অধ্যায় ১: অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচিতি

সদ্যজাত যে কোন জাতি প্রাণ লাভ করার পর তার জীবদ্দশায় প্রাপ্ত সর্বোত্তম ঐশ্বর্য্য হচ্ছে চিন্তা; এবং এগুলো কোন প্রজন্মের জন্য তার পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে লাভ করা সর্বোত্তম উপহার। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল জাতির মধ্যে আলোকিত চিন্তা গভীরভাবে প্রোথিত থাকতে হবে। বস্তুগত সম্পদ, শিল্প ও বৈজ্ঞানিক আবিস্কার এবং এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় চিন্তার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব বস্তুগত বিষয়াদি অর্জন এবং এগুলোর সংরক্ষণ নির্ভর করে চিন্তার উপর।

বস্তুগত সম্পদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব যদি জাতি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংরক্ষণ করে। তবে যদি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং জাতি শুধুমাত্র বস্তুগত সম্পদ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়, তবে তা খুব দ্রুত সংকুচিত হয়ে সে জাতিকে দারিদ্রতায় নিপতিত করে। একটি জাতি তার অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক অর্জন পুনরুদ্ধার করতে পারে যদি জাতিটি তার চিন্তার প্রক্রিয়া না হারায়। আর যদি সে ফলপ্রসূ চিন্তার পথ হারিয়ে ফেলে, তবে সে খুব দ্রুত পশ্চাৎমুখী হয়ে যাবে এবং তার সব আবিষ্কার ও উদ্ভাবন হারিয়ে ফেলবে। তাই প্রথমেই চিন্তার যত্ন নেওয়া অত্যাবশ্যক। এই চিন্তার উপর ভিত্তি করে ফলপ্রসূ চিন্তার পদ্ধতি দ্বারা বস্তুগত সম্পদ অর্জন করা যায় এবং সেই সাথে অর্জন করা যায় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, শিল্পের জন্য উদ্ভাবন এবং আরও অনেক কিছু।

এই চিন্তা বলতে বুঝায় জাতির মধ্যে বিদ্যমান জীবন সম্পর্কিত বিষয়ে চিন্তার একটি প্রক্রিয়া। জাতি যখন কোন ঘটনার মুখোমুখি হয় তখন বেশীরভাগ জনগোষ্ঠী সে ঘটনাকে বিচার করতে তাদের কাছে বিদ্যমান তথ্যগুলো ব্যবহার করবে এই চিন্তার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এর অর্থ এই যে, তাদের কাছে চিন্তা আছে যা তারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করে এবং বারবার এই চিন্তা সফলভাবে ব্যবহার করার ফলে একটি ফলপ্রসূ চিন্তার প্রক্রিয়া তৈরী হয়।

আজ মুসলিম উম্মাহ্‌ এমন এক সময় অতিক্রম করছে যখন অতীতের ফলপ্রসূ চিন্তার পদ্ধতি দুর্বল হয়ে পড়েছে, এমনকি তা হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা’র, খিলা-ফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী জীবনধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাওয়াহ্‌’র প্রসারতার ফলে বিগত বছরগুলোতে এই বাস্তবতার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এটা আজ সুস্পষ্ট যে মুসলিমরা ইসলামের দিকে মুখ ফিরিয়েছে, এবং ইসলামের ধারনা, সমাধান ও হুকুমের উপর আস্থা স্থাপন করেছে। যদিও এটা পরিষ্কার যে মুসলিম ভূখন্ডে প্রচারিত সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ধারনাসমূহের অসারতা ও এর ভ্রান্তিসমূহ জনগণের কাছে উম্মোচিত হয়ে গেছে, মুসলিম জাতি এখনও কুফর রাষ্ট্র ও তাদের দালালদের আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই কুফর রাষ্ট্র ও তাদের দালালরা মুসলিম ভূখন্ডে জঘন্য মিথ্যা ও প্রতারণামূলক প্রচারণার পদ্ধতি ও ধরন ব্যবহার করে তাদের বস্তাপঁচা ধারনা সুন্দরভাবে সাজিয়ে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে সেসব ধারনা যা অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের সাথে সম্পর্কিত।

ফলে ইসলামি দাওয়াহ্‌ বহনকারীদের প্রমে অবশ্যই যে ভিত্তির উপর পুঁজিবাদী সমাধানগুলো প্রতিষ্ঠিত তা প্রকাশ করে দিতে হবে, এগুলোর অসারতা তুলে ধরে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমাধানগুলোর বিনাশ সাধন করতে হবে। দাওয়াহ্‌ বহনকারীদের জীবনের নতুন ইস্যুসমূহ আলোচনা করতে হবে এবং এগুলোর সমাধান তুলে ধরে দেখাতে হবে যে ঐশী হুকুম বিধায় তা মানতে হবে। কারণ এ হুকুমসমূহ কুর’আন ও সুন্নাহ্‌ বা এ দু’টি উৎস যে দিকনির্দেশনা দেয়, তা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা – কখনই এ দৃষ্টিভঙ্গী বিবেচ্য নয়। তার মানে ইসলামী সমাধানকে আক্বীদার ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে এবং কখনই তা থেকে প্রাপ্ত লাভের উপর ভিত্তি করে গ্রহণ করা যাবে না। সুতরাং প্রত্যেকটি হুকুমের সাথে যেসব ঐশী দলিল থেকে সেগুলোকে আহরণ করা হয়েছে অথবা ঐশী হুকুম বা বাণী যে ঐশী কারণ বা ইলাহ্‌ নিয়ে এসেছে তা উপস্থাপন করতে হবে।

শাসন ব্যবস্থা ও অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত চিন্তাসমূহ মুসলিমদেরকে সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ করে এবং এগুলোর জন্য তাদেরকে জীবনে সবচেয়ে বেশী যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। মুসলিমরা সাধারণত এ চিন্তাগুলোকে প্রশংসা করে। অন্যদিকে পশ্চিমারা বাস্তবে এই চিন্তাগুলো প্রয়োগ করার চেষ্টা করে, এমনকি তারা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অধ্যবসায়ী। যদিও উম্মাহ্‌ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাফের উপনিবেশবাদীদের দ্বারা তাত্ত্বিকভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত, পশ্চিমা ব্যবস্থা ও উপনিবেশবাদ বজায়রাখার জন্য উম্মাহ্‌ বাস্তবে অর্থনৈতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত। সুতরাং ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী বিশ্বের মুসলিমদের অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। এই প্রভাব এতটাই বেশী হবে যে উম্মাহ্‌ চলমান ব্যবস্থা উল্টে দিতে উদ্বুদ্ধ হবে। আর কাফের উপনিবেশবাদী, পশ্চিমাদের গুণমুগ্ধ লোকজন – বিশেষ করে যারা অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করে, যারা পরাজিত মানসিকতা সম্পন্ন ও শাসকগোষ্ঠী – এই ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার তীব্র বিরোধীতা করবে।

সুতরাং, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যে চিত্র সুবিন্যস্ত আকারে পশ্চিমা রাজনৈতিক অর্থনীতি যে মৌলিক চিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত তা প্রকাশ করবে। এটা এজন্য প্রয়োজন যাতে করে পশ্চিমা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা মুগ্ধ লোকেরা এ ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ ও ইসলামের সাথে এর সাংঘর্ষিক দিকসমূহ উপলদ্ধি করতে পারে। অতঃপর তারা অর্থনৈতিক জীবনের সমস্যা সঠিকভাবে সমাধানকারী ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চিন্তাসমূহ পরীক্ষা করে দেখতে পারবে এবং তাদের কাছে এটি সাধারণ মূলনীতি ও বিস্তারিত – উভয় আঙ্গিকে পুঁজিবাদী জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হিসেবে উপস্থাপিত হবে।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply