তার নাম আমর, আবু নাজীহ কুনিয়াত বা ডাকনাম। পিতা আবাসা ইবন আমের এবং মাতা রামলা বিনতুল ওয়াকীয়া। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবুযার আল গিফারীর (রা) বৈপিত্রীয় ভাই। (আল ইসাবা-৩/৫)।
জীবনের প্রথম থেকেই আমর ছিলেন সত প্রকৃতির লোক। জাহিলী যুগে যখন গোটা আরব মূর্তি পূজায় লিপ্ত তখনও তিনি এ কাজকে ঘৃণা এবং মূর্তি পূজারীদের পথভ্রষ্ট বলে মনে করতেন। তিনি নিজেকে ইসলামের চতুর্থ ব্যক্তি অথবা ইসলামের এক চতুর্থাংশ বলে দাবী করতেন। তার কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো, আপনি কিসের ভিত্তিতে এ দাবী করেন? তিনি বললেন: জাহিলী যুগে আমি মানুষকে পথভ্রষ্ট বলে বিশ্বাস করতাম। মূর্তির কোন গুরুত্ব আমার কাছে ছিল না। আমি জানতাম, এগুলি যেমন কোন ক্ষতি করতে পারে না, তেমনি কোন উপকারও করতে পারে না। কারণ, তারা পাথরের মূর্তির পূজা করতো। এ সময় আমি একজন আহলি কিতাব বা ঐশী ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির নিকট সর্বোত্তম দ্বীন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন: মক্কায় এক ব্যক্তির আবির্ভাব হবে। তিনি নিজ কাওমের ইলাহ বা উপাস্য পরিত্যাগ করে অন্য ইলাহর দিকে মানুষকে আহবান জানাবেন। তিনিই সর্বোত্তম দ্বীন নিয়ে আসবেন। তুমি তার আবির্ভাবের কথা শুনতে পেলে তাকে অনুসরণ করবে।
আমর বলেন, এমন সময় আমি মক্কা থেকে একটি সংবাদ পেলাম। মক্কায় নতুন কোন ঘটনা ঘটেছে কি না-এ কথা আমি কারও কাছে জিজ্ঞেস করতে সাহস পেলাম না। অবশেষে পশুর পিঠে সওয়ার হয়ে আমি মক্কায় পৌঁছলাম। সেখানে এক আরোহীকে প্রশ্ন করলে সে বললো: এখানে এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে যে তার কাওম বা স্বজাতীয় ইলাহকে ঘৃণা করে। আমি গোপনে রাসূল সা: সাথে সাক্ষাত করলাম। কারণ, তখন তার স্বজাতীয় লোকেরা চরমভাবে তার বিরোধিতা করছে। অন্য একটি বর্ণনা মতে রাসূল সা: সাথে আমরের এ সাক্ষাত হয় উকাজ মেলায়। প্রথম সাক্ষাতে তাদের কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ: আমর প্রশ্ন করেন: আপনি কে?
-আমি আল্লাহর নবী।
-আল্লাহ কি আপনাকে পাঠিয়েছেন?
-হাঁ।
-কি কি জিনিস সহকারে পাঠিয়েছেন?
-আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করবে, তার সাথে কোন কিছু শরিক করবে না, মূর্তি ভেঙ্গে ফেলবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখবে।
– কেউ কি এ দাওয়াত কবুল করেছে?
-হাঁ, একজন আযাদ, একজন দাস।
আমর বলেন, সে দুজন হলেন আবু বকর ও বিলাল। অত:পর আমার আরজ করেন, আমাকেও আল্লাহর উপাসকদের মধ্যে শরীক করে নিন। আমি আপনারই সাথে থাকবো। রাসূল সা: বললেন, যখন চারদিক থেকে আমার বিরোধিতা চলছে তখন কিভাবে তুমি আমার সাথে থাকবে? এখন তোমার স্বদেশ ভূমিতে ফিরে যাও। যখন আমি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতে শুরু করি তখন আমার নিকট চলে এসো। আমর বলেন এভাবে আমি ইসলাম গ্রহণ করি এবং নিজেকে ইসলামের এক চতুর্থ হিসেবে দেখতে পাই। (আল ইসাবা-৩/৬, হায়াতুস সাহাবা-১/৭১-৭২)।
রাসুল সা: এর নির্দেশমত আমর ইসলাম গ্রহণ করে স্বগোত্রে ফিরে যান। তবে মক্কায় যাতায়াতকারীদের মাধ্যমে সব সময় রাসুলুল্লাহর সা: খোঁজ খবর রাখতেন। রাসূল সা: মদীনায় হিজরাতের পর ইয়াসরিব বা মদীনার কিছু লোক আমরের গোত্রে আসে। তিনি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেন, মক্কা থেকে যে লোকটি মদীনায় এসেছেন, তার অবস্থা কি? তারা বললো, দলে দলে লোক তার দিকে ছুটে আসছে। তার স্বজাতি তো তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল; কিন্তু পারেনি। এখন তিনি মদীনায়।
তাদের কাছে এই খবর পেয়ে আমর মদীনায় রওয়ানা হয়ে গেলেন। মদীনায় রাসুল সা: এর নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের পরিচয় দিলে তিনি বললেন: হাঁ, তোমাকে আমি চিনেছি, মক্কায় তুমি আমার সাথে দেখা করেছিলে। তখন থেকে আমর মদীনায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান।
হযরত আমরের মদীনায় আগমনের সময় সম্পর্কে মতভেদ আছে। একটি মতে তিনি বদর যুদ্ধের পূর্বে মদীনায় আসেন এবং বদরে অংশগ্রহণ করেন। তবে প্রসিদ্ধ মতে তিনি খাইবার যুদ্ধের পরে এবং মক্কা বিজয়ের পূর্বে মদীনায় আসেন। (আল ইসাবা-৩/৫)।
বদর, উহুদ, হুদাইবিয়া, খাইবার সহ বিভিন্ন যুদ্ধ তার স্বদেশ থাকাকালেই শেষ হয়ে যায়। মক্কা বিজয় অভিযানে তিনি সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করেন। তায়িফ অভিযানেও যে তিনি শরিক ছিলেন, এমন বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন। তায়িফ অবরোধকালে হযরত রাসূলে কারীম সা: বললেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একটি তীর নিক্ষেপ করবে, তার জন্য জান্নাতের একটি দরযা খুলে যাবে। এই সুসংবাদ শুনে আমি ১৬টি তীর নিক্ষেপ করি। তায়িফ অভিযানের পর আর কোন যুদ্ধে তার তার যোগদানের কথা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, তিনি আরও কিছু যুদ্ধে যোগদান করেন। হযরত আমর ইবন আবাসার (রা) মৃত্যুর সময়কাল সঠিকভাবে জানা যায় না। সীরাত বিশেষজ্ঞরা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলেছেন, তিনি খলীফা হযরত উসমানের (রা) খিলাফতের শেষ দিকে মৃত্যু বরণ করেছেন। সুতরাং ‘আল ইসাবা ফী তাময়ী যিস সাহাবা’ গ্রন্থকার আল্লামা ইবন হাজার আল ‘আসকালানী’ শুধু এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে-যেহেতু আলী-মুআবিয়ার (রা) দ্বন্দ্ব এবং আমীর মুআবিয়ার খিলাফতকালে কোথাও তাকে দেখা যায় না- উসমানী খিলাফতের শেষদিকে তার মৃত্যুকাল উল্লেখ করেছেন। (আল ইসাবা-৩/৬) কিন্তু মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের এক বর্ণনায় জানা যায়, আমীর মুআবিয়া (রা) ও রোমানদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তির কারণে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমীর মুআবিয়া (রা) রোমানদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারতেন না। কিন্তু হযরত মুআবিয়া (রা) পরিকল্পনা করেন, তার বাহিনী রোমানদের সীমান্তে পৌঁছে যাবে, আর এদিকে চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। অত:পর তার বাহিনী সাথে সাথে হামলা চালিয়ে দেবে। এ সময় আমর ইবন আবাসা চিতকার করে বলে বেড়াতেন, অঙ্গীকার পূর্ণ কর, ধোকা দিওনা। উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় তিনি আমীর মুআবিয়ার খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু যদি ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থকারের মতটি সত্য ধরা হয়, তাহলে এই ঘটনাটি ছিল উসমানী খিলাফতকালের, যখন হযরত মুআবিয়া (রা) শামের গভর্ণর ছিলেন। তখনও রোমানদের সাথে তার সংঘর্ষ হয়েছিল।
হযরত আমর ইবন আবাসা (রা) রাসূলুল্লাহর সা: মুহাব্বত বা সাহচর্যের খুব বেশি সুযোগ পাননি। তবে যতটুকু পেয়েছেন তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। আমরা তার প্রমাণ পাই মদীনায় রাসুল সা: এর সাথে প্রথম সাক্ষাতে। তিনি আরজ করেন- আল্লিমনী মা আল্লামাকাল্লাহু- আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন তার কিছু আমাকেও শিখিয়ে দিন। এ কারণে এত কম সময়ের সাহচর্য সত্ত্বেও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে তার বর্ণিত মোট ৪৮টি হাদীস দেখা যায়।
সাহাবীদের মধ্যে ইবন মাসউদ, আবু উমামা আল বাহিলী,সাহল ইবন সাদ, এবং তাবেঈদের মধ্যে শুরাহবীল ইবন সামাত, সাদান ইবন আবী তালহা, সুলাইম ইবন আমের, আবদুর রহমান ইবন আমের, জুবাইর ইবন নাফীর, আবু সালাম ও অন্যরা তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল ইসাবা-৩/৫)।
আবু নুঈম কাবের মাওলা বা আযাদকৃত দাস থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: একদিন আমর ইবন আবাসা পশু চড়াতে গেলেন। আমি তার খোঁজে দুপুরে বের হলাম। আমি দেখতে পেলাম, আমর একস্থানে ঘুমিয়ে আছেন এবং একখানি মেঘ তার ওপর ছায়া দিচ্ছে। আমি তাকে জাগালাম। তিনি জেগে আমাকে বললেন, এই ব্যাপারটি আমার ও তোমার মধ্যে গোপন থাকুক। অন্য কারও নিকট প্রকাশ করলে তোমার ভালো হবে না। আমি তার জীবদ্দশায় এ কথা কারও নিকট বলিনি। (আল ইসাবা-৩/৬)