সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের ক্রমবর্ধমান হুমকি অপশক্তির পদধ্বনি

ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাকে নস্যাৎ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ দালাল বাশারের বিকল্প তৈরি করাই এর লক্ষ্য

আসাদ সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধীতার অজুহাতে আমেরিকা এবং তার মিত্রদের কর্তৃক সামরিক অভিযানের প্রচারণা সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অভিযানকে তারা “মানবতা ও নৈতিকতা রক্ষার” আবরণে ঢেকে রেখেছে অথচ তারা এসবের তোয়াক্কা করেনা। বাগ্রাম, গুয়ানতানামো এবং আবু গারিব কারাগারগুলোতে…আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ সকল কাফের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো যুগ যুগ ধরে মানবিক এবং নৈতিক মূল্যবোধকে পদদলিত করেছে…আর গুপ্তচরবৃত্তির কথা না হয় বাদই দিলাম! পারমাণবিক এবং জীবাণু অস্ত্রের অপব্যবহার, ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র এবং পৈশাচিক হত্যাকান্ডের প্রতিযোগীতায় তাদের কুখ্যাতি রয়েছে যার নিদর্শন হিরোশিমা-নাগাসাকি থেকে শুরু করে ইরাক এবং আফগানিস্তান, ককেশাস, মালি এবং চেচনিয়াসহ পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই ছড়িয়ে আছে।

শিশু, নারী এবং বয়োবৃদ্ধদেরকে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে হত্যা করতে এই দেশগুলো বিশেষতঃ আমেরিকাই বাশারকে সবচেয়ে সবুজতম সংকেতটি প্রদান করেছিল। এই সংকেত না পেলে যালিম বাশারের আল-গওতায় তা প্রয়োগের কোনো সাহস ছিলনা। আল-গওতার পূর্বেও সে সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং এমনকি আল-গওতার পরেও, যেমন সরকার কর্তৃক সিরিয়ার বিভিন্নস্থানে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগের খবর আজও প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকা এবং তার সহযোগীদের জ্ঞাতসারে ও অনুমোদনে এসব সংঘটিত হয়েছে।

সুতরাং মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধের আবরণে ঢাকা এই সেনা অভিযান অত্যন্ত দুর্বল ও সুস্পষ্ট একটি মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে আছে। বিবেকবান, দৃষ্টিসম্পন্ন এবং সুস্থ চিত্তের প্রতিটি মানুষের পক্ষে তা সহজে বোঝা সম্ভব।

সাম্রাজ্যবাদী কাফেরদের মোড়ল আমেরিকা কর্তৃক ঘোষিত এই সেনাঅভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে চাপ সৃষ্টি করে সিরিয়ার সার্বিক পরিস্থিতির উপর আয়ত্ত প্রতিষ্ঠা করে মেয়াদোত্তীর্ণ দালাল বাশারের বিকল্প দালাল তৈরি করা। কারণ বাশার ও তার তল্পীবাহকদের বিকল্প হিসেবে সৃষ্ট ন্যাশনাল কাউন্সিল এবং কোয়ালিশনকে তারা সিরিয়ার জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য করতে পারেনি। তাদের ভয় সিরিয়ার জনগণ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে কাফের ও মুনাফিকদের মূলোৎপাটন করবে। আর তাই আমেরিকা ও তার মিত্ররা কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় সামরিক হামলা চালিয়ে এই সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে চায়, তারপর সরকার ও কোয়ালিশনের মধ্যে সমঝোতাকে গতিশীল করে কম মন্দ চেহারার বাশারের অনুরূপ কোনো দালালকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে চায়!

হে মুসলিমগণ, হে সিরিয়াবাসী, হে আশ-শামের অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সততা ও নিষ্ঠার সাথে সংগ্রামরত জনগণ:

যেকোনো মূল্যে এই সামরিক অভিযান ও ধ্বংসযজ্ঞকে প্রতিহত করতে হবে। আপনাদের হাতে বাশারের পরাজয় প্রায় চূড়ান্ত! দ্বীন, জনগণ, জনগণের সম্মান ও সম্পদের রক্ষাকবজ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় আপনারা সফলতার দ্বারগোড়ায় পৌঁছে গেছেন। ইসলামী শাসনের আদি আবাসস্থল সিরিয়া হেদায়েতপ্রাপ্ত ও ন্যায়ের খোলাফায়ে রাশেদার শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে ইনশা’আল্লাহ্‌!

ধৈর্য্য ও অবিচলতা সহকারে যালিম ও যুলুমের মোকাবেলা করুন এবং জেনে রাখুন উদ্ধার অভিযানের অজুহাতে সাম্রাজ্যবাদী কাফেরদের প্রবেশ করতে দেয়ার চেয়ে যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে নিজস্ব সক্ষমতায় তা চেষ্টা করা আপনাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম! এটা উদ্ধার নয় আপনাদের জন্য নির্ঘাত আত্মঘাতি অভিযান!

كَيْفَ وَإِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لَا يَرْقُبُوا فِيكُمْ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً يُرْضُونَكُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَى قُلُوبُهُمْ وَأَكْثَرُهُمْ فَاسِقُونَ

“কিভাবে (তোমরা তাদের বিশ্বাস করো?)! যদি তারা তোমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তবে তারা পারস্পরিক সম্পর্ক ও কৃত অঙ্গীকারের কোনো তোয়াক্কা করবে না; তারা মুখে তোমাদের তুষ্ট করে যখন তাদের অন্তর ভিনড়ব ইচ্ছা পোষণ করে; তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” [সূরা আত্‌ তওবা : ০৮]

হে মুসলিমগণ, হে সিরিয়ার ভাইগণ, হে আশ-শামের অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সততা ও নিষ্ঠার সাথে সংগ্রামরত জনগণ:

আমাদের সমস্যা সমাধানে সাম্রাজ্যবাদী কাফের রাষ্ট্রগুলোর দ্বারস্থ হওয়া একটি গুরুতর ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত এবং আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, তাঁর রাসূল (সা) ও ঈমানদারগণের সাথে স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতার শামীল। এর দ্বারা আপনারা সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র ভয়ানক ক্রোধে নিমজ্জিত হবেন। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَنْ تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُبِينًا

হে বিশ্বাসীগণ, মুমিনদের পরিবর্তে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কী তা করে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট তোমাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ তুলে দিতে চাও?” [সূরা নিসা : ১৪৪]

এবং রাসূল (সা) বলেন:

لَا تَسْتَضِيئُوا بِنَارِ الْمُشْرِكِينَ

“মুশরিকের আগুন হতে আলো আকাঙ্খা করোনা।” আনাসের বরাত দিয়ে আহ্‌মদ তা বর্ণনা করেছেন। এবং আল-বায়হাকিতে বর্ণিত আছে:

لاَ تَسْتَضِيئُوا بِنَارِ الْمُشْرِكِينَ

“মুশরিকদের আগুন হতে আলো আকাঙ্খা করোনা।”

এবং একইভাবে আল-বুখারী তার ত্বরিক আল-কাবি’র গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মুশরিকদের আগুনকে তোমরা তোমাদের আলো বানিওনা।

আগুন যুদ্ধের সমার্থক শব্দ এবং হাদীসটিতে রূপক অর্থে মুশরিকদের পাশে যুদ্ধ করা এবং পরামর্শ নেয়াকে বুঝাচ্ছে। সুতরাং হাদীস অনুযায়ী তাদের ব্যবহার করা সুস্পষ্ট নিষেধ। রাসূল (সা) বলেছেন:

إِنَّا لاَ نَسْتَعِينُ بِمُشْرِكٍ

“আমরা মুশরিকদের ব্যবহার করিনা।” আহ্‌মাদ এবং আবু-দাউদ হতে বর্ণিত। সুতরাং আমাদের সমস্যা সমাধানে কাফেরদের সেনা অভিযানকে ব্যবহার করা, এমনকি পরামর্শ করাও একটি ভয়াবহ গুনাহ্‌ এবং কখনও সঠিক ও গ্রহণযোগ্য নয়।

অথচ আজ অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা প্রত্যক্ষ করছি একদিকে সাম্রাজ্যবাদীরা সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে অন্যদিকে মুসলিম শাসকেরা হাত গুটিয়ে কী হচ্ছে কী হবে সেই তামাশা দেখছে এবং অন্ধ-বধিরের মতো এমন আচরণ করছে যেন তারা সিরিয়ার জনগণের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা দেখতে ও শুনতে পায়না, যেন এসবই ঘটছে তাদের দৃষ্টিসীমার অনেক বাইরে। সুতরাং আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র বক্তব্যনুযায়ী এরা সিরিয়ার জনগণের রক্ষাকারী নয়:

وَإِنِ اسْتَنْصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ

“এবং দ্বীনের ব্যাপারে তারা যদি তোমাদের সাহায্য কামনা করে, তবে অবশ্যই তোমরা সাহায্য করবে।” [সূরা আনফাল : ৭২]

তাদের মধ্যে যদি একবিন্দু লজ্জা অবশিষ্ট থাকে তবে সিরিয়ার ভাইদের রক্ষায় এবং আশ-শামের এই যালিমের কবল থেকে তাদের উদ্ধারে ব্যারাকে অবস্থানরত সেনাবাহিনীগুলোকে প্রেরণ করা তাদের কর্তব্য।

আল্লাহ্‌’র ইচ্ছায় সিরিয়ার জনগণ তাদের পারিপার্শ্বিক ইসলামী ভু-খন্ডের ভাইদের সহায়তায় এই যালিম শাসককে অপসারণ করে ইসলামের কেন্দ্রস্থল আল-শামে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম এবং এজন্য তাদের সাম্রাজ্যবাদী কাফেরদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নাই। কারণ তাদের হস্তক্ষেপ মানেই ভিন্ন চেহারার একই দালাল শাসকের পুনরাবৃত্তি এবং আরো একবার ইসলামী শাসন দ্বারা আলোকিত হওয়ার সুযোগ থেকে সিরিয়াকে বঞ্চিত করে তাগুতের শাসন ফেরত দেয়া।

সাম্রাজ্যবাদী কাফেরেরা কোন ভু-খন্ডকে দুর্নীতিগ্রস্ত, বিধ্বস্ত এবং তছনছ না করে প্রবেশ করেনি যার চিহ্ন এখনো বিরাজমান এবং এখনো মুছে যায়নি বরং তাদের বর্বরোচিত হস্তক্ষেপের সাক্ষী হয়ে আছে। এই সামরিক অভিযান এক মারাত্মক বিপর্যয় ও দুর্যোগের প্রতিধ্বনি। সুতরাং একে প্রতিহত করুন। তারা আপনাদেরকে উদ্ধার করবে এটা ভেবে তাদের দ্বারস্ত হওয়া থেকে সাবধান থাকুন। নয়তো পরবর্তীতে এমন আক্ষেপ করবেন যে আক্ষেপ কোনোই কাজে আসবে না।

فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ فَعَسَى اللَّهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَى مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ

বস্তুত অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত লোকদের আপনি তাদের সহযোগীতায় সবচেয়ে অগ্রগামী পাবেন এই বলে যে: “আমরা দুর্ভাগ্যে পতিত হওয়ার আশঙ্কা করি”। কিন্তু সেদিন দূরে নয় যেদিন আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে বিজয় অথবা চূড়ান্ত ফয়সালা প্রকাশিত হবে এবং স্বীয় গোপন মনোভাবের জন্যে তারা অনুতপ্ত হবে। [সূরা মায়িদাহ্‌ : ৫২]

إِنَّ فِي هَذَا لَبَلَاغًا لِقَوْمٍ عَابِدِينَ

“নিশ্চয়ই এতে (কুর’আনে) এবাদতকারী সম্প্রদায়ের জন্যে সতর্কবার্তা রয়েছে।” [সূরা আম্বিয়া : ১০৬]

২১ শাওয়া’ল ১৪৩৪ হিজরী
২৮ আগষ্ট ২০১৩ খ্রীষ্টাব্দ

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply