ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ১৬ (মদীনার জীবন)

ইসলামের রয়েছে একটি নির্দিষ্ট জীবনব্যবস্থা যেটা মূলতঃ রূপ লাভ করছে জীবন সম্পর্কে কিছু বিশেষ ধ্যানধারনার থেকে। এগুলোই হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতির মূল উপাদান, যেটা অন্য যে কোন সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ন ভাবে আলাদা। ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে তিনটি মূল বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়ঃ

১.        ইসলামী জীবনব্যবস্থা ইসলামী আকীদাহ বা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত।

২.        ইসলামী জীবনব্যবস্থায় মানুষের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় আল্লাহ নির্ধারিত হালাল-হারামের উপর ভিত্তি করে।

৩.        আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই এ জীবনব্যবস্থায় সুখের প্রকৃত অর্থ।

এটাই হচ্ছে ইসলামী জীবনব্যবস্থা এবং এ রকম একটি জীবনই মুসলিমদের এক এবং একমাত্র কাম্য। কিন্তু, এ রকম একটি জীবনব্যবস্থা পেতে হলে মুসলিমদের অবশ্যই দরকার একটি ইসলামী রাষ্ট্র, যা ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করবে এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম-আহকামকে সমাজে সর্বতোভাবে বাস্তবায়ন করবে।

মুসলিমরা মদীনায় হিজরতের পর ইসলামী আকীদাহর ভিত্তিতে রচিত একটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী জীবন পরিচালনা করেছিলো। আর, এই সময়ই সমাজ জীবন, বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি সম্পকির্ত আয়াত এবং ইবাদত সম্পকির্ত আয়াত নাজিল হয়। হিজরী দ্বিতীয় সালে মুসলিমদের উপর যাকাত ও সিয়াম ফরজ করা হয়। এরপর আজান ফরজ করা হয় এবং মদীনাবাসী বিলাল ইবন রাবি’য়াহ সুললিত কন্ঠে দিনে পাঁচবার আজান শুনতে থাকে। আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় আসার ১৭ মাস পর কিবলার দিক পরিবর্তন করে কাবাকে কিবলা হিসাবে নির্ধারন করা হয়। এরপর একে একে ইবাদত, খাদ্য, মূল্যবোধ, মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক এবং আল্লাহর হুকুম অমান্য করা সম্পর্কিত কুরআনের বিভিন্ন আয়াত নাজিল হতে থাকে। মদ এবং শুকরের মাংস নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড ও অপরাধীর শাস্তি বিষয়ক আয়াতও এ সময়ে নাজিল হয়। আয়াত নাজিল করা হয় ব্যাবসায়িক লেনদেন বিষয়ে, সব ধরনের সুদ কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মদীনায় যখনই মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কিত কোন আয়াত নাজিল হতো আল্লাহর রাসূল (সা) আয়াতটিকে মুসলিমদের জন্য ব্যাখ্যা করতেন যেন তারা সে অনুযায়ী তাদের জীবন পরিচালনা করতে পারে। তিনি (সা) মদীনার মুসলিমদের সকল বিষয় দেখাশুনা করতেন, তিনি তাঁর কথা, কাজ ও তাঁর সম্মুখে ঘটিত কাজের ব্যাপারে নীরব থেকে মুসলিমের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ মিটমাট ও সমস্যার সমাধান করতেন। এজন্যই রাসূল (সা) এর কথা, কাজ ও বিশেষ বিষয়ে তাঁর নীরবতা সবই শরীয়াহর উৎস। কারণ, আল্লাহ সুবহানুওয়াতায়ালা সুরা নাজমে বলেছেন,

“এবং (তিনি) প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। (এই) কুরআন হলো ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়।” [সুরা নাজমঃ ৩-৪]

এভাবেই মদীনায় মুসলিমদের জীবন সম্পূর্ন ব্যতিক্রমধর্মী একটি দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পরিচালিত হতে থাকে, আর এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো পুরোপুরি ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি। আর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই একটি ব্যতিক্রমধর্মী সমাজ ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠে। ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও আবেগ অনুভূতি  ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে এবং সমাজের সর্বস্তরে ইসলামের হুকুম-আহকামগুলোও পরিপূর্ণ ভাবে বাস্তবায়িত হয়। দ্বীন ইসলাম সমাজের  মানুষকে দেয় জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান এবং দেয় জীবনের সমস্ত বিষয়ে দিকনিদের্শ না। ইসলামী দাওয়াতের এ পর্যায়টি, যে পর্যায়ে মুসলিমরা ইসলামের উপর পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো তা রাসূল (সা)-কে সত্যিকার ভাবে আনন্দিত করেছিলো। কারণ, এ পর্যায়ে মুসলিমরা নির্ভয়ে এবং কোনরূপ অত্যাচার নির্যাতন ব্যতীতই ব্যক্তিগত ও দলবদ্ধ ভাবে ইসলামের সমস্ত হুকুম-আহকাম মেনে চলতে পারছিলো এবং ইসলাম একটি শক্ত ভিত্তির  উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো। তারা তাদের জীবনের সমস্ত সমস্যা আল্লাহতায়ালার হুকুম অনুযায়ী সমাধান করতো, নতুন কোন বিষয়ের অবতারণা হলে তা সবসময়ই তা আল্লাহর রাসুলের দিকে ফিরিয়ে দিতো এবং তারা কখনোই আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করতো না। শুধু তাই নয়, তারা তাদের প্রতিটি কর্মকান্ডও আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে পরিচালিত করতো আর এতেই তারা সত্যিকারের মানসিক শান্তি ও সুখ লাভ করতো। মুসলিমদের মধ্য হতে অনেকে দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহন, কুরআন মুখস্ত করা কিংবা জ্ঞানার্জনের আশায় মুহাম্মদ (সা)-কে ছায়ার মতো অনুসরণ করতো। এভাবে ধীরে ধীরে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে এবং মুসলিমরাও দিনে দিনে শক্তিশালী হতে থাকে।

Leave a Reply