একাধিক দলের বৈধতা

এই বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে একাধিক দলের বৈধতাকে যেসব দলীলের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয় সেগুলোকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এর ফলে অন্যান্য যেসব মত একাধিক দলের উপস্থিতিকে অনুমোদন করে সেগুলোও বৈধ হয়ে যায়নি। কারণ কোনো বিষয় অবৈধ হলেই বিপরীত বিষয়টি বৈধ বলে প্রমাণিত হয়ে যায়না। এর জন্য এমনসব দলীলের প্রয়োজন যেগুলো ইসতিদলাল ও ইসতিনবাদের যথার্থতাকে প্রমাণ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এক্ষেত্রে কী কী দলীল বিদ্যমান? 

অসংখ্য দলীল রয়েছে যেগুলো ফুরু’র (আহকাম) ক্ষেত্রে মতভেদকে অনুমোদন করে, উসূলের (আক্বীদাহ) ক্ষেত্রে নয়। ফুরু সংক্রান্ত মতভেদকে অনুমোদনের ব্যাপারে সুন্নাহ’তে নির্দেশনা আছে। এজন্যই আমরা দেখি সাহাবীদেরকে (রা), তাবিঈন এবং সলফে-সালেহীন (পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল) উলেমাদেরকে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করতে। মতভেদ নিষিদ্ধ হওয়ার দলীলগুলো এসেছে মূলত কাফিরদের মতভেদ সংক্রান্ত বিষয়ে অর্থাৎ দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহে, ফুরু’র ক্ষেত্রে নয়। উদাহরণস্বরূপ, নবীগণ, পুনরুত্থান, জীবন, মৃত্যু এবং পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের ব্যাপারে তাদের মতভেদ ছিল যার ফলে তারা ভিন্ন সম্প্রদায়, দল এবং মিলাল ও নিহালে পরিবর্তিত হলো। তাদের নবীদের নিকট আল্লাহ যে সত্য প্রেরণ করেছিলেন সেগুলো থেকে তারা অনেকদূরে সরে গিয়েছিল এবং নবীদের অনুসারীদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছিল। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেন:

“অতঃপর তাদের মধ্যে দলগুলো পৃথক পৃথক পথ অবলম্বন করল। সুতরাং, মহাদিবস আগমনকালে তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংস।”
(আল কুরআন ১৯:৩৭)

এজন্য কাফিরদের অনুরূপ মতভেদের ব্যাপারে আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।

পরিখার যুদ্ধের দিন সাহাবীদের ভিন্ন ভিন্ন মতকে রাসূল (সা) অনুমোদন করেছিলেন। তিনি (সা) বলেছিলেন:

“যে শুনে এবং আনুগত্য করে, সে যেন বনী কোরাইযা না পৌঁছে আসরের সালাত আদায় না করে।”
[সীরাতে ইবনে হিশাম]

এই হাদিসটি থেকে নিচের বিষয়গুলো প্রতিপাদন করা যায়:

১) মুজতাহিদ ভুল করতে পারেন আবার সঠিক সিদ্ধান্তেও পৌঁছতে পারেন। অর্থাৎ মুজতাহিদ হওয়ার মানে এই না যে সে কোনো ভুল করতে পারবে না।

২) মুজতাহিদ কর্তৃক প্রতিপাদিত হুকুম হচ্ছে একটি শরঈ হুকুম, এমনকি যদি তা ভুলও হয়।

৩) মুজতাহিদ জেনেশুনে কোনো ভুল করেন না, তবে নিজের ভুল সম্পর্কে যদি জানতে পারেন তাহলে ভুলের মধ্যে থাকার কোনো সুযোগও তার নেই। নিজের দৃষ্টিতে তার সিদ্ধান্ত অন্যদের চাইতে শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হওয়াতেই তিনি ঐ মতটি পোষণ করেন।

৪) মুজতাহিদ আল্লাহ কর্তৃক পুরস্কৃত হবেন; তবে ভুল বা সঠিক হওয়ার কারণে পুরস্কার ভিন্ন হবে।

এ ব্যাপারে ইমামগণ একমত যে, ফিকহের কোনো সংশয়যুক্ত বিষয়ের শরঈ হুকুম প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে ভুল হলে মুজতাহিদ গোনাহগার হবেন না।

আল কুরতুবী (র) তাঁর তাফসীরে বলেন; “ঐক্যবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিষয়ের হুকুমের ব্যাপারে সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ ছিল।” আল-বাগদাদী তার ‘আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ গ্রন্থে উমর বিন আব্দুল আযীয এর একটি মন্তব্য বিবৃত করেছেন: “মুহাম্মদ (সা)-এর আসহাব (রা) যদি মতভেদ না করতেন তাহলে আমি সন্তুষ্ট হতে পারতাম না, কারণ সেক্ষেত্রে আমাদের জন্যও (মতভেদ করার) সুযোগ থাকতনা।”

বিখ্যাত অনেক মুসলিম উলেমা তাদের গ্রন্থে মতভেদের কারণসমূহ বিবৃত করেছেন।

তাদের অন্যতম একটি হচ্ছে, কোনোকিছু বুঝার ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষমতা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষে মানুষে ভিন্ন হয়। মানুষের ক্ষমতা ভিন্ন হওয়াতে তাদের সিদ্ধান্তেও ভিন্নতা আসে। এজন্যই সাহাবাদের (রা) যুগ থেকে আমাদের যুগ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ইজতিহাদ এবং ভিন্ন ভিন্ন ইসতিম্বাত চলে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে শরীয়াহ’র প্রকৃতি যার জন্য মানুষ ভিন্নমতে উপনীত হয় এবং এর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর করুণা।

— কিরাআতের (পঠন পদ্ধতি) ভিন্নতার কারণেও সিদ্ধান্তে ভিন্নতা আসে। কোনো মুজতাহিদ যেভাবে পড়েছেন সে আলোকেই তিনি চিন্তা করবেন। এরূপ মতভেদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ওযু সংক্রান্ত একটি আয়াত যার আলোকে প্রশ্ন ওঠেছে পায়ের পাতা কি ধুতে হবে নাকি মুছে ফেললেই হবে?

— কিছু হাদীসের ব্যাপারে উলেমা এবং ফুকাহগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হাদীসকে গ্রহণ বা বর্জন করার যে পদ্ধতি কোনো ইমাম প্রয়োগ করেন তার আলোকে কোনো হাদীস একজনের দৃষ্টিতে সহীহ হলেও তা অন্যজনের দৃষ্টিতে সেরূপ নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মুরসাল হাদীসের বিষয়টি দেখা যেতে পারে। এই উম্মতের ইমামগণের মধ্যে মুহাদ্দিস (হাদিস বিশেষজ্ঞ), উসূলী আলেম (আইনশাস্ত্রের ভিত্তি নিয়ে যারা আলোচনা করেন) এবং ফকীহদের (আইনজ্ঞ) মধ্যে মুরসাল হাদীসকে দলীল হিসেবে ব্যবহার করা নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ একে দলীল হিসেবে ব্যবহার করেছেন আর কেউ কেউ মুনকাতী হাদীস (যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের ধারার মধ্যে কোথাও ফাঁকা আছে) বলে একে ব্যবহার করেননি।

— মতভেদের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে দলীলসমূহের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক বিষয়াদি। উদাহরণস্বরূপ, কিছু দলীলে চিকিৎসাকার্যে নাজাস (অপবিত্র কিছু) এবং হারাম উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যেমন:

“প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ রোগ এবং এর প্রতিকার উভয়ই দিয়েছেন এবং প্রত্যেক রোগের জন্যই তিনি এর প্রতিকার দিয়েছেন। অতএব, হারাম কিছু দিয়ে প্রতিকার করো না।”
[আবু দাউদ কর্তৃক বর্ণিত]

অন্যদিকে কিছু দলীলে আবার নাজাস অথবা হারাম উপকরণ ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যেমন:

“রাসূল (সা) আব্দুর রহমান বিন আওফ এবং আয—যুবাইরকে সিল্ক পরিধানের অনুমতি দিয়েছিলেন কারণ তারা চর্মরোগে ভুগছিলেন।” এছাড়া নিচের হাদীসটি

“মুসলিমগণ ওষুধ হিসেবে উটের মূত্র ব্যবহার করতেন এবং এতে দোষের কিছু আছে বলে মনে করতেন না।”
[বুখারী থেকে বর্ণিত]

— যখন কোনো বিষয়ে স্পষ্ট দলীল থাকে না তখন সে বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার হুকুম বের করার জন্য প্রয়োজন ইজতিহাদের এবং ইজতিহাদ হচ্ছে একটি অনুমানমুলক সিদ্ধান্ত যাতে মতভেদের সুযোগ থাকতে পারে।

— মতভেদের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে অর্থের দিক থেকে আরবি ভাষার ব্যাপকতা। ইশতিরাক (ভিন্নার্থবোধক সমোচ্চারণ শব্দ), হাকীকাহ (আক্ষরিক অর্থ), মাজায (উপমা), মুতলাক (চরম) এবং মুকাইয়্যাদ (সীমিত), আম (সার্বজনীন) এবং খাস (সুনির্দিষ্ট) প্রভৃতি বিষয়ের উপস্থিতিই হচ্ছে এর প্রমাণ। কুরআন নাযিল হওয়ার ভাষা আরবির প্রকৃতিই হচ্ছে এরকম যে এর প্রকাশভঙ্গি এবং বাক্যপ্রকরণ (সিনট্যাক্স) এর কারণে তা বিভিন্ন অর্থ এবং বৈচিত্র্যময় নির্দেশনার জন্ম দেয়।

ফলে তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের ব্যাপারে আল্লাহর এই আয়াত:

“আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন কুরু পর্যন্ত।”
(আল কুরআন ২:২২৮)

এখানে ব্যবহৃত কুরু শব্দটির অর্থ আরবিতে হতে পারে পবিত্র অথবা ঋতুস্রাবকালীন সময়। প্রশ্ন হচ্ছে এখানে কোন অর্থটিকে বোঝানো হয়েছে? এজন্য এই বিষয়টিতে ফুকাহাগণের মতভেদ করার অন্যতম একটি কারণ এটি।

সাধারণভাবে বলতে গেলে এটিই হচ্ছে এ সংক্রান্ত শরঈ আলোচনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে তাদের কোনো একটিও কি আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে? অর্থাৎ শরঈ আহকামের ব্যাপারে মতভেদ করার যে সুযোগ শরীয়াহ অনুমোদন করেছে তার আলোকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য কর্মরত একাধিক আন্দোলন বা দলের বিষয়টি কি অনুমোদিত হয়? নাকি এ বিষয়ের নিজস্ব কিছু সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি বিদ্যমান যেগুলো একে মূল নিয়ম থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে?

মৌলিক নিয়মসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বাদে শরঈ দলীলের অন্য যেসব জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই জ্ঞানকে অন্যান্য বিষয়ের শরঈ জ্ঞানের মতই ভিন্নভাবে বোঝার সুযোগ আছে। যেহেতু দলটি কর্তৃক গ্রহণকৃত শরঈ হুকুম হচ্ছে কিছু প্রতিপাদিত হুকুম সেহেতু সেগুলো ভুল বা সঠিক দুটোই হতে পারে। কোনো মুসলিম যদি দেখে যে একটি দলের চিন্তায় প্রচুর ভুল রয়েছে তাহলে সেই দলের সাথে কাজ করা তার জন্য উচিত হবে না। বরং তখন দলটিকে উপদেশ দিতে হবে এবং এমন একটি দলের খেঁাজ করতে হবে যার সাথে কাজ করার মাধ্যমে সে আল্লাহর নিকট নিজেকে গোনাহমুক্ত রাখতে পারে। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে মানবীয় প্রকৃতি, উলেমাগণের ভিন্নমত এবং শরীয়াহ ও আরবি ভাষার প্রকৃতি থেকে বোঝা যায় যে ভিন্নমতে পৌঁছার বিষয়টি অনুমোদিত। আর এ কারণেই একাধিক দল অস্তিত্বে আসতে পারে। তবে এই বিষয়টি ততক্ষণ পর্যন্ত দোষের কিছু না যতক্ষণ পর্যন্ত তা শুধুমাত্র জ্ঞানের ক্ষেত্রে মতভেদ সংক্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে যে দলটি সত্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী তার সাথে কাজ করা ফরয।

এছাড়া নিচের আয়াতটি:

“আর তোমাদের মধ্য থেকে একটি দল বের হোক যারা মানুষকে খায়র (ইসলাম) এর দিকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজের নিষেধ করবে। আর এরাই হচ্ছে সফলকাম।”
(আল কুরআন ৩:১০৪)

এই আয়াতটি কমপক্ষে এমন একটি দল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিচ্ছে যার কাজ হবে: খায়র (ইসলাম)-এর দিকে ডাকা, সৎকাজের আদেশ করা এবং অসৎকাজের নিষেধ করা। এই আয়াতটি কেবলমাত্র একটি দলের উপস্থিতিকে বুঝাচ্ছে না; যদি তাই হতো তাহলে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলতেন: ‘উম্মাহ ওয়াহিদা (এক উম্মত)’। বরং এখানে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে কাজের ধরন সম্পর্কে যা হচ্ছে দাওয়াত দেওয়া, সৎকাজের আদেশ করা এবং অসৎকাজের নিষেধ করা। এটি ফরযে কিফায়া যা বাস্তবায়নের জন্য কমপক্ষে একটি দলের প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে একাধিক দল সৃষ্টি হলে তাতে দোষের কিছু নেই। এই ধরনের নির্দেশনা শতশত আয়াত ও হাদীসে বিদ্যমান আছে। উদাহরণস্বরূপ নিচের হাদীসটি;

“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনো মুনকার সংঘটিত হতে দেখে তাহলে সে যেন নিজের হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়…” যা কোনো একটি মুনকারকে বুঝাচ্ছে না বরং মুনকারের ধরন সম্পর্কে বুঝাচ্ছে।

Abu al-A’la al-Mawdudi (may Allah have mercy on him) mentioned the following in his book ‘Islamic concepts regarding religion and state’ under the chapter on: The obligation of enjoning the ma’roof and forbidding the munkar; “What is apparant from the partative in the ayah;

‘আর তোমাদের মধ্যে থেকে বের হোক একটি দল যারা মানুষকে খায়র (ইসলাম)-এর দিকে ডাকবে।’ তার অর্থ এই না যে, ইসলামের দিকে ডাকা, সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজের নিষেধ করার ফরয দায়িত্বটি কেবলমাত্র একটি দলের এবং এই দলের বাইরের মুসলিমদের জন্য এই কাজগুলো ফরয না। বরং এর মানে হচ্ছে উম্মাহর মধ্যে কমপক্ষে এমন একটি দল সবসময়ই থাকা ফরয যা হক্ব ও খায়র-এর আলোকবর্তিকাকে রক্ষা করবে এবং অন্যায় ও বিভ্রান্তির অন্ধকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। যদি উম্মাহর মধ্যে এরকম কোনো একটি দলও বিদ্যমান না থাকে তাহলে মানবজাতির জন্য উত্থানকৃত সর্বোত্তম উম্মত আল্লাহর অভিশাপ ও ভয়ঙ্কর শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না।”

পূর্বে আমরা যা বর্ণনা করেছি তার আলোকে বলা যায়:

আমাদেরকে এই বিষয়টি খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে যে শরীয়াহ যা অনুমোদন করেছে তা হচ্ছে আমাদের জন্য অনুগ্রহস্বরূপ। যদি এটি কোনো বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা কেবল মুসলিমদের ভুল বোঝার পরিণতি, অন্য কিছু না। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, দুজন মহান ইমামের উন্নত ফিকহ আমাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। ‘শুযূর আয-যাহাব’ (স্বর্ণখণ্ড)-এ বর্ণিত আছে, ইমাম শাফেঈর ছাত্ররা একদিন তার নিকট এসে অভিযোগ করল তিনি কিভাবে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের সাথে দেখা করেন যেখানে ইমাম হাম্বলের ছাত্ররা তাদের সাথে ভিন্নমতের বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়। এ ব্যাপারে শাফেঈ বলেন:

তারা বলল; ‘আহমাদ আপনার সাথে দেখা করে এবং আপনি তার সাথে দেখা করেন’,

আমি বললাম, ‘তার গৃহে কল্যাণ আছে। যদি তিনি আমার সাথে দেখা করেন তাহলে তাকে ধন্যবাদ আর যদি আমি তার সাথে দেখা করি তাহলে সেটা তারই বদান্যতা। উভয়ক্ষেত্রেই প্রশংসা তার।’

একই ধরনের ঘটনা ইমাম আহমাদ এবং তার ছাত্রদের মধ্যে ঘটেছিল। ইমাম আহমাদ তখন তার ছাত্রদেরকে বললেন;

“যদি আমাদের বংশ ভিন্ন হয় তাহলে যে জ্ঞানটি আমাদেরকে এক করবে তা হচ্ছে আমরা একই পিতা থেকে এসেছি; যদি আমরা ভিন্ন সমুদ্রের পানি হই, তাহলে বুঝতে হবে যে আমরা একই উৎস থেকে নিঃসৃত বিশুদ্ধ পানি।”

— শরীয়াহ’র প্রকৃতি এবং মানবীয় প্রকৃতির বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে যদি কেউ মনে করে যে, সে কোনো কাজের ব্যাপারে সমস্ত মুসলিমকে এক করে ফেলবে তাহলে তাকে আমরা সেই কথাটি বলতে চাই যেই কথাটি ইমাম মালিক হারুনুর রশীদকে বলেছিলেন, যখন হারুনুর রশীদ মালিকের জ্ঞান ও মাযহাবকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, একে লোকজনের উপরে বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছিলেন এবং অন্যদের জ্ঞানকে নিষিদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন; “লোকজনের জন্য সংকীর্ণ করে দিওনা, যখন আল্লাহ তাদেরকে প্রশস্ততা দিয়েছেন।”

— যখন কুফর রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্র দেখতে পায় কোনো এক বা একাধিক দল আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছে এবং পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে ও জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে তখন তারা চায় এসব দলকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে দিতে অথবা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন দল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সঠিক দলগুলোকে ব্যর্থ করে দিতে। যদি আমরা ধরে নিই যে একাধিক দলের বিষয়টি অনুমোদিত নয় তাহলে সঠিক দলটিকে অন্যান্য দলের সাথে এক হয়ে যেতে হবে এবং ফলে ভালো ও খারাপের সংমিশ্রণ ঘটবে। কিন্তু শরীয়াহ’র নির্দেশ হচ্ছে বিপরীত অর্থাৎ আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খারাপকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে এবং উত্তমকে সাথে রাখতে যাতে লোকজন উপকৃত হয়।

— যেহেতু এই প্রস্তাবনাটি (ইসলামী কর্মকাণ্ডসমূহকে এক করে ফেলার বাধ্যবাধকতা এবং একাধিক দলের উপস্থিতিকে নিষিদ্ধ করা) শরীয়াহ, মানবীয় প্রকৃতি এবং যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে তার প্রকৃতিগত বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেহেতু এই প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে থাকলে আমরা এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ খিলাফত প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে সরে থাকব। মুসলিমরা যতক্ষণ এক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ সাহায্য করবেন না, এই মন্তব্য ভিত্তিহীন এবং অগ্রহণযোগ্য। বরং আল্লাহ মুসলিমদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য করেন না যতক্ষণ না তারা শরীয়াহ’র আনুগত্য করছে, আল্লাহর রজ্জুকে অঁাকড়ে ধরছে এবং তাঁর (সুবহানাহু তায়ালার ) নির্দেশগুলো পূরণ করছে। এক্ষেত্রে যদি তারা সংখ্যায় অল্প হয় তবুও তাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করবেন। কারণ সত্যের ব্যাপারে প্রতিশ্রম্নতিশীল একজন লোকই অনেক বেশি বলে গণ্য এবং বিপরীতে ভ্রান্ত পথের অনুসারী অনেক হলেও তারা সমুদ্রের ফেনার মতো বলে বিবেচিত।

এই বিষয়ে একটি কথা না বললেই নয় যে, খলিফা এবং ইসলামী রাষ্ট্র হচ্ছে মুসলিমদেরকে এক করার সবচেয়ে বড় দিক এবং এটি ছাড়া কোনো একত্রীকরণ সম্ভব না। ভিন্ন ভিন্ন সিদ্বান্ত থাকতে পারে কিন্তু আমরা খলিফার আনুগত্য করতে নির্দেশপ্রাপ্ত। ইমাম কোনো হুকুম গ্রহণ করে এবং গ্রহণকৃত হুকুমের সাহায্যে মুসলিমদের মধ্যকার বিবাদ নিষ্পত্তি করে কিন্তু তিনি ভিন্নমতকে প্রতিরোধ বা নিষিদ্ধ করেন না। মুসলিমরা তার নির্দেশ প্রকাশ্যে এবং গোপনে মানতে বাধ্য। কোনো দলের আমীরের নির্দেশ দলের ভিতরের সবাই মানতে বাধ্য এবং তিনি বৃহৎ পরিসরে সমস্ত মুসলিমের সমস্যার সমাধান না করলেও দলের সদস্যদের মধ্যকার বিবাদ নিষ্পত্তি করেন।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply