যারা ত্বারিকা (পদ্ধতি) কে উপেক্ষা করে

যে জন্য আমরা ইসলামকে ফিকরা (চিন্তা) এবং ত্বারিকা (পদ্ধতি) এ দুয়ের সমষ্টি হিসেবে দেখাতে বাধ্য হচ্ছি তা হলো এই যে, এভাবে না দেখার কারণে মুসলিমরা অনেক শরীয়া বিধান বর্জন করছে এই বলে যে আমরা এগুলো অনুসরনে বাধ্য নই। তারা এই অজুহাতও দেখায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) অমুক কাজটি অমুক অবস্থা ও পরিস্থিতির কারণে সেসময় করেছিলেন। তাই, যদি সেগুলো আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে আমরা সেগুলো এখন গ্রহণ করব, অন্যথায় পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য কোন আইন গ্রহণ করব। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনেকে ইসলামের পেনাল কোড পরিবর্তনের জন্য আহ্বান করে কেননা তারা মনে করে এগুলো বর্তমান সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারা চাবুক মারা, পাথর মারা অথবা হাত কাটা এখন আর গ্রহণযোগ্য মনে করে না যেহেতু তাদের মতে এগুলো অনেক নিষ্ঠুর নিয়মকানুন ও পশ্চিমারা এসবকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা মনে করে কেননা এসব তাদের মনে করিয়ে দেয় তাদের ধর্মের কথা যেখানে মধ্যযুগে কঠিন ও নিষ্ঠুর সব নিয়মকানুনের মাধ্যমে মানুষের উপর জুলুম করা হত, সুতরাং এইসব আইন কানুনের কথা বললে মানুষ ইসলাম থেকেও দূরে সরে যাবে। তাই, এইসব আইন কানুনকে জেল ও জরিমানা দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে কোন অসুবিধা নেই। একইভাবে আমরা দেখতে পাই কেউ কেউ জিহাদের অবলুপ্তির কথা বলে। ইসলাম প্রসারের জন্য যে জিহাদ এসেছিল তা বর্তমানে বিজ্ঞাপন ও প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। বর্তমান সময় হল সংস্কৃতি বিনিময়ের। যেহেতু ইসলামে রয়েছে প্রামাণ্য দলিলাদি ও পরিষ্কার সত্য, সেহেতু কলম, টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে শক্তিপ্রয়োগের চেয়ে বেশী সুফল পাওয়া যাবে। আর শক্তি প্রয়োগ করা হলে হৃদয়সমূহ রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং ঘৃণা ও অসৎ প্রবৃত্তি জাগ্রত হবে। কেউ কেউ জিজিয়াকে বিড়ম্বনাকর ও দ্রোহাত্নক বলে একে পরিত্যাগ করবার পক্ষে মতামত প্রদান করে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ইসলামি আইনে খিলাফত ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক নয়। তারা এমন ফতওয়া প্রদান করেছে যা ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটিয়ে আধুনিক শাসনপ্রথা গ্রহণের যৌক্তিকতাকে দৃঢ় করেছে। তাদের মতে ইসলামি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা জরুরী , কিন্তু যে কাঠামো তা বাস্তবায়ন করে তা নয়, কেননা এই কাঠামো অনেক ধরনের হতে পারে।

এভাবে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির ব্যাপারে অনেক প্রস্তাবনা এসেছে, যেমন: ইসলামী বই লেখা, মসজিদ নির্মাণ করা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা, মিশনারী স্কুলের আদলে ইসলামি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, লোকদের নৈতিকতার দিকে আহ্বান করা, সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করা বা গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা ইত্যাদি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) এর ক্ষমতা গ্রহণের পদ্ধতি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে।    

এভাবে মুসলিমগন আজকে ফিকরাহর সাথে সম্পৃক্ত শরঈ নীতিমালা অস্পষ্ট ও দ্বান্দিক উপায়ে গ্রহণ করছে। সেকারণে তারা ত্বারীকার সাথে যুক্ত শরীয়া নিয়মকানুনকে অবজ্ঞা করছে। এসবই ঘটেছে একারণে যে, তারা পশ্চিম ধ্যানধারণার শিকার হয়ে ইসলামকে পরিষ্কার ও আইনগতভাবে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে ইসলামের প্রয়োগকে বুঝতে অসমর্থ হয়েছে।

একারণে ফিকরাহ (চিন্তা) ও ত্বারীকা (পদ্ধতি) এর আলোচনা উঠে আসে যাতে করে মুসলিমগন গুরুত্বপূর্ণ শরীয়া নীতিমালাকে অবহেলা না করে যেগুলো পূর্ণাঙ্গ ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও আমাদের বাস্তব জীবনে বাস্তবায়নের জন্য এসেছে। এইসব হুকুমকে অবজ্ঞা করার অর্থ হল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশকে পরিত্যাগ করা যা একটি অপরাধ এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে এর জন্য আমাদের জবাবদিহী করতে হবে।

সেকারণে আমরা এই শ্রেনীবিন্যাসের মধ্যে এসেছি যে, ‘ইসলাম হল ফিকরাহ (চিন্তা) ও ত্বারীকা (পদ্ধতি) এর সমন্বিত রূপ।’ এর মাধ্যমে ইসলাম আরও স্পষ্ট হয়, বুঝতে সহজ ও প্রয়োগ সরলতর হয়। পূর্বে মুসলিমগন এ ধরনের শ্রেণীবিন্যাস করেছিল, যেমন: ইসলাম হল আক্বীদা ও ব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মাতু’মাত (খাদ্যদ্রব্য) এর নিয়ম, মালবুসাত (পরিচ্ছদ), আখলাক (নৈতিকতা) ও ইবাদত (উপাসনা)। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময় এগুলো একসাথে সুবিন্যস্ত ছিলনা। তারপর ফকীহগন এগুলো সংগ্রহ ও সুবিন্যস্ত করেছেন এবং বইয়ের অধ্যায়ে স্থান দিয়েছেন যাতে করে মুসলিমরা খুব সহজে এগুলো অনুধাবন ও প্রয়োগ করতে পারে ইত্যাদি।

এই আলোচনার অবতারণা একারণে করা হচ্ছে যাতে মুসলিমগন সুনির্দিষ্ট শরীয়া নিয়ম এমনভাবে গ্রহণ না করে যে প্রয়োজনে সেগুলো পরিবর্তিত, ও বিকৃত করে ফেলে এবং সবশেষে অবহেলা ও পরিত্যাগ করে।

শরীয়া শাস্তিকে আধুনিক শাস্তি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা অনুমোদিত নয়, একইভাবে খিলাফতকে রিপাবলিকান পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যাবে না। পশ্চিমা সিভিল আইন ইসলামি আইনের বদলে গ্রহণ করা যাবে না অথবা রাসূলুল্লাহ (সা) এর ক্ষমতা গ্রহণের পদ্ধতির বদলে নিজস্ব আকল বা নিয়মকানুন মানা যাবে না যদিও এ ব্যাপারে অনেক ফতওয়া দেয়া হয়েছে।

সুতরাং, যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা একটি শরীয়া হুকুম, সেহেতু এটি প্রতিষ্ঠা করবার পদ্ধতিও একইভাবে শরীয়া হুকুম। এর অর্থ হল পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট শরীয়ার অন্যান্য নিয়মকানুনের মত এ ব্যাপারে বিস্তারিত দলিলাদি রয়েছে এবং গ্রহণ করবার জন্য এবং তা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

কেউ যদি ফিকাহশাস্ত্রের বইগুলোর দিকে তাকায় তাহলে দেখতে পাবে যে, মুসলিম ফকীহগন সুনির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে উকুবাত (শাস্তি), জিহাদ, ইমারাত বা রাষ্ট্র এবং অন্যান্য পদ্ধতিগত হুকুম আলোচনা করেছেন। প্রয়োজন হয়নি বিধায় কেবলমাত্র ইসলামি রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পদ্ধতি সেখানে আলোচিত হয়নি। এর কারণ হল কালপরিক্রমায় মুসলিমগন এমন কোন পরিস্থিতিতে উপনীত হয়নি যখন একদিনের জন্যও ইসলামি রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু আজকে মুসলিমদের এটি প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি বের করা ও তা গ্রহণ করবার জন্য সব প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করা উচিত। পরিস্থিতি বিবেচনা করে খেয়ালখুশী বা প্রবৃত্তির ভিত্তিতে নয় বরং এটা হওয়া উচিত শরীয় দলিলাদির ভিত্তিতে।

শরীয়া অনুসারে যখন পদ্ধতি আইনসম্মত হয়ে যাবে তখন আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সা) এর আদর্শ সেখানে প্রতিফলিত হবে। যখন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে তখন জবাবদিহীতা ও পরামর্শ প্রদানের সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ আমীরসহ দলের যে কোন সদস্যকে তখন জবাবদিহী ও উপদেশ প্রদান করা যাবে। বিষয়সমূহ মানুষের মন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক অথবা জীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ করা যাবে না। কর্মপদ্ধতি কখনওই পরীক্ষামূলক বিষয় হওয়া উচিত নয়, বরং এ ব্যাপারে শুধুমাত্র শরীয়ার দ্বারস্থ হওয়া উচিত।

যে ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে সে স্বভাবতই এটা করবার শরীয়া পদ্ধতি ও বিস্তারিত দলিল সম্পর্কে জানতে চাইবে। সে এ ব্যাপারে আলোচনা করবে ও লোকদের সেদিকে আহ্বান করবে। এখন জানা দরকার কী সেই শরীয়া কর্মপদ্ধতি যা একজনকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রহণ করতে হবে? শরীয়া কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাবার আগে একজন মুসলিমকে অবশ্যই আজকে মুসলিমগন কী ধরনের বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করছে তা সুনির্দিষ্ট ও গভীরতার সাথে উপলদ্ধি করতে হবে যাতে করে মৌলিক কার্যকারণ বুঝা যায়। এতে করে মৌলিক কার্যকারণের সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় সমাধান করা যাবে। সেকারণে এই সমাধান হবে মৌলিক। যখন বাস্তবতা অনুধাবনে আসবে ও মৌলিক কার্যকারণ বুঝা যাবে তখন শরীয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা সহজতর হবে। এর পরই দলটি তার শরীয়া কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হবে যা তাকে মেনে চলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সুন্নাহকে অনুসরণ করতে হলে তার জীবনকালের কোন সময় বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বা নিকটবর্তী তা বিবেচনায় আনতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply