প্রশ্ন: এমন অনেকেই আছে যারা বলে, হিযব তার খিলাফত প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিতে মাদানী যুগকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র মক্কী যুগকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র সংগ্রাম বা জিহাদকে শরীয়া’হ-র সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে যার কারণ হিসেবে তুলে আনা হয় রাসূল (সা) তা করেননি। প্রশ্নকর্তা আরও বলেন: কেন হচ্ছে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির জন্য মাদানী যুগকে নেয়া হইনি যেখানে জিহাদ করা জায়েজ এবং ফরজ ছিল? এর কি কোন সুস্পষ্ট উত্তর আছে? ওয়া জাযাকাল্লাহু খাইরান।
উত্তর:
প্রশ্নে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ:
১. যেকোন যথার্থ দলীল আমাদেরকে অবশ্যই মান্য করতে হবে যদি তা কুরআন বা সুন্নাহ থেকে উঠে আসে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে লক্ষ্য রাখা উচিত নয় তা কি মক্কী যুগের নাকি মাদানী যুগের।
২. দলীল খোঁজার ক্ষেত্রে আমাদের সেইসব দলীলই খোঁজা উচিত যা ঐ মাসআলা বা ইস্যুর সাথে জড়িত, সেসব দলীল আমাদের দরকার নাই যা ঐ মাসআলা বা ইস্যুর সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়-
ক. উদাহরণস্বরূপ: আমি যদি ওযু কিভাবে করতে হয় তা জানতে চাই, তবে আমি সেসব দলীল অন্বেষন করব যা ওযুর সাথে সম্পর্কিত, সেটি মক্কায় অবতীর্ণ হোক কিংবা মদীনায় অবতীর্ণ হোক। এরপর সেসব দলীল থেকে প্রতিষ্ঠিত শরীয়া’হ পদ্ধতি অনুসরণ করে আমি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব… কিন্তু আমি রোজার সাথে জড়িত দলীল থেকে ওযুর হুকুম ও প্রণালী বের করতে গবেষনা করব না।
খ. আবার যেমন: আমি যদি হজ্জ্ব কিভাবে করতে হয় তা জানতে চাই, তবে আমি সেসব দলীল খুজব যা হজ্জ্বের সাথে সম্পর্কিত, সেটি মক্কায় অবতীর্ণ হোক আর মদীনায় অবতীর্ণ হোক। এরপর সেসব দলীল থেকে প্রতিষ্ঠিত শর’ঈ পদ্ধতি অনুসরণ করে আহকাম বের করে আনা হবে… কিন্তু আমি সালাতের সাথে জড়িত দলীল থেকে হজ্জ্বের প্রস্তুতি ও নিয়মাবলী বের করতে চেষ্টা করব না।
গ. আরও উল্লেখ করা যায়, আমি যদি জিহাদের বিষয়ে জানতে চাই, সেটি ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক ফরযিয়াত হিসেবে হোক কিংবা আক্রমনাত্নক বা রক্ষনাত্নক হোক কিংবা বিজয়ের জন্য বা ইসলাম প্রচারের জন্য হোক, বিজয়টি বলপ্রয়োগ বা আপোসরফার মাধ্যমে হোক…আমি সেসব দলীল খুজব যা জিহাদের সাথে সম্পর্কিত, এক্ষেত্রে মক্কী যুগের বা মাদানী যুগের দলীল বলে পার্থক্য করা আমার জন্য সমীচিন নয়। এরপর সেসব দলীল থেকে প্রতিষ্ঠিত শর’ঈ পদ্ধতি অনুসরণ করে আইনসমূহ বের করে আনা হবে… কিন্তু আমি কখনোই যাকাতের দলীল ব্যবহার করে জিহাদের হুকুম ও এর বিস্তারিত বের করে আনার গবেষনা করব না।
ঘ. এটিই হলো সকল মাসআলা বা ইস্যুর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নীতি, অর্থাৎ দলীল গবেষনা করা, হোক তা মাক্কী কিংবা মাদানী এবং সেই দলীল হতে প্রতিষ্ঠিত শর’ঈ পদ্ধতি অনুসরণ করে শরীআহ’র আইন বের করা আনা।
৩. এখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আলোচনায় আসা যাক এবং সে সম্পর্কিত দলীল খোঁজার চেষ্টা করি, তা সেটি মক্কায় কিংবা মদীনায় অবতীর্ণ হোক এবং সেই দলীল থেকে উৎসারিত হুকুম বের করি যা প্রতিষ্ঠিত শর’ঈ পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হয়েছে।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে সব দলীল আমরা পাই তা পবিত্র মক্কা নগরীতে আল্লাহর রাসূলের জীবনকাল ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তিনি প্রথমে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দেন, তারপর বিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা একটি দল গঠন করেন, এরপর তিনি মক্কা ও এর আশেপাশে ইসলামকে প্রকাশ্যে ঘোষনা করেন…এরপর ক্ষমতাধর, সামর্থ্যবান ব্যাক্তিবর্গের কাছ থেকে সাহায্য (নুসরাহ) খোঁজার প্রায়াস চালান। পরিশেষে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তার উপর মদীনা আনসার বাহিনীর মাধ্যমে তার উপর রহম করেন, তাই তিনি তাদের দিকে হিজরত করেন এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এটিই দলীল এবং এর বাইরে আর কোন দলীল নেই। রাসূল (সা) তার জীবনকালে এটি আমাদের পরিষ্কার দলীলের মাধ্যমে দেখিয়েছেন এবং তা আমাদের আঁকড়ে ধরতে হবে। তাই ইস্যুটি জিহাদের হুকুম আসার আগে মক্কী যুগের কিংবা জিহাদকে ফরজ করার পর মাদানী যুগের সাথে সম্পর্কিত নয় বরং এটি রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত দলীলাদির অনুসন্ধান-গবেষনার ফল যা শুধুমাত্র মক্কায় পাওয়া যায় যতক্ষন না রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করেন এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এ বিষয়টি ও জিহাদ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আগেই উল্লেখ করেছি, খিলাফত প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির দলীল তার সাথে সম্পর্কিত দলীলাদি থেকে এবং জিহাদের দলীল তার সাথে সম্পর্কিত দলীলাদি থেকে নিতে হবে। তারা একে অপর থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন। তাই খিলাফতের অনুপস্থিতিতে জিহাদ থেমে থাকবে না কারণ রাসূল (সা) বলেছেন-
«وَالْجِهَادُ مَاضٍ مُنْذُ بَعَثَنِي اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى أَنْ يُقَاتِلَ آخِرُ أُمَّتِي الدَّجَّالَ، لَا يُبْطِلُهُ جَوْرُ جَائِرٍ وَلَا عَدْلُ عَادِلٍ»
“আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল কর্তৃক আমার প্রেরণ হওয়া হতে যতক্ষন পর্যন্ত না আমার উম্মতের শেষ অংশ দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে, ততক্ষন পর্যন্ত জিহাদ চলতে থাকবে, জালেমের জলুম কিংবা ন্যায়পরায়নের ন্যায়বিচার তা কখনোও বন্ধ করতে পারবে না”। (বায়হাকি তার সুনান আল-কুবরা’য়, আনাস বিন মালিক থেকে বর্ণিত)।
সুতরাং, শরীয়া’হর গন্ডির মধ্যে জিহাদ চলতে থাকবে যদিওবা খিলাফত প্রতিষ্ঠা হোক বা না হোক।
এবং শাসকগোষ্ঠী জিহাদ করা ছেড়ে দিয়েছে তাই আমরা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ছেড়ে দেব তাও নয়। যতক্ষন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না ততক্ষন খিলাফত এর কাজ চলতে থাকবে কেননা কাধে খলীফার বা’য়াত বিহীন অবস্থায় মুসলিমদের থাকা হারাম যারা (এর জন্য কাজ করতে) সক্ষম। মুসলিম আবদুল্লাহ বিন উমর হতে বর্ণনা করেন, আমি শুনেছি রাসূল (সা) বলেন,
«مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ، لَقِيَ اللهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا حُجَّةَ لَهُ، وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ، مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً»
“যে আনুগত্য থেকে হাত তুলে নিল তাকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে দেখা করবে এমন অবস্থায় যে তার স্বপক্ষে কোন দলীল নেই এবং যে এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল যখন তার কাধে বা’য়াত নেই, সে এক জাহেলী মরন মরল”।
তাই জিহাদও চলবে এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজ ততক্ষন পর্যন্ত চলবে যতক্ষন না তা প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি আর একটির উপর নির্ভরশীল নয়, তারা দুটি ভিন্ন বিষয়। প্রত্যেক ইস্যুর জন্যই তার শরীয়াহ দলীল অন্বেষন করা হয় এবং সেসব দলীল হতে প্রতিষ্ঠিত শর’ঈ পদ্ধতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য হুকুম বের করে আনা হয়।
৪. তাই হিযব সেই পদ্ধতির প্রতি অনুগত যা রাসূল (সা) মক্কায় দেখিয়ে গিয়েছেন মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার আগ পর্যন্ত, খিলাফত প্রতিষ্ঠায় কোন সশস্ত্র সংগ্রাম না করার সাথে মক্কী যুগের কিংবা মাদানী যুগের কোন সম্পর্ক নেই। বরং নবী (সা) মক্কায় যে পদ্ধতি দেখিয়ে গিয়েছেন মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত – এ ছাড়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আর কোন দলীল নেই। সুতরাং ইস্যুটা হচ্ছে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি, এবং তিনি (সা) মক্কায় যে পদ্ধতি দেখিয়ে গিয়েছেন তা ছাড়া আর কোনো পদ্ধতি নেই।
যদি ইস্যুটা হতো ইসলামী রাষ্ট্রের কাজ কিংবা তার কাঠামোসমূহের তখন আমরা মদীনায় রাসূল (সা) যা দেখিয়ে দিয়েছেন তা দলীল হিসেবে নিতাম কারণ রাষ্ট্র সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল।
৫. পরিশেষে:
ক. একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নির্দিষ্ট দলীল বা প্রমান দরকার সেটি মক্কা বা মদীনায় অবতীর্ণ হোক না কেন। যেমন- রোজার জন্য রোজা সম্পর্কিত দলীল, সালাতের জন্য সালাত সম্পর্কিত দলীল, অনুরূপভাবে জিহাদের জন্য জিহাদ সম্পর্কিত দলীল এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত দলীল অনুসন্ধান করা ইত্যাদি।
খ. নবী (সা) মক্কায় থাকাকালীন পদ্ধতির প্রতি অনুগত থাকার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র মক্কা শহরে যা দেখানো হয়েছে তাছাড়া এর জন্য আর কোন দলীল পাওয়া যায় না। যদি মদিনায় সেরূপ দলীল থাকতো তবে তাও গবেষনার বিষয় হিসেবে আমলে নেয়া হত।
আমরা আল্লাহ সর্বশক্তিমানের সাহায্য ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাফল্য জন্য কামনা করি, একটি খিলাফতে রাশেদার কামনা করি যা ইসলাম ও মুসলিমদের সম্মান পুনর্বহাল করবে, কাফের ও কুফ্ফারকে অপদস্থ করবে যাতে করে বিশ্বে কল্যাণ ব্যপ্তি লাভ করে এবং এটি আল্লাহ-র কাছে অতীব প্রিয়।
১৭ই জুল-কাদা, ১৪৩৪ হিজরী
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩