টিকফা চুক্তি: মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক দাসত্বের কৌশলপত্র

গত ১৭ জুন, ২০১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রী পরিষদ সভায় টিকফা চুক্তির খসড়া অনুমোদন হয়। মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দাবি করেন- “এ চুক্তির কারণে আমেরিকা আর একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেনা”। যদিও দুই সরকারের কোনো এক পক্ষ এ চুক্তির কোনো ধারা উপধারা বিস্তারিতভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি শুধুমাত্র কিছু অস্পষ্ট বিবৃতি দেয়া ছাড়া, যেমন: ‘বাংলাদেশের জন্য এ চুক্তি সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিবে’, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি একটি বিরাট মাইলফলক’ এবং আরো অনেক কিছু। তাই এ চুক্তির বিষয়বস্তু যা প্রকাশিত হয়েছে তার গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন। এর জন্য আমরা সাহায্য নিব, টিকফার খসড়া, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে আমেরিকার টিকফা চুক্তির অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের সাথে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এখানে বলে রাখা ভালো ভারত ও চীন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তি করেনি। যেহেতু এটি একটি অসম চুক্তি তাই এ চুক্তির আড়ালে আমেরিকার লুকায়িত কর্মপরিকল্পনা এবং এর পরিণতি কী হবে তা এখানে তুলে ধরব।

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার (Intellectual Property Rights):

এ চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ IPR এর নিয়ম মেনে চলতে হবে। যদিও চুক্তিতে উভয় পক্ষের মেনে চলার কথা বলা হয়েছে তবে এটি সত্য বাংলাদেশের মত দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের নিজ নামে কোনো প্যাটেন্ট নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এই IPR নিয়ম এমনভাবে করে রেখেছে যে সবচাইতে বেশি অর্থ পরিশোধ করবে সেই প্যাটেন্ট পাবে। এতে চুক্তির অন্য পক্ষই সুবিধাটা পাবে।

কৃষি:

এই প্যাটেন্ট স্বত্ব আইন অনুযায়ী ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ও দুর্লভ পণ্যের প্যাটেন্ট করে রেখেছে। যার পরবর্তী উৎপাদন, বন্টন ও সংরক্ষণের জন্য আমেরিকার নিকট বিপুল অংকের রয়্যালটি, কপিরাইট ও লাইসেন্স ফি দিতে হবে। এ চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশের কৃষি, ফারমাসিউটিকেল, তথ্য প্রযুক্তি খাত ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। 

প্যাটেন্ট আইন প্রয়োগে আমাদের কৃষি ও প্রাণীজগতের জন্য সংকট বয়ে আনবে। বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের প্রাণী ও নানাজাতের উদ্ভিদ বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা প্যাটেন্ট করা। আরা এর বাস্তবায়নে কৃষক বীজ উৎপাদন, স্তূপকরণ, সংরক্ষণ করতে দেয়া হবেনা। কৃষিজাত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে ও দেশকে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি করবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ট করা কৃষি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কৃষিতে ভর্তুকি কমাতে বাধ্য করবে। তাই এ প্যাটেন্ট আইন আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিকে করবে সম্পদশালী আর এ দেশের কৃষকদের করবে সর্বহারা। 

সেবা খাত:

এই চুক্তি আমাদের অর্থনীতির বৃহত্তম অংশ সেবা খাতের উপর বিরূপ প্রভাবিত ফেলবে। যেখানে আমেরিকার মতো একটি উন্নত অর্থনীতির রয়েছে শক্তিশালী সেবা খাত। টিকফা চুক্তি একবার স্বাক্ষরিত হলে মার্কিন সেবা দানকারী প্রতিষ্টানগুলি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হবে যা এ দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাকে হুমকির মুখে ফেলবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বহুজাতিক কোম্পানিগুলাকে সেবা খাতে ব্যবসার অনুমতি দিতে বাধ্য ছিল যার ফলে আর্থিক ও টেলিযোগাযোগ খাতে তাদের ব্যাপক আধিপত্য প্রতিষ্টিত হয়েছে। যদি মার্কিনীদের আরো সুবিধা দেয়া হয় এর পরিণতিতে স্থানীয় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলি নির্মূল হয়ে পড়বে এবং মার্কিন কোম্পানিগুলা তার জায়গা দখল করে নিবে। দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ কর মুনাফা হারাবে এবং মুনাফা খাত পরিণত হবে কর অব্যাহতির বিষয়ে।

অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রবল হবে:

আমেরিকান কোম্পানিগুলা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সহজে প্রবেশের দরুন, বিশেষত আর্থিক খাত, দেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সাথে জড়িয়ে পড়বে যা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের সময় দেশের অর্থনীতিও সংকটে পরবে। ২০০৬-০৭ এ যখন যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয় ইউরোপের বাজারেও তা আঘাত করে কারণ ইউরোপের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যে জড়িত ছিল। এতে ইউরোপ এ সঙ্কট এড়াতেও পারে নি। যার উত্তম উদাহরণ গ্রীস, এ সংকটের পরিণতিতে গ্রীস কার্যকরভাবে যে কোন প্রকারের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারায় এবং এটি অদ্ভুত হবে না, টিকফার কারণে বাংলাদেশকেও আগামীতে যদি একই ভাগ্য বরণ করতে হয়।

অন্যান্য:

  • টিকফা চুক্তি বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করবে তৈরী পোষাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে অনুমতি দিতে। যা মার্কিন স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করবে। এতে তৈরী পোশাক শিল্পে চলমান আস্তিরতা আরো বেগবান করবে। সত্যিকার অর্থে আমেরিকান কোম্পানিগুলা তাদের সরকারের সাথে অংশীদার হয়ে বাংলাদেশের পোষাক শ্রমিকদের শোষণই করছে আর টিকফা কোনভাবেই এর প্রতিকার হতে পারনা।
  • এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবহন ইত্যাদি খাতে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে । যা আমাদের অর্থনীতির জন্য হবে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।
  • চুক্তির শর্ত মোতাবেক বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং ঢালাওভাবে সরকারি খাতগুলিকে বেসরকারিকরণ করতে হবে । যা পরবর্তীতে আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা বিলুপ্ত করা হবে।

সংক্ষেপে, টিকফা চুক্তি মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার এর দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে এ দেশীয় সকল ব্যবসা, শিল্প এবং বিনিয়োগ সম্পর্কিত নীতিগুলা নিয়ন্ত্রিত হবে। যার ব্যত্যয় ঘটলে তারা রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ করবে।

আমেরিকার কর্মপরিকল্পনা:

টিকফা চুক্তির প্রক্রিয়ায় আমেরিকার লুকায়িত এজেন্ডা আমাদের অদূরদর্শী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকবর্গ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অনেক বছর ধরেই এ দেশে জ্বালানি খাতে শেভরন, অক্সিডেন্টাল এর মত বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা ব্যবসা করে সন্তুষ্ট ছিল কিন্তু তারা এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে বসে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতে মনোযোগ দিয়েছে। টিকফা তারই নীলনকশা বাস্তবায়ন করবে। তাদের এ প্রবণতার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারতের আধিপত্য, যেমন এ্যায়ারটেলের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতে অনুপ্রবেশ যা আমেরিকার কাছে খুব বেশি সুখকর নয়। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে নতুন বাজার খোলা যা তাদের ইরাক আফগানিস্তানের মত অনিঃশেষ যুদ্ধে হাজার হাজার কোটি ডলারের যে ক্ষতি তা পূরণ করতে সহায়তা করবে। তৃতীয়ত, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি তা হল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের বাণিজ্যিক ও সামরিক অবস্থান দৃঢ় করা। বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে তাদের এ উদ্দেশ্য হাসিলে সবচাইতে কৌশলগত অবস্থানে আছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে টিকফা চুক্তি:

ইসলামে পররাষ্ট্র নীতি সহ একটি রাষ্ট্র চালানোর জন্য আবশ্যক সমস্ত ব্যবস্থা আছে । এর স্বরূপ শুধুমাত্র খিলাফত রাষ্ট্রেই পরিপূর্ণভাবে দেখা যাবে। ইসলামে যে কোন চুক্তির সুস্পষ্ট নীতিমালা আছে। সীমিত পরিসরে এখানে আমরা শুধুমাত্র টিকফা সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি নিয়ে আসব।

১. ইসলাম অনুযায়ী যেকোন আন্তর্জাতিক চুক্তি যা ইসলাম ও মুসলিমের উপকৃত করে এমন চুক্তির অনুমতি আছে। ইসলাম 

সে সমস্ত চুক্তি অনুমোদন দেয় না যা মুসলিমদের চাইতে  
ইসলামের শত্রুদের সুবিধাজনক অবস্থানে রাখে। টিকফা এমন চুক্তি যা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত আমেরিকার নির্দেশে করা, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে করবে বিদ্ধস্ত এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে। এতে কম করে বললেও এটাকে প্রভু-দাস সম্পর্কের চুক্তি বলা চলে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

……এবং আল্লাহ কখনোই মুমিনদের উপর কাফেরদের কোন পথ (বিজয়) অবশিষ্ট রাখেন না” [সূরা নিসা- ১৪১]

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায় মুসলিমদের উপর কাফেরদের কতৃত্ব চলবেনা। টিকফা চুক্তির যতটুকু প্রকাশ পেয়েছে এটি তারই নির্দেশ করছে। অতএব এ ধরনের কোন চুক্তিই করা যাবেনা।

২. যে সমস্ত দেশ মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত তাদের সাথে চুক্তির অনুমতি ইসলাম দেয়না। আর আমেরিকা শুধু যুদ্ধে লিপ্ত না সম্প্রতি তারা ইরাক ও আফগানিস্তানকে দখলও করে নিয়েছে। ইসলামের পররাষ্ট্র নীতি অনুযায়ী যুদ্ধরত কোন দেশের সাথে কোন প্রকার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যাবেনা।

৩. যে কোন চুক্তি দুপক্ষের স্বাধীন ইচ্ছার ফলে হতে হবে। আর আমেরিকা ক্রমাগত বাংলাদেশকে পীড়াপীড়ি করে যাচ্ছে এ চুক্তি সইয়ে। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা জি এস পি সুবিধা বাতিল করে দিবে এমন ভয় ভীতি হুমকি দিয়ে এক প্রকারের চাপের মধ্যে রাখছে। যা এ চুক্তি সইয়ের অনুমোদন দেয়না।

অতীতে ইসলামিক রাষ্ট্র এই আমেরিকার সাথে কীভাবে আচরণ করত তার ছোট্ট একটা ঘটনা উল্লেখ করি… ভূমধ্য সাগরে নিরাপদে আমেরিকার পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য ৫ই জুন, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার একটি চুক্তি হয় যেখানে আমেরিকাকে কর স্বরূপ ৬,৪২,০০০ গোল্ড ডলার যা বছরান্তে ১২,০০০ উসমানী গোল্ড লিরা উসমানী খিলাফতকে পরিশোধ করতে হয় । আমেরিকার ইতিহাসে এটিই একমাত্র চুক্তি যা অন্য ভাষায় করে অর্থাৎ আরবি চুক্তি সই হয়। অথচ আজকে যে চুক্তি সই হচ্ছে তা অসম চুক্তিই নয় অপমানজনকও বটে। একমাত্র ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্টার মাধ্যমেই মুসলিমদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং বিশ্বের পরাশক্তি হিসাবে ইসলামকে বিজয়ী রাখবে অন্য সকল দ্বীনের উপর।

আল্লাহ্ তায়ালা বলেন-

তিনিই প্রেরন করেছেন আপন রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) সহকারে, যেন এই দ্বীন অন্যান্য সকল দ্বীনের উপর বিজয় লাভ করেন…” [সূরা আত-তাওবা: ৩৩]  

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply