ইসলাম কি সেঁকেলে ?

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

বিগত দুই শতক ধরে পুরো বিশ্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অচিন্ত্যনীয় সাফল্য অর্জন করেছে- রেলপথের উন্নয়ন, উড়োজাহাজ, পারমাণবিক প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, আই ভি এফ, জেনেটিক উপায়ে রূপান্তরিত খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি। এসব উন্নয়নের সাথে সাথে যুগপৎভাবে পশ্চিমারাও এগিয়েছে এবং ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের একপেশে উন্নয়ন আমাদের এ ধরণের ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে যে, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হল উদার মূল্যবোধ।



অনেক চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকের মতে বর্তমান বিশ্বে ইসলামের কোন অবস্থান নেই। মুসলিম দেশ সমূহ বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতায় কোন ভূমিকা না রাখায় এ ধরণের ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। পশ্চিমারা দাবী করে জ্ঞান বিজ্ঞানে তখনই তারা অগ্রগতি অর্জন করেছিল যখন তারা গীর্জা নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে ধারণ করেছে। গীর্জা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য অন্তরায়, কেননা ধর্ম কিছু অলীক বিশ্বাস ও কুসংস্কারের উপর নির্ভরশীল। ধর্ম থেকে শাসনব্যবস্থার পৃথকীকরণের কারণেই শিল্প বিপ্লব সম্ভবপর হয়েছিল এবং তারা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উদারপন্থীদের কারণেই আজকের জ্ঞান এবং বিজ্ঞান। তাদের দাবী, জ্ঞানের ভিত্তিমূল তারাই রচনা করেছিল এবং এর বিভিন্ন শাখা প্রশাখাও তাদেরই সৃষ্টি।



পশ্চিমারা তাদের ইতিহাসকে পৃথিবীর ইতিহাস বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পশ্চিমাদের ইতিহাস বর্ণনায় কখনওই মুসলিম সভ্যতার কাছ থেকে গৃহীত জ্ঞানকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করা হয় না। ঐতিহাসিকভাবে সকল সভ্যতারই কিছু না কিছু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ইতিহাস রয়েছে। পশ্চিমারা গ্রীক সভ্যতা থেকে গৃহীত জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করেছে এবং ইসলামী সভ্যতাও ৮ম-১০ম শতাব্দী পর্যন্ত গ্রীক কাজসমূহকে আরবীতে অনুবাদ করেছিল।

বিজ্ঞান হল বিশ্বব্রক্ষান্ড সম্পর্কে গবেষণা, নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত বিশেষ জ্ঞান।

প্রাথমিকভাবে দহন ইজ্ঞিনের উন্নতরূপই হল আজকের অটোমোবাইল। যেখানে দাহ্য জ্বালানী ইজ্ঞিনের পিস্টনের উপর চাপ প্রয়োগ করে এবং অটোমোবাইলকে চালনা করে। বৃটিশ সাম্রাজ্যে তৎকালীন সময়ে পিস্টন চালনা এবং যন্ত্রের মধ্যে ঘূর্ণন গতি সৃষ্টির জন্য প্রথমে বাষ্প এবং পরবর্তীতে কয়লাকে ব্যবহার করা হত। এ ধরণের উন্নয়ন সম্ভবপর ছিল ১২ শতকে আল জাজারির ক্রাঙ্কশ্যাফট আবিষ্কারের মাধ্যমে যেখানে তিনি রড এবং সিলিন্ডারের মাধ্যমে ঘূর্ণন গতি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম যন্ত্রে এটি ব্যবহার করেন।

ড্র্যাগ (Drag) ফোর্সকে ব্যবহার করে বাতাসের মধ্যে একটি বস্তুর গতিকে ধীর করবার প্রক্রিয়ায় প্যারাসুট কাজ করে। পূর্বের নিরীক্ষালদ্ধ ফলাফল থেকে বর্তমানে প্যারাসুট ডিজাইন করা হয়েছে। ৯ম শতাব্দীতে ইবনে ফিরনাস প্যারাসুটের প্রাথমিক নকশা করেন। তিনি কর্ডোভার ম্যাজকুইটা মসজিদ থেকে বিশাল ডানা সম্বলিত আলখেল্লা পরে লাফ দিয়েছিলেন এবং সামান্য আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। কাঠের কাঠামোর উপর লিনেন কাপড় জুড়ে দিয়ে এর চেয়েও ভাল নকশা সম্বলিত প্যারাসুট নির্মিত হয়। পরবর্তীতে শক্তিমত্তা ও কম ওজনের কারণে মোড়ানো সিল্ক ব্যবহার করা হয়।

এসব উদাহরণ এটাই প্রমাণ করে যে, কোন সভ্যতা বিজ্ঞানে তাদের অবদানকে নিরঙ্কুশ বলতে পারে না। বরং সার্বজনীন এ বিশাল জ্ঞান সমুদ্রের অন্যতম অংশীদার হতে পারে। যেমন অণু পরমাণু সমূহ বিশ্বব্রক্ষ্ণাণ্ডের নিয়ম অনুসারে চলে। এই নিয়মকানুনসমূহ কোন মুসলিম, হিন্দু বা খ্রিস্টান যেই আবিষ্কার করুক না কেন তা ব্যক্তিনিরপেক্ষ। এটা সার্বজনীন এবং কারো বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত নয়। সত্যিকারের বিতর্কের বিষয় হল কোন সভ্যতা জ্ঞান বিজ্ঞানে কতটুকু অবদান রেখেছে এবং কেন তারা এক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনে তৎপর ছিলো।

৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দীকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এসময়ে ইসলামী বিশ্বের প্রকৌশলী, পন্ডিত এবং ব্যবসায়ীরা কলা, কৃষি, অর্থনীতি, শিল্পকারখানা, আইন, সাহিত্য, নৌবিদ্যা, দর্শন, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পূর্বের জ্ঞান সংরক্ষণ ও নতুন জ্ঞান অন্বেষণে বড় ভূমিকা পালন করে। মধ্যযুগের ইতিহাসের উপর বিশেষজ্ঞ একজন ঐতিহাসিক হাওয়ার্ড টার্নার তার বই ‘সায়েন্স ইন ম্যাডিভেল ইসলাম’ এ উল্লেখ করেন, ‘মুসলিম শিল্পী এবং বিজ্ঞানী, রাজপুত্রগন এবং শ্রমিকরা একত্রে এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন যে, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সকল মহাদেশের সমাজকে প্রভাবিত করেছিল।’ ইসলামের ভেতরেই এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞানে অনন্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল।

আল্লাহ্‌’কে উপাসনা করা এমন একটি ব্যাপার যে তা আবিষ্কারে উদ্ধুদ্ধ করে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, কিবলা ঠিক করা, রমযান শুরু এবং শেষ করা প্রভৃতি বিষয়ের জন্য চাঁদ এবং নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান জানা অত্যাবশ্যকীয়। আর একারণেই মুসলমানরা দূরবীক্ষণ এবং নৌবিক্ষণ বিষয়ে গবেষণা শুরু করে। একারণে অধিকাংশ নৌবীক্ষণিক নক্ষত্রের নাম আরবীতে, যেমন: একামার, বাহাম, বাতেন কাইতোস, ক্যাফ, যাবিহ, ফুরুয, ইযার, লিসাস, মিরাক, নাশিরা, র্তা‌ফ এবং ভেগা ইত্যাদি।

মুসলিমরা মহাকাশবিজ্ঞানে অনেক অবদান রেখেছে এবং পরবর্তীতে তারা অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ঘড়ি উদ্ভাবন করেছে। ১০ম শতাব্দীতে আবু রায়হান আল বিরুণী গিয়ার হুইল সমৃদ্ধ যান্ত্রিক সৌর-চন্দ্র বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করেন। ১৫শ শতাব্দীতে এই নকশার উপর ভিত্তি করে তাকী আল দীন যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। কিবলা নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা থেকেই কম্পাস আবিষ্কৃত হয় যা মুসলিম জ্যোতির্বিদ্যার আবিষ্কারলব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়েছিল। মুসলিমরা কমপাস রোজ আবিষ্কার করে- যার মাধ্যমে মানচিত্রে এবং নটিক্যাল ম্যাপে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিন প্রদর্শন করা হয়।



আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন:

‘তিনিই তোমাদের জন্য তারকারাজি সৃষ্টি করেছেন যেন জল-স্থলের অন্ধকারে পথের দিশা পাও‘ (সূরা আন’আম: ৯৭)



এ আয়াত মুসলমানদেরকে ভাল দূরবীক্ষণ ও নৌবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করে। এ যন্ত্রপাতি পৃথিবী অভিযানে ব্যবহৃত হয়। অনেক মুসলিম ভূ-বিজ্ঞানী এগুলোকে ম্যানুয়াল হিসেবে সংগ্রহ করেন। কুরআনের আয়াত তাদের এ ব্যাপারে উৎসাহী করেছে যেখানে আল্লাহ বলেন,



‘আর আমি যমিনে পর্বত সৃষ্টি করলাম, যেন জমিন টলতে না পারে, এবং আমি তথায় তাদের চলবার জন্য প্রশস্ত পথ নির্মান করে রেখেছি।‘ (সূরা আম্বিয়া:৩১)



আগের মুসলিমরা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে, ইসলাম সকল বস্তগত উন্নয়ন- যেমন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পায়ন প্রভূতিকে গ্রহণ ও উদ্বুদ্ধ করে। কেননা এতে মানুষের অবস্থা ও জীবনমানকে উন্নত করবার জন্য বস্তুর রূপান্তর ও উন্নয়ন করার জ্ঞান শেখানো হয়। যেহেতু অনেক অঞ্চল ধীরে ধীরে মুসলিম সভ্যতার আওতায় আসে সেহেতু এসব অঞ্চলে নগরায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন শুরু হয়। আরবের অনেক মরু অঞ্চল পানির মাধ্যমে বসবাসের উপযোগী করা হয়। মুসলিম প্রকৌশলীরা ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদী থেকে অসংখ্য খাল খনন করে পানির ব্যবস্থা করেন। বাগদাদের চারিদিকের নীচু জায়গায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে শহরকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করা হয়। মুসলিম প্রকৌশলীরা পানির চাকাকে (ওয়াটার হুইল) অধিকতর উপযোগী করে গড়ে তুলেন এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির ধারাগুলোকে বিস্তৃত করেন যাকে কানাতস্‌ বলা হয়। একারণে উন্নত গার্হস্থ্য পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠে। যার মধ্যে ছিল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণগোসলখানা, পান উপযোগী ঝর্ণা, পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ এবং বহুলব্যবহৃত ব্যক্তিমালিকানাধীন অথবা গণশৌচাগার ও গোসলখানা।

মুসলিম চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং বিশেষজ্ঞগণ বিজ্ঞানসহ অন্যান্য শাখায় ব্যাপক অবদান রাখেন। এসব অবদান আজকাল পশ্চিমারা ব্যবহার করছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারাও এগুলোর উন্নয়ন বিধান করেছে। কেননা একক কোন সভ্যতা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার কৃতিত্ব নিতে পারে না। প্রত্যেক সভ্যতাই তার আবিষ্কারসমূহকে লিপিবদ্ধ করেছে যা পরবর্তীতে একই বিষয়ের উপর চালিত গবেষণার জন্য সহায়ক (রেফারেন্স) হিসেবে কাজ করে। ইসলামের উত্থানের আগে আরব বিশ্ব বিজ্ঞানে কোন অবদান রাখেনি। এই একই জনগণ যখন ইসলাম গ্রহণ করল তখন তারা আবিষ্কার করতে শুরু করল-যা পরবর্তী প্রজন্ম সদ্ব্যবহার করেছিল। এমনকি এসব আজও আমাদের কাজে আসে। ইসলাম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা তো নয়ই বরং এক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে।

Leave a Reply