এবং সত্য বুলন্দিত হবে। ক্ষমতার ভাগাভাগি থেকে ইসলামী আন্দোলনগুলো তথাকথিত কী কী সুবিধা লাভ করতে পারে তার সারমর্ম নিম্নরূপ:

১. দরজার ওপাশে কী হচ্ছে এ ব্যাপারে ধারণালাভের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া ও ব্যর্থ করা।

২. লোকদের এটা বুঝতে দেয়া দলটি শাসন করতে সক্ষম এবং এটি দরবেশদের একটি সংঘ নয়।

৩. ইসলামের ব্যাপারে আত্নবিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে আসা এই অর্থে যে, এটি মানুষের ব্যক্তিগত ও সার্বজনীন বিষয়সমূহ সমাধান দিতে সক্ষম।

৪. শাসনব্যবস্থার প্রশাসনিক কাজের জন্য দলটির অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করা।

৫. বর্তমান শাসনব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়ে এর ক্ষতি থেকে আন্দোলনকে রক্ষা করা।

৬. বিশেষ ইসলামী ব্যক্তি ও কর্মীদের সরকারী বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করে তোলা যায়।

৭. একটি ইসলামী দলের ভেতর থেকে এমন কিছু ব্যক্তিকে বের করে নিয়ে আসা যারা লোকদের মধ্যে উচ্চপদে আসীন হবে। তারাই দল এবং এর সদস্যদের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান করবে।

৮. ইসলামী কেন্দ্রসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি করে কুফরী কেন্দ্রসমূহের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করা।

৯. রাজনীতিতে ইসলামী ব্যক্তিত্বদের গড়ে তোলা এবং শেখানো কীভাবে এ ব্যবস্থার দোষণীয় বিষয়গুলো বর্জন করা যায়।

১০. শাসনব্যবস্থায় সুনামের মাধ্যমে দলের সুনাম বৃদ্ধি করা।

১১. যদি দলটি ক্ষমতার অংশীদারিত্ব না নেয়, তাহলে ইসলামের শত্রু কেউ অংশগ্রহণ করবে এবং তারা ইসলামী আন্দোলনকে আক্রমণ করার জন্য এবং ইসলাম ও মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবে। 

আমরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছি। যদিও আমাদের বক্তব্য কেবলমাত্র বক্তব্য দেয়ার জন্য নয়, বরং যুক্তিখন্ডনের জন্য। পরিষ্কারভাবে এর আসল প্রকৃতি তুলে ধরা এবং আল্লাহ্’র দ্বীন থেকে তারা কতটা বিচ্যুত হওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে তা বুঝার জন্য। তারা যখন কোনো ফাতওয়া বা রায় দেয় তখন তা দুনিয়া ও আখেরাতের অধিপতি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) হক ও নির্দেশের প্রতি কোনরূপ শ্রদ্ধা সৃষ্টির বদলে মুসলিমদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আর সেজন্যই তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অকাট্য দলিলসম্পন্ন শারী’আহ্’র সাথে কী পরিমাণ সাংঘর্ষিক সেটা মুসলিমদের বুঝানো প্রয়োজন এবং ইসলামের সঠিক ইসতিম্বাতের (মাসআ’লা আহরণ)পদ্ধতি গ্রহণ থেকে তারা কতটা বিচ্যুত তাও আমাদের জানা প্রয়োজন; এবং দেখানো প্রয়োজন তাদের নতুন আবিষ্কৃত পদ্ধতি যা মুসলিমদের অধঃপতনের সময়কার একটি স্মারক যখন তারা পশ্চিমা চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল যাতে করে আমরা তাদের চিন্তা বিশদভাবে বুঝতে পারি এবং খন্ডন করতে পারি ও তাদের চিন্তার পদ্ধতিকে উপলদ্ধি করতে পারি এবং তা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারি।

একটি সুস্পষ্ট ও অকাট্য শারী’আহগত হুকুম হচ্ছে সুদ খাওয়া যাবে না, যে ব্যাপারে কোনরূপ ইজতিহাদ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এটাকে নিষিদ্ধ করেছেন যখন তিনি বলেন,

“আল্লাহ্ ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।”
(সূরা বাক্বারা: ২৭৫)  

এগুলো হল অকাট্য শারী’ঈ দৃষ্টান্ত যে ব্যাপারে কঠিনভাবে বলা হয়েছে, যেমন যখন তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,

“আল্লাহ্ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-খয়রাতকে বর্ধিত করেন।”
(সূরা বাক্বারা: ২৭৬)

যারা সুদের সাথে সম্পর্ক রাখে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন এবং একে যুদ্ধের ঘোষণার শামীল হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন,

“হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহ্’কে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া রয়েছে তা পরিত্যাগ কর যদি তোমরা মু’মিন হও। অতঃপর যদি তোমরা তা না কর তবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও….”
(সূরা বাক্বারা : ২৭৮—২৭৯)

যারা সুদ খায় তাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে ঐ ব্যক্তির ন্যয়, যাকে শয়তান আছর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়।”
(সূরা বাক্বারা: ২৭৫)

রাসূলুল্লাহ্ (সা) এটা ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং একে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র সাথে শিরক হিসেবে দেখিয়েছেন:

“সাত ধরনের মুবিকাত (ভয়ঙ্কর গুণাহ্’র কাজ) থেকে বিরত থাক। তারা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেগুলো কী ইয়া রাসূলুল্লাহ্?’ তিনি (সা) বললেন, ‘আল্লাহ্’র সাথে শিরক করা, যাদু, বিনা কারণে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পত্তি ভক্ষণ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসা, মু’মিনা সৎ সতী-সাধ্বী নারীর উপর অপবাদ আরোপ করা’।”

এতদসত্ত্বে আমরা দেখি যে তারা তাদের অনুসৃত পদ্ধতি অনুসারে বলে, সুদ অনুমোদিত! তাহলে এই সুস্পষ্ট ও অকাট্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কী হল? এই সাবধান বাণী ও ভীতি প্রদর্শনের কী হবে?  এ পদ্ধতির মাধ্যমে তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত হুকুম পরিবর্তন ও সংশোধন করছে, শারী’আহ্’র গায়ে কালিমালেপন করছে, দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে অবহেলা প্রদর্শন করাকে স্বাভাবিক করে ফেলছে এবং এটাকে মুসলিমদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপস্থাপন করছে।

একইভাবে আল্লাহ্ যা দিয়ে নাযিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করা হল ফরয। তাদের সুপারিশক্রমেই বলা যায় যে, আইন তৈরির বিষয়টি কেবলমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র জন্য রাখাটাই বাধ্যতামূলক। এতদসত্ত্বেও তাদের তৈরি করা পদ্ধতি অনুসারে, তারা মুসলিমদের কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের অনুমোদন দিচ্ছে। নিজেদের ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও চিন্তাবিদ হিসেবে দাবি করলেও তারা সত্য থেকে কতটুকু বিচ্যুত তা আমরা দেখিয়েছি যদিও নেতাদের তাদের অনুসারীদের নিকট মিথ্যা বলা কোনভাবেই কাম্য নয়।

তারা নিজেরাই বলে,

— এটা সন্দেহাতীত যে জাহেলী শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ আমাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। সরকারগুলো তাগুতের হুকুম বাস্তবায়ন করে এবং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র হুকুম থেকে বিচ্যুত হয় ও তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করে।

— জাহেলী শাসনব্যবস্থায় মুসলিমদের অংশগ্রহণ তাদের একটি বড় দ্বন্দের দিকে ঠেলে দেয়। মুসলিমদের তাগুত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত। তাহলে কী করে একজন তাগুত প্রতিষ্ঠাকারীদের সাথে থাকতে পারে?

— তাগুতের প্রতি আনুগত্য করা আইনগতভাবে আল্লাহ্’র আদেশের বিরুদ্ধে যায় এবং সেক্ষেত্রে আল্লাহ্’কে ইলাহ্ মানার বদলে তাদেরকে ইলাহ্ মানা বুঝায়।

— আজকাল আমরা দেখতে পাই শাসকগণ সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ ও সাধারণ জনগণকে প্রতারিত করার জন্য কিছু মর্যাদাবান মুসলিমকে অলংকারিক কিছু পদে নিয়োগ দেন যারা ঐ সব শাসকদের দুঃশাসনকে বৈধতা দেয়। তখন শাসকেরা বলে যে, যদি তারা মিথ্যের মধ্যে থাকতেন তাহলে অমুক এবং অমুক কোনভাবেই তাদের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আসত না।

— পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন সেসব শাসকরা মুসলিম মন্ত্রীদের দিয়ে অন্যায় ও নিষ্ঠুর আইনসমূহ পাস করিয়ে নেয় এবং কার্যসিদ্ধির পর সেসব ব্যক্তিদের তারা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতই ছুড়ে ফেলে দেয়।

— ক্ষমতার ভাগাভাগি হল অবিচারকারী শাসকদের প্রতি মন্দ প্রবণতার উজ্জল দৃষ্টান্ত।

— এছাড়াও ক্ষমতার ভাগাভাগি জাহেল শাসকদের কার্যকালকে প্রলম্বিত করে।

আমাদের জন্য এটুকু জানা যথেষ্ট যে, যে ব্যক্তি এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে তারা এমন সব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“…তারাই কাফের।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৪)

“… তারাই যালেম।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৫)

“…তারাই ফাসেক।”
(সূরা মায়িদাহ্: ৪৭)

এতদসত্ত্বেও তারা এহেন মতামত বা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। আল্লাহ্’র দ্বীনের বিরুদ্ধে কীভাবে তারা এরকম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে! আরও ঘৃণ্য বিষয় হচ্ছে, তারা কেবল নিজেরাই ইসলামের হুকুমসমূহকে অমান্য করে না বরং অন্যদেরকেও অমান্য করতে উৎসাহী করে তোলে। এটা অবশ্যই একটি ভয়াবহ গুণাহ্।

শারী’আহগত হুকুমকে তারা কীভাবে অমান্য করেছে সেটা উপস্থাপনের পর আমরা জিজ্ঞেস করতে চাই কুফর শাসব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা কী অর্জন করবে? আমরা ভেবেছিলাম এই দাওয়াহ্’র বিরুদ্ধে তাদের পূর্বসর্তকতা উপস্থাপনের পর তারা শারী’আহ্ উপেক্ষিত এসব ভ্রান্ত সুবিধাবাদী চিন্তাসমূহ উল্লেখ করবে কিন্তু এটা বুঝতে পারার মতো তারা যথেষ্ট চতুর ছিল যে, এসব পরিত্যাজ্য যুক্তি এবং অথর্ব চিন্তা দ্বারা নিঃসন্দেহে শারী’আহ্ লঙ্ঘিত হবে এবং আল্লাহ্’র শত্রুরা সুবিধা পাবে। আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ দানকারী তাদের এসব ‘অভিনব’ চিন্তা না মুসলিমদেরকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে লাভবান করেছে, না তাদেরকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, না বিজয়কে নিকটবর্তী করেছে এবং না বাস্তবতাকে সামান্যতম পরিবর্তন করেছে। বরং প্রাপ্তিটা হয়েছে ঠিক তার উল্টো। যার সত্যতা বাস্তবতা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান।

জাহেল শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের কী সুবিধা হয়েছে এ ব্যাপারে তাদের ১১ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। আল্লাহ্’র কসম! একবার এগুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায় যে এর বিশাল গুণাহ্’র তুলনায় এর প্রাপ্তি কত সামান্য। এর কয়েকটিকে পরীক্ষা করে দেখা যাক:

— শাসনব্যবস্থার প্রশাসনিক কাজের জন্য দলটির অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করা।

— বিশেষ ইসলামী ব্যক্তিদের সরকারী বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করে তোলা।

— রাজনীতিতে ইসলামী ব্যক্তিত্বদের গড়ে তোলা এবং তাদের শেখানো কীভাবে এ ব্যবস্থার দোষণীয় বিষয়গুলো বর্জন করা যায়।

এ তিনটি অনুচ্ছেদ একটি বিষয়ের সাথে বিজড়িত। এ তিনটিকে একটি অনুচ্ছেদে রাখলেই বরং বেশী উপযোগী যদি না কেউ এর স্বপক্ষে অনেক বেশী যুক্তি তুলে ধরতে চায়। এটাও জানা দরকার যে, এ বিষয়ে কে কতটুকু কথা বলতে পারল তা নয়, বরং সত্যিকারের যথার্থতাই এখানে মুখ্য। এ অনুচ্ছেদগুলো কী ধারনাভিত্তিক সুবিধার বিনিময়ে মুসলিমদের আল্লাহ্’র হুকুম অমান্য করতে বৈধতা প্রদান করে? কোনো আন্দোলনের কর্মীদের প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ করে তোলার জন্য আল্লাহ্’র ক্রোধের এই পথ ছাড়া কি অন্য কোনো পথ নেই? শারী’আহ্ পদ্ধতি অনুসরণ করলে কী এ প্রশিক্ষণে ঘাটতি হতো? যে ইসলামী আন্দোলন রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর পদ্ধতিকে অনুসরন করে বৈধভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে তারাও তাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি  করতে পারে, শাসকদের বাস্তবতার সাথে পরিচিতি হতে পারে, কুফর রাষ্ট্রের সাথে এই শাসকদের সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে পারে এবং তাদের নানা কৌশল ও শঠতা ধরতে পারে । একজন দাওয়াহ্ বহনকারী কি মদখোরকে তার মদ খাওয়া পরিত্যাগ করার ব্যাপারে আহ্বান করতে অক্ষম? নাকি এর জন্য দাওয়াহ্ বহনকারীকে পানশালায় প্রবেশ করতে হবে, মদ পানকারীর সাথে তাকেও পান করতে হবে এবং এরপর তা ছেড়ে দিবে যাতে করে এ পদ্ধতির মাধ্যমে মদ পানকারী মনে করে যে, সেও চাইলে মদ পান ছাড়তে পারে। আল্লাহ্’র কসম! যারা এমন পদ্ধতিতে কাজ করে তাদের মন কতটাই না দূর্বল! তারা কী করে নিজেদের জন্য আল্লাহ্’র আইন পরিবর্তন করাকে অনুমোদন করে!

(জাহেল শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুবিধা হিসেবে) অতঃপর তাদের উল্লেখিত আরও তিনটি অনুচ্ছেদ—

— বর্তমান শাসনব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়ে এর ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া।

— দরজার ওপাশে কী হচ্ছে এ ব্যাপারে ধারণালাভের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া এবং একে ব্যর্থ করে দেয়া।

— যদি দলটি ক্ষমতার অংশীদারিত্ব না নেয়, তাহলে ইসলামের শত্রু কেউ অংশগ্রহণ করবে এবং তারা ইসলামী আন্দোলনকে আক্রমণ করার জন্য এবং ইসলাম ও মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করতে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবে। 

এখানে আমরা তিনটি অনুচ্ছেদ দেখতে পাই যা একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তা হল বর্তমান শাসনব্যবস্থার কুফল থেকে নিজেকে হেফাযত করা এবং ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করা। এ বিষয়ে আমরা তাদের সাথে একমত পোষণ না করেও তাদের মূলনীতি অনুসারে বিবেচনা করে ও তাদের উপস্থাপিত বাস্তবতার দৃষ্টিতেই বলতে পারি তারা কী আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে শাসন না করে উম্মাহ্’কে এবং নিজেদেরকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে? তাদের নিজেদের ভাষায়, শাসকগণ মুসলিম মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন যাতে করে তাদের শাসনব্যবস্থা প্রলম্বিত হয়, তাদের পরিকল্পনাগুলোকে পাশ করিয়ে নেয়া যায় এবং জনগণের সামনে তাদের ভাবমূর্তিকে উন্নত করা যায়। আর শাসকদের চাওয়া পাওয়া বাস্তবায়িত হওয়ার পর খেজুরের বীচির মতই তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। তাহলে কীভাবে ক্ষতি ও ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পাওয়া গেল? মুসলিমগণ ঐ শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করায় সে শাসনব্যবস্থার ভাবমূর্তি উন্নত হলেও অংশগ্রহণকারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় এবং জনগণ ঐ শাসনব্যবস্থা ও এতে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের একই দৃষ্টিতে বিচার করে।

অতঃপর নিম্নবর্ণিত অনুচ্ছেদ দুটিকেও একটি অনুচ্ছেদের আওতায় উপস্থাপন করা যায়:

— লোকদের এটা বুঝতে দেয়া যে দলটি শাসন করতে সক্ষম।

— ইসলামের ব্যাপারে আত্নবিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে আসা এই অর্থে যে, এটি মানুষের ব্যক্তিগত ও সার্বিক বিষয়সমূহের সমাধান দিতে সক্ষম।

দলটি এ ধরনের ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে না। বরং এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করবে যা অনুসরণীয় নয়। বান্তবতা হল এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যদি এসব দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধাচরণকারী খাঁটি ও সচেতন ইসলামী আন্দোলন এবং আন্তরিকতাসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদগণ না থাকত তাহলে যারা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে বিদ্যমান শাসনের ওকালতি করছে তাদের কারণে ইসলাম ইতিমধ্যে মানুষের অন্তর থেকে খসে পড়তো। যেসব দল ও এর চিন্তাবিদগণ এই শাসকদের আনুকূল্যে আয়েশী জীবনযাপন করে, তাদের মিথ্যা নেতৃত্বের জাঁকজমক পরিবেষ্টিত থাকে, তাদের সাথে অহংকার ঔদ্ধত্যের ঘ্রাণ নেয় তারা আর যেসব আন্দোলন বা ইসলামী চিন্তাবিদগণ কেবলমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র ওয়াস্তে সত্যের দিকে আহ্বান করে ও তা ধারণ করে এবং এ বিষয়ে কারও নিন্দার পরোয়া করে না তাদের মধ্যে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও তাঁর বান্দাদের দৃষ্টিতে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলেও তা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র বাণীই স্মরণ করিয়ে দেয়,

“অতএব আপনি সবর করুন (হে মুহাম্মদ) যেমন উচ্চ সাহসী পয়গম্বরগণ সবর করেছেন।”
(সূরা আল আহক্বাফ: ৩৫)

“আপনি আপনার পালনকর্তার নির্দেশের অপেক্ষায় সবর করুন (হে মুহাম্মদ) । আপনি আমার দৃষ্টির সামনে আছেন।”
(সূরা আত তূর: ৪৮)

“অতএব আপনি সবর করুন (হে মুহাম্মদ) । নিশ্চয় আল্লাহ্’র ওয়াদা সত্য।”
(সূরা মুমিনুন: ৫৫)

এ দুইয়ের দৃষ্টান্ত কি একই রকম?

তাদের পরবর্তী চারটি অনুচ্ছেদকেও একটি অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা যায়:

— ইসলামী একটি দলের ভেতর থেকে এমন কিছু ব্যক্তিকে বের করে নিয়ে আসা যারা লোকদের মধ্যে উচ্চপদে আসীন হবে। তারাই দল এবং এর সদস্যদের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান করবে।

— ইসলামী কেন্দ্রসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি করে কুফরী কেন্দ্রসমূহের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করা।

— রাজনীতিতে ইসলামী ব্যক্তিত্বদের গড়ে তোলা এবং শেখানো কীভাবে এ ব্যবস্থার দোষণীয় বিষয়গুলো বর্জন করা যায়।

— শাসনকতৃর্ত্বের সুনামের মাধ্যমে দলের সুনাম বৃদ্ধি করা।

এ বক্তব্যসমূহ এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী পোষণকারীদের চিন্তার ক্ষুদ্রতাকেই প্রমাণ করে। এ ধরনের ফলাফল কী আল্লাহ্’র সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না এবং যালিমুন বা অবিচারী, ফাসিকুন বা মিথ্যাবাদী এবং অত্যাচারীদের দোসর হবার ঝুঁকি বাড়ায় না? কোনো আন্দোলন কি এ অবস্থায় পতিত না হয়ে কাজগুলো করতে পারে না? আমরা কখনই মনে করিনা যে কোনো দল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আনুগত্য না করে এবং জাহেলী শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে এসব লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে, বরং ঐ দলের জন্য ফলাফল এর উল্টোই হবে এবং দাওয়াহ্ ও ইসলামের ঊপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে।

উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গী পোষণকারীরা যদি তাদের এসব কাজের যৌক্তিকতা দেখাতে ১১টি অনুচ্ছেদ বা কারণের আবতারণা করে থাকে তবে তাদের বাতিল চিন্তার ধারা অনুসরণ করে আমরাও এরূপ কাজের ফলে সৃষ্ট অসংখ্য ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা দেখাতে পারি। যেমন:

— এ পদ্ধতির অনুসরণকারী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও সদস্যগণ মুনাফিকীর শিক্ষা লাভ করে। যেসব শাসকরা তাদের জাহেলী শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করে তাদের সামনে যখন তারা যায় তখন তারা এমনকিছুই বলে যা সেসব শাসকদের সন্তুষ্ট করে। যখন তারা জনগণের সামনে যায় তখন অন্যকিছু বলে এবং তাদের বুঝানোর চেষ্টা করে যে, তারা শাসনব্যবস্থা ও শাসকদের কাছে যাচ্ছে যাতে করে শাসনক্ষমতা কেড়ে নিতে পারে।

— দলটির আচরণ সামগ্রিক পরিবর্তনমুখী হওয়ার বদলে হালকা, আত্মতুষ্টিমূলক ও নমনীয় হয়ে যায়।

— শাসনব্যবস্থার অধিকারীরা আন্দোলনকারীদের সংখ্যা সম্বন্ধে ধারণা লাভের সুযোগ পায় যাতে করে তারা এবং তাদের গোপন বিষয়সমূহ জানতে পারে। দলের সদস্যদের মধ্যকার পার্থক্যকে শাসকরা খুঁজে বের করতে পারে এবং এ বিভেদকে আরও শক্তিশালী এবং অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত করে। এভাবে দলটিকে সহজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারে এবং যখন প্রয়োজন তখন ভাঁঙ্গন সৃষ্টি করতে পারে।

— এই সমস্ত দলগুলোর দাওয়াহ্ শাসকদের শাসনের (সমালোচনার) মধ্যে সীমাবদ্ধ যা শাসকদের জন্য কোনো বিপদজ্জনক বিষয় নয় এবং তারা (ইসলামের) মূখ্য বিষয়ে নীরব থাকে যা দাওয়াহ্ ও ইসলাম সম্পর্কে ভুল দৃষ্টিভঙ্গী প্রদান করে।

— যখন একটি শাসনব্যবস্থা কোন ইসলামী আন্দোলনকে তার ভেতরে কাজ করবার সুযোগ দেয় তখন সে দলটিকে নিজের কাজ করার জন্য শাসনকতৃর্ত্বের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির অনুমতি নিতে হয় এবং এভাবে দলটি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আটকা পড়ে যায়, কারণ তখন একটি ভীতি কাজ করে যে, শাসনকতৃর্ত্ব হয়ত এসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিবে এবং বাজেয়াপ্ত করবে। সে কারণে তারা এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা যা সরকারকে নাখোশ করে এবং ফলে তা অবসানের সিদ্ধান্তও নিতে পারেনা।

— এসব তথাকথিত ইসলামী আন্দোলনগুলো জাহেলী শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর পদ্ধতির অনুসারী সঠিক ইসলামী আন্দোলনগুলোর উপর মৌলবাদী বা ধর্মান্ধ আখ্যা দিয়ে দমন-নিপীড়ন চালানোর সুযোগ করে দেয়। অন্যদিকে যারা শাসন কাজে সহযোগীতা করে তারা আলোকিত ও উদারমনা হিসেবে পরিগণিত হয়। এটা সত্যিই অদ্ভুত একটি ব্যাপার। এই উদার আচরণকারীরা যুক্তি উপস্থাপন করে যে, পদ্ধতিগত কারণেই তারা অনেক বেশী সহনশীল যেজন্য শাসকরা তাদের প্রতি সহযোগীতার হাত প্রসারিত করতে পারে এবং তারা বাদে অন্যরা ধর্মান্ধ।

— এ ধরনের ইসলামী দলের ধারণা বাস্তবতার সাথে মিল রেখে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, অমুসলিম জিম্মিদের কাছ থেকে জিযিয়া না নেওয়া, জিম্মি বলে তাদের অসন্তুোষকে উস্কে না দেয়া। এছাড়াও তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হল গণতন্ত্র তাদেরই একটি সম্পদ যা তাদের কাছেই আবার ফিরে এসেছে অথবা সুদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কোনো কিছু দিয়ে পরিচালিত যে শাসনব্যবস্থা তাতে অংশগ্রহণ করাও এর আরেকটি উদাহরণ।

— এটা (বিদ্যমান) শাসনকার্যকালকে আরো দীর্ঘ করে।

— (বিদ্যমান) শাসনব্যবস্থার একটি সুন্দর ভাবমূর্তি তুলে ধরে।

— লোকদের মন থেকে তখনই ইসলাম সম্পর্কিত বিষয়াদি হারিয়ে যেতে থাকে যখন তারা দেখে যে, এ শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম তাদের কিছুই দিতে পারছে না, বিশেষ করে তারা যখন আল মান্না ওয়া সালওয়া বা সবধরনের ঐশ্বর্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেয়। এটা প্রমাণ করে যে তারা সমস্যাসমূহের সমাধান সঠিক উপায়ে দিতে অক্ষম। ফলে এধরনের আন্দোলন অনুসরণীয় দৃষ্টান্তের বদলে নোংরা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।

— আন্দোলনের কমীর্গণের নৈতিক অধঃপতন ঘটে কারণ তাদের নিকট শাসকের অবৈধ কর্মকান্ড এবং তার যথার্থতার সমালোচনার বদলে দলের কর্মকান্ডের যুক্তি যথার্থতা তুলে ধরে দাওয়াহ্ বহন করাটাই মূখ্য বিষয় হয়ে পড়ে।

— শাসকরা যখন অন্য দলের দাওয়াহ্ বহনকারীদের উপর দমন-নিপীড়ন চালায় বা এর সদস্যদের গ্রেফতার করে তখন তারা পুরোপুরি নিশ্চুপ থাকে, এমনকি শাসকদের খুশি করার জন্য বা তাদের অনুরোধে এরূপ আন্দোলন অন্য (ইসলামী) আন্দোলনের কর্মীদের উপর হামলা চালায় যেমনি আজকাল মিশরে ঘটছে।

— এধরনের আচরণ পুরো দলটিকে শারী’আহ্ গ্রহণ করার বদলে সুবিধাবাদী করে তোলে। শারী’আহ্’র সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক হলেও যদি কোন কাজ সুবিধা বয়ে নিয়ে আসে তবে তাই সম্পাদিত হবে। মুসলিমদের কাছে তখন লাভের বিষয়টি শারী’আহ্’র চেয়ে প্রিয় হয়ে যায়। সুতরাং এরকম আরও অনেক কারণ রয়েছে যা দ্বীন ও দাওয়াহ্’র ক্ষতি করছে।

আমরা এসব কিছুই বাস্তবতার নিরিখে তুলে ধরেছি, শারী’আহ্’র ভিত্তিতে নয়, যাতে করে আমরা দেখাতে পারি যে তাদের অবলম্বিত পথ অনুযায়ীও যদি আমরা তাদের চিন্তার পদ্ধতিকে বিবেচনা করে দেখি তবে তা থেকে দাওয়াহ্ ও ইসলামের জন্য কুফল ছাড়া আর কিছু দৃষ্ট হয়না। এটি একটি নিষ্ফল চিন্তা যে ব্যাপারে শারী’আহ্’র কোন অনুমোদন নেই।

শারী’আহ্ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এটা করতে আমাদের বাধা দেয় যে আমরা (কেবল) বাস্তবতার বিচারে কোন একটি চিন্তার ভ্রান্তি তুলে ধরবো বা বুদ্ধিবৃত্তির বিচারে শারী’আহ্’র কোন বিষয়কে পরিত্যাগ করবো। আমরা তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করে আলোচনার সূত্রপাত করেছি শুধু এজন্য যাতে করে তাদের মুখের কথা দিয়েই তাদের ভুল দেখিয়ে দেয়া যায় ও তাদের নিজস্ব মানদন্ড দিয়েই তাদের কথার অসারতা প্রমাণ করা যায়। তবে আমরাসহ সব সচেতন ও আন্তরিক মুসলিম এটা জানে যে, কোন কাজ বা কথা গ্রহণ বা বর্জনের মানদন্ড হল শারী’আহ্। যেহেতু এটাই মূল ব্যাপার, অতএব যেসব শারী’আহগত দলিল তারা উল্লেখ করেছে যা তারা নিজেরা জানে এবং অন্যরাও জানে  সেগুলোই তাদের মতামত ও উপলদ্ধিকে খন্ডানোর জন্য যথেষ্ট যদিওবা তারা আরও ঊদাহরণ নিয়ে আসতে পারে। সমস্যাটি অনেক উদাহরণ দেখানোর বিষয় নয়, বরং চিন্তার পদ্ধতি সম্পর্কিত।

(শারী’আহ্’র ঐ প্রমাণগুলো) তারা জানে বলে (দাবী করলেও) তাদের  সেকথা আমরা মেনে নেব না। তাদেরকে তা মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই তাও নয়। কেননা, এসব শারী’আহ্ দলিলের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তারা যেসব কারণ উল্লেখ করেছে সেগুলোর দোহাই দিয়ে এ দলিলগুলোকে তারা  গ্রহণ করেনি। এটা অনুমোদিত নয়; পাশাপাশি এটি দ্বীনের ব্যাপারে উদ্ধ্যত্বপূর্ণ আচরণ এবং সুস্পষ্ট ও সঠিক হুকুমের বিষয়ে চরম অবহেলা। আর তাদের চিন্তার পিছনে কিছু ইসলামী চিন্তাবিদের বক্তব্য, যা কিনা এমনিতেও এই বাস্তবতার উপর প্রযোজ্য নয় তা  দলিল হিসেবে উপস্থাপন করার বিষয়ে আমরা বলবো, কোন মানুষের বক্তব্য শারী’আহ্’র দলিল হতে পারে না। যেটা একমাত্র  বিবেচ্য তা হলো  দলিল এবং ইসতিদ’লাল বা লদ্ধ বিষয়ের যথার্থতা। যদি তারা বলে অমুক ও অমুক ব্যক্তি বলেন, তখন আমরা বলি এ ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) যা বলেন তাই চূড়ান্ত এবং মুহকাম (সুস্পষ্ট ও অরহিত)। কোন একজন ব্যক্তির কথায় আল্লাহ্ এবং তার রাসূল (সা) এর বাণী কি রহিত হয়ে যাবে? এ পদ্ধতির পক্ষালম্বনকারীদের মাথায় লাভের চিন্তা এতটাই প্রাধান্য বিস্তার করে যে তাদের দাওয়াহ্’র ব্যবসায়ী বলাই সঙ্গত। অবশ্য ব্যবসায়ীরা সর্বদা লাভের আশায়ই ব্যবসা করে থাকে, লোকসানের জন্য নয়।

তাদের চিন্তার দূষণ আরো যেভাবে বুঝা যায় তা হলো তারা নিয়মবহির্ভূত ক্বিয়াসের উপর ভরসা করে যা সুবিধাকে প্রাধান্য দেয়ার ভিত্তিতে যুক্তি দিয়ে শারী’আহ্’র বিধানকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে লদ্ধ। এটা তাদের নুতন ইসতিম্বাতের দিকে ধাবিত করে যে ব্যাপারে ইসলামী উম্মাহ্ ও চিন্তাবিদগণ ওয়াকিফহাল ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রদর্শিত এবং উম্মাহ্’র সব উলামাগণ (সালাফ আস সালীহ বা নেককার পূর্বসূরী) কর্তৃক অনুসৃত এবং তাদেরকে যারা ইহসান বা সৎ কাজের ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছেন, তাদের গৃহীত সঠিক ইসতিম্বাদের পদ্ধতিকে তারা পরিত্যাগ করেছে। তাদের কোনো আলোচনার মধ্যে এ ধরনের সুশৃঙ্খল ও যথার্থ শারী’আহগত পদ্ধতির উল্লেখ নেই। তারা পশ্চিমা পদ্ধতি অর্থাৎ বুদ্ধিজাত সাদৃশ্যতা এবং লাভকে মানদন্ড হিসেবে ব্যবহার করে। নিম্নের হাদীসটি যথার্থভাবে তাদের জন্যই প্রযোজ্য:

“তোমাদের মধ্যে যারা দীর্ঘজীবী হবে তারা অনেক মতপার্থক্য লক্ষ্য করবে। নতুন জিনিসের ব্যাপারে সাবধান হও, প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত (নবপ্রচলন) এবং প্রত্যেক বিদআতই জাহান্নামের আগুনের দিকে যাবে।” (তিরমিযী ও আবু দাউদ)

তাদের ভাষ্য অনুসারে, ইসলাম মদ ও জুয়াকে নিষিদ্ধ করেছে যদিও মানুষ এগুলো থেকে কিছু উপকারিতা পেয়ে থাকে। সে কারণে বড় উপকারিতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মদ ও জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিশ্বাসীদের জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও শারী’আহ্ জিহাদকে বাধ্যতামূলক করেছে। এর কারণ হলো জিহাদ মানুষের রবের নিকট ও মানবজাতির জন্য মঙ্গলজনক।

ধমীর্য় গুরুত্ব থাকার পরও রাসূলুল্লাহ্ (সা) কাবা’কে ধ্বংস করে ইব্রাহীম (আ) এর ভিত্তির উপর তা পূনঃনির্মাণ করার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেছিলেন। কারণ কাবা’র কাঠামোগত সংস্কার করলে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হতো বেশী।

এর উপর ভিত্তি করে তারা বলে যে, জাহেলী শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা সত্যিই বড় ক্ষতির কারণ। তবে আন্দোলনটি কিছু পরিস্থিতিতে মনে করতে পারে যে, ক্ষমতার অংশীদারিত্ব কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলাম, মুসলিম ও ইসলামী আন্দোলনকে লাভবান করবে। এর মাধ্যমে তাগুত দূরীভূত হবে এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

তারা তাদের চিন্তাকে আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে যা থেকে উপলদ্ধি করা যায় যে এ চিন্তাকে তারা তাদের মর্মমূলে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শারী’আহ্’র বাণীকে এরকম পন্থায় উপলদ্ধি করে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হুকুমসমূহ বের করা খুবই বেদনাদায়ক। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনের এই যুগে লাভ-লোকসানের সাথে তুলনা করে লব্দ এসব চিন্তা বর্তমান যুগে আমাদের বেদনাকে আরও বহুমাত্রায় বৃদ্ধি করেছে। পূর্বে ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সুশৃংখল নীতিমালাকে অনুসরণ করতেন, যেখানে মানুষের বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ ছিলনা বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত নিয়মকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হতো, যা আমরা খুব দ্রুতই ব্যাখ্যা করব ইনশা’আল্লাহ্। অপরদিকে, আমরা দেখি কিছু মুসলিম নতুন আবিষ্কৃত এই পদ্ধতির দ্বারা আইন তৈরির একটি দরজাকে উন্মোচন করে এবং এতে প্রবেশ করে। কোনো কাজের লাভ বা ক্ষতি বের করার ক্ষেত্রে তারা তাদের খেয়ালখুশী বা প্রবৃত্তির বশবতীর্ হয় এবং এ পদ্ধতিকে গ্রহণ করে। বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে যখন একটি উপকার, সংশ্লিষ্ট ক্ষতিকে ছাড়িয়ে যায় তখন কাজটি অনুমোদিত। আবার যখন ক্ষতি, সংশ্লিষ্ট উপকারকে অতিক্রম করে তখন কাজটি পরিত্যাজ্য। এ নতুন আবিষ্কৃত পদ্ধতি অনুসারে মানুষ তার খেয়াল ও প্রবৃত্তির বশবতীর্ হয়ে আইনপ্রণেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

উল্লেখিত পদ্ধতিতে কোনো কর্মের হুকুম বের করতে তারা শারী’আহ্’র বাণীকে উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে খেয়াল-খুশিমতো ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে। এটাই পশ্চিমাদের চিন্তা পদ্ধতি। পশ্চিমারা এ ধরনের চিন্তার উপর নির্ভর করে থাকে।

যাইহোক এ পদ্ধতি মুসলিমদেরকে লাভ-ক্ষতির উপাসক বানায়, আল্লাহ্’র আদেশের নয়। এটা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যেখানে লাভ অকাট্য শারী’আহ্’র হুকুমের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায় এবং লাভ-ক্ষতির মাপকাঠিকে প্রাপ্ত হুকুমসমূহ দ্বারা শারী’আহ্’র হুকুমসমূহ বাতিল হয়ে যায়।

শারী’আহ্’র হুকুমসমূহের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয় সুসংজ্ঞায়িত মূলনীতির মাধ্যমে। যে মুসলিম এটাকে সঠিকভাবে অনুসরণ করেন তিনি সত্যিকার অর্থে আল্লাহ্’র বান্দা এবং তাঁর হুকুমের প্রতি আনুগত্যশীল। হুকুম বের করার সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে লদ্ধ শারী’আহ্’ই আল্লাহ্’র হুকুম। আর এটা ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব হবে না যতক্ষণ না সে ব্যক্তি ক্বিয়াসের জন্য শারী’আহগত ইল্লাহ্ বা কারণের উপর নির্ভর করবে।

ভাল ও মন্দ, আকর্ষণীয় ও অনাকর্ষণীয়, হালাল ও হারামকে সংজ্ঞায়িত করার এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র। এটা কখনওই মানুষের হাতে অর্পণ করা হয়নি। যদি মানুষকে এ অধিকার দেয়া হতো তাহলে শুরু থেকেই তাকে আইন প্রণয়নের সুযোগ দেয়া হতো। শারী’আহ্ মানুষের কর্মকান্ডজনিত হুকুমের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতো না। এবং মানব জীবনের সব কাজের নিয়ন্ত্রক এবং সংগঠক শুধুমাত্র আল্লাহ্ এটা বিশ্বাস না করে মুসলিমদের শুধু এতটুকু বিশ্বাস করলে হতো যে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তা।

সমগ্র মুসলিম যুগ ধরেই ইসতিম্বাতের শারী’আহগত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। আমাদের বিশিষ্ট বিচারকগণ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে ব্যক্তির এ ব্যাপারে জ্ঞান রয়েছে এবং নিজেকে এইসব মূলনীতির আওতায় রাখে তার জন্য এটা একটি সহজ ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি।

এই নবআবিষ্কৃত পদ্ধতির দূর্বলতা হলো, এগুলো শারী’আহ্’র অকাট্য হুকুমের সাথে সাংঘর্ষিক। যদি পদ্ধতিটি সঠিক হতো তাহলে এর মাধ্যমে লদ্ধ হুকুমসমূহ অবশ্যই শারী’আহ্’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো। এটা স্বয়ং এবং এটা যে প্রভাব তৈরী করে উভয়ই প্রমাণ করে যে, এ পদ্ধতিটি ত্রুটিপূর্ণ। নিম্নের কিছু উদাহরণ ব্যাপারটি আরো পরিষ্কারভাবে বুঝতে সহায়তা করবে:

— বৈধ উপায়ে দাওয়াহ্’র জন্য প্রয়োজন সৎ স্পষ্টবাদিতা, সাহস, শক্তি এবং চিন্তা। একজনকে অবশ্যই যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং দ্বন্দে অবতীর্ণ হতে হবে যাতে পরিস্থিতির কোনরকম তোয়াক্কা না করে এর অসত্যতা স্পষ্ট করে তোলা যায়। এর জন্য প্রয়োজন কেবলমাত্র ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতি নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব, যদিও এটা অধিকাংশ লোকের মতামত বা ঐতিহ্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয় অথবা তারা এর গ্রহণ, প্রত্যাখ্যান বা বিরোধিতা করে। দাওয়াহ্ বহনকারী ব্যক্তি লোকদের ও ক্ষমতাসীনদের তোষামোদ করে না। এভাবেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) যে সত্যের দাওয়াহ্ দিতেন তার উপর বিশ্বাস করে আহ্বান অব্যাহত রাখতেন। এসময় তিনি কোনো প্রথা, ঐতিহ্য, ধর্ম, বিশ্বাস, শাসক ও জনগণকে তোয়াক্কা না করে পুরো পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি ইসলামের বাণী ব্যতিরেকে অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করেননি। ইবনে হিশাম উল্লেখ করেন, যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুরাইশদের চ্যালেঞ্জ করেন তখন তাদের দেবতাসমূহকে অপদস্থ করেছিলেন, তাদের মানসিকতাকে কটাক্ষ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন পথভ্রষ্ট। কুরাইশগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তার বিরোধিতা ও শত্রুতায় একতাবদ্ধ হয়েছিল। এভাবেই মুসলিমদের আজকে দাওয়াহ্ বহন করা উচিত। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে অনুসরণ করতে চায় তারা যাতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা’র নিম্নের আয়াতকে মনে রাখে:

“বলুন (হে মুহাম্মদ)! এটাই আমার পথ। ‘আমি পূর্ণ সচেতনতার সাথে আল্লাহ্’র দিকে আহ্বান জানাই, আমি এবং আমার অনুসারীরা।”
(সূরা ইউসুফ: ১০৮)

এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন,

“আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তা তোমরা ধারণ করো তাহলে কখনও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে না। এটি হলো সুস্পষ্ট বিষয়: আল্লাহ্’র কিতাব ও তাঁর প্রেরিত রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্।”
(সীরাতে ইবনে হিশাম)

এবং যারা সালাফ আস সালিহ’দের পথ ও তাদের কথা অনুসরণ করে তারা বলে “বিষয়ের (দ্বীনের) সমাপ্তি ভাল হতে পারে না, যদি না যার মাধ্যমে এর শুরুটা ভাল হয়েছিল, তা না থাকে”, আর এ ধরনের দাওয়াহ্’তে তা মানতেই হবে।

বর্তমানে শারী’আহ্ কতৃর্ক অননুমোদিত এই নতুন ও নবআবিষ্কৃত পদ্ধতির অনুসারীদের বক্তব্য হচ্ছে অধিকতর সুবিধা সবচেয়ে উপযোগী ও সর্বোত্তম চিন্তার দিকে ঈঙ্গিত প্রদান করে এবং তারা ইস্যুসমূহকে হিকমাহ্’র (প্রজ্ঞা) সাথে উপস্থাপন করে এবং সর্বোত্তম পন্থায় আহ্বান করে। এটা তাদের কর্মপদ্ধতি, এটা কখনোই শারী’আহগত কোনো পদ্ধতি নয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, দাওয়াহ্’র প্রতিবন্ধক সববিষয়কে চ্যালেঞ্জ করে দাওয়াহ্’র লাভ কি? এর মাধ্যমে অন্যদের হৃদয় উন্মুক্ত নাকি বন্ধ হয়? অন্যদের সাথে মৌলিক মতপার্থক্যের ভিন্নতা প্রকাশের দরকার কি? অন্যদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়াটাই কি ভাল নয় এবং এটাই হল তাদের হৃদয় মনে জায়গা করে নেয়ার অন্যতম প্রধান কৌশলগত দিক? তাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে, যখন তারা আমাদের ও তাদের মাঝে বড় কোন মতপার্থক্য খুঁজে পাবে না তখন কি তারা আমাদের আরও নিকটবর্তী হবে না? শাসকের বিরোধীতা করা এবং উম্মাহ্’র সম্মুখে তাদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা উন্মোচন করা কি দাওয়াহ্’র স্বার্থের আনুকুল্য? তাদের ক্ষিপ্ত করা এবং তাদের মন্দ দিকসমূহ উন্মোচন করার চেয়ে তাদের নিকটবর্তী ও বন্ধুসুলভ হওয়াই কি বেশী ভাল নয়? হয়ত এতে তারা তাদের খুব কাছে আসবে এবং তাদেরকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে আসবে যাতে দাওয়াহ্ লাভবান হবে এবং সবাই এর সুফল ভোগ করবে। সম্ভবত এভাবে তারা ক্ষমতায় পৌঁছে যাবে। আর একারণেই তারা এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, তারা শাসকগোষ্ঠীর জন্য ভয়ের কারণ না এবং তাদেরকে নিকটবর্তী হতে দিলে তারা ক্ষতির কারণ হবে না। এখানেই তোষামোদের অধ্যায়ের শুরু এবং যা সঠিক পদ্ধতি থেকে যোজন যোজন দূরে। এছাড়া এটি হল শাসকদের তুষ্ট করার সূচনা, তাদের কর্মকান্ডের মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেয়া, তাদের প্রতারণামূলক কর্মকান্ডের ব্যাপারে নীরব থাকা, শাসকদের উষ্মা সৃষ্টি করে না এমনসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা, কথা বলা এবং উম্মাহ্’কে সাবধান করা উচিত এমনসব অপরিহার্য বিষয়কে অবহেলা করা এবং সত্যের সাথে আপোষকারী এজাতীয় আরও অনেক কথা ও কাজে ব্যস্ত থাকা। এসব কিছুর পেছনে দায়ী তাদের চিন্তার পদ্ধতির পরিবর্তন।

— নবী (সা)-এর জ্ঞানের উত্তরসুরী ইসলামী চিন্তাবিদগণের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র হক্ব হচ্ছে তারা মুজাহিদীনদের মধ্যে সামনের সারিতে থাকবেন, সত্য উচ্চারণ করবেন, তা ধারণ করবেন এবং শাসকদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরে তাদের সাথে দ্বন্দে লিপ্ত হবেন। অন্যকথায় তারা অবশ্যই জ্ঞান, মিহরাব ও যুদ্ধের ইমাম হবেন। সালাফ আস সালিহগণ এরুপ ছিলেন। এ নবআবিষ্কৃত পদ্ধতিতে আমরা দেখতে পাই যে, এমন এক নতুন উপলদ্ধি তৈরি হয়েছে যা পূর্বের ইসলামী চিন্তাবিদদের চিন্তার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তাদের চিন্তা কথার মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়। তারা বলে যদি আমাদের চিন্তাবিদগণ হক্ব কথা বলতে গিয়ে গ্রেফতার অথবা মারা যান তাহলে কে তার স্থলাভিষিক্ত হবে? উম্মাহ্ এতে করে যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা এর লাভের চেয়ে অনেক গুণ বেশী। তাহলে কেন আমরা উম্মাহ্’কে এসব চিন্তাবিদের ঊপকার থেকে বঞ্চিত করব?

— অনুরূপভাবে, সংসদীয় নির্বাচনের অংশগ্রহণ করা কিছু শর্তের ভিত্তিতে অনুমোদিত: প্রার্থীকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে এবং তাকে ইসলামী শাসনের প্রতি আনুগত্যশীল থাকতে হবে। তিনি অবশ্যই কুফর আইনকে মেনে নেবে না বরং খন্ডন করবেন এবং শারী’আহ্ আইনকে এর বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করবেন। তিনি নির্বাচিত করতে পারবেন না একজন অমুসলিম প্রেসিডেন্টকে কিংবা এমন একটি সরকারকে যার ভিত্তি কুফর। সরকারকে আস্থা ভোট দেয়া তার জন্য অনুমোদিত নয়, বরং তিনি তা প্রতিরোধ করবেন। কারণ সরকার ইসলামের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। আর এটাই হল সুস্পষ্ট শারী’আহ্ আইন।

তবে আমরা এই নবআবিষ্কৃত পদ্ধতি অনুসারে দেখতে পাই যে, মুসলিমদের এমন কাউকে নির্বাচিত করার অনুমোদন দেয়া হয় যিনি শারী’আহ্ দিয়ে শাসন, জবাবদিহিতা ও শাসক নির্বাচন করেন না । বরং তারা খ্রিস্টান প্রার্থীদের নির্বাচনও মেনে নেন এবং নির্বাচনী তালিকায় অংশগ্রহনের জন্য তাদের সম্মতি দেন এ অজুহাতে যে, আইন প্রত্যেক অঞ্চলে এমপি সংখ্যা নির্ধারন করে দিয়েছে। মুসলিমরা নির্বাচিত করুক বা না করুক এভাবে খ্রিস্টান প্রার্থী বিজয়ী হয়। তাই তাদের দৃষ্টিতে প্রতিদ্বন্ধি পক্ষের লোকেরা তাকে নির্বাচিত করার চেয়ে মুসলিমদের জন্য উত্তম হলো তাদের জন্য অধিক উপকারী কাউকে নির্বাচিত করা।

এ কারণে এ পদ্ধতির সমর্থকগণ যত বেশী যুক্তি নিয়ে অগ্রসর হয় ততবেশী তারা সত্য থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।

ইসলামের সঠিক উপলদ্ধি থেকে দূরে থাকা এই নবআবিষ্কৃত ও নতুন মানসিকতার সমর্থকদের এটা বোঝা উচিত যে তাদের মানসিকতা ও আচরণের সাথে ইসলামের কোনো সম্পৃক্ততা নাই এবং এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত। তারা যা প্রতিষ্ঠা করেছে সে ব্যাপারে তাদের অনুতপ্ত হওয়া উচিত। ইসলামী দাওয়াহ্’তে তাদের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু তার আগে প্রথমে তাদেরকে এ মানসিকতা ও আচরণ হতে বের হয়ে আসতে হবে যাতে তারা আল্লাহ্’র নাযিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্যকিছু দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনাকারী শাসকগোষ্ঠীকে পরিত্যাগ করে ইসলামী শাসনের সমর্থক হয়।

মহাবিশ্বের অধিপতি একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হচ্ছেন লাভ-ক্ষতির অকাট্য সংজ্ঞা প্রদানের মালিক। তিনি ছাড়া আর কেউই কোনটি আমাদের জন্য কল্যাণকর এবং কোনটি অকল্যাণকর তা বলতে পারে না। যদি কোন মানুষ তা পারতো তবে সে আইনপ্রণেতার স্থান পেত এবং মানুষের জীবনযাপনের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র পক্ষ থেকে দ্বীনের কোনো প্রয়োজন ছিলনা। সেকারণে ইসলাম মুসলিমদের জন্য তাদের প্রভূর শারী’আহ্’কে গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করেছে। শারী’আহ্ যা বলে তাই আমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা নিষেধ করে তাই অকল্যাণকর। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কোন কিছুকে আমাদের জন্য কল্যাণকর বা ক্ষতিকর বলতে পারি না যতক্ষণ না এ ব্যাপারে কোনো হুকুম জারি হয়। এর আগে এটা খুঁজে বের করা আমাদের আয়ত্তাধীন নয়। কারণ মনের এমন কোন মানদন্ড নেই যার ভিত্তিতে যে ভাল বা খায়ের, মন্দ বা শা’র এবং হাসান বা সুন্দর ও কুব্হ বা নিন্দনীয় এর মধ্যে পার্থক্য করা যেতে পারে। সুতরাং আমাদের রয়েছে শারী’আহগত নীতিমালা, ‘যেখানে আমরা আল্লাহ্’র শারী’আহ্ পাই সেখানেই রয়েছে কল্যাণ।’ তাদের সেই মূলনীতি যাতে তারা বলে, ‘যেখানে মানুষের উপকারিতা রয়েছে সেখানেই আল্লাহ্’র আইন’ এ ধারণাটি ভুল। এ ব্যাপারে নীচের আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উল্লেখ করেন,

“তোমাদের উপর জিহাদ ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের নিকট অপছন্দনীয়; এবং হয়তো তোমরা এমনকিছুকে অপছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, আর এমনকিছুকে পছন্দ করছো যা তোমাদের জন্য অকল্যানকর। বস্তুত, আল্লাহ্ যা জানেন তা তোমরা জান না।”
(সূরা বাক্বারা: ২১৬)

এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আয়াতটি বুঝতে পারি,

“তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ।”
(সূরা আল আ’রাফ: ১৫৭)

তাইয়্যিব বা ভাল হলো সেটিই যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হালাল করেছেন এবং তিনি আমাদের এ ব্যাপারে অবহিত করার আগে আমরা এ ব্যাপারে জানতাম না। খাবিস বা খারাপ হলো সে জিনিস যা আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা নিষিদ্ধ করেছেন এবং আমরা এ ব্যাপারে কখনওই জানতে পারতাম না যদি না তিনি তা নিষিদ্ধ করতেন। এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের মন বুঝতে পারে কোনটি হালাল যেজন্য তিনি তা অনুমোদন করেন এবং মন যেটিকে হারাম বলে তিনি তা নিষেধ করেন।

যখন তারা বলে দু’টি ভাল জিনিসের মধ্যে শ্রেয়তর, দু’টি মন্দ জিনিসের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম দোষযুক্ত এবং দু’টি উপকারের মধ্যে উত্তমটি ও দু’টি ক্ষতির মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিটি বেছে নেয়া যায় এই বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ভুল এবং এটা শারী’আহ্’র জন্য সত্যিই বিপদজনক। এটা মাসালিহ্ মুরসালাহ্’র বিষয়ে মতামতের চেয়েও ভয়াবহ। এটা একারণে যে, মাসালিহ্’র ভিত্তিতে তারা তখনই কাজ করে যখন বাস্তবতা শারী’আহ্’র দিক নির্দেশনা বর্হিভূত হয়, কিন্তু উপরোক্ত বক্তব্য অনুযায়ী তারা আল্লাহ্’র হুকুমকে পর্যন্ত বদলাতে পারে, প্রবৃত্তিকে এগুলো রহিত করতে অনুমোদন দেয়। এর মাধ্যমে তারা হারামকে অনুমোদন দেয় এবং হালালকে বাতিল করে দেয়। এটা দ্বীনের জন্য ক্ষতিকারক এবং ভয়ংকর কার্যপদ্ধতি। একারণে তাদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গী সত্য থেকে অনেক দূরে।

এতক্ষন আমরা যা উপস্থাপন করলাম তাতে দেখতে পাই যে তাদের উসুল বা মুলনীতিগুলো একটি আরেকটির সহযোগী যা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আইনের মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে চায়, কেননা তারা শারী’আহ্’র মূলনীতির বদলে তাদের মন প্রদত্ত যুক্তিকে গ্রহণ করেছে এবং শারী’আহ্ যা চায় তা নয় বরং তারা যা চায় তাতে পৌঁছাতে তারা শারী’আহ্ প্রদত্ত চিন্তাপদ্ধতির বদলে যুক্তিনির্ভর চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছে। সে কারণে যৌক্তিক সাদৃশ্যতা হলো সব আলোচনায় তাদের পথনির্দেশক মূলনীতি। যদিও বিধানদাতা (আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মুসলিমদের জন্য যুক্তিনির্ভর সাদৃশ্যতা অনুসরণকে নিষিদ্ধ করেছেন। কারণ এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র বিরুদ্ধে যায় এবং কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের অনুমোদন দেয় ও এটা সত্য এবং যথার্থতা থেকে বিচ্যুত হয়ে একজনকে খেয়ালখুশী ও প্রবণতার দিকে ধাবিত করে। তাদের আলোচনা হলো তাগুতের সাথে মধ্যস্থতা করা যা আমাদের প্রত্যাখান করতে বলা হয়েছে। কারণ তাগুত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যা নাজিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কিছুর সাথে মধ্যস্থতা করে।

পরিশেষে আমরা অবশ্যই যুক্তিনির্ভর সাদৃশ্যতা এবং শারী’আহগত সাদৃশ্যতার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরবো যাতে যুক্তিনির্ভর সাদৃশ্যতার কুফল তুলে ধরা যায় এবং শারী’আহগত সাদৃশ্যতার গুরুত্ব তুলে ধরা যায় এবং এভাবে আমরা আমাদের নিজেদের, উম্মাহ ও সমগ্র মানবজাতিকে হেফাজত করতে পারি।

ঐসব মুসলিমগণ শারী’আহ্ হুকুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে যৌক্তিক মানদন্ডের ভিত্তিতে উপলদ্ধ অধিকতর লাভের দিকে ধাবিত হয়। যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তারা শারী’আহ্ হুকুম থেকে প্রাপ্ত লাভ এবং এ থেকে উদ্ভুত ক্ষতির মধ্যে তুলনা করে । তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী যদি এতে ক্ষতির পরিমান বেশী দেখা যায় তাহলে তারা যুক্তির ভিত্তিতে যে হুকুমটি নিলে বেশী লাভ হবে তা গ্রহণ করে ঐ বিষয়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট শারী’আহ্ হুকুমকে পরিত্যাগ করে। যদি শারী’আহ্ হুকুমের মধ্যে উপকারের পরিমাণ বেশী থাকে তাহলে তারা সেটা গ্রহণ করে, তবে আল্লাহ্’র হুকুম হিসেবে নয় বরং তাদের মন সম্মত বলে। এটা একটি বিপজ্জনক বিষয় এবং এ ব্যাপারে কারও নীরব থাকা কাম্য নয়। কারণ এটা মন ও প্রবৃত্তিকে শারী’আহ্’র অভিভাবক বানায় এবং মনকে আল্লাহ্’র হুকুমের উপর হস্তক্ষেপকারী বানায় এবং শারী’আহ্’র উপর প্রাধান্য দেয়। আর এটাই মানবরচিত আইন। আর এটাই তাদের এই বিষয়ে প্রদত্ত মতামতসমূহ যে শারী’আহ্’র সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক তার ব্যাখ্যা দেয়। তাই শুধু পার্থক্য এটা নয় যে তাদের মতামত অনুমোদিত না অনঅনুমোদিত কিংবা আল্লাহ্’র বিধান বাদে দিয়ে শাসন ক্ষমতায় অংশগ্রহন করা না করার বিষয়, বরং পার্থক্য হলো চিন্তার পদ্ধতিতে; কারণ এর দ্বারাই তারা শারী’আহ্বহির্ভূত হুকুম, যুক্তিনির্ভর হুকুম, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র নাযিল বর্হিভূত হুকুম ও প্রত্যাখ্যাত তাগুতের হুকুমের নিকটবর্তী হয়।

একারণে আমরা বলি যে, এ ধরনের উপলদ্ধি সঠিক উপলদ্ধি থেকে দূরবতীর্ অথবা বিপরীত। এর স্বরূপই এর অসারতাকে তুলে ধরে। এর উপর নির্ভর করা বা এর ভিত্তিকে হুকুম গ্রহণ করা সঠিক নয়। কারণ লাভ-লোকসানের অকাট্য সংজ্ঞা কেবলমাত্র জগতসমূহের অধিপতি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র জন্যই নির্ধারিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ জানে এরকম কোন লাভ বা ক্ষতি থেকে বিরত থাকার মধ্যে আমাদের জন্য কি উপকার রয়েছে? আর যদি এটা সম্ভব হতো তাহলে মানুষ নিজেই আইনপ্রণেতা হতো। মানুষের জীবনের সামগ্রিক বিষয়াবলীর ব্যবস্থাপনার জন্য ঐশী ব্যবস্থার অপরিহার্যতার কথা বিবেচনায় রেখেই ইসলাম মুসলিমদের জন্য তাদের প্রভূর শারী’আহ্কে গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করেছে। সে কারণে শারী’আহ্ আমাদের যা করতে বলেছে তাই আমাদের জন্য কল্যাণকর আর যা পরিত্যাগ করতে বলেছে তাই ক্ষতিকর। আল্লাহ্’র নির্দেশ বা নাযিল করা হুকুম ব্যাতিরেকে কোন কিছুর দ্বারা কল্যাণ বা ক্ষতি সম্পর্কে আমাদের জানা নাই। এর পূর্বে এ ব্যাপারে কোন কিছু সংজ্ঞায়িত করতে আমরা অক্ষম।

যখন মানুষ আইন প্রণয়ন করে তখন সে যুক্তিনির্ভর সাদৃশ্যতার পথ অনুসরণ করে, যেখানে সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়ের জন্য একই রকম হুকুম আসে এবং বৈসাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়ের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন হুকুম আসে। যখন আমরা ইসলামী শারী’আহ্’র দিকে লক্ষ্য করি তখন দেখি যে, এর প্রবক্তা সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাত স্রষ্টা সাদৃশ্যপূর্ণ অনেক বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন হুকুম ও বৈসাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়ে একইরকম হুকুম দিয়েছেন। এটা যুক্তিনির্ভর সাদৃশ্যতার বিপরীত। এটা এমন সব হুকুম দিয়েছে যেখানে মন কোন ভূমিকা রাখে না। আর এটাই ঐসব লোকদের জন্য নবআবিষ্কৃত পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যানের জন্য যথেষ্ট।   

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply