যেহেতু সমগ্র পৃথিবীর জন্য ইসলাম একটি দ্বীন হিসেবে এসেছে এবং মুহাম্মাদ (সা) পুরো মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন সেজন্য কিছু মুসলিম প্রস্তাব করে যে ইসলামী আন্দোলনকেও বৈশ্বিক হতে হবে। এছাড়া বাস্তবতা বিবেচনা করলেও দেখা যায় ইসলামী আন্দোলনকে বৈশ্বিক বিভিন্ন আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। উপরন্তু, ইসলামী পরিবর্তন সূচিত করার লক্ষ্যে যে বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন সেজন্যও প্রয়োজন বৈশ্বিক আন্দোলন। যারা এরূপ ধারণা পোষণ করে তারা প্রমাণ হিসেবে কুরআনের এ আয়াতগুলো উদ্ধৃত করে:
“এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্যে এবং রাসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্যে।”
(আল কুরআন ২:১৪৩)
“বলে দিন (হে মুহাম্মাদ): ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহ প্রেরিত রাসূল।”
(আল কুরআন ৭:১৫৮)
“আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানেনা।”
(আল কুরআন ৩৪:২৮)
এজন্যই আমরা দেখি রাসূল (সা) পুরো মানবজাতি, প্রত্যেকটা শক্তি ও দল এবং রাজার নিকট তাঁর দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন। তিনি নাজ্জাশী (আবিসিনিয়ার রাজা), হিরাক্লিয়াস (রোমের সম্রাট), মুকাওকিস (মিশরের সম্রাট) এবং কিসরা (পারস্যের সম্রাট) সবার নিকট পত্র পাঠিয়েছিলেন। এজন্য ইসলামী কর্মকাণ্ডকে কোনো একটি দোকান বা মাঠে বিচ্ছিন্নভাবে রেখে দেয়া যায়না। যার ফলে ইসলামী কর্মকাণ্ড কেবল একটি উপত্যকা থেকে উঠে আসা আর্তচিৎকার বলে মনে না হয়।
প্রকৃতপক্ষে, আক্বীদাহ এবং ব্যবস্থার দিক থেকে ইসলাম একটি বৈশ্বিক দ্বীন।
মূল্যহীন তরল (শুক্রাণু) থেকে সৃষ্ট এবং দুর্বল ও চাহিদাসম্পন্ন মানবজাতি অবশ্যই ফিরে যাবে সেই মহান সত্তার নিকট যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, সমস্ত বিষয়ের পরিচালনাকারী এবং সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাত। আল্লাহই মানুষের সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই পুরো মানবজাতির রব। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের সাথে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য জড়িত, যা হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত। জীবনের পরের ঘটনাসমূহ অর্থাৎ পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম এবং ঈমান ও কুফর, আনুগত্য ও অবাধ্যতার প্রতিদান প্রভৃতি বিষয়ের সাথেও তার অস্তিত্ব জড়িত। আক্বীদাহ’র সত্যতার প্রমাণ অবশ্যই সঞ্চালিত হতে হবে এবং সকলের নিকট তা পৌঁছাতে হবে;
“যাতে যেসব লোক নিহত হওয়ার ছিল তারা (ঈমান প্রত্যাখ্যানের ফলে) নিহত হয় প্রমাণ প্রতিষ্ঠার পর এবং যাদের বাঁচার ছিল তারা বেঁচে থাকে প্রমাণ প্রতিষ্ঠার পরে।”
(আল কুরআন ৮:৪২)
ইসলামী আক্বীদাহ থেকে উৎসারিত যে জীবনব্যবস্থা আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন সেটা বর্ণ, গোত্র বা অবস্থানের ঊর্ধ্বে সমস্ত মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম হচ্ছে একটি বৈশ্বিক জীবনব্যবস্থা। অতএব, ইসলামকে প্রতিষ্ঠার যে বীজ বপন করা হবে তা যেন হয় একটি বৈশ্বিক বীজ— সেজন্য ইসলাম আমাদেরকে বাধ্য করে। ইসলাম দলটিকে বাধ্য করে যাতে সে এই দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। ফলে দলটি নিজেদের কর্মকাণ্ডকে সংকীর্ণরূপে দেখতে পারে না অথবা কোনো একটি দেশে এর কর্মকাণ্ডকে সে সীমিতও করতে পারে না। কোনো গেঁাজামিল দেওয়া অথবা ক্রমান্বয়িক প্রস্তাবনাও সে গ্রহণ করতে পারে না যার ফলে সত্যকে আংশিকভাবে গ্রহণ করবে এবং সত্যের চরম রূপ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে। বরং দলটিকে এটা এভাবে দেখতে হবে যে সে কুফরের নষ্টামি এবং শিরকের বিভ্রান্তি থেকে মানবজাতিকে একক সত্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অতীতে লোকজন মনে করত যে, মূর্তি মানুষের মঙ্গল করে এবং মঙ্গল-অমঙ্গলের বিষয়টি মূর্তির হাতেই নিহিত। বর্তমানে কিছু নির্দিষ্ট চিন্তাকে মানুষ কল্যাণ আনয়নকারী বলে মনে করে এবং অন্য চিন্তাকে ক্ষতিকর বলে মনে করে। এসমস্ত বিষয় বিবেচনায় রেখে দলটিকে প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা গ্রহণ করতে হবে— যার উপর ভিত্তি করে নিজেদের কর্মকাণ্ড এবং চলার পথ তাকে স্থির করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে যদি দলটি ধৈর্যে্যর সাথে এবং কোনোরূপ বিচ্যুতি প্রদর্শন না করে, দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় পথ না চলে, আপোষ না করে এবং নমনীয়তা প্রদর্শন না করে, তাহলে আল্লাহ দলটিকে সেরকমভাবে প্রস্তুত করবেন যা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে এই দায়িত্বকে বৈশ্বিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়। চিন্তার দিক থেকে দলটি বৈশ্বিক, কিন্তু কাজের দিক থেকে বাস্তবিকভাবে চিন্তা করতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে এবং এর বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। অতএব, এই বিশাল দায়িত্বটি খিলাফত রাষ্ট্রের কাজ।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। বর্তমানে মুসলিমরা যেসব ভূখণ্ডে বাস করছে সেগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হয়েছে এবং এসব ভূখণ্ডের মুসলিমরা প্রায় একইরকম পরিবেশে আছে। ফলে কোনো সুসংগঠিত কর্মকাণ্ড যদি এসব ভূখণ্ডে বিস্তার লাভ করতে চায় তাহলে এর পদ্ধতি পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই, যদিও এসব রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। দলটির বিস্তৃতি একে শক্তিশালী করে তুলবে, এর সচেতনাকে বৃদ্ধি করবে এবং একে আরো কার্যকর করে তুলবে। কোনো ভূখণ্ডে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রের বিস্তৃতির জন্যও তা সহায়ক হবে। ফলে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পরের দায়িত্ব বহন করতে দলটির জন্য তা সহায়ক হবে এবং রাষ্ট্রের জন্য বৈশ্বিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ সহজতর হবে। উভয় পরিস্থিতিতেই দলটিকে নির্ভর করতে হবে আল্লাহর সাহায্যের উপরে।