প্রয়োজন ও তা পূরণের উপায়সমূহ মিশ্রিতকরণ

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনীতি মূলতঃ মানুষের প্রয়োজন ও তা পূরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করে। সেকারণে প্রয়োজন পূরণের উপায় হিসেবে পণ্য ও সেবার উৎপাদন এবং পণ্য ও সেবার বন্টন তাদের দৃষ্টিতে একই বিষয়। প্রয়োজন ও তা পূরণের উপায় পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত ও এমনভাবে অবিচ্ছেদ্য যে একটি আরেকটি মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে বিধায় এগুলো একই বিষয়। ফলে পণ্য ও সেবার উৎপাদনের মধ্যে পণ্য ও সেবার বন্টন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। এর উপর ভিত্তি করে তারা অর্থনীতিকে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে যেখানে অর্থনৈতিক পণ্য ও পণ্যের মালিকানা লাভ করার পদ্ধতিকে কোনরূপ পার্থক্য করা ছাড়া এক করে দেখা হয়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা ছাড়া তারা এক করে দেখে। তবে অর্থনৈতিক বিজ্ঞান ও ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বনাম অর্থনৈতিক বিজ্ঞান

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হল তাই যা কীভাবে সম্পদের বন্টন হবে, কীভাবে এর মালিকানা লাভ করা যাবে, কীভাবে ব্যয় ও হস্তান্তর করা হবে তা নির্ধারণ করে। এসব বিষয় নির্ধারণ করা হয় জীবন সম্পর্কে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা আদর্শ অনুসরণ করে। সুতরাং ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজতন্ত্র/কম্যুনিজম এবং পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণআলাদা। কারণ এ ব্যবস্থাগুলোর প্রত্যেকটি জীবন সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে।

অর্থনৈতিক বিজ্ঞান উৎপাদন, এর উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও এর উপকরণের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করে। অন্যান্য বিজ্ঞানের মত অর্থনৈতিক বিজ্ঞান সব জাতির জন্য সার্বজনীন এবং কোন আদর্শের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুঁজিবাদে মালিকানার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজতন্ত্র/কম্যুনিজম ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলাদা। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি করার আলোচনা একটি পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক ইস্যু এবং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সর্ম্পকহীন ও সব লোকের জন্য সমান। মানুষের প্রয়োজন এবং তা পূরণ করার বিষয় অধ্যয়ন – একটি বিষয় হিসেবে অর্ন্তভুক্তি অর্থাৎ অর্থনৈতিক পণ্য উৎপাদন করা ও তা বন্টনের ধরণকে এক বিষয় ও ইস্যু হিসেবে দেখা ভুল। যার ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির অধ্যয়নে মিশ্রণ ও বিঘড়ব সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভিত্তিই ভুল।

মানুষের প্রয়োজন কেবলই বস্তুগত

যেসব প্রয়োজন পূরণ করতে হয় সেগুলো সব কেবলই বস্তুগত – এটি ঠিক নয় এবং প্রয়োজনের বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক। বস্তুগত প্রয়োজন ছাড়াও মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চাহিদা রয়েছে এবং এগুলো পূরণ হওয়া দরকার এবং এগুলোর প্রত্যেকটির পূরণের জন্য পণ্য ও সেবা প্রয়োজন।

পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদেরা সমাজ কিরকম হওয়া উচিত সে দিকে দৃষ্টি না দিয়ে প্রয়োজন ও উপযোগ যেমন সেগুলোকে তেমনভাবেই দেখেছে, অর্থাৎ তারা মানুষকে আধ্যাত্মিক চাহিদা, নীতি চিন্তা বিবর্জিত ও নৈতিক উদ্দেশ্য শূন্য একটি বস্তুগত প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করেছে। একইভাবে নৈতিকতার উৎকর্ষতার ভিত্তিতে সমাজ কীভাবে গঠিত হয়, ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে সামাজিক সম্পর্কগুলো কীভাবে নিরূপিত হয় অথবা সমাজে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা অর্থাৎ আল্লাহ্’র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সব সম্পর্কের পেছনে মানুষের সাথে আল্লাহ্’র সম্পর্ক উপলব্ধিকে চালিকা শক্তি হিসেবে কীভাবে থাকা উচিত সে ব্যাপারে তারা পরোয়া করে না। বস্তুগত চাহিদা পূরণ করার জন্য তার লক্ষ্যও পুরোপুরি বস্তুগত হওয়ায় পুঁজিবাদীরা এসবকে পরোয়া করে না। তার ব্যবসায় যদি লাভ হয় তাহলে সে প্রতারণা করে না, আর প্রতারণা করে যদি লাভ করা যায় তাহলে তার জন্য সেটি বৈধ। স্রষ্টার নির্দেশ মোতাবেক দান করার জন্য সে দরিদ্র মানুষকে খাওয়ায় না, বরং দরিদ্র লোক যাতে তার কাছ থেকে চুরি না করে সে জন্য তাদের খাওয়ায়। যদি দরিদ্র মানুষকে না খাওয়ালে তার সম্পদ বৃদ্ধি পায় তবে সে তাই করবে। সুতরাং পুঁজিবাদীদের প্রধান উদ্বেগ হল কেবলমাত্র বস্তুগত প্রয়োজন পূরণ করে যে লাভ – সেদিকে লক্ষ্য রাখা। ব্যক্তি তার নিজের লাভের ভিত্তিতে অন্যের দিকে তাকায় এবং এর ভিত্তিতে অর্থনৈতিক জীবন প্রতিষ্ঠা করে এবং এরূপ লোক সমাজ ও জনগণের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি।

এটি হল প্রয়োজন ও উপযোগের আলোকে আলোচনা। সম্পদ ও শ্রমের নিরীখে অর্থাৎ যেগুলোকে পণ্য ও সেবা বলা হয় সেগুলোকে পাওয়ার জন্য ব্যক্তি প্রচেষ্টা চালায় যাতে করে উপযোগ পাওয়া যায়। সম্পদ ও শ্রমের বিনিময়ের কারণে লোকদের মধ্যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয় এবং এর উপর ভিত্তি করে গঠিত হয় সামাজ কাঠামো। সুতরাং সম্পদ ও শ্রমকে মূল্যায়ন করার সময় সমাজের কাঠামো কীরকম হওয়া উচিত তা সাধারণ ও বিস্তারিত উভয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা অপরিহার্য।

সমাজ কীরকম হওয়া উচিত সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে প্রয়োজন পূরণ করার জন্য অর্থনৈতিক পণ্যের দিকে কেবল দৃষ্টি নিবদ্ধ করা অর্থনৈতিক পণ্যকে সমাজ বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কহীন করার নামান্তর – যা অস্বাভাবিক। এই অর্থনৈতিক পণ্য লোকদের মধ্যে বিনিময় হয়, ফলে তাদের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় এবং সমাজ থেকেও সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। সুতরাং অর্থনৈতিক পণ্যকে বিবেচনা করার সময় সমাজের উপর এর প্রভাব উপলব্ধি করা উচিত। কেউ পছন্দ করে বলে একটি পণ্যকে সমাজের উপযোগী বলে বিবেচনা করা ঠিক নয় – হতে পারে এটি নিজেই ক্ষতিকারক অথবা ক্ষতিকারক নয়, এটি মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে প্রভাবিত করে অথবা করে না, সমাজের লোকদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে এটি অনুমোদিত অথবা নিষিদ্ধ। বরং একটি পণ্যকে তখনই উপযোগী বলা উচিত যখন এর থেকে সমাজ যে রকম হওয়া উচিত তার ভিত্তিতে সত্যিকার অর্থে সমাজ উপকৃত হয়। সুতরাং ক্যানাবিস, আফিম ও এজাতীয় তথাকথিত পণ্যকে উপযোগী বিবেচনা করা ও কেউ এগুলো চায় বলে সেগুলোকে অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক হবে না। তার বদলে যখন কোন অর্থনৈতিক পণ্যকে উপযোগী বিবেচনা করা হবে তখন সমাজের লোকদের সম্পর্কের উপর এর প্রভাব বিবেচনা করতে হবে, অর্থাৎ এর ভিত্তিতে পণ্যটিকে আমরা অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করব অথবা করব না। সমাজ যে রকম হওয়া উচিত এর ভিত্তিতে জিনিসসমূহকে দেখা উচিত। সমাজ কীরকম হওয়া উচিত তা বিবেচনায় না এনে পণ্যটিকে খোলা চোখে যেরকম মনে হয়, সেরকম মনে করা ভুল।

প্রয়োজন পূরণ করার বিষয়টি প্রয়োজন পূরণের উপকরণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে এবং অন্য কিছু বিবেচনায় না এনে প্রয়োজন পূরণের উপকরণকে প্রয়োজন পূরণের একমাত্র অবলম্বন মনে করে অর্থনীতিবিদেরা সম্পদের বন্টনের চেয়ে সম্পদ সৃষ্টি করার দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদ বন্টন করার গুরুত্ব এখানে গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটিই লক্ষ্য এবং সেটি হল সামগ্রিকভাবে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা এবং এটি সর্বোচ্চ পরিমাণের উৎপাদন অর্জন করার জন্য কাজ করে। এটি বিবেচনা করে যে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি করে জাতীয় আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং উৎপাদন ও মালিকানা লাভ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন হওয়ায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে সম্পদ অর্জন করার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়ে সমাজের সদস্যদের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। সুতরাং ব্যক্তির চাহিদা পূরণ করা বা একটি সম্প্রদায়ের প্রত্যেক ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানো সহজতর করার জন্য অর্থনীতি নয়, বরং যা ব্যক্তির প্রয়োজন মেটায় তা বৃদ্ধির দিকে এটি অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্প্রদায়ের প্রয়োজন পূরণ করাই এর লক্ষ্য। মালিকানা লাভ করা ও কাজ স্বাধীনতার দ্বারা জাতীয় আয়ের সুপ্রাপ্যতার মাধ্যমে সমাজের সদস্যদের মধ্যে আয়ের বন্টন নিশ্চিত হয়। সম্পদ অর্জন করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির উৎপাদনের সামর্থ অনুসারে এটি তার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে – হোক এর মাধ্যমে সব ব্যক্তি কিংবা কেবল কিছু ব্যক্তি সন্তুষ্ট থাকে।

এটি হল রাজনৈতিক অর্থনীতি অর্থাৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতি। এটি একটি প্রকাশ্য ভ্রান্তি এবং বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক। এটি সব ব্যক্তির জীবনমান উন্নত করার জন্য কাজ করে না এবং প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক কল্যাণ নিশ্চিত করে না। এ দৃষ্টিভঙ্গির ভুল দিকটি হল যে, যেসব প্রয়োজন মেটানোর কথা বলা হয় সেগুলো হল ব্যক্তির প্রয়োজন। এগুলো হল মানুষের প্রয়োজন। সুতরাং এগুলো হল মুহাম্মদ, সালিহ ও হাসানের প্রয়োজন, এ প্রয়োজন কোন ব্যক্তি সমষ্টি, কিছু জাতির বা একটি জনসমষ্টির নয়। সুতরাং ব্যক্তি নিজেই তার প্রয়োজন পূরণের জন্য কাজ করবে – হোক সে এটি সরাসরি পূরণ করে, যেমন: খাওয়া দাওয়া অথবা সে পুরো জনসমষ্টির চাহিদা পূরণ করার মাধ্যমে এটি করে থাকে, যেমন: একটি জাতির প্রতিরক্ষা । সুতরাং ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের উপকরণ বন্টনের মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যা নিহিত রয়েছে অর্থাৎ জাতির মধ্যে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির কথা বিবেচনা না করে জাতি বা লোকদের যা প্রয়োজন তা পূরণ করার মধ্যে নয়, বরং জাতির সদস্য ও লোকদের কাছে তহবিল ও উপযোগ বন্টন করার মধ্যে। অন্য কথায় সমস্যা হল ব্যক্তির দরিদ্রতা কিন্তু জাতির নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল বিষয় হতে হবে, কখনই অর্থনৈতিক পণ্য উৎপাদনের আলোচনা করা নয়।

ফলে জাতীয় উৎপাদনের আকারকে প্রভাবিত করে এমন নিয়ামকসমূহের অধ্যয়ন অবশ্যই প্রত্যেক ব্যক্তির আলাদা আলাদাভাবে ও সম্পূর্ণরূপে সব মৌলিক প্রয়োজন পূরণের অধ্যয়ন থেকে আলাদা। একজন ব্যক্তির সব মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমাজের সদস্যদের মধ্যে সম্পদের বন্টনের আলোচনা অধ্যয়নের বিষয় হতে হবে। এটিই গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত এবং প্রম থেকেই এটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাছাড়া একটি দেশের দরিদ্রতা বিমোচনের প্রচেষ্টা ব্যক্তিগতভাবে একজন ব্যক্তির দরিদ্রতা নিরসন করে না। বরং ব্যক্তির দরিদ্রতা নিরসনের জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ এবং পদক্ষেপগুলোর মধ্যে দেশের সম্পদ বন্টনের কর্মসূচী দেশের লোকদের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। উৎপাদনের পরিমাণ ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে এমন নিয়ামকসমূহের গবেষণা অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে আলোচনা করা উচিত অর্থাৎ প্রয়োজন পূরণের আলোচনায় নয় বরং অর্থনেতিক পণ্য এবং এর বৃদ্ধির আলোচনায় এটি স্থান পাবে। কেননা প্রয়োজন পূরণের বিষয়টি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আলোচিত হবে।

পুঁজিবাদীরা দাবি করে যে কোন একটি সমাজ অর্থনৈতিকভাবে যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হল পণ্য ও সেবার অভাব। তারা আরও দাবি করে যে, চাহিদা অবিরতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে এবং এগুলোকে পূরণ করার অক্ষমতা অর্থাৎ মানুষের সব প্রয়োজন পুরোপুরি পূরণ করার জন্য পণ্য ও সেবার অপর্যাপ্ততাই হল অর্থনৈতিক সমস্যার ভিত্তি। এ দৃষ্টিভঙ্গি ত্রুটিপূর্ণ ও বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক। এর কারণ হল একজন মানুষের ব্যক্তি হিসেবে তার মৌলিক প্রয়োজন (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান) পূরণ হতে হবে, কিন্তু বিলাস সামগ্রী নয় – যদিও এগুলোও মানুষ চায়। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন সীমিত এবং পৃথিবীতে বর্তমান যেসব সম্পদ ও প্রচেষ্টাকে তারা পণ্য ও সেবা হিসেবে অভিহিত করে থাকে সেসব অবশ্যই সব মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য পর্যাপ্ত, মানবজাতির সব মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব। মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা নিয়ে কোন সমস্যা নেই যদি না সেটিকে সমাজের জন্য অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাস্তবে অর্থনৈতিক সমস্যা হল ব্যক্তির সব মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য এইসব সম্পদ ও প্রচেষ্টাসমূহের বন্টন এবং এরপর তাদেরকে বিলাস সামগ্রী অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে সাহায্য করা।

অবিরতভাবে প্রয়োজন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বলা যায় এটি মৌলিক প্রয়োজন বৃদ্ধির সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নয়। কারণ মানুষ হিসেবে কোন ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন বাড়ে না। অন্যদিকে বিলাস সামগ্রীর চাহিদা বাড়ে ও পরিবর্তিত হয়। শহুরে জীবনে উন্নতির সাথে চাহিদার বৃদ্ধি মৌলিক প্রয়োজনের সাথে বিজড়িত নয় বরং বিলাস সামগ্রীর সাথে জড়িত। মানুষ বিলাস সামগ্রী অর্জনের জন্য কাজ করে, কিন্তু এগুলো পূরণ না হলে সমস্যার সৃষ্টি হয় না। যা সমস্যার সৃষ্টি করে তা হল মৌলিক অধিকার পূরণ না হওয়া। এসব কিছুর পাশাপাশি বিলাস সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধির প্রশ্নটি কেবলমাত্র কিছু লোকের সাথে জড়িত যারা একটি নির্দিষ্ট দেশে বাস

করে এবং এ প্রশ্নটি দেশের সব ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত নয়। মানুষের মধ্যে প্রয়োজন পূরণের স্বাভাবিক প্রবণতার মাধ্যমে এ প্রশ্নটির সমাধান হয়। বিলাস সামগ্রী অর্জনের প্রবল আকাঙ্খার ফলে মানুষ তার দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করে, অন্য দেশে কাজ করে অথবা অন্য দেশের সাথে একীভূতকরণ বা প্রসারণের মাধ্যমে এগুলো পূরণের জন্য ধাবিত হয়। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পুরোপুরি পূরণের ইস্যুটির চেয়ে এটি আলাদা। এর কারণ হল প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা ও বিলাস সামগ্রীর চাহিদা পূরণ করার জন্য সম্পদ বন্টন করার সমস্যাটি জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পর্কযুক্ত যা বিশেষ আদর্শ বহনকারী কোন বিশেষ জাতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় আয় বৃদ্ধির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, বিদেশ গমন, রাষ্ট্রের সীমানা বর্ধন অথবা অন্য দেশের সাথে একীভূত হওয়া ইত্যাদি জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করে। দেশের সম্পদ বৃদ্ধি কোন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ বা জাতির সম্পর্কিত নয়, বরং তা বাস্তবভিত্তিক সমাধানের উপর নির্ভরশীল।

সুতরাং এমন অর্থনৈতিক মূলনীতি প্রণয়ন করতে হবে যেগুলো জাতির প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সম্পদের বন্টন নিশ্চিত করবে – যাতে করে প্রত্যেকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হয় এবং অতঃপর প্রত্যেককে বিলাস সামগ্রী অর্জনের জন্য সামর্থ্যবান করে তোলা যায়। তবে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এর আলোচনা অর্থনৈতিক সমস্যাটির সমাধান করে না – যা হল প্রত্যেক ব্যক্তির চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করা। উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি দেশের সম্পদ বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায় কিন্তু কার্যকরভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করে না। দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারে, যেমন: ইরাক ও সৌদি আরব, কিন্ত তাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হয়নি। সুতরাং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি প্রত্যেক ব্যক্তির সবার আগে ও সর্বপ্রম বিবেচনা করতে হয় এমন মৌলিক সমস্যার সমাধান করে না অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পুরোপুরি পূরণ করা ও অতঃপর তাদেরকে বিলাস সামগ্রী অর্জনের জন্য সামর্থ্যবান করে তোলার সাথে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সম্পর্ক নেই। সুতরাং দরিদ্রতা ও বঞ্চনা মানুষ হিসেবে মৌলিক অধিকার পূরণ না হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে, কিন্তু কখনই নগরায়নের কারণে ক্রমবর্ধমান বিলাস সামগ্রীর চাহিদার কারণে নয়। সুতরাং সমাজের প্রত্যেকের দরিদ্রতা ও বঞ্চনাকেই বঞ্চনা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে হিসেব করা দেশের দরিদ্রতা বঞ্চনা সমস্যা নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির দরিদ্রতা ও বঞ্চনা বিবেচনা করার দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমবর্ধমান জাতীয় আয় বৃদ্ধি দ্বারা নিরূপিত হয় না, বরং এটিকে এমনভাবে বিবেচনা করা হয় যাতে মৌলিক অধিকার পুরোপুরি পূরণ করার জন্য সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সম্পদ বন্টিত হয় এবং তারপর প্রত্যেককে বিলাস সামগ্রী অর্জনের জন্য সামর্থ্যবান করে তোলা যায়।

পুঁজিবাদ মূল্যকে প্রকৃত নয়, বরং আপেক্ষিক হিসেবে বিবেচনা করে, এবং এটি একটি অনুমান ভিত্তিক পরিমাপ হিসেবে পরিগণিত হয়। বাজারে সুপ্রাপ্যতার ভিত্তিতে এক হাত কাপড়ের মূল্য হল তা থেকে প্রাপ্ত প্রান্তিক উপযোগিতা। এর মূল্য বলতে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা এর জন্য বিনিম করা যাবে তাও বুঝায়। এক হাত কাপড়ের বিনিময় হিসেবে যদি অর্থ পাওয়া যায় তাহলে তা ‘দাম’ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের দৃষ্টিতে এ দু’টি মূল্য স্বতন্ত্র, এবং এগুলোর আলাদা নাম রয়েছে: উপযোগিতা এবং বিনিময়ের মূল্য। এ সংজ্ঞা অনুসারে মূল্যের এই অর্থ ভুল। কারণ কোন পণ্যের মূল্য হল পণ্যটির দুষ্প্রাপ্যতা সাপেক্ষে ঐ পণ্যের মধ্যে থাকা উপযোগিতার পরিমাণ। সুতরাং একটি পণ্যের জন্য সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গী হল এর দুষ্প্রাপ্যতাকে বিবেচনা করে এর মধ্যে থাকা উপযোগিতা পর্যবেক্ষণ করা, তা এই পণ্যটি শুরু থেকেই কোন ব্যক্তির মালিকানায় শিকারের মাধ্যমেই আসুক অথবা বেচাকেনার মাধ্যমেই আসুক অথবা এটি ব্যক্তি সম্পর্কিত হোক অথবা কোন জিনিষ সম্পর্কিত হোক। সুতরাং মূল্য এমন একটি সুনির্ধারিত বিষয়ের নাম যার সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা রয়েছে এবং এটি কোন আপেক্ষিক বিষয় নয় যা কোন ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়, অন্যক্ষেত্রে নয়। সুতরাং মূল্য একটি বাস্তব পরিমাপ, আপেক্ষিক নয় সুতরাং অর্থনীতিবিদদের মূল্য সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গী তা এর ভিত্তি থেকেই ভুল।

প্রান্তিক উপযোগিতা বা মূল্য বলতে মূল্যর এমন একটি হিসাব বা অনুমানকে বুঝায় যা পণ্য বন্টনের নিকৃষ্টতম পরিস্থিতিতে উৎপাদন পরিচালনার অভিপ্রায়ে প্রাক্কলিত। ফলতঃ একটি পণ্যের মূল্য হিসাব করা হয় সর্বনিম্ন সীমার উপর ভিত্তি করে যাতে উৎপাদন সুনিশ্চিতভাবে চলতে থাকে। প্রান্তিক উপযোগিতা একটি পণ্যের প্রকৃত মূল্য নয় অথবা এমনকি পণ্যের দামও নয়। কেননা পণ্যের দুষ্প্রাপ্যতাকে বিবেচনায় এনে হিসাব করার সময় এর মধ্যে থাকা উপযোগিতাই হল এর মূল্য। এর মূল্য কমবে না যখন পরবর্তীতে এর দাম পড়ে যায় এবং বৃদ্ধি পাবে না যদি এর দাম বেড়ে যায়। কারণ মূল্যায়ন করার সময় এর মূল্য বিবেচনা করা হয়েছে। সুতরাং প্রান্তিক উপযোগিতা তত্ত্ব মূল্য সম্পর্কিত কিছু নয়, ববং এটি দামের সাথে সংশ্লিষ্ট। এমনকি পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতেও দাম ও মূল্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দামের হিসাবকে যা পরিচালনা করে তা হল চাহিদার প্রাচূর্যতার সাথে সরবরাহের ঘাটতি অথবা সরবরাহের প্রাচূর্যতার সাথে চাহিদার ঘাটতি। এগুলো একটি পণ্যের উৎপাদনের পরিমাণের সাথে সম্পর্কযুক্ত, বন্টনের সাথে নয়। বরং মূল্য, মূল্যায়নের সময় পণ্যের মধ্যে থাকা মোট উপযোগিতার পরিমাণ যা পণ্যের দুষ্প্রাপ্যতাকে মাথায় রেখে পরিমাপ করা হয় যদিও তা পণ্যের মূল্য নির্ধারণের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সুতরাং সরবরাহ ও চাহিদা মূল্যকে প্রভাবিত করে না।

সুতরাং, মূল্যের বিষয়টি এর গোড়া থেকেই ভুল। সে কারণে ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা যে কোন কিছু ভুল হতে বাধ্য। যদি শ্রম কিংবা অন্য কোন পণ্য হতে প্রাপ্ত সুবিধা মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিয়ে পণ্যের মধ্যে উপস্থিত সুবিধাকে পরিমাপ করা হয় তবে সে মূল্যায়নটি সঠিক হবে এবং স্বল্পমেয়াদে অনেক বেশী স্থিতিশীলতা প্রদান করবে। যদি মূল্য দামের ভিত্তিতে পরিমাপ করা হয় তাহলে মূল্যায়ন প্রকৃত হবে না, আপেক্ষিক হবে। এবং বাজার অনুসারে এটি সর্বদা পরিবর্তিত হতে থাকবে। এক্ষেত্রে এটিকে মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক হবে না বিধায় মূল্য শব্দটি এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সমীচীন নয়। কারণ সেক্ষেত্রে এটি পণ্যের গুণাগুণ অনুযায়ী নয় বরং বাজার অনুযায়ী টাকা কামানোর মাধ্যমে পরিণত হবে।

পুঁজিবাদীরা বলে মানুষ যে শ্রম ব্যয় করে তার ফলাফল হিসেবে উপযোগ পাওয়া যায়। সুতরাং পুরষ্কার যদি কাজের অনুরূপ না হয় তাহলে নিঃসন্দেহে উৎপাদন নিম্নমুখী হবে এবং তারা এটি থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, সমাজের সদস্যদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের আদর্শিক পদ্ধতি হল তাই যা সর্বোচ্চ পরিমাণের উৎপাদনকে সুনিশ্চিত করে। এ পদ্ধতি পুরোপুরি ভুল। কেননা বাস্তবে যেসব সম্পদ স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন সেগুলোই পণ্যের মধ্যে থাকা উপযোগের ভিত্তি। এবং এসব সম্পদের উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ব্যয়কৃত খরচ অথবা নতুন একটি উপযোগের সুত্রপাত করতে এর সাথে যোগকৃত শ্রম একটি বিশেষ উপযোগের যোগান দেয়। সুতরাং উপযোগকে কেবলমাত্র শ্রমের ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করা পুরোপুরি ভুল। কেননা এটি কাঁচামাল ও অন্যান্য ব্যয়কে উপেক্ষা করে। কিছুক্ষেত্রে এ খরচ কাঁচামালের জন্য ক্ষতিপূরণস্বরূপ, কোনভাবেই শ্রমের জন্য নয়। সুতরাং উপযোগ মানুষের শ্রমের ফলাফল হিসেবে আসতে পারে অথবা কাঁচামালের জন্যও আসতে পারে অথবা উভয়ের ফলাফল হিসেবে আসতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র মানুষের শ্রমের ফলাফল হিসেবে নয়।

কেবলমাত্র কাজের পুরষ্কার হ্রাস পেলেই উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায় না, বরং দেশ থেকে সম্পদ ক্রমাগত উজাড় হতে থাকলে, যুদ্ধ বা অন্য কোন কারণে উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বৃটেন ও ফ্রান্সের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণ কাজের পুরষ্কার কমে যাওয়ায় নয়, বরং ঐশ্বর্যপূর্ণ উপনিবেশগুলোর উপর তাদের প্রভাব সংকুচিত হওয়ায় এবং যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের কারণে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণ কাজের পুরষ্কার কমে যাওয়ায় নয়, বরং জার্মানীর সাথে তাদের যুদ্ধের কারণে। ইসলামী বিশ্বে আজকে উৎপাদনের যে হ্রাস ঘটেছে সেটিও কাজের পুরষ্কার কমে যাওয়ায় নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তিক অধঃপতনের কারণে যাতে গোটা উম্মাহ্ নিপতিত। সুতরাং কাজের পুরষ্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ততাই উৎপাদন হ্রাসের একমাত্র কারণ নয় এবং এই ভিত্তিতে চিন্তা করাও ভুল যে, বন্টনের আদর্শিক পদ্ধতি হল উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। উৎপাদনের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্জনের সাথে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সম্পদ বন্টনের কোন সম্পর্ক নেই।

পুঁজিবাদীরা বলে দাম উৎপাদনের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে এবং একজন ব্যক্তির শ্রম ব্যয় করার লক্ষ্যই হল বস্তুগতভাবে পুরষ্কৃত হওয়া। এ দৃষ্টিভঙ্গী ভুল এবং বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক। মানুষ অনেক সময় নৈতিক পুরষ্কার পাওয়ার জন্য শ্রম ব্যয় করে, যেমন স্রষ্টার কাছ থেকে পুরষ্কার পাওয়ার জন্য অথবা কোন নৈতিক যোগ্যতা অর্জনের জন্য, যেমন: কারও অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেয়া। মানুষের চাহিদা বস্তুগত হতে পারে, যেমন: বস্তুগত লাভ; এটি আধ্যাত্মিকও হতে পারে, যেমন: মুক্তি লাভ করা; অথবা নৈতিক, যেমন: প্রশংসা করা। সুতরাং কেবলমাত্র বস্তুগত চাহিদাকে বিবেচনা করা ভুল। বাস্তবে একজন ব্যক্তি তার বস্তুগত চাহিদা পূরণের চেয়ে আধ্যাত্মিক বা নৈতিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে অনেক উদারভাবে ব্যয় করতে পারে। সুতরাং দামই উৎপাদনের একমাত্র প্রণোদনা নয়। একজন রাজমিস্ত্রী মাসের পর মাস পাথর কেটে মসজিদ বানানোর জন্য আত্মনিয়োগ করতে পারে, একটি কারখানা কিছুদিনের উৎপাদন দরিদ্রদের মধ্যে বন্টনের জন্য বরাদ্দ করতে পারে এবং একটি জাতি কিছু অথবা সব প্রচেষ্টা তার ভূমিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ব্যয় করতে পারে। এ ধরনের উৎপাদন দাম দ্বারা প্রণোদিত নয়। তাছাড়া বস্তুগত পুরষ্কার কেবলমাত্র দামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি অন্য পণ্য ও সেবার মাধ্যমেও আসতে পারে। সুতরাং দামকে উৎপাদনের একমাত্র প্রণোদনা বিবেচনা করা ভুল।

পুঁজিবাদের একটি বড় অনিয়ম হল দামকে সমাজের লোকদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের জন্য একমাত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিবেচনা করা। তারা বলে দাম হল একমাত্র প্রতিবন্ধকতা যা ভোক্তাকে তার আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোন কিছুর মালিকানা লাভ ও সে অনুসারে ব্যয় করতে বাধ্য করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার আয় যতটুকু অনুমোদন করে ঠিক ততটুকুর মধ্যে ব্যয়কে সীমিত রাখে। একইভাবে কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও অন্য কিছুর দাম হ্রাসের মাধ্যমে এবং কিছু লোকের হাতে অর্থের সুলভতা ও অন্য কিছু লোকের হাতে এর দুষ্প্রাপ্যতার কারণে দাম ভোক্তাদের মধ্যে সম্পদের বন্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি যে পরিমাণ সম্পদের অংশীদার হয় তা তার মৌলিক চাহিদার সমপরিমাণ নয়, বরং পণ্য বা সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে তার যতটুকু অবদান রয়েছে অর্থাৎ ভূমি বা মূলধনের ক্ষেত্রে সে যতটুকুর মালিক সে পরিমাণ অথবা সে কাজের বা প্রজেক্টের যতটুকু করেছে সে পরিমাণ।

এ মূলনীতি থেকে অর্থাৎ দাম বন্টনের নিয়ন্ত্রক থেকে বলা যায় যে, পুঁজিবাদ কার্যকরভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মানুষ একটি সুন্দর জীবন পাবে না যদি সে পণ্য ও সেবা উৎপাদনে অবদান রাখতে সামর্থবান না হতে পারে। যে ব্যক্তি অবদান রাখতে অক্ষম অর্থাৎ সে যদি জন্মসূত্রে শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম থাকে তাহলে সে জীবন পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না এবং তার চাহিদা পূরণের জন্য সম্পদ নেয়ার ক্ষেত্রেও তার যোগ্যতা নেই। তাছাড়া যে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে জন্ম লাভ করেছে এবং সে তার ইচ্ছেমত সম্পদ সৃষ্টি ও মালিকানা লাভ করতে সমর্থ্য। এ ধরনের লোক বিলাসী জীবনযাপনের মাধ্যমে খরচ করার যোগ্য এবং তার সম্পদ দ্বারা অন্যদের উপর নিয়ন্ত্রণ ও প্রভূত্ব করার যোগ্যতা রাখে। তাছাড়া বস্তুগত লাভ খোঁজার ক্ষেত্রে যে ব্যক্তির প্রণোদনা বেশী সে ব্যক্তি সম্পদের মালিকানা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যদের ছাড়িয়ে যাবে, আর অন্যদিকে যার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি (উপার্জনের সময় যেগুলো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে) ঝোঁক বেশী শক্তিশালী তার মালিকানা অর্জন বা সম্পদ অর্জন অন্যদের তুলনায় কম হবে। এ প্রক্রিয়া জীবন থেকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নিয়ামক সমূহকে বাদ দিয়েছে এবং বস্তুগত চাহিদা পূরণের বিভিন্ন উপায় অনুসন্ধানে লালায়িত বস্তুগত সংগ্রামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এক জীবন তৈরি করেছে। পুঁজিবাদ প্রয়োগকারী প্রতিটি দেশে ক্রমাগত এটাই ঘটেছে। যেসব দেশ পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছে সেসব দেশে ভোক্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন উৎপাদক পুঁজিপতিদের একচেটিয়া আধিপত্য গড়ে উঠেছে। জনগণের ছোট্ট একটি অংশ, বড় তেল কোম্পানী, স্বয়ক্রিয় যান, ভারী শিল্প করপোরেশনের মালিক হওয়ায় তারা যা উৎপাদন করে সেসবের উপর যথেচ্ছভাবে একটি দাম বসিয়ে তারা ভোক্তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। যা একটি জোড়াতালি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করে। জাতীয় অর্থনীতিকে রক্ষা, ভোক্তাদের রক্ষা এবং কিছু পণ্যের ব্যবহারকে হ্রাস করা এবং একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের কর্তৃত্ব সীমিত করার জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষমতা দিয়ে তারা এটি করে থাকে। সরকার পরিচালিত কিছু গণ প্রকল্পকেও তারা এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করে থাকে। এসব হস্তক্ষেপ তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার (অর্থনৈতিক স্বাধীনতা) সাথে সাংঘর্ষিক এবং এগুলো কেবলমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। অনেক (রক্ষণশীল) পুঁজিবাদী এ হস্তক্ষেপ নীতি গ্রহণ করে না এবং তারা একে প্রশ্নবিদ্ধ করে ও প্রচার করে যে, সরকারি কোন হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে দামের কলাকৌশলই কেবল উৎপাদক ও ভোক্তার স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে যথেষ্ট। হস্তক্ষেপের সমর্থকরা (উদারপন্থীরা) ধরনের জোড়াতালি দেয়া সমাধানের ব্যাপারে সুপারিশ করেছে যা বিশেষ পরিস্থিতিতে ও অবস্থাতে প্রয়োগ করা হয়। এমনকি এসব পরিস্থিতিতেও প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সম্পদের বন্টন প্রত্যেকের সব মৌলিক চাহিদাকে পরিপূর্ণভাবে পূরণ করতে পারে না।

মালিকানার স্বাধীনতার ধারণা এবং দামকে সম্পদ বন্টনের একমাত্র কলাকৌশল হিসেবে বিবেচনা করার ধারণার কারণে পণ্য ও সেবার খারাপ বন্টন হয় এবং এ চিত্র পুঁজিবাদ প্রয়োগ হয় এমন সব সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে। আমেরিকান সমাজের ক্ষেত্রে অনেক আমেরিকানদের তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও এমনকি বিলাস সামগ্রী অর্জনের জন্য দেশের সম্পদে যথেষ্ট শেয়ার রয়েছে। এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সে দেশের ব্যাপক সম্পদের কারণে, যা সে দেশের প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও বিলাসী সামগ্রী অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে এটি একজন ব্যক্তি উৎপাদনে যতটুকু শ্রম দিতে পারছে তার মূল্যের সমপরিমাণ শেয়ারের কারণে হচ্ছে এরূপ বলা যাবে না। তাছাড়া দামের কৌশলকে বন্টনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে নির্ধারণের কারণে পশ্চিমা পুঁজিপতি একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা অন্য দেশের নতুন বাজার খুঁজতে প্রণোদিত হয়, যেখান থেকে তারা কাঁচামাল সংগ্রহ করে ও উৎপাদিত পণ্য বিμয় করে। উপনিবেশবাদ, আঞ্চলিক কর্তৃত্ব, অর্থনৈতিক দখলদারিত্ব থেকে উদ্ভুত সমস্যাগুলো একচেটিয়া ব্যবসা ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে দামকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এ ভিত্তিতেই পৃথিবীর সম্পদ পুঁজিপতি একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে। পুঁজিবাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এসব ভুল নিয়ম-নীতির কারণে তা সম্ভব হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply