প্রাগমেটিজম: একটি অনৈসলামি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি

প্রাগমেটিজম শব্দের কোন যুতসই বাংলা প্রতিশব্দ না পেয়ে এর ইংরেজী পরিভাষাটিই ব্যবহার করছি। শাব্দিক অর্থ নয় বরং এর প্রায়োগিক দিকটি নিয়েই আলোচনা করব। প্রাগমেটিজম বলতে বাস্তবতা প্রবণতাকে বুঝায়। কোন ব্যক্তির চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি যদি নিছক বাস্তবতাই হয় তবে তাকে প্রাগমেটিক বলে। সাধারণত যারা পুঁজিবাদী আদর্শ অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রাগমেটিক বা বাস্তবতানুরাগী হয়। কারণ পুঁজিবাদে সুনির্দিষ্ট কোন নীতি নেই, বরং বাস্তবতা থেকে আইন আসে বা বাস্তবতা হল আইনের উৎস। কিন্তু ইসলামে আইনের উৎস হল ইসলামী শরী’আহ-যা সুনির্দিষ্ট। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এই শরী’আহ পরিবর্তনীয় নয়। সেকারণে একজন মুসলিম বিভিন্ন বাস্তবতায় সঙ্গতিপূর্ণ অপরিবর্তনীয় শরী’আহ এর দলিল থেকে তার করণীয় নির্ধারণ করে। সে কখনওই বাস্তবতা থেকে তার করণীয় ঠিক করবে না। বাস্তবতা এখানে চিন্তা বা সিদ্ধান্তের উৎস নয়, বরং বিষয়বস্তুমাত্র। সে সঙ্গতিপূর্ন অপরিবর্তনীয় শরী’আহ থেকে বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য হুকুম গ্রহণ করবে। বিধায় একজন ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী প্রাগমেটিক হলেও মুসলিম কখনওই প্রাগমেটিক হতে পারে না। মুসলিম প্রাগমেটিক হলে সে হুকুম শরী’আহ ব্যবহার করে বাস্তবতা পরিবর্তন করতে পারবে না, বরং সেই বাস্তবতা অনুসারে নিজেই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। অনেকে এ আলোচনা শুনে মনে করতে পারেন তাহলে একজন মুসলিম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে কী বিবেচনায় রাখবে না? উত্তর হল, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই বাস্তবতাকে বিবেচনায় রাখতে হবে, কিন্তু বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না। বাস্তবতাকে বিবেচনায় না রাখলে সে কী করে বাস্তবতাকে পরিবর্তন করবে?

কুরআন এবং সুন্নাহতে এ বিষয়ে অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য রয়েছে। পবিত্র কুরআনে পূর্বের অনেক নবী রাসূলদের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ বর্ণণা করা হয়েছে। নিশ্চয় এগুলো থেকে উম্মাতে মোহাম্মদীর জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে। অন্যথায় এগুলো কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উল্লেখ করতেন না। আমরা দেখি সাইয়্যুদনা ইবরাহীম (আ) আল্লাহ’র নির্দেশে পরাক্রমশালী বাদশাহ নমরুদের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কিরূপ অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন একা। অনেকে তার এই একাকী অবস্থান নেয়াকে বাস্তবানুগ বা প্রাগম্যাটিক না ও বলতে পারেন। কিন্তু সাইয়্যুদনা ইবরাহীম (আ) আল্লাহ’র নির্দেশ পালনকে বাস্তবতার উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। একারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সাইয়্যুদনা ইবরাহীম (আ) কে নমরুদের ভয়ংকর অগ্নিকুন্ডের মধ্যে হেফাজত করেছিলেন এবং নমরুদকে নগন্য মশা দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সাইয়্যুদনা মুসা (আ) এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি পরাক্রমশালী ফেরাউনকে আল্লাহ’র একত্ববাদ বা তাওহীদের দিকে আহ্বান করেছিলেন। তখন শক্তির দিক থেকে মুসা (আ) ফেরাউনের সমকক্ষ ছিলেন না বলে প্রাগমেটিক লোকেরা তার এ আচরণকে ভুল ভাবতে পারেন। ফেরাউনের ভয়ে মুসা (আ)কে প্রায় দশ বছর নির্বাসনেও কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ’র রাস্তায় দৃঢ় থাকায় দিনশেষে আল্লাহ মুসা (আ) কে বিজয়ী করেছেন এবং অত্যাচারী ফেরাউনকে বিপর্যস্ত করেছেন। একই কথা আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা) এর ক্ষেত্রেও সত্য। মক্কায় অত্যন্ত প্রতিকূল একটি পরিবেশে রাসূলুল্লাহ (সা) এবং সাহাবী (রা) ইসলামের দাওয়াত বহন করেছেন। এক্ষেত্রে তারা অসম প্রতিদ্বন্দীতার মুখোমুখি হয়েছেন। মক্কার কাফেরদরে কর্তৃক মিথ্যা প্রপাগান্ডা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হত্যার বাস্তবতায় আপোসের প্রস্তাবে রাজী হয়ে তারা প্রাগমেটিক হননি। রাসূল (সা) এবং সাহাবীগন বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে একমাত্র শরী’আহ’র প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন। যার পরিণতিতে তারাই বিজয়ী হয়েছেন। কারণ বিজয় তো হুকুম প্রদানকারী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকেই আসে। আর তিনিই বাস্তবতাকে মুমিনদের অনুকূলে এনে দেন। তিনিই ভয়কে নিরাপত্তা ও সম্মান দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন।

এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) মি’রাজের ঘটনাটি প্রণিধানযোগ্য। মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞানে অসম্ভব একটি সফর ছিল ইসরা ও মিরাজ। রাসূল (সা) এমন একটি সময়ে মিরাজে গিয়েছিলেন যখন বিচক্ষণ স্ত্রী খাদিজাতুল কুবরা (রা) ইন্তেকাল করেছেন এবং আশ্রয় দানকারী চাচা আবু তালিবও ইইলোক ত্যাগ করেছিলেন। আর মক্কার পরিস্থিতি ছিল দারুণভাবে প্রতিকূল। এই ভয়ংকর প্রতিকূল পরিবেশে ইসরা ও মিরাজ থেকে ফিরে এসে রাসূল (সা) এ বিষয়টি আল্লাহ’র নির্দেশে মক্কাবাসীকে জানাতে চাচ্ছিলেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতত না জানানোর ব্যাপারে তার তৎকালীণ স্ত্রী পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু রাসূল (সা) প্রাগমেটিক না হয়ে আল্লাহ’র নির্দেশে তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু আবু জাহেলকে দিয়ে মিরাজের বিষয়টি প্রচার করা শুরু করলেন। কাফেরগণ ইসরা ও মিরাজের ঘটনাকে বাস্তবতাবিবর্জিত ও অসুস্থ মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা বলে প্রপাগান্ডার নতুন জাল বুনতে লাগল। এমতাবস্থায় একদিন কাবা’র সামনে কাফেররা রাসূল (সা)কে বায়তুল মাকদিস সর্ম্পকে বর্ণণা দিতে বলল। আল্লাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বায়তুল মাকদিসকে রাসূল (সা) এর সামনে এনে রাখল এবং তিনি (সা) দেখে দেখে কাফেরদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন এবং কাফেররা সেদিন নতশিরে অপমানিত হয়ে চলে গিয়েছিল। প্রাগমেটিক না হয়ে আল্লাহ’র নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করায় সেদিন রাসূল (সা) কাফেরদের ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে পেরেছিলেন।

বদর, খন্দক, তাবুক প্রভৃতি জিহাদের বিজয়ও অসম প্রতিদ্বন্দীতার মাধ্যমে এসেছিল। অর্থাৎ সেখানে কাফেরদের সংখ্যা, অস্ত্র ও আয়োজনের বিপরীতে মুসলিমদের সংখ্যা ও প্রস্তুতি ছিল অনুল্লেখযোগ্য। তারপরও বাস্তবতা নয়, তাওয়াক্কুল ও শরী’আহকে প্রাধান্য দেয়ায় আল্লাহ বিজয়ী করেছিলেন।

নবী-রাসূলদের এসব ঘটনা শুনার পর অনেক প্রাগমেটিক লোক এগুলো নবীদের মত বিশেষ মানুষ দ্বারা সম্ভব হিসেবে দেখতে পারে। এবং আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য এইরকম হুকুম মানা বাস্তবসম্মত নয় বলে যুক্তি দেখাতে পারে। কিন্তু আমরা দেখেছি রাসূল (সা) ওফাতের পর সাহাবী (রা), তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনগন এবং তৎপরবর্তী মুসলিমগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাগমেটিক ছিলেন না, বরং শরী’আহ’র অনুবর্তী ছিলেন। রাসূল (সা) এর ওফাতের পর আবু বকর (রা) যখন ধর্মত্যাগ, ভন্ডপীর, যাকাত অস্বীকারকারীদের উদ্ভব হয়েছিল তখন তিনি প্রাগমেটিক না হয়ে এদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। যদিও সেসময় উমর (রা) আবু বকর (রা) কে মদীনায় উম্মুল মুমিনীনদের অরক্ষিত রেখে বাইরে গিয়ে মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই উমর (রা) স্বীকার করেছিলেন যে, আবু বকর (রা) এর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ তিনি বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তাওয়াক্কুলের সাথে শরী’আহ মেনে করণীয় নির্ধারণ করেছিলেন।

ইসলামের ইতিহাসে তারপর অসংখ্য বিজয় এসেছে। মুসলিমগণ তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন বিজয় নিশ্চিত করেছিল সামান্য কিছু সৈনিক নিয়ে, মহাবীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী ক্রুসাডারদের বিশাল সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। তারা কেউই নবী ছিলেন না। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি একক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোভুক্ত আরও প্রায় ৪০টি দেশ নিয়ে বিগত ১৮ বছর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে পুরো আফগানিস্তান তালেবানমুক্ত করতে পারছে না। উল্টো তালেবানরা আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশ ভূমি এখনও দখল করে রেখেছে এবং আমেরিকা তাদের সাথে সমঝোতায় বসতে বাধ্য হচ্ছে। তালেবানদের নেই সুপ্রশিক্ষিত বাহিনী, আমেরিকার মত সর্বাধুনিক অস্ত্র-ভান্ডার, পারমাণবিক বোমা, যুদ্ধ জাহাজের বহর। তাহলে বাস্তবতার বিপরীতে গিয়ে কীভাবে এটি সম্ভব হচ্ছে?

তিরমিযী শরীফের একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

‘‘যখন কেউ আল্লাহকে অখুশী করে মানুষকে খুশী করে,তখন তাকে মানুষের মর্জির উপর ছেড়ে দেয়া হয়। আর যখন কেউ মানুষকে অখুশী করে আল্লাহকে খুশী করে,তখন তাকে মানুষের নির্ভরশীলতা থেকে (আল্লাহ) মুক্ত করে দেন।’’

সেকারণে ইসলাম বহন করার সময় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুন্নাহ’র বাইরে যাওয়া উচিত হবে না। যদি সুন্নাহ’র বাইরে যায় তবে তারা দুনিয়াতে হবে লাঞ্চিত এবং আখেরাতে পাবে মর্মন্তুদ শাস্তি। আর একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে কুরআন এবং সুন্নাহতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর উপর যে আদেশসমূহ আমভাবে এসেছে সেগুলো মুসলিম হিসেবে আমরা সবাই মানতে বাধ্য। এক্ষেত্রে নবী কি নবী না, সাহাবী কী সাহাবী না, এটি বিবেচ্য বিষয় নয়।

“বল,যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস,তাহলে আমার অনুসরণ কর,আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।”(সূরা আল ইমরান:৩১)

“‘রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর,আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন-তা থেকে বিরত হও।”(সূরা হাশর:৭)  

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply