আজকাল কিছু মুসলিম তরীকার সাথে ধরনকে (উসলুব) গুলিয়ে ফেলে

এ ধরনের সন্দেহ কিছু মুসলিমের মধ্যে সৃষ্টি হবার কারণ হল তারা মনে করে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময় থেকে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্নতর। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময় সমাজের বিভক্তি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের, অর্থাৎ বংশ এবং গোত্র। আজকে এ বিভক্তি আরও জটিল ও পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি রাষ্ট্রের সাথে আগের গোত্র সমূহের তুলনা করা চলে, যার জনসংখ্যা ছিল হাজার হাজার। এখন এ সংখ্যা মিলিয়ন মিলিয়ন। তখন দাওয়াত ছিল লোকদের কুফর থেকে ইসলাম গ্রহণের জন্য। আর আজকে দাওয়াত করা হয় মুসলিমদের ইসলামী জীবনধারা পুণপ্রবর্তনের জন্য। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময় সুপার পাওয়ার পারস্য ও রোমানরা মক্কায় তার দাওয়াতে হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু আজকের দিনে শাসকেরা পশ্চিমাদের আজ্ঞাবহ ও পুতুল মাত্র। এখন সুপার পাওয়ারগুলোই ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে….ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিভ্রান্ত লোকেরা আরও বলে, ‘আমরা কীভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) কে মানবো যখন অনেক বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে গেছে? যদি পরিবর্তিত না হই তাহলে সেটা হবে কঠোরতা ও অনমনীয়তা। আমরা এভাবে কিছু গ্রহণ করতে বাধ্য নই। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল দাওয়াতের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে লক্ষ্য রাখা, অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং আল্লাহর দাসত্ব বা উবুদিয়্যাহ উপলদ্ধি করা।’

এই ইস্যুটিকে কীভাবে দেখতে হবে তা ব্যাখ্যা করতে হবে, এভাবে শরীয় হুকুম নাজিল হয়েছিল বিভিন্ন বাস্তবতায় পরিপ্রেক্ষিতে। যখন বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে গেছে তখন এর সাথে বিজড়িত হুকুম পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যদি বাস্তবতা পরিবর্তিত না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে শরীয় হুকুম অপরিবর্তিত থাকবে। বাস্তবতার ক্ষেত্রে এর বাহ্যিক দিকে খেয়াল না রেখে এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।   

সমাজ হল কিছু লোকের সমষ্টি যাদের রয়েছে সাধারণ ধারণা, এ সাধারণ ধারণা হতে কিছু আবেগ ও এর সাথে একমত সবকিছুকে সমর্থন করার বিষয় উৎসারিত হয়, এবং এ সাধারণ ধারণা হতে কিছু ক্ষোভের বিষয় উৎসারিত হয় যখন কোন কিছু এর বিরুদ্ধে যায়। অতপর একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় যা এই চিন্তা বা ধারণাকে বাস্তবায়ন করে এবং এর কোনরকম ব্যাত্যয়কে প্রতিহত করে। সুতরাং লোকেরা এমনভাবে জীবনযাপন করে যে তারা পুরো বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে এবং এ ব্যাপারে তারা সন্তুষ্ট।    

সমাজের বাস্তবতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। এটা হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ের বা জটিল। কিন্তু প্রত্যেক জনসমষ্টিই একটি সাধারণ চিন্তা ও আবেগের ভিত্তিতে একত্রিত হয় এবং শাসিত হয় এমন একটি ব্যবস্থা দ্বারা যা ঐ চিন্তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। হতে পারে এ জনসমষ্টি একটি রাষ্ট্র বা গোত্র এবং সংখ্যায় হাজার হাজার বা মিলিয়ন মিলিয়ন। রাষ্ট্র বা গোত্র নির্বিশেষে এটি একটি সমাজ। কারণ উভয়ক্ষেত্রেই সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি রয়েছে এবং এটি পরিবর্তিত হয়নি। 

রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামি চিন্তা, আবেগ ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন। ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি শরীয় পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। তার সমস্ত কর্মকান্ড সেদিকেই লক্ষ্য করে ঠিক করা হয়েছিল। মদীনাতে তিনি প্রত্যেকটি বিশ্বাসী ব্যক্তিকে গড়ে তুলেছিলেন। তাদের মনের ভেতরে তিনি ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যা একটি সুষম আবেগের সৃষ্টি করেছিল। তিনি সেখানে হিজরত করলেন ও ইসলামি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলেন এবং এভাবে ইসলামি সমাজ কায়েম হল। শুরুতে এটি সহজ অবয়বে ছিল এবং তারপর একটি সমাজে রূপান্তরিত হয় যা পরিচালনার জন্য একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। 

এখন ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুপার পাওয়ারগুলো যেভাবে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে আগে সেভাবে হস্তক্ষেপ করেনি, এর জবাবে আমরা বলতে চাই, একারণে পদ্ধতির কোন পরিবর্তন হতে পারে না। তবে এটা পদ্ধতির অনুসরণকে আরও কঠিনতর করে ফেলেছে। এর জন্য প্রয়োজন বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় এনে অতিরিক্ত বিকাশ প্রক্রিয়া ও নিবিড় দাওয়াত চালু রাখা। একারণে দলটি এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং তাদেরকে মোকাবেলা করবার জন্য সুপার-পাওয়ারগুলোর পরিকল্পনা ও পুতুল শাসকগুলোর মাধ্যমে যে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চায় তা বুঝতে হবে।   

রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কাতে কেবলমাত্র ঈমান ও সামান্য কিছু শরীয় আহকাম ব্যাপারে আহ্বান করেছিলেন এ দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই, সামান্য কিছু হলেও তিনি শরীয় আহকাম ব্যাপারে আহ্বান করেছিলেন। এছাড়াও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মক্কায় দাওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম গ্রহণের জন্য লোকদের আহ্বান। কিন্তু আজকে মুসলিমদের দাওয়াত দেয়া হচ্ছে যাদের রয়েছে ইসলামি আক্বীদা এবং নাজিলকৃত সব শরীয় হুকুম। সেকারণে মুসলিমগন আজ আল্লাহর কাছে কেবলমাত্র ঈমান নয় পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সুতরাং মক্কার একজন মুসলিম তার মৃত্যুর আগে সে পর্যন্ত নাজিল হওয়া হুকুমের জন্য দায়িত্বশীল। আজকে যে মুসলিম মারা যাচ্ছে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে পুরো ইসলামের ব্যাপারে জবাবদিহীতার সম্মুখীন হবে। সে কারণে আজকের আহ্বান হতে হবে পূর্ণাঙ্গ এবং ইসলামি জীবনধারা পূণরায় শুরু করবার জন্য, কেবলমাত্র ঈমানের দাওয়াত নয়। কারণ এটা কোন নতুন দ্বীনের আহ্বান নয়।      

এছাড়া মুসলিম উম্মাহর দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, আক্বীদা থেকে বিচ্যুত হওয়া এখন মুসলিম উম্মাহর সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হল এই আক্বীদার সাথে জীবনের চিন্তা ও আইনী ব্যবস্থার সম্পর্ক উপলদ্ধি করতে না পারা। এভাবে আক্বিদা তার প্রাণশক্তি হারিয়ে বসেছে। এসবই সম্ভব হয়েছে মুসলিমদের উপর পশ্চিমা চিন্তার প্রভাব বিস্তার করবার কারণে। পশ্চিমা কাফের রাষ্ট্রগুলো নতজানু শাসকদের ক্ষমতায় বসানো, শিক্ষা ব্যবস্থা ও মিডিয়ায় প্রচারণার মাধ্যমে এসব চিন্তার বিস্তার ঘটায়, সংরক্ষণ করে এবং এগুলো বলবৎ ও এর প্রতি আকর্ষণ বজায় রাখবার জন্য কাজ করে। 

সুতরাং আমাদের দাওয়াতে ইসলামকে সঠিকভাবে, পূর্ণাঙ্গরূপে ও সমন্বিতভাবে উপস্থাপন করতে হবে যার আক্বীদা ও ঈমান মৌলিক চিন্তা হিসেব আবিভূর্ত হবে, যা হতে হুকুম উৎসারিত হয় ও যার উপর ভিত্তি করে জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারিত হয়। তারপর আক্বীদার মাধ্যমে জীবনের চিন্তাসমূহকে ব্যাখ্যা করতে হবে। এটা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা আহ্বান করব আল্লাহসুবহানহুতায়ালাই একমাত্র স্রষ্টা ও আল মুদাব্বির (সব বিষয়ের পালনকর্তা), বিচার দিবসের মালিক এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সব বিষয়ের জন্য তার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এভাবে যখন ঈমান ও হুকুম সমুহ মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য তা ব্যাখ্যা করা হয় তখন সত্যের ক্ষমতা ও এর প্রাণশক্তি তাদের কাছে পরিস্ফুট হয়ে উঠে, এবং ইসলাম বুঝা ও এর আহ্বান করার কাজে দাওয়াতকারী দলের শক্তিমত্তা এবং দলের পরিবর্তনের সক্ষমতা সবার কাছে পরিস্ফুট হয়ে উঠে।        

সেকারণে আজকে দাওয়াত হল ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলিমদের ইসলামি জীবনধারায় ফিরে আসার জন্য আহ্বান করা। এ দাওয়াতের ভিত্তি হবে ইসলামি আক্বীদা, এবং এর রাজনৈতিক চিন্তার উপস্থাপন করতে হবে যাতে মুসলিমরা আল্লাহর নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী এটিকে জীবনের সব কাজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে গ্রহণ করে।     

সুতরাং যা পরিবর্তিত হয়েছে তা হল বাহ্যিক রূপ। মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সুতরাং ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়নের হুকুম এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজের পদ্ধতির হুকুম মোটেও পরিবর্তিত হয়নি। 

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply