আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা

সূচনা:

তিনটি কারণে ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।

এক. ধারণাটি ইসলামি আক্বীদার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন প্রধান ভিত্তি। শাইখ আহমাদ ইবনে আতিক (রহ) বলেন:

“তাওহীদের বাধ্যবাধকতা এবং এর বিপরীতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টির পরে আল্লাহ্‌র কিতাবে অন্য কোন বিষয়েই ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’-র চেয়ে বেশি প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। অন্য কোন বিষয় এতো পরিষ্কারভাবে ব্যখ্যা করা হয়নি।”

যদি ওয়ালা’ (আনুগত্য) বলতে আল্লাহ, তার নবী-রাসূলগণ ও মুমিনদের প্রতি নিষ্ঠাপূর্ন ভালোবাসা ও সহযোগিতা প্রকাশকে বোঝায়। অন্যদিকে বারা’ (সম্পর্কচ্ছেদ) বলতে মিথ্যা ও মিথ্যার অনুসারী মানুষদের সাথে শত্রুতা পোষন ও সম্পর্কচ্ছেদ বোঝায়। আর প্রকৃতপক্ষে এসবের উদ্ভব ঈমানের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়গুলো থেকেই।

দুই. মুসলিমরা বর্তমানে এমন একটি কঠিন সঙ্কটপূর্ন সময় পার করছে যখন ইসলামের অনেক মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয় বিস্মৃত হয়েছে, ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিংবা অবহেলা করা হয়েছে। ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’-র বিষয়টি সে ধরনেরই একটি বিষয়। এ কারণে বহু মুসলিমই এখন আর মুমিন ও কাফেরের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যাপারে সচেতন নয়। এর ফলশ্রুতিতে বহু মুসলিমের ঈমান/বিশ্বাস এখন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং কাফেরদের সাথে তারা গভীর বন্ধুত্ব করছে আচরণ, চালচলন ও আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে কাফেরদের অনুকরণ করছে।

তিন. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র অর্থের সাথে ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’-র বিষয়টি এমন গভীরভাবে সম্পর্কিত যে, এই বিষয়টি কোনো ভূল করলে মূল কালিমার অর্থটিও ভূলভাবে বোঝা হবে।

‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’-র উপাদানসমূহ বোঝা

‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’-র ধারণাটি বুঝতে হলে নিচের ছয়টি বিষয় আলোচনা করতে হবে:

১. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র অর্থ:

এর অর্থ: ‘আল্লাহ ছাড়া আর কারোই উপাসনা পাওয়ার অধিকার নেই। সুতরাং এর মাধ্যমে অন্য সব উপাস্যের উপাসনা বাতিল করা হয়েছে এবং একমাত্র আল্লাহর উপাসনাকেই সত্যায়ন করা হয়েছে।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেন, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে অন্তরের সুখ নেই বা পূর্ন কোনো আনন্দ নেই। আল্লাহর পাশাপাশি যেসব জিনিসকে ভালোবাসা হয়। সেগুলোকে পুরোপুরি ছুড়ে না ফেলা পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি [প্রকৃত] ভালোবাসা পোষন করা কখনোই সম্ভব নয়। এটাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র প্রকৃত বাস্তবতা এবং এটাই আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইবরাহিম (আ)-সহ অন্য সব নবী-রাসূলদের দ্বীন।

তাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র প্রকৃত বাস্তবতা হল আল্লাহকে ভালবাসা এবং তিনি যেসব কাজ ভালোবাসেন ও যেসব কাজে সন্তুষ্ট হন সেসব কাজ করা।

আল হাফিয আল হাকামী (রহ) বলেন, কোনো ব্যক্তি যে তার প্রভুকে ভালোবাসে তার নিদর্শন হলো: সে ব্যক্তি সবসময় আল্লাহর পছন্দকেই প্রাধান্য দেয়, এমনকি যদিও সেটা তার নিজের ইচ্ছার বিপরীত হয়; আল্লাহ যেটাকে ঘৃণা করে, সেও সেটাকে ঘৃণা করে, এমনকি যদিও সেটা তার নিজের ইচ্ছার অনুগামী হয়; আল্লাহ ও তার রাসূল (সা)-এর মিত্রদের প্রতি নিষ্ঠাপূর্ণ ভালবাসা ও সহযোগিতা প্রদর্শন করা; আল্লাহ ও তার রাসূল (সা)-এর প্রতি যারা শত্রুতা প্রদর্শন করে তাদের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করা;  আল্লাহর রাসূল (সা)-কে অনুসরণ করা; এবং তাঁর দেখানো পথকে/হেদায়েতকে গ্রহণ করা।

ইবনুল কাইয়িম (রহ) কবিতা আকারে বলেন,

সত্যিকারের ভালোবাসার শর্ত হলো
তুমি যাকে ভালোবাসো তার ভালোবাসার সাথে
তোমার ভালোবাসা কোনোরকম অবাধ্যতা ছাড়াই
একমত হয়ে থাকবে।

তুমি যদি আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি কর
অথচ কাজ কর এর বিপরীতটা
তাহলে তোমার সেই ভালোবাসা
আর কিছু নয়, কেবল মিথ্যা ভণিতা

আল্লাহকে ভালোবাসার নাম করে
তুমি কি ভালোবাসো তোমার প্রিয়তমের শত্রুদেরও
প্রতিদানে তুমি ভালোবাসা পেতে চাও? তারপরও?

আর তুমি তো তাদের সাথে যুদ্ধ কর ও শত্রুতা দেখাও
যাদেরকে ভালোবাসেন স্বয়ং আল্লাহ।
হে ভাই, এটা কি সত্যিকারের ভালোবাসা
নাকি শয়তানের অনুসরন করা?

কেবলমাত্র আল্লাহকেই এককভাবে বেছে নেয়া ছাড়া
কোনো ইবাদত নেই;
পাশাপাশি সারা দেহ-মন
দীন-হীনভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে তার কাছেই।

২. ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’-র ঘোষনা করা মানে কয়েকটি ক্ষেত্রে ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’-র প্রয়োগ থাকা।

কালিমার মানে হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর দ্বীন, তাঁর কিতাব, তাঁর নবী রাসূল ও তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ ইবাদতকারীদের প্রতি ওয়ালা (নিষ্ঠাপূর্ন ভালোবাসা ও সহায়তা) প্রদর্শন করা এবং এর পাশাপাশি তাঁদেরকেই ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করা:

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ

নিঃসন্দেহ তোমাদের ওলী হচ্ছেন কেবলমাত্র আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল, আর যারা ঈমান এনেছে, আর যারা নামায কায়েম করে, আর যাকাত আদায় করে, আর তারা রুকুকারী। [সুরা মায়িদা:৫৫]

কালিমার মানে হচ্ছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুকে উপাসনা করে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা ও যেসব জিনিসকে আল্লাহর পাশাপাশি উপাসনা করা হয় সেগুলোর প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করা।

قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

তোমাদের জন্যে ইব্রাহীম ও তাঁর সঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল: তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে। [মুমতাহিনা:৪]

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী ‘তাগুত’দেরকে মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন। [বাকারা:২৫৬]

শাইখ মুহাম্মদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব বলেন, জেনে রেখো, আল্লাহর পাশাপাশি যেসব জিনিসের উপাসনা করা হয় সেসব জিনিসকে পরিত্যাগ না করলে কোনো ব্যক্তি ঈমানদার হিসেবে গন্য হতে পারবে না। এই আয়াতই তার প্রমাণ।

কালিমার মানে হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশনার প্রতি ভালোবাসা পোষন করা:

اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ ۗ قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ

”তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে তোমাদের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অনুসরণ করো আর তাঁকে বাদ দিয়ে অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। অল্পই যা তোমরা মনে রাখো।” [সুরা আরাফ:৩]

কালিমার মানে হচ্ছে ইসলামবিরোধী আইন ও রায়ের প্রতি শত্রুতা পোষন করা:

وَمَن يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

আর যে কেউ ঈমান অস্বীকার করে সে তাহলে তার আচরণ ব্যর্থ করেছে, আর সে পরকালে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যেকার। [সুরা মায়েদা:৫]

কালিমার মানে হচ্ছে ইসলাম ছাড়া বাকি অন্য সব দ্বীন ত্যাগ করা:

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত। [আলে ইমরান:৮৫]

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যা কিছু বাতিল করে এবং যা কিছু সত্যায়ন করে:

এই কালিমা কিছু বিষয়কে/জিনিসকে বাতিল করে, আবার কিছু বিষয়কে সত্যায়ন করে। এটি চারটি বাতিল করে: আলিহাহ, তাওয়াগীত, আনদাদ এবং আরবাব।

আলিহাহ: কেউ যদি কোনো বস্তুও ওপর আশা ও ভয় পোষণ করে এই ভেবে যে, ওই বস্তুটি নিজে নিজেই কোনো লাভ বা ক্ষতি ঘটাতে পারে, তাহলে ওই বস্তুটিকে আল্লাহর পাশাপাশি উপাস্য বানিয়ে ফেলা। তাই কালিমা এক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুকেই বাতিল করে দেয়।

وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ

আল্লাহ আপনাকে কোন কষ্টে ফেললে তিনি ছাড়া মুক্ত করার কেউ নেই। এবং তিনি মঙ্গল চাইলে তা রদ করার কেউ নেই। [সুরা ইউনুস:১০৭]

তাওয়াগীত: যাকে উপাসনা করা হয় ও যে এতে সন্তুষ্ট, কিংবা যারা কিছু ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্য দাবি করে, যেমন- গায়েব জানার দাবি করা, অথবা আল্লাহর আইনের বিপরীত আইন প্রণয়ন করাকে বৈধ মনে করা, এ ধরনের লোকেরাই সীমালঙ্ঘনকারী (তাওয়াগীত)।

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

প্রত্যেক জাতির কাছে কোন না কোন রাসূল পাঠিয়েছি এই নির্দেশ দিয়ে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে পরিহার কর। [সুরা নাহল:৩৬]

আনদাদ: যা কিছু কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে ফিরিয়ে রাখে, যেমন- পরিবার, সন্তান বা বাড়িঘর, এসব আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বি (আনদাদ) হয়ে দাড়ায়।

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا

কিন্তু মুমিনরা আল্লাহর ভালোবাসায় দৃঢ়। [সুরা বাকারা:১৬৫]

আরবাব: যারা জেনেশুনে আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে রায় দেয় ও সেসব রায় কার্যকর করা হয়, তাহলে তাদেরকে আল্লাহর পাশাপাশি প্রভু (আরবাব) বানিয়ে ফেলা হয়।

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ

তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে পাদ্রী ও বৈরাগীদেরকে তাদের রব বানিয়ে রেখেছে। [সুরা তাওবাহ:৩১]

এই কালিমা চারটি বিষয়ের/জিনিসের সত্যতা ঘোষনা করে/স্বীকৃতি দেয়:

১) নিষ্ঠা (ইখলাস): আল্লাহই হবেন আমাদের ইবাদতের উদ্দেশ্য এবং আমাদের সকল ইবাদত কেবল তারই প্রতি নিবেদিত হবে।

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ

তাদেরকে এ ছাড়া আর অন্য কোন কিছুই আদেশ করা হয়নি যে তারা বিশুদ্ধ চিত্তে ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করবে, … [বাইয়িনাহ: ৫]

২) ভালোবাসা: যে কোনো কিছুর চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভালোবাসতে হবে।

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ

আর মানুষের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছে যারা আল্লাহকে ছাড়া অন্যকে আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদেরকে এমনভাবে ভালোবাসে যেভাবে আল্লাহকে ভালোবাসা উচিত। [বাকারা:১৬৫]

৩) ভয় ও আশা: শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় ও আশা কেবল আল্লাহর প্রতিই থাকতে হবে।

إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো [এবং আমার অবাধ্য হওয়ার ব্যাপারে সাবধান হও], যদি তোমরা মুমিন হও। [আলে ইমরান:১৭৫]

فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

অতএব যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাৎ লাভের আশা পোষণ করে সে যেন সৎকাজ করতে থাকে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে অংশীদার না বানায়। [কাহফ:১১০]

৪) সাহাবাগণ ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ: সাহাবাগণ (রা) কিভাবে এই মহান কালিমাকে বুঝেছিলেন ও এর দাবিগুলো পূরণ করেছিলেন, সেটা ইমাম সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহ (রহ) সুন্দরভাবে ব্যখ্যা করেছেন। মুহম্মদ ইবন আবদুল মালিক আল মুসাইসি বলেন:

১৭০ হিজরিতে আমরা সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহর সাথে ছিলাম। এক ব্যক্তি তাকে ঈমান সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলো। তিনি জবাব দিলেন, ‘এটা হলো সত্যের স্বীকোরোক্তি ও আমল।’

লোকটি জিজ্ঞাসা করলো, এটা কি বাড়ে-কমে?

তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহ ইচ্ছা করলে এটা বাড়ে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে এটা কমে; এমনভাবে কমে যে আর এতটুকুই বাকি থাকে [তিনি তার বা হাত দিয়ে তা দেখান]।

লোকটি প্রশ্ন করলো, ঈমানকে যারা আমলহীন স্বীকরোক্তি বলে তাদেরকে আমরা কিভাবে মোকাবেলা করবো?

সুফিয়ান জবাব দিলেন, ঈমানের বিধিবিধান ও সীমাগুলো নির্ধারিত হওয়ার আগে তারা এই কথাটি বলতো। আসলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা)-কে মানবজাতির কাছে এই কথা বলার জন্য পাঠিয়েছেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারোই উপাসনা পাওয়ার অধিকার নেই এবং আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। মানুষ এটা বলার পর তাদের রক্ত ও সম্পদ (বৈধ কারণ ব্যতিত) নিরাপত্তা পেল এবং তাদের হিসাব হবে আল্লাহর সাথে। যখন আল্লাহ হাইয়ুল কাইয়ুম এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন তখন তিনি রাসূল (সা) কে বললেন তাদেরকে নামাজের নির্দেশ দিতে। রাসূল (সা) তাদেরকে নামাজের নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলেন। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো তাহলে তাদের প্রথম কাজটা কোনোই উপকারে আসতো না।

যখন আল্লাহ হাইয়ুল কাইয়ুম এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন তখন তিনি রাসূল (সা) কে বললেন তাদেরকে মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দিতে। রাসূল (সা) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলো। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো তাহলে তাদের প্রথম কাজ কিংবা নামাজ কোনোটাই তাদের উপকারে আসতো না।

যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন তখন তিনি রাসূল (সা) কে বললেন তাদেরকে মক্কায় ফেরার নির্দেশ দিতে যেন তারা তাদের (কাফের) পিতা ও সন্তানদের সাথে ততক্ষন পর্যন্ত যুদ্ধ করে যতক্ষন না তারা (কাফেররা) সেই কালিমাটি বলে যেটি তারা নিজেরা বলেছে, তাদের সাথে নামাজ পড়ে ও তাদের হিজরতের সাথে যুক্ত হয়। রাসূল (সা) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলো। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো তাহলে প্রথম প্রথম কাজ, নামাজ কিংবা হিজরত কোনোটাই তাদের উপকারে আসতো না।

যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন তখন তিনি রাসূল (সা)-কে বললেন তাদেরকে নির্দেশ দিতে তারা যেন হিজরত করে এসে আল্লাহকে উপাসনার জন্য কারা তাওয়াফ করে ও দীনহীনভাবে মাথার চুল ছেটে ফেলে। রাসূল (সা) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিলেন ও তারা তা পালন করলো। আল্লাহর শপথ, যদি তারা এটা না করত তাহলে তাদের প্রথম কাজ, তাদের নামাজ, তাদের হিজরত কিংবা পিতার সাথে যুদ্ধ করা কোনটাই তাদের উপকারে আসতো না।

যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন তখন তিনি রাসূল (সা)-কে বললেন তাদেরকে নির্দেশ দিতে তারা যেন হিজরত করে গিয়ে নিজেদের সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করে, যাতে সেই সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে। রাসূল (সা) তাদেরকে সেই নির্দেশ দিল এবং তারা তা পালন করলো ……..। আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটা না করতো তাহলে তাদের প্রথম কাজ, তাদের নামাজ, তাদের হিজরত, তাদের পিতাদের সাথে যুদ্ধ কিংবা তাদের তাওয়াফ কোনোটাই তাদের উপকারে আসতো না।

যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বিষয়ে তাদের অন্তরের সত্যতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলেন, যেটা ঈমানের বিধিবিধান ও সীমাগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলো, তখন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বললেন:

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

আজ হতে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, আমারা নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম তোমাদের প্রতি এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। [মায়িদা ৩]

সুফিয়ান এরপর বললেন, ‘তাই কেউ যদি ঈমানের কোনো একটি অংশ বাদ দেয় তাহলে আমাদের দৃষ্টিতে সে ঈমানহীন (কাফের)। অবশ্য যদি সে আলস্য বা অবহেলার কারণে তা ত্যাগ করে থাকে, তাহলে আমরা তাকে শুধরাবো এবং আমাদের দৃষ্টিতে সে দূর্বল/অপূর্ন ঈমানের অধিকারী। এটাই সুন্নাহ। কেউ এ বিষয়ে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলে এই কথাগুলো আমার বরাত দিয়ে বলবে।

শাইখ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন) বলেন, আমরা যদি এটা পরিষ্কারভাবে বুঝে থাকি তাহলে আমরা দেখব যে, দ্বীন পালনের দাবি করে এমন অনেকেই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র প্রকৃত অর্থ বোঝেনি। [প্রথম দিককার মুসলিমরা নির্যাতন, বন্দিত্ব, প্রহার ও ইথিওপিয়ায় হিজরতের সময যে অবর্ণনীয় ধৈর্য ধারণ করেছে, এটার সাথে যদি আমরা মনে রাখি যে, রাসূল (সা) মানুষের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন, তাহলে বুঝতে হবে উপায় থাকলে রাসূল (সা) অবশ্যই তার সাহাবীদের বিপদের বোঝা কমানোর পথ বের করতেন।

[আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্যে সমাপ্ত]

মূল: খালিদ আল-গারীব

প্রথম প্রকাশ: আগষ্ট ২০১৩

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply