১৩তম অধ্যায়: সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ:) এবং কুফর ব্যবস্থার অধীনে শাসন

সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তিনি (আ) এমন একটি জাহেলী সমাজে বসবাস করতেন যেখানে শিরকী বিশ্বাসের কতৃর্ত্ব ছিল। সমাজটির নৈতিক বিপর্যয়ও ছিল ব্যাপক। লোভ এবং অবিচার এতই বিস্তার লাভ করেছিল যে সেই সমাজের লোকেরা ইউসুফ (আ)-এর নিষ্পাপ চরিত্রের নিদর্শন পেয়ে তাকে কারাবন্দি করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ইউসুফ (আ) এর সততা ও স্বপ্নের সুব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি উপলদ্ধি করে রাজা তাকে কারামুক্ত করেন এবং নিজের নিকটবর্তী করেন। সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) রাজাকে বলেছিলেন তাকে যেন কোষাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং রাজা তাঁর অনুরোধ রেখেছিলেন। তাই তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ইউসুফ (আ) জাহেলী শাসন ও শাসনব্যবস্থার মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যা ছিল বনী ইসরাইলের শারী’আহ্’র বিপরীত। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তিনি (আ) রাজার দ্বীনের (ব্যবস্থার) অথার্ৎ রাজার শাসন ও কতৃর্ত্বের উপর বহাল ছিলেন, এমনকি তিনি (আ) নিজের ভাইকে তাঁর নিকটে রাখতে কৌশল হিসেবে ইয়াকুব (আ)-এর শারী’আহ্ উল্লেখ করেন। ভাইয়ের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ দায়ের করার পুরো ঘটনাটিই ছিল তাঁর একটি কৌশল কারণ ইয়াকুব (আ) শারী’আহ্ মোতাবেক চোরকে দাসত্ব বরণ করতে হতো।

তারা আরও বলে বিষয়টি যে শুধুমাত্র সাইয়্যিদূনা ইউসুফ (আ)-এর জন্যই প্রযোজ্য এটা বলা যাবে না কারণ তা বলার জন্য দলিল প্রয়োজন। কারণ মৌলিকভাবে নবীগণ (আ) এবং তাঁদের (আ) নির্দেশিত পথের ব্যাপারে যাই উল্লেখ আছে তাই আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।

তাছাড়া তারা আরো বলে কারও এ দাবীও করা উচিত নয় যে এটা আমাদের পূর্ববতীর্গণের জন্য প্রযোজ্য শারী’আহ্ হতে এসেছে, কারণ শাসন সংক্রান্ত বিষয়টি শারী’আহ্’র ফুরু (শাখা) হতে উৎসারিত হয়নি যেখানে ভিন্নতার অবকাশ থাকবে বরং তা উসূল হতে উৎসারিত যেখানে সকলের ঐক্যমত্য রয়েছে। তাছাড়া সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) জানতেন যে,

“হুকুম একমাত্র আল্লাহ্’র।”
(সূরা ইউসুফ: ৪০),

এবং তা জানা সত্ত্বেও তিনি (আ) রাজার শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

সূরা ইউসুফের এ বিষয় সংক্রান্ত আয়াতগুলো অধ্যয়ন করলে লক্ষ্য করা যায় যে নিম্নোক্ত আয়াত দু’টির উপর ভিত্তি করে তারা কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের  বৈধতার পক্ষে মতামত দেয়,

“সে বাদশাহ্’র আইনে নিজ ভাইকে কখনও দাসত্বে দিতে পারত না, যদি আল্লাহ্ না চাইতেন।”
(সূরা ইউসুফ: ৭৬)

এবং

“(ইউসুফ) বলল: আমাকে দেশের কোষাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন।”
(সূরা ইউসুফ: ৫৫)

তারা বিষয়টিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছে যাতে তা তাদের মতামতের সাথে মিলে যায়। তারা ভুলে গেল সেসব মূলনীতির কথা যেগুলোর উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত যা তাদের মতের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সেইসব আয়াতগুলোকে পাশ কাটিয়ে গেল যা তাদের এই ব্যাখ্যার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তারা নবীদের নিষ্পাপতার বিষয়টিও ভুলে গেল। যদি এ আয়াত দুটির ব্যাপারে তাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় তবে সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) সম্পর্কিত তাদের সকল ব্যাখ্যাও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হবে।

নবীগণ আল্লাহ্’র সকর সৃষ্টির মাঝে পবিত্রতম এবং তারা নির্বাচিত। স্বীয় দ্বীনকে বিস্তৃত করার জন্যই তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদের (আ) নির্বাচিত করেছেন। তারা (আ) ছিলেন তাদের স্বীয় সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য সঠিক দৃষ্টান্ত ও অনুসরণীয় আদর্শ। কারণ তারা (আ) আল্লাহ্’র হুকুমকে সর্বোত্তম উপায়ে পালন করেছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদেরকে সমস্ত গুণাহ্ এবং প্রলোভন হতে পবিত্র রেখেছেন, এবং তাদেরকে সত্যের উপর অবিচল রেখেছেন এবং তাদের সাহায্য করেছেন। সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) ছিলেন সেই বাছাইকৃতদেরই একজন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা একাধিক আয়াতে তাঁর প্রশংসা ও তারিফ করেছেন।

“এমনিভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তোমাকে বাণীসমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব শিক্ষা দেবেন এবং পূর্ণ করবেন স্বীয় অনুগ্রহ….”
(সূরা ইউসুফ: ৬)

“যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেল, তখন তাকে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দেই।”
(সূরা ইউসুফ: ২২)

“এটা ছিল এজন্য যাতে আমি তার কাছ থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে আমার মনোনীত বান্দাদের একজন।”
(সূরা ইউসুফ: ২৪)

“এমনিভাবে আমি ইউসুফকে (মিশরের) ভূখন্ডে ক্ষমতা দান করলাম। সে তথায় যেখানে ইচ্ছা স্থান করে নিতে পারত। আমি স্বীয় রহমত যাকে ইচ্ছা পৌঁছে দেই এবং আমি পুণ্যবানদের প্রতিদান বিনষ্ট করি না।”
(সূরা ইউসুফ: ৫৬)

আল্লাহ্’র নিকট তিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ের দাওয়াহ্ বহনকারী ছিলেন। পবিত্র কুর’আনে উল্লেখ আছে যে যখন কয়েদখানায় তার সহকয়েদীরা তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইল তখন তিনি বলেলেন,

“হে কারাগারের সঙ্গীরা। পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভাল, নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ্? তোমরা আল্লাহ্’কে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের এবাদত করছো, যেগুলো (অজ্ঞতাবশত) তোমাদের ও তোমাদের বাপ-দাদাদের সাব্যস্ত করে নেয়া। অথচ এ ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোন দলীল-প্রমাণ নাযিল করেননি। আল্লাহ্ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও এবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”
(সূরা ইউসুফ: ৩৯-৪০)

তিনি ছিলেন পরিশুদ্ধ, আল্লাহ্’র প্রতি আনুগত্যশীল এবং তার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতেন। সে কারণে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাকে নারীদের ও আল আযিযের স্ত্রীর কূটকৌশল থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং যা পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত আছে,

“ইউসুফ বলল: হে প্রতিপালক, তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহ্বান করে, তার চাইতে আমি কারাগারই পছন্দ করি। যদি আপনি তাদের চক্রান্ত আমার উপর থেকে প্রতিহত না করেন, তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যাব। অতঃপর তার প্রতিপালক তার দো’আ কবুল করে নিলেন। অতঃপর তাদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।”
(সূরা ইউসুফ: ৩২-৩৪)

লোকেরা তাঁর ধর্মপরায়ণতা, সততা ও মহত্ত্ব পরীক্ষা করেছে। কয়েদখানায় তার দু’জন সহচর বলেছিল,

“আমাদেরকে এর ব্যাখ্যা বলুন। আমরা আপনাকে সৎকর্মশীল দেখতে পাচ্ছি।”
(সূরা ইউসুফ: ৩৬)

রাজা স্বপ্ন দেখার পর দুই বন্দীর একজন যিনি মুক্ত হয়েছিলেন তিনি ইউসুফ (আ)-কে বললেন,

“হে ইউসুফ! হে সত্যবাদী।”
[সূরা ইউসুফ: ৪৬]

নির্দোষিতা প্রমাণের আগে কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করায় তাঁর সম্পর্কে নারীগণ বলল,

“তারা বলল: ‘আশ্চর্য আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র মাহাত্ম্য! আমরা তো তাঁর উপর কোন পাপ কিংবা এ ধরণের কোন অভিযোগই দেখতে পাইনি!’ (একথা শুনে) আযীযের স্ত্রী বলল: ‘এখন (যখন) সত্য প্রকাশিত হয়েই গেছে, (তখন আমাকেও বলতে হয়, আসলে) আমিই তাঁর কাছে অসৎ কাজ কামনা করেছিলাম, অবশ্যই সে ছিল সত্যবাদীদের একজন।”
(সূরা ইউসুফ: ৫১)

ইউসুফ (আ) এর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে রাজা বললেন,

“বাদশাহ্ বলল: তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে নিজের বিশ্বস্ত সহচর করে রাখব।”
(সূরা ইউসুফ: ৫৪)

তাঁর ভাইকে নেয়ার সিদ্ধান্তের পর, ভাই বলল,

“সুতরাং আপনি আমাদের একজনকে তাঁর বদলে রেখে দিন। আমরা আপনাকে অনুগ্রহশীল ব্যক্তিদের একজন দেখতে পাচ্ছি।”
(সূরা ইউসুফ: ৭৮)

সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) তাক্ওয়া, দৃঢ়তা, আনুগত্য ও পাপ থেকে মুক্ত থাকার কারণে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাকে যে রহমত দিয়েছেন তা তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন,

“বললেন: আমিই ইউসুফ এবং এই হল আমার সহোদর ভাই। আল্লাহ্ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয়ই যে তাক্ওয়া অবলম্বন করে এবং সবর করে, আল্লাহ্ এহেন সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।”
(সূরা ইউসুফ: ৯০)

যার ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নিজে এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎকারী সকলেই সাক্ষ্য প্রদান করছেন তাকে কিভাবে কিছু মুসলিম অভিযুক্ত করে? পবিত্র কুর’আনে তিনি রাজার আইন দিয়ে শাসন করেছেন এ ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্তও উল্লেখ নেই। তিনি যে আইন দিয়ে শাসন করেছেন তার সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতটি বাদে আরও কোনকিছু উল্লেখ নেই,

“তারা বলল: এর শাস্তি এই যে, যার রসদপত্র থেকে তা পাওয়া যাবে, এর প্রতিদানে সে দাসত্বে যাবে।”
(সূরা ইউসুফ: ৭৫)

এই হুকুমটি ছিল ইয়াকুব (আ)-এর শারী’আহ্ অনুসারে। তিনি আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কোন কিছু দিয়ে শাসন করেছেন এ ব্যাপারে কোন দৃষ্টান্ত বা জ্ঞান কারও জানা নেই। তাদের সন্দেহযুক্ত যুক্তি নিম্নোক্ত আয়াত থেকে আসে:

“সে বাদশাহ্ আইনে আপন ভাইকে কখনও দাসত্বে দিতে পারত না, কিন্তু আল্লাহ্ যদি ইচ্ছা করেন।”
(সূরা ইউসুফ: ৭৬)

যখন এ আয়াতটির সঠিক তাফসীর করা হয় তখন সব সুবাহ বা সন্দেহ দূর হয় এবং তাদের দাবী অযৌক্তিক প্রমাণিত হয়।

এই পদ্ধতির পক্ষালম্বনকারীরা আয়াতটিকে দ্বান্দিক মনে করে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছে যা তাদের অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাদের ব্যাখ্যা ছিল নিম্নরূপ-

দূর্ভিক্ষের বছর, লোকেরা প্রতিটি এলাকা থেকে ইউসুফ (আ) কাছে আসা শুরু করল যাতে করে সংরক্ষিত ফসল থেকে তারা কিছু পায় এবং রাজা এগুলো বন্টনের দায়িত্ব ইউসুফ (আ) এর উপর ন্যস্ত করেছিলেন। তাঁর ভাইয়েরা আসল। যদিও ভাইয়েরা তাকে সনাক্ত করতে পারেনি, কিন্তু তিনি ঠিকই ভাইদের সনাক্ত করতে পারলেন। তিনি তার ছোট ভাইকে বললেন যে তিনি তাদের ভাই। তিনি তাঁর ভাইয়ের জন্য একটি কৌশল আঁটলেন। সবার অগোচরে একটি পানপাত্র বা সিকায়াহ তার ভাইয়ের উটের জিনের মধ্যে পুরে দিলেন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করে দিলেন যে পানপাত্রটি চুরি গেছে এবং কেউ বলল ঐ উটের বহরের কেউ এটি চুরি করেছে। যে তা খুঁজে বের করবে তাকে একটি শস্যবাহী উট দ্বারা পুরষ্কৃত করা হবে। ইউসুফ (আ)-এর ভাইয়েরা এ দাবীকে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করল। যারা বিতরণকার্য তত্ত্বাবধান করছিলেন তারা বললেন,

“…….যদি তোমরা মিথ্যাবাদী হও, তবে যে চুরি করেছে তার কি শাস্তি?”
(সূরা ইউসুফ: ৭৪)

ইউসুফ (আ)-এর ভাইগণ বললেন,

“…….শাস্তি হচ্ছে, যার রসদপত্রের মাঝে তা পাওয়া যাবে, প্রতিদানে সে দাসত্বে যাবে।”
(সূরা ইউসুফ: ৭৫);

অর্থাৎ চুরির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। আর এটা ছিল ইয়াকুব (আ) এর শারী’আহ্ মোতাবেক শাস্তি। সে কারণে ইউসুফ (আ) তার ভাইয়ের তল্পিতল্পা খোঁজার আগে অন্যদের তল্পিতল্পা খোঁজা শুরু করলেন। অতঃপর তার ভাইয়ের থলে থেকে এটি উদ্ধার করা হল এবং নিয়ম অনুসারে তাকে দাসত্ব বরণ করতে হল। তারপর ইউসুফ (আ) সম্পর্কে আয়াতটি বর্ণিত হয়েছে,

“সে বাদশাহ্’র প্রচলিত আইনানুযায়ী তাঁর ভাইকে তাঁর নিকটে রাখতে পারত না।”
(সূরা ইউসুফ: ৭৬);

কেউ কেউ এটাকে রাজার শারী’আহ্ (আইন) বা নিযাম (জীবন ব্যবস্থা) বলে ব্যাখ্যা করে থাকে। এর অর্থ হল মিশরের রাজার একটি শারী’আহ্ বা ব্যবস্থা ছিল এবং সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) তা দ্বারা পরিচালিত হতেন। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণে তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন যাতে তাঁর ভাইকে তাঁর কাছে রেখে দেয়া যায়। সে কারণে তিনি একটি শিষ্টাচারসম্মত কৌশলের আশ্রয় নিলেন এবং অভিযুক্তকেই তার শাস্তির ব্যাপারে মতামত দিতে বললেন। তিনি রাজার আইনানুসারে এ অপরাধের শাস্তি কি মোটেও তা বর্ণনা করেননি। বরং তিনি ভাইদের মুখ দিয়ে ইয়াকুব (আ)-এর আইনানুসারে রায় বের করে নিয়ে এসেছেন যাতে নিজ ভাইকে নিজের কাছে রাখা যায়।

আয়াতের এহেন ব্যাখ্যাই তাদেরকে উপরোক্ত উপলদ্ধিতে আসতে সহায়তা করেছে।

আমরা যদি আরবীতে ‘দ্বীন’ শব্দটির উপর আলোকপাত করি তাহলে দেখতে পাব যে, এটি একটি সার্বজনীন শব্দ যার একাধিক অর্থ রয়েছে। লিসান আল আরব (আরবদের ভাষা) ভাষাকোষ অনুসারে ‘দ্বীন’ বলতে বুঝায় বলপ্রয়োগের শাসন এবং আনুগত্য। সুতরাং ‘দ্বীনতুহুম ফা দ্বানও’ অর্থ হল ‘আমি তাদেরকে বাধ্য করলাম, তারা আমাকে আনুগত্য করল।’ দ্বীন বলতে আরও বুঝায় পুরষ্কার ও মূল্যবান বস্তু। ‘আমি তাকে পুরষ্কৃত করলাম’ এটা ব্যক্ত করতে আপনি বলতে পারেন, ‘তার দ্বীনুন কাজের জন্য দ্বীনতুহু’।  আবার ‘ইয়াওম আল-দ্বীন’ অর্থ হল ‘বিচার দিবস’। ‘দ্বীন’ বলতে জবাবদিহী করাকেও বোঝায়। যেমন: আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“যিনি বিচার দিবসের মালিক।”
(সূরা ফাতিহা : ৪)

দ্বীন এর আরেকটি অর্থ হল শারী’আহ্ এবং সুলতান। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না সমস্ত ফিত্না দূর হয়, এবং আল্লাহ্’র সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়।”
(সূরা আনফাল: ৩৯)

দ্বীন শব্দের আরও অর্থ হল অবমাননা বা দাসত্ব বরণ করা এবং ‘মাদ্বীন’ অর্থ হল দাস। আল-মাদ্বীনা মানে অধীনস্থ জাতি। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন, “আমরা কি মাদ্বীনুন?” [আল কুর’আন- ৩৭: ৫৩] যার অর্থ ‘অধিকার লাভ’।

একইভাবে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) অন্যত্র বলেন,

“যদি তোমাদের হিসাব-কিতাব না হওয়াই ঠিক হয়, তবে তোমরা একে (আত্মাকে) ফিরিয়ে দাও না কেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও?”
[সূরা আল ওয়াক্বিয়াহ্: ৮৬-৮৭];

এখানেও মাদ্বীনান অর্থ হল ‘অধিকার প্রাপ্ত হওয়া’।

‘দ্বীন’ এর এরকম আরও অনেক অর্থ রয়েছে।

সুতরাং এ আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোন অর্থটি বুঝিয়েছেন? এই অর্থগুলোর মধ্যে থেকে কোনও একটি অর্থ গ্রহণ করতে হলে সেই সুনির্দিষ্ট  অর্থের প্রতি ইঙ্গিতদানকারী ক্বারিনা (নির্দেশক) প্রয়োজন। যদি কেউ তা না করে তার মত ও দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে অর্থ গ্রহণ করে; নিজের খেয়াল-খুশিকে শারী’আহ্’র উপর স্থান প্রদান করে তবে তার অসৎ উদ্দেশ্য উন্মোচিত হবে। অন্যদিকে যিনি শারী’আহ্ ক্বারা’ইন (নির্দেশনা) কতৃর্ক দিকনির্দেশনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সীমাবব্ধ থেকে অর্থ গ্রহণ করেন, তিনি শারী’আহ্’কে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং প্রভূর হুকুম পালন করেছেন বলে গণ্য হবেন। সুতরাং বুঝা দরকার যে এসব একাধিক অর্থের মধ্যে কোন অর্থটি আসলে ঊদ্দেশ্য?

আমরা যদি বলি দ্বীন শব্দটি এখানে শারী’আহ্ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তবে আমাদের জানা উচিত শারী’আহ্’র নির্দেশনা এমন যেকোন ধরনের ব্যাখ্যা হতে আমাদের বিরত থাকতে বলেছে, যে ব্যাখ্যা মনে করে যে সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেছেন। কারণ তা নবীগণ(আ) এবং বিশ্বাসীগণদের জন্য হারাম করা হয়েছে, এবং তা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কতৃর্ক প্রেরিত বাণীর প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক যে বাণী একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র ইবাদত ও দাসত্বের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং তা আইন প্রণয়নের একচ্ছত্র মালিক একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা-এই বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।”
(সূরা আম্বিয়া: ২৫)

একই কথা ইউসুফ (আ) এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যখন তিনিও বলেন,

“আল্লাহ্ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”
(সূরা ইউসুফ: ৪০)

এটা অসম্ভব যে তিনি এ আয়াতের ব্যাত্যয় ঘটিয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রভূর হুকুমকে মেনে নিয়েছেন। একই অবস্থা আমরা সাইয়্যিদুনা শোয়াইব (আ) এর ক্ষেত্রেও দেখতে পাই, যখন তিনি বলেন,

“আর আমি চাই না যে তোমাদেরকে যা ছাড়াতে চাই পরে নিজেই সে কাজে লিপ্ত হব, আমিতো যথাসাধ্য শোধরাতে চাই। আল্লাহ্’র মদদ দ্বারাই কিন্তু কাজ হয়ে থাকে, আমি তাঁর উপরই নির্ভর করি এবং তাঁরই প্রতি ফিরে যাই।”
(সূরা হুদ: ৮৮)

আল কুরতুবীর মতে এ আয়াতের তাফসীর হল আমি নিজে যা করি সে সম্পর্কে তোমাদের নিষেধ করতে পারি না যেমনিভাবে আমি তোমাদের যা করার আদেশ দেই তা পরিত্যাগ করি না।

‘দ্বীন’ শব্দের অভিপ্রেত অর্থ যদি ’দাসত্ব’ নেয়া হয় যার মানে হচ্ছে তার ভাই ‘মাদ্বীনান’ অর্থাৎ মালিকবিহীন দাসে পরিণত হয়েছে তাহলে এই অর্থ পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ যাতে ইউসুফ (আ) এর ভাইয়ের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে চোরকে দাসত্বে আবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় এই যে, রাজা কতৃর্ক দাসে পরিণত না হলে অর্থাৎ মাদ্বীন (মালিকানাধীন দাস) না হলে তিনি তাঁর ভাইকে নিতে পারতেন না যদি না আল্লাহ্ ইচ্ছা করতেন। আর এই অর্থই সত্যের খুব কাছাকাছি। এমন কোন শারী’আহ্ ইঙ্গিত নেই যা এরূপ অর্থের অন্তরায় হতে পারে। বরং আয়াতে এর আগে যা এসেছিল তার সাথে এটা সঙ্গতিপূর্ণ এবং এটা প্রমাণ করে যে, সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) একজন মুহসীন বা সৎকর্মশীল, মুখলেসীন বা আল্লাহ্’র প্রতি আন্তরিক যেমনটি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন। লোকেরা যে বিষয়ে স্বাক্ষ্য দিয়েছে এটা তার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ।

সেকারণে এরকম তাফসীর প্রত্যাখাত হবে যা নবীদের নিষ্পাপতা ও পাপ থেকে পবিত্র হওয়ার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক এবং যার মানে দাঁড়ায় তারা যা বলেন তা করেন না।

রাজার প্রতি সাইয়্যুদনা ইউসুফ (আ)-এর বক্তব্যের তাফসিরের বেলায়,

“(ইউসুফ) বলল: আমাকে দেশের কোষাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান।”
(সূরা ইউসুফ: ৫৫)

এর তাফসীর প্রসঙ্গে তারা বলতে চায়, তিনি অর্থমন্ত্রী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন এবং এ পদে তাকে বহালের সময় তিনি ইয়াকুব (আ) এর শারী’আহ্ প্রয়োগ করেননি, বরং রাজার ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছেন যা ন্যায়বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলনা।

এটি একটি বিশাল পদস্খলন ও সত্য বিচ্যুতি। বিষয়টিতে সঠিক পথনির্দেশনা পেতে হলে আমাদেরকে নিম্নে বর্ণিত কিছু ইস্যুর সাথে পরিচিত হওয়া খুবই জরুরী।

— সেসময়ের শাসব্যবস্থাটি ছিল রাজতান্ত্রিক যেখানে রাজা তার নিজের আদেশ ও মতামতের ভিত্তিতে রাজ্য পরিচালনা করতেন। ইতিহাসে দু’ধরনের রাজতান্ত্রিক শাসব্যবস্থা দেখা যায়:

— রাজতন্ত্রের নির্বাহী ব্যবস্থায় রাজা তার মতামত ও হুকুমের মাধ্যমে রাজ্য পরিচালনা করেন। লোকদের তাই মানতে হয় যা কিছুকে রাজা উপযুক্ত মনে করেন এবং কেউ তার বিচারকে পরিবর্তন করতে পারেন না। আইন, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ সবই থাকে তার করতলগত। তিনি নিজে তার সহকারীদের নিয়োগ দেন এবং যখন খুশী তখন অপসারণ করেন। আনুগত্য ও ঘনিষ্টতার উপর নির্ভর করে অথবা তাদের যথার্থ বিচার ও সুপরিকল্পনার জন্য তিনি তাদের এ পদে নিযুক্ত করেন। এইসব সহকারীদের আনুগত্য ও বাধ্যতাই মুক্তভাবে শাসন করবার জন্য যথেষ্ট এবং তখন তারা নিজেদের হুকুম ও মতামতের মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করতে পারেন। অর্থাৎ ক্ষুদ্র পরিসরে তারা প্রত্যেকেই আলাদাভাবে একেকজন রাজা।

— সীমাবদ্ধ নির্বাহী ক্ষমতাচর্চার মাধ্যমে রাজতন্ত্র। এ ব্যবস্থায় রাজা একজন প্রকৃত রাজার বদলে একটি প্রতিচ্ছবি হয়েই থাকেন যেখানে তার নিরঙ্কুশ কোন ক্ষমতা থাকে না। এক্ষেত্রে রাজা নন, সংবিধান ও কানুনের উপর সার্বভৌমত্বের দায়িত্ব অর্পিত থাকে। রাজাকে ছাড়াই আইনপ্রণেতাগণ আইন প্রণয়ন করেন। এমন নির্বাহী কাঠামো থাকে যারা সংবিধান ও কানুন বাস্তবায়ন করে থাকেন। এছাড়াও এমন বিচার কাঠামো থাকে যারা রাজা ব্যতিরেকে বিবাদ মিমাংসা করেন এবং লোকদের মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটান। এ ধরনের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যাপকতা পায় যখন গণতন্ত্র বিস্তৃতি লাভ করে। আর এটাই হল সীমাবদ্ধ বা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। ইউসুফ (আ) এর সময়ে মিশরে তাহলে এই দু’টির মধ্যে কী ধরনের রাজতন্ত্র বলবৎ ছিল?

কেউ এ বিষয়টি কল্পনাও করতে পারবে না যে সেসময় মিশরের রাজা কোন ব্যবস্থা বা সংবিধানের অনুগত ছিলেন। ‘দ্বীন আল মালিক’ বলতে তারা বুঝায় তা নয় বরং রাজার আইনকেই বোঝানো হয়। শাসকের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রনকারী আজকের রাজতন্ত্র ও ইউসুফ (আ)-এর সময়কার রাজতন্ত্রের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ার ভিত্তিতে যে মতামত তা সঠিক মতামত থেকে বিচ্যুত এবং এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ সাদৃশ্যতা।

কোষাগারের দায়িত্ব প্রদান করতে রাজার প্রতি সাইয়িু্যদুনা ইউসুফ (আ)-এর অনুরোধ এবং এ ব্যাপারে রাজার সম্মতির সাথে শাসনের কোনরূপ সম্পর্ক বিদ্যমান নেই। বরং কুর’আন এ বিষয়টিকে স্বপ্নের বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে এবং এর বাইরে আর কিছুই নয়। এটা ফসলের উৎপাদন, ফসল কাটার বছর, খরার বছর এবং এ ব্যাপারে করণীয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সেকারণে তিনি বাহুল্য বর্জন করে অর্পিত বিশ্বাসে আস্থা রেখে সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) কে ময়দা মজুদ করবার দায়িত্ব নিতে এবং খরার বছরের জন্য ফসল কাটার বছরে বন্টনের ব্যবস্থা করবার আদেশ করেন। এটা ছিল একটি কঠিন কাজ এবং এটা ইউসুফ (আ)-এর মত কোন দক্ষ, বিশ্বস্ত, সচেতন এবং জ্ঞানী ব্যক্তি ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ইউসুফ (আ)-এর ভাইদের সাথে যা হয়েছে তা আলোচ্য ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের এ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোন সুযোগ নেই এবং সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ)-এর দায়দায়িত্ব পর্যন্ত একে বিস্তৃত করবার কোন সুযোগ নেই। আমরা এ কথা বলার অধিকার রাখি না যে সম্পদ সংগ্রহ করা এবং তা রাজার পরিষদবর্গ, পরিবার, সেনাবাহিনী ও নাগরিকদের জন্য ইয়াকুব (আ)-এর শারী’আহ্ ব্যতিরেকে রাজার ব্যবস্থা অনুযায়ী ব্যায় করা ছিল তাঁর দায়িত্ব। কিতাবের বাণীর এহেন ব্যাখা দেয়ার জন্য দলিল প্রয়োজন।

মুলতঃ রাজা ইউসুফ (আ)-এর বিচক্ষণ রায়, বিষয়াদি পর্যালোচনার ক্ষমতা ও দক্ষতার বিষয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। আর এটাই ইউসুফ (আ) কে রাজার অত্যন্ত নিকটে নিয়ে এসেছিল এবং এতো বড় দায়িত্বে নিযুক্ত হবার সুযোগ করে দিয়েছিল যা স্বপ্ন দেখার পর থেকেই তার (রাজার) মনে আসন গেড়েছিল। অতএব এটা গুরুত্বপূর্ণ যে ইউসুফ (আ) অন্য কারো হস্তক্ষেপ ছাড়াই এ সুযোগ লাভ করেছিলেন।  

কেঊ হয়ত এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে যে সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) কেবলমাত্র রাজার স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করেননি। বরং তিনি এ ব্যাপারে বিকল্প ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সংস্থার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। এটাই গুদামজাত পণ্যের দেখাশুনার দায়িত্ব প্রদান করতে ও এ ব্যাপারে তাকে স্বাধীন ক্ষমতা প্রদানে রাজাকে আস্থাশীল করেছে। রাজা ইউসুফ (আ) কে এমনটা বলেননি যে তার একটি শারী’আহ্ বা ব্যবস্থা রয়েছে এবং এটা দিয়েই পরিচালিত হতে হবে। বরং রাজা ইউসুফ (আ) এর স্বপ্নের ব্যাখ্যা এবং এ ব্যাপারে তার সমাধানকে গ্রহণ করেছেন। ফলে রাজা উপযুক্ত মনে করেই তাকে ফসল বন্টন ও মজুদের দায়িত্ব দেন।

এটা অনস্বীকার্য যে খরার বছরের পর ইউসুফ (আ)-এর কাছে জনগণকে দুভীর্ক্ষ থেকে উদ্ধারের জন্য আসতে হয়েছে। এটাও অবধারিত যে সুবিচার ও সঠিক বন্টনের জন্য তার সুখ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা রাজার সাথে তার সম্পর্ককে আরও ঘনীভূত করেছে ও তাকে আরও নিকটে নিয়ে এসেছে। হয়ত এটাই তাকে আজিজ হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে যেমনটি তার ভাইদের কথায় পাওয়া যায়।

“হে ভূমির অধিপতি (হে আযীয)।”
(সূরা ইউসুফ : ৮৮);

সেই রাজা যার কাছে তার পিতামাতাকে মরুভূমি থেকে আসতে হয়েছে।

তিনি রবের নিকট দু’আ করলেন এবং বললেন;

“হে আমার রব! তুমি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছ……।”
(সূরা ইউসুফ: ১০১)

অতঃপর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“সে তার পিতামাতাকে উচ্চাসনে বসালো…।”
(সূরা ইউসুফ: ১০০);

এর অর্থ হল তাকে কর্তৃত্বও দেয়া হয়েছিল।

পবিত্র কুর’আন এর বর্ণনানুসারে একমাত্র আইন যা ইউসুফ (আ) বাস্তবায়ন করেছিলেন তা হলো ইয়াকুব (আ)-এর শারী’আহ্ অনুসারে তার ভাইকে দাস হিসেবে গ্রহণ করা। যদি রাজার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সেটা না গ্রহণ করার মাধ্যমে তিনি রাজকীয় ব্যবস্থার ব্যাত্যয় ঘটালেন কেন?

এটা কল্পনা করা সম্ভব নয় যে সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) শারী’আহ্’র বিন্দুমাত্র ব্যাত্যয় ঘটিয়েছেন। কারণ তিনি হলেন মাসুম বা ভুলের উর্ধ্বে এবং তাঁর রব তাকে মুহসীন বা উত্তম, আন্তরিক ও ধার্মিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যিনি প্রেমের চেয়ে কারাভোগকে অির্ধক প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি কারাগারের ভেতরে দাওয়াহ্’র কাজ করতেন। তিনি নিজেকে নিরাপরাধ প্রমাণ না করে কারাগার থেকে বের হতে চাননি। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর সততা ও দক্ষতার কারণে আযীয পত্নী হতে শুরু করে শহরের নারীগণ, কারাগারে তাঁর দুই সাথী, রাজার, এমনকি পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে তাঁর ভাইগণ পর্যন্ত তৎকালীন সমাজের সকর কাফেরদের প্রসংশা অর্জন করেছিলেন।

এটা উল্লেখযোগ্য যে সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ)-এর অবস্থা ও রাজার রাষ্ট্রবিষয়ক তাফসীর এসবই হল তাফসির জান্নি (ধারণামূলক ব্যাখ্যা (Speculative interpretation))। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তারা আসুক না কেন সবই অসাঢ়। সুতরাং রাজা কি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নাকি কাফের রয়ে গিয়েছিলেন, নাকি রাজার মৃত্যু বা অপসারণের পর রাজর্ষিক দায়িত্ব ইউসুফ (আ)-এর উপর অর্পিত হয়েছিল, নাকি পূর্বের আযিযের মৃত্যু বা অপসারণের পর তিনি কি আযিয হয়েছিলেন-এসব সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র বক্তব্য হল :

“সে বাদশাহ্ আইনে নিজ ভাইকে দাসত্বে নিতে পারত না।”
[সূরা ইউসুফ: ৭৬],

অথবা তাঁর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র) বক্তব্যের ব্যাখ্যা,

“আমাকে দেশের কোষাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন……।”
[সূরা ইউসুফ : ৫৫];

এসব প্রশ্নের সব উত্তরই ধারণামূলক (Speculative)। কারণ পবিত্র কুর’আন এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উত্তরের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করেনি। এছাড়া এ বিস্তারিত বিষয়গুলো আইন হিসেবে মেনে নেয়া আমাদের জন্য অপরিহার্যও নয়। আমাদের ব্যাখ্যাও এর ব্যতিক্রম নয়, যেহেতু এটাও অন্যান্য ধারণামূলক (Speculative) ব্যাখ্যার মতোই ভিন্নরুপের আরেকটি ব্যাখ্যা মাত্র। তবে আমাদের ব্যাখ্যাটি অন্যান্য ব্যাখ্যার চেয়ে এদিক থেকে অনন্য যে এটা তাক্বওয়া ও ঈমানের ভিত্তিতে নবীদের যথার্থতা তুলে ধরে এবং নবীদের নিষ্পাপতার সাথেও সাংঘর্ষিক নয় যা কিনা দ্বীনের অন্যতম ভিত্তি। একটি ব্যাখ্যা সত্য হতে কতটা বিচ্যুত হতে পারে যার নমূনা ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি যখন তা স্বয়ং ইউসুফ (আ) মুখ হতে নিসৃত অকাট্য বক্তব্য যা তিনি শিরকের আক্বীদা বর্জনের জন্য সকলকে আহ্বান জানিয়েছেন তার সাথে সাংঘর্ষিক হয় এবং বিচার-ফয়সালায় শুধুমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র প্রতি মুখাপেক্ষিতাকে বর্জন করে? এভাবে অগ্রসর হয়ে ইউসুফ (আ) এর পরিস্থিতি সুস্পষ্ট করার মাধ্যমে আমরা এমন একটি অবস্থায় উপনীত হতে পারি যেখান থেকে কুফর ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের পক্ষে কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীই হলো শারী’আহ্’র হুকুম, কোন ধারণানির্ভর (Speculative) হুকুম নয়। এটা দলিলের অর্থ ও সত্যতার বিচারে অকাট্য।

কেউ হয়ত বলতে পারে যে ইউসুফ (আ) আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র  নির্দেশ মোতাবেকই রাজার ব্যবস্থা অনুসারে শাসন করেছিলেন এবং এতে তাঁর রবের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়েছে। এর উত্তরে বলা যায়, হয় এই কুফর ব্যবস্থা দিয়ে শাসন করার অনুমোদন সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ)-এর জন্য সুনির্দিষ্ট ছিল, না হয় তা ছিল সার্বজনীন?

যদি এটা শুধুমাত্র সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ)-এর জন্য সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকে তাহলে এটা আমাদের জন্য অনুমোদিত নয়। সে কারণে এটা আমাদের জন্য দলিল বা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে না।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, যদি এটা তৎকালীন সময়ের সার্বজনীন হয়ে থাকে তাহলে এটা এমন একটি হুকুম যা পূর্ববর্তীগণের শারী’আহ্’র বর্ণনা হিসেবে আমাদের নিকট এসেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পূর্ববতীর্গণদের শারী’আহ্ কি আমাদের জন্য প্রযোজ্য? একদল ফিক্হ ও উসূলবিদগণ নিম্নোক্ত উসুলী মূলনীতিটি বর্ণনা করেছেন,

“পূর্ববতীর্গণদের শারী’আহ্, আমাদের জন্য শারী’আহ্ নয়।”

এ ব্যাপারে অনেক দলিল পেশ করা যায়, যার মাধ্যমে দেখানো যাবে যে মুহম্মদ (সা) আনীত ব্যবস্থা পূর্ববর্তী সকল শারী’আহ্’র হুকুমকে রহিত করেছে এবং কিছু হুকুমকে ব্যাখ্যাসহ রহিত করেছে। আমরা যদি এই চিন্তাবিদদের মতামতকে গ্রহণ করি, তাহলে ইউসুফ (আ)-এর সময়কে কিংবা অন্যকোন নবীর (আ) সময়কে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা বা অনুসরণ করা অনুমোদিত নয়। আরেকদল ফিক্হ ও উসুলবিদ নিম্নোক্ত মূলনীতিটি বর্ণনা করেছেন,

“পূর্ববতীর্গণদের শারী’আহ্ ততক্ষণ আমাদের জন্য শারী’আহ্ হয়ে থাকবে যতক্ষন না তা রহিত হয়।” এসব চিন্তাবিদগণ তাদের আইনগত কারণও উল্লেখ করেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, যদি পূর্ববতীর্দের আইনের মধ্যে আমাদের কোন উপকারীতা না থাকত তবে সেগুলো পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত হতো না। তারা আরও বলে থাকেন যে পবিত্র কুর’আন পূর্ববর্তী শারী’আহ্’র হুকুমকে হঠাৎ রহিত করেনি। তারা বলেন যে, পূর্ববতীর্দের ব্যাপারে পবিত্র কুর’আন এবং হাদীসে যা বলা হয়েছে তা আমাদের জন্যও প্রযোজ্য যদি না নতুন কোন আইন দ্বারা সেগুলো রহিত কিংবা প্রতিস্থাপিত হয়।

যখন এই মূলনীতিকে আমরা আলোচ্য বিষয়ে প্রয়োগ করি তখন আমরা কি পাই? আমাদের শারী’আহ্ কী আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা বাদ দিয়ে অন্য কিছু দিয়ে শাসন করাকে অবৈধ করেনি? পবিত্র কুর’আন বা মুহাম্মদ (সা), শাসনের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সা)-এর শারী’আহ্ হতে চুল পরিমাণ বিচ্যুতির ব্যাপারে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেনি?

অবশ্যই মুহম্মদ (সা)-এর শারী’আহ্ আমাদের বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রে সেটি ছাড়া অন্যকোন কিছুর নিকট দ্বারস্থ হতে নিষেধ করেছে। কুফর ও জাহেলিয়াতের কাছ থেকে যেকোন হুকুম নেয়া থেকে বিরত থাকবার জন্য অকাট্যভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যদি এটা দাবি করা হয় যে এটা সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ)-এর সময়ে বৈধ ছিল, তাদেরকে আমরা বলতে চাই যদি তাদের কথা মেনেও নেয়া হয় তারপরেও কুর’আনের শারী’আহ্ মোতাবেক এটা সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ (রহিত)।

যারা বলেন যে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করার দৃষ্টিভঙ্গী উসূল থেকে উৎসারিত, শাখা থেকে নয়, তাদের এ মতটিও সঠিক নয়। কারণ বিশ্বাসের জায়গা হল চিন্তায় এবং শারী’আহ্গত হুকুমের জায়গা হল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। আক্বীদা হল শারী’আহ্’র ভিত্তি এবং শারী’আহ্গত হুকুম হল আক্বীদার ফসল।

বান্দার কাজের সাথে সম্পর্কিত শারী’আহ্গত হুকুমের দু’টি দিক রয়েছে :

১. বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিশ্বাসগত দিক যা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

এই ক্ষেত্রটি আক্বীদার সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং দলিল ক্বাতী’ঈ (অকাট্য) কিংবা জান্নি (ধারণামূলক) যাই হোক এর অস্বীকার কুফরী বা পাপের দিকে ধাবিত করবে।

— ব্যবহারিক দিক যা কার্যসম্পাদনের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

যেমন: সালাত হল ফরয এবং এটাকে ফরয হিসেবেই বিশ্বাস করতে হবে। এটাকে ফরয হিসেবে বিশ্বাস না করা কুফরী।

আবার, (আমলের ক্ষেত্রে) সালাত হল ফরয এবং এটাকে ফরয হিসেবেই পালন করতে হবে। এটা ফরয হিসেবে পালন না করা গুনাহ্।        

মদ খাওয়া হারাম এবং এর হারাম হওয়াটা অবশ্যই মেনে নিতে হবে। আর এটাকে অনুমোদিত বলা কুফরী।

আবার, মদ হারাম এবং এটা পান করা পরিত্যাজ্য। কাজেই (আমলের ক্ষেত্রে) মদপান একটি গুনাহ্।

একইভাবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র আইন দিয়ে শাসন করা ফরয। আর এটাকে মেনে নেয়া ঈমানের সাথে সম্পর্কিত যা অকাট্য দলিল থেকে উদ্ভুত। একে কার্যকর করার ক্ষেত্রে এটা হল তা’আহ্ বা আনুগত্য এবং কার্যকর না করা হল মা’সিয়াহ্ বা গুনাহ্। সুতরাং আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা না করাটা কুফর হিসেবে গণ্য হবে যদি আল্লাহ্’র ওহী দ্বারা শাসনের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করা হয় কিংবা তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। আর যদি আল্লাহ্’র ওহী দ্বারা শাসনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা হয় কিন্তু তা কার্যকর না করা হয় তবে তা গুনাহ্ (কাফের হবে না) হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা দিয়ে শাসন করা একটি উসুলী ঐক্যমত-এ বক্তব্য প্রথম দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে এবং এটা সঠিক। দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে (ব্যবহারিক দিক) এটা শারী’আহ্ এবং এর প্রয়োগের ব্যাপার। অন্য কথায়, এটা ফুরু বা শাখা-প্রশাখার সাথে সম্পর্কিত, উসুল বা ভিত্তির সাথে নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই এটা আলোচনার ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে যে এটা কি আমাদের পূর্ববর্তী শারী’আহ্’তে ছিল কি না?

এ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা বলতে পারি যে সাইয়্যিদুনা ইউসুফ (আ) শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেননি এবং ঐভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা অনুমোদিত নয়। যেসব লোকেরা বিষয়টিকে অন্যভাবে নিয়েছে তাদের দাবি প্রত্যাখ্যাত, এমনকি তাদের নিজেদের যুক্তির দিক থেকে দেখলেও। এর কারণ হল আলেমগণ শা’রা মান কাবলানা বা পূর্ববতীর্গণের শারী’আহ্’র ব্যাপারে দু’টি মত পোষণ করেছেন। একটির মতে, পূর্ববতীর্দের শারী’আহ্ আমাদের জন্য শারী’আহ্ নয়। সুতরাং এ উপলদ্ধি অনুসারে, জাহেল ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের অনুমোদন প্রত্যাখাত। অন্য একটি অংশের মতামত হল, পূর্ববতীর্দের শারী’আহ্ ততক্ষণ আমাদের জন্য শারী’আহ্ হিসেবে থাকবে যতক্ষণ না সেটি রহিত হবে। অনেক আয়াত, আক্বীদা ও রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর কাজের মাধ্যমে কীভাবে আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা প্রতিষ্ঠিত করা যায় সে পদ্ধতি বলে দেয়া হয়েছে এবং এসব মূলনীতি অনুসারে কুফর ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা অনুমোদিত নয়। বরং ইসলাম সামগ্রিকভাবেই এ ধরনের চিন্তাকে প্রত্যাখ্যান করে। অন্য কথায়, যদি জাহেল শাসনব্যবস্থায় অংশ নেয়া পূর্ববতীর্দের শারী’আহ্ হয়েও থাকে, তবে আমাদের শারী’আহ্ অসংখ্য দলিলের মাধ্যমে এটাকে রহিত করে দিয়েছে।

নবীদের জীবন এবং তাদের প্রতি নাযিলকৃত নির্দেশনা সম্পর্কে (আল-কুর’আনে) যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তার ঊদ্দেশ্য হল (সেসব বিষয়ে) তাদেরকে অনুকরণ ও অনুসরণ করা, এ কথাটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

আক্বীদার ক্ষেত্রে সব নবী একই দাওয়াত দিয়েছেন। সবাই লোকদেরকে আল্লাহ্, তার একত্ববাদ, আল খালিক্ব বা স্রষ্টা, আল মুদাব্বির বা সবকিছুর পরিচালনাকারী এ দিকে আহ্বান করেছেন। তারা ফেরেশতা, আল্লাহ্’র কিতাব, রাসূল ও শেষ বিচার দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য লোকদের দাওয়াত দিয়েছেন,

“আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।”
(সূরা আম্বিয়া: ২৫)

দাওয়াহ্ বহন, বহনের সময় দূর্ভোগ, ক্ষতি ও নির্যাতন ভোগ করা, আল্লাহ্’র জন্য ধৈর্যধারণ করা ও তাঁর পথে ত্যাগ স্বীকার করা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“আপনার পূর্ববর্তী অনেক পয়গম্বরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তারা ধৈয্য ধারণ করেছেন। তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছানো পর্যন্ত তারা নির্যাতিত হয়েছেন। আল্লাহ্’র বাণী কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। আপনার কাছে পয়গম্বরদের কিছু কাহিনী এসে পৌঁছেছে।”
(সূরা আল আনআম: ৩৪)

তিনি আরও বলেন,

“আপনাকে তো তাই বলা হয়, যা বলা হতো পূর্ববর্তী রাসূলগণকে।”
(সূরা হামীম সিজদাহ্: ৪৩)

গ্রহণ ও আনুগত্য করার বেলায় তাদের লোকদের বলার ক্ষেত্রেও সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

“বস্তুত আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহ্’র নির্দেশানুযায়ী তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়।”
(সূরা নিসা: ৬৪)

তাদের দাওয়াহ্’কে অবিশ্বাস করা ও প্রত্যাখানের দিক থেকে একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“হায় মানবজাতি! তাদের কাছে এমন কোন রাসূলই আগমন করেনি যাদেরকে তারা বিদ্রুপ করেনি।”
(সূরা ইয়াসীন: ৩০)

এবং তিনি আরও বলেন,

“কাফেররা পয়গম্বরগণদের বলেছিল: ‘আমরা তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে।’ তখন তাদের কাছে তাদের প্রতিপালক ওহী প্রেরণ করলেন যে, ‘আমি যালিমদের অবশ্যই ধ্বংস করব। তাদের পর তোমাদেরকে ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত করব। এটা ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আমার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে এবং আমার আযাবের ওয়াদাকে ভয় করে।”
(সূরা ইবরাহীম : ১৩-১৪)

অবশেষে তাদের দ্বীনকে বিজয়ী করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“এমনকি যখন পয়গম্বরগণ নৈরাশ্যে পতিত হয়ে যেতেন, এমনকি এরূপ ধারণা করতে শুরু করতেন যে, তাদের অনুমান ভুল হয়েছিল, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছে। অতঃপর আমি যাদের চেয়েছি তারা উদ্ধার পেয়েছে। আর নাফরমান জাতির উপর থেকে আমার আযাব কখনোই রোধ হবে না।”
(সূরা ইউসুফ: ১১০)

এভাবে দাওয়াহ্’র ক্ষেত্রে বিভিন্ন পয়গম্বরগণ একইরকম ছিলেন, যার কিছু ঊদাহরণ আমরা উপস্থাপন করেছি। যারা আগে এসেছিলেন তাদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এগুলো এজন্যই বিধৃত করেছেন যাতে এগুলো থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি, সতর্ক হতে পারি, ঈমানকে বুলন্দ করতে পারি, দৃঢ়চেতা হই ও ধৈর্যকে বাড়াতে পারি। তারা আমাদের আরও দেখিয়েছেন যে, আক্বীদার দিক থেকে, সর্বজ্ঞানী এবং সবজান্তার (আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র) পথে অটল থাকার বিষয়ে এবং এই কাজের ফলাফলের দিক থেকে তাদের দাওয়াহ্’র ধারা সবসময় একইরকম।  এ বিষয়ক আয়াতগুলো এসেছে যাতে দাওয়াহ্’র পথ আলোকিত হয় এবং এ পথে লোকদের বিরোধীতা, কুফর ও ঈমানের মধ্যকার প্রচন্ড বৈরীতা এবং অবিরাম কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাবার বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল থাকি। এসব আমাদেরকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র প্রতি ওয়া’লা বা আনুগত্য এবং বা’রা বা শিরক থেকে মুক্ত থাকবার শিক্ষা দেয় এবং ঈমানের পরীক্ষার পর ঐশী হস্তক্ষেপসহ আরও অনেক ব্যাপারে আমাদের ওয়াকিবহাল করে।

যাই হোক, (সত্যের পথে) দৃঢ়তা প্রদর্শনের বিষয়ে আমাদের পূর্ববর্তী নবীগণদের জীবনচরিত অনুসরণ করা উচিত। বিধানের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রত্যেক নবীকে পৃথক পৃথক ব্যবস্থা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“প্রত্যেকের (নবীগণ) জন্য, আমি শারী’আহ্ ও মিনহায (পদ্ধতি) নির্ধারণ করে দিয়েছি।”
(সূরা আল মায়েদা: ৪৮)

এর কারণ হলো অন্যান্য নবীদের কেবলমাত্র তার লোকদের জন্য এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা) কে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁর বাণীই চূড়ান্ত। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের তাদের নিজস্ব ধর্মকে পরিত্যাগ করে এ ধর্মকে অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“নিশ্চয়ই আল্লাহ্’র নিকট মনোনীত দ্বীন একমাত্র ইসলাম।”
[সূরা আল-ইমরান: ১৯]

এবং তিনি বলেন,

“এবং যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যাতীত অন্য কোন দ্বীনের তালাশ করে কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্থ।”
[সূরা আল-ইমরান: ৮৫]

“আমি আপনার প্রতি (হে মুহাম্মদ) সত্যসহকারে এই কিতাব (কুর’আন) নাযিল করেছি যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী।”
[সূরা মায়িদাহ্: ৪৮]

এছাড়া সাইয়্যিদুনা মুহম্মদ (সা) এর উপর নাযিলকৃত বাণীর প্রকৃতি ভিন্ন ছিল, কেননা তা ছিল চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ। ইসলামী রাষ্ট্র এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে এবং শারী’আহ্ রক্ষা, প্রয়োগ ও প্রসারের জন্য পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে। অন্যান্য নবীদের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে তাদের দাওয়াহ্ অন্যদের বাদ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর অর্থ হলো তাদের দাওয়াহ্ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল ও সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটা ইসলামের মত নয় যার হুকুম সব সময় ও অঞ্চলের জন্য উপযোগী। এই পার্থক্য ইসলাম ও অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্যে সাদৃশ্য অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে অন্তরায়। এটা মুসলিমদের কেবলমাত্র ইসলাম থেকে সমাধান নিতে বাধ্য করে, কারণ এর হুকুমসমূহের সাথে এর প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে সাইয়্যিদুনা ঈসা (আ) এর উদাহরণ দেখা যেতে পারে। তা ছিল সাইয়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যবস্থা হতে আলাদা। কেননা সেটা ছিল কেবল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বাণী সম্বলিত যেখানে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোন আহ্বান অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এছাড়াও এটা ছিল কেবল বণী ইসরাঈলের জন্য সুনির্দিষ্ট। তাহলে কীভাবে শারী’আহ্ হুকুমসমূহ তুলনীয় হবে?

এটা দুঃখজনক যে দ্বীনের সুস্পষ্ট বিষয়সমূহকে নিয়ে আমাদের কথা বলতে হচ্ছে। এতে বোঝা যায় বর্তমানে দাওয়াহ্’র স্তর কতটা অধঃপতিত হয়েছে। আমরা পবিত্র কুর’আনে সাইয়্যিদুনা মুহাম্মদ (সা)-কে যা বলা হয়েছে তা বলতে পারি:

“বলুন: ‘এটাই আমার পথ; আমি পরিপূর্ণ জ্ঞান অনুসারে আল্লাহ্’র দিকে মানুষকে আহ্বান করি, আমি এবং আমার অনুসারীগণ…।”
[সূরা ইউসুফ: ১০৮]

“(মিশরের) রাজার আইন অনুযায়ী সে তাঁর ভাইকে রেখে (দাসত্বে) দিতে পারত না, তবে আল্লাহ্ চাইলে ভিন্ন কথা।”
[সূরা ইউসুফ: ৭৬]

“(ইউসুফ) বললেন: আমাকে দেশের কোষাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান।”
[সূরা ইউসুফ: ৫৫]

“আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলকেই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই এবাদত কর।”
[সূরা আম্বিয়া: ২৫]

“আপনার পূর্ববর্তী অনেক পয়গম্বরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তারা ধৈয্য ধারণ করেছেন। তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছানো পর্যন্ত তারা নির্যাতিত হয়েছেন। আল্লাহ্’র বাণী কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। আপনার কাছে পয়গম্বরদের কিছু কাহিনী এসে পৌঁছেছে।”
[সূরা আল আনআম: ৩৪]

“বস্তুত আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহ্’র নির্দেশানুযায়ী তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়।”
[সূরা আন-নিসা: ৬৪]

“আপনি তাদের কাছে সে জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করুন, যখন সেখানে রাসূলগণ আগমন করেছিলেন।”
[সূরা ইয়াসীন: ৩০]

“কাফেররা পয়গম্বরগণদের বলেছিল: ‘আমরা তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে।’ তখন তাদের কাছে তাদের প্রতিপালক ওহী প্রেরণ করলেন যে, ‘আমি যালিমদের অবশ্যই ধ্বংস করব। তাদের পর তোমাদেরকে ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত করব। এটা ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আমার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে এবং আমার আযাবের ওয়াদাকে ভয় করে।”
[সূরা ইবরাহীম: ১৩-১৪]

“এমনকি যখন পয়গম্বরগণ নৈরাশ্যে পতিত হয়ে যেতেন, এমনকি এরূপ ধারণা করতে শুরু করতেন যে, তাদের অনুমান ভুল হয়েছিল, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছে। অতঃপর আমি যাদের চেয়েছি তারা উদ্ধার পেয়েছে। আর নাফরমান জাতির উপর থেকে আমার আযাব কখনোই রোধ হবে না।”
[সূরা ইউসুফ: ১১০]

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply