১০ম অধ্যায়: ক্রমান্বয়ে ইসলামের বাস্তবায়ন

ক্রমাণ্বয়ে বা ধাপে ধাপে ইসলামকে বাস্তবায়নের যে দূষিত চিন্তাটি সমাজে বিদ্যমান সেটি এবং তা থেকে উদ্ভূত অন্যসব দূষিত চিন্তা যেমন বিদ্যমান ব্যবস্থাসমূহে অংশগ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে আমরা এখানে আলোকপাত করতে চাই, সেগুলোর প্রতি ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে চাই এবং এসব চিন্তার  ভ্রান্তি সম্পর্কে উম্মাহকে সচেতন করতে চাই। সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টারত কিছু দলের লোক মানুষের মনে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এরকম একটি  দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে থাকে যে,  ইসলাম থেকে গণতন্ত্র এসেছে ।এর কারণ হচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ডের সাথে এ জাতীয় চিন্তার জোরালো সম্পর্ক রয়েছে।

অতএব প্রথমেই আমাদের বোঝা দরকার, ধাপেধাপে ইসলামের বাস্তবায়ন বলতে কি বোঝায়? যারা এই চিন্তাকে ধারণ করে তাদের মতে এতে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে? এই চিন্তাকে ধারণ করার পেছনে কি যুক্তি রয়েছে? এবং এ ব্যাপারে শরঈ হুকুম কি?

যখন মুসলিমরা আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ল, বস্তুগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ল এবং রাজনৈতিকভাবে অধ:পতনের চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে পৌঁছাল তখন এই অধ:পতিত অবস্থার ছাপ তাদের চিন্তার মধ্যেও ফুটতে শুরু করল। যারা তখন ইসলামের আনুগত্যের দাবী করত তাদের চিন্তার মধ্যে ইসলামের সত্যতা এবং জীবন সম্পর্কে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির কোন প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যেতনা; বরং তাদের চিন্তার মধ্যে ইসলামের সত্যতা এবং জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ভুল এবং দুর্বল ধারণার প্রতিফলন দেখা যেত। কাফির সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ যখন মুসলিমদের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হল তখন নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী মুসলিমদেরকে পরিবর্তন করার এবং নিজেদের কুফরী ধ্যান-ধারণা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ মুসলিমদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার সামর্থ্য অর্জন করল। তারা তাদের বিজাতীয় চিন্তাসমূহ মুসলিমদের অন্তরে প্রোথিত করে দিল যেগুলো ভিন্ন স্বাদের ফল বহন করে এবং ইসলামের শত্রুদের মুখে সুন্দর শোনায় ও তাদের জিহ্বার মিষ্টতা বাড়ায়। ফলাফল যায় কাফিরদের পক্ষে এবং এই ঘটনার জন্য ইসলাম দায়ী ছিলনা বরং দায়ী ছিল ইসলামের অনুসারীদের স্পষ্ট আনুগত্য ও সঠিক জ্ঞানের অভাব। যেসব মুসলিম এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করছিল তারা একদিকে বাস্তবতার দ্বারা এবং অন্যদিকে পার্থিব স্বার্থ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। যাইহোক তাদের এসব ভুল প্রচেষ্টা এবং খোঁড়া পদক্ষেপ দ্রুতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল এবং কুফরের নিকট চরমভাবে আত্মসমর্পণ করল। ফলে আমাদের ভূমিগুলোতে কোনরকম প্রতিবন্ধকতা অথবা প্রতিরোধ ছাড়াই কুফর অবাধে বিচরণ করতে লাগল। এখন প্রশ্ন হল কাফির সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ কিভাবে ইসলামকে আক্রমণ করল? এবং তখন মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

কাফির সাম্রাজ্যবাদীরা এই বলে ইসলামকে আক্রমণ করল যে ইসলাম যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধান দিতে সক্ষম নয়। জবাবে মুসলিমরা এমনসব সমাধান বের করতে শুরু করল যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেহেতু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তি এবং ইসলামের ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক সেহেতু তারা এই বৈপরীত্যকে  সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করতে লাগল। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে তারা বিভিন্ন ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল যা থেকে পরবর্তীতে আরো অনেক ভুল ধ্যান-ধারণা এবং বৈশিষ্ট্য জন্ম নেয়। সেসব ভুল ধ্যান-ধারণা এবং বৈশিষ্ট্যসমূহকে তখন ইসলামী শরীয়াহর উপর আরোপ করা শুরু হল যার উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ও পুঁজিবাদের সামঞ্জস্যতা বিধানের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করা যে ইসলাম যুগের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। ফলাফল দাঁড়াল এরূপ যে এসব সমাধানকে ইসলামী  চিন্তা, মৌলিক নীতিমালা এবং বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করা হলো; এগুলো ব্যবহার করে ইসলামকে বোঝার চেষ্টা করা হতে লাগল যদিও এসব চিন্তাকে গ্রহণ করার মানে হচ্ছে বাস্তবে ইসলামকে পরিত্যাগ করা এবং পুঁজিবাদের অনুসরণ করা। সামঞ্জস্যতা বিধান এবং এ চিন্তা দ্বারা আক্রান্ত যেকোন ধ্যান-ধারণার দিকে আহ্বান ছিল প্রকৃতপক্ষে কুফরের গ্রহণ এবং ইসলামের বর্জন। এর মাধ্যমে মুসলিমদেরকে আহ্বান করা হয় যাতে তারা কুফরী চিন্তাসমূহকে গ্রহণ করে এবং ইসলামের প্রকৃত দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে।

অতএব অধ:পতনের যুগে উম্মাহর পুনর্জাগরণের জন্য গৃহীত এসব চিন্তা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলল। ফলে উম্মাহকে চূড়ান্ত অধ:পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে তারা ব্যর্থ হল কারণ তারা নিজেরাই সেই অধ:পতিত অবস্থায় নিমজ্জিত ছিল।

ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে হোক অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে লোকজনের মুখে এমনসব কথা শোনা যেতে লাগল যা ছিল ইসলামী শরীয়ার জন্য লজ্জাজনক। তারা দাবী করতে লাগল রাসূল (সা) এর চৌদ্দশত বছর পরে সেই সনাতন মানসিকতা নিয়ে ইসলামকে ব্যখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। তাদের মতে আমাদের উচিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য নিজেদেরকে এমনভাবে আধুনিকায়ন করা যাতে ইসলাম আবারো নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে। তারা বলতে লাগল ইসলামকে আধুনিকভাবে সজ্জিত করতে হবে এবং এর মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে যাতে অন্তর আবারো এতে আস্থা ফিরে পায়। একে অস্পষ্টতা থেকে এবং লোকজনের অভিযোগ থেকে বের করে আনতে হবে। ফলে ইসলামের পুরানো চেহারা আর জীবিত রইলনা।

যাইহোক এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু মুসলিম বিভিন্ন নতুন চিন্তার উদ্ভাবন শুরু করল। তারা নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক নীতিমালা উদ্ভাবন করল, এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করল এবং জীবনকে নতুন পথে পরিচালিত করল। এগুলোই হচ্ছে অধ:পতিত যুগের চিন্তা যেগুলোর জন্ম হয়েছে আমাদের ভূখণ্ডগুলোতে পাশ্চাত্যের নষ্ট চিন্তাসমূহের উত্থানকালে। তখনকার মুসলিমরা ভাবতে লাগল যে ইসলাম যাতে যুগের চাহিদা পূরণ করতে পারে সেজন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং পাশ্চাতের আধিপত্য বিস্তারকারী চিন্তাসমূহ থেকে সুবিধা গ্রহণ করা তাদের জন্য একটি শরঈ দায়িত্ব।

এই নতুন বিন্যাসকে ধারণকারী অনেক চিন্তা সামনে আসতে শুরু করল যেমন; “ধর্ম হচ্ছে একটি নমনীয় এবং পরিবর্তনশীল বিষয়”, “গ্রহণ কর এবং চাহিদা পূর্ণ কর”, “সেসব বিষয় গ্রহণ কর যেগুলো শরীয়তসম্মত অথবা যেগুলো শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয়”,  “সেটি গ্রহণ কর যেটি তুলনামূলকভাবে কম খারাপ বা কম ক্ষতিকর”, “যদি পুরো বিষয়টিকে গ্রহণ করতে না পার তাহলে এর অধিকাংশকে ছুঁড়ে ফেলোনা”, “ইসলামকে ক্রমান্বয়ে গ্রহণ কর”, “এই বিষয়টি প্রত্যাখ্যাত নয় যে সময় এবং স্থানভেদে হুকুমের পরিবর্তন হয়” “যেখানে সুবিধা বিদ্যমান সেটিই হচ্ছে আল্লাহর শরীয়াহ”। আধুনিক ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য যারা আহ্বান করত এসব চিন্তা এবং এজাতীয় চিন্তাসমূহ ছিল তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান বা মৌলিক নীতিমালা। বিশ্বব্যাপী এসব চিন্তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রদূত ছিল freemason জামালউদ্দিন আফগানী এবং শায়খুল ইসলাম নামে পরিচিত তার ছাত্র freemason মুহাম্মাদ আবদুহু।

অন্তরে খারাপ ইচ্ছা এবং কুপরিকল্পনা নিয়ে লোকজন এসব কথা বলতে লাগল যাতে তারা মুসলিমদেরকে তাদের শক্তির উৎস থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে পারে, তাদেরকে দুর্বল করে ফেলতে পারে এবং এভাবে আবারো আল্লাহর হুকুমকে প্রতিষ্ঠিত করা থেকে বিরত রাখতে পারে।

অন্তরে সদুদ্দেশ্য এবং ভাল পরিকল্পনা নিয়েও কিছু লোক এসব কথা বলছিল কারণ তারা ভাবছিল উম্মাহর অধ:পতনের ফলে মুসলিমদের অসুস্থতার আরোগ্যকারী ওষুধ হিসেবে এসব চিন্তা কাজ করবে।

সদুদ্দেশ্যে বলা হোক অথবা অসদুদ্দেশ্যে এসব চিন্তার ফলাফল ছিল একই রকম। যাই হোক আমরা দ্বীনের বিরুদ্ধে কাফিরদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুসলিমদেরকে সচেতন করে দিতে চাই এবং তাদেরকে উপদেশ দিতে চাই এসব দূষিত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দেয়ার জন্য যেগুলোর ভ্রান্তি বাস্তবে প্রমাণিত। কারণ এগুলো কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনা এবং কোন অমঙ্গলও দূর করতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ আমাদেরকে পৃথিবীর সবচেযে সমৃদ্ধতম জাতিতে পরিণত করেছেন কারণ আমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই ইসলামে আছে যার বাইরে অন্যকিছুর দরকার নেই আমাদের। ইসলামের প্রকৃতিই আমাদেরকে একটি পদ্ধতির সন্ধান দেয় এবং বাধ্য করে সে অনুযায়ী বিধিবিধান নেয়ার জন্য। জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্য আল্লাহ দ্বীন ইসলাম নাযিল করেছেন এবং আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শুধুমাত্র ইজতিহাদের মাধ্যমে শরীয়াহ দলীলসমূহ থেকে আল্লাহর হুকুমসমূহ জেনে নেয়া, অন্য কোথাও থেকে নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক নীতিমালাসমূহকে অবশ্যই শরীয়াহর দলীলাদি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে কারণ শরীয়াহ দলীলসমূহেরই বিস্তারিত প্রমাণাদি বিদ্যমান। ইজতিহাদের প্রক্রিয়া একটি নির্ধারিত বিষয় যা সবসময় একই রকম থাকবে এবং একে কোন ভাবে পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এই ভিত্তি থেকেই আমাদের অগ্রযাত্রার সূচনা হবে যা আমাদের পূর্বেও  ঠিক একইভাবে শুরু হয়েছিল।

কিছু নিয়ন্ত্রিত শর’ঈ চিন্তা এবং মৌলিক নীতিমালা উল্লেখ করা প্রয়োজন যেগুলো দ্বারা অবশ্যই আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে যাতে সেগুলো আমাদের সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে পারে এবং সঠিকভাবে বিন্যস্ত করতে পারে ফলে তখন আমরা সে অনুযায়ী কাজ করতে পারব। উদাহরণ স্বরুপ “যেখানে শরঈ হুকুম বিদ্যমান সেটাই স্বার্থ এবং এর বিপরীত নয়”, “কাজের ভিত্তি অবশ্যই শরঈ হুকুম দ্বারা সীমাবদ্ধ হতে হবে”, “নিষিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ না থাকলেই কেবল কোন বস্তু মুবাহ (অনুমোদিত) বলে গণ্য হবে”, “হাসান (প্রশংসনীয়) হচ্ছে তাই যাকে শরীয়াহ হাসান সাব্যস্ত করেছে এবং কাবীহ (নিন্দনীয়) হচ্ছে তাই যাকে শরীয়াহ কাবীহ সাব্যস্ত করেছে ”, “ভাল হচ্ছে তাই যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং খারাপ হচ্ছে তাই যা আল্লাহকে রাগান্বিত করে”, “শরীয়াহর উপরে অন্যকিছুর প্রাধান্য নেই”, “যে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে পড়বে তিনি তাদের জীবনকে সংকীর্ণ এবং কঠিন করে দিবেন”, “অন্য সমস্ত জাতির বাইরে মুসলিসমরা হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র জাতি”, “ স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্রকে ইসলাম অনুমোদন করে না”, “ ইসলাম একটি স্বতন্ত্র জীবনব্যবস্থা যা অন্যসব জীবনব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন।”

কিছু শরঈ মূলনীতির সাথে নিজেদেরকে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে আমরা যাতে পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলগণের অনুসরণ করতে পারি এবং তাদের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ইবতিদায় (বিদআতে) লিপ্ত হয়ে না যাই। কারণ প্রত্যেকটা বিদআতই (দ্বীনের মাঝে নতুন সংযোজন) প্রত্যাখ্যাত।   

রাসূল (সা) বলেছেন:                    

“আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনো বিপথে যাবেনা। একটি স্পষ্ট বিষয় আল্লাহর কিতাব এবং অন্যটি তাঁর রাসূলের সুন্নাহ।”
[সীরাতে ইবনে হিশাম]

এখানে কখনো শব্দটি দ্বারা পরবর্তী যুগের লোকজনকেও অন্তভূর্ক্ত করে নেওয়া হয়েছে যারা বিপথে যাবেনা; ফলে আমরাও এর অন্তর্ভূক্ত হচ্ছি।

তিনি (সা) বলেছেন:

“আমার উম্মত ৭৩টি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তাদের মধ্য থেকে একটি বাদে বাকি সবগুলো জাহান্নামে যাবে।‘  তাঁরা (সাহাবীরা) জিজ্ঞেস করলেন; ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ তারা কারা’? তিনি (সা) বললেন: ‘আমি এবং আমার সাহাবীরা আজকে যে পথের উপরে আছি (সে পথের উপরে যারা থাকবে তারা)।’”
[আবু দাউদ,আত-তিরমিযি,ইবনে মাজাহ এবং ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত]

তিনি (সা) বলেছেন:

“আমি তোমাদের জন্য উজ্জ্বল প্রমাণ রেখে যাচ্ছি। আমার পরে পথভ্রষ্টরা ব্যতীত অন্য কেউ তা থেকে বিচ্যুত হবেনা।”
[ইবনে মাজাহ এবং ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত]

তিনি (সা) বলেছেন:

“আমার প্রজন্মের লোকেরা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম, তারপরে এদের পরবর্তীগণ এবং তারপরে তাদের পরবর্তীগণ…।”
[মুসলিম হতে বর্ণিত]

তিনি (সা) বলেছেন:

“…তোমাদের মধ্যে যারা দীর্ঘজীবী হবে নিশ্চিতভাবেই তারা অনেক বিতর্ক দেখতে পাবে। নতুন উদ্ভাবিত বিষয় সম্পর্কে সতর্ক থাক কারণ প্রত্যেকটা নতুন বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেকটা বিদআতই জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়…নিজেদেরকে আমার সুন্নাহর উপরে এবং সৎপথপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নাহর উপরে রাখ তাদেরকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধর।”
[আবু দাউদ এবং আত-তিরমিযি থেকে বর্ণিত]

তিনি (সা) আরো বলেছেন:

“যে কাজ আমাদের বিষয়ের (দ্বীনের) মধ্য থেকে নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” [বুখারী এবং মুসলিম থেকে বর্ণিত]

এই হাদীসগুলো আমাদেরকে কল্যাণের (খায়র) অনুসরণ করতে এবং বিদআতের ব্যপারে সতর্ক থাকতে আহ্বান করে। কল্যাণের (খায়র) অনুসরণ করলে তা রাসূল (সা) এর যুগ থেকে অধিক বিচ্যুতির সম্ভাবনাকে দুর্বল করে ফেলে। এ থেকে এই অনুভূতির জন্ম হয় যে যুগ যত পরবর্তী হবে তত কঠোর এবং জোরালোভাবে আনুগত্য করতে হবে আমাদের, সত্যের সন্ধানে অধিক মনোযোগী হতে হবে এবং আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। কারণ আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে যাতে আমরা রাসূল(সা) এর সুন্নাহর উপরে ও সৎপথপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নাহর উপরে এবং রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবাদের (রা) সুন্নাহর উপরে থাকি। সুতরাং আমরা নতুন বিষয়ের উদ্ভাবন করবনা এবং নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ের অনুসরণও করবনা, কারণ যারা এরূপ করে তারা প্রত্যাখ্যাত। অতএব প্রশ্ন হলো আজকের দিনে এসব বিষয় নিশ্চিত করার উপায় কি?

— ইসলামী আক্বীদাকে নিজেদের অন্তরে স্পষ্টভাবে ও বিশুদ্ধরূপে সংরক্ষণ করতে হবে আমাদের এবং এটা যাতে কোন অস্পষ্ট বিষয় দ্বারা প্রভাবিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

— ইসলামের পবিত্র এবং বিশুদ্ধ উৎস থেকেই নিজেদের তৃষ্ণা মিটাতে হবে আমাদের।

— হুকুম বের করার যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে তা অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে আমাদের কারণ এটা শরঈ হুকুমসমূহকে লোকজনের খেয়াল-খুশী এবং ব্যক্তিগত মতামতসমূহ থেকে রক্ষা করে।

— ইসলামকে নিজেদের জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত করতে হবে আমাদের; নিজেদের উপরে, নিজেদের সন্তানদের উপরে, পার্থিব যেকোন সুবিধার উপরে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপরে তাকে স্থান দিতে হবে; যাতে আল্লাহর কথাগুলো  জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) উপরে অন্য কিছুকেই আমরা প্রাধান্য না দেই এবং সেই অবস্থানে থাকি যে অবস্থানে সালফে-সালেহীন (পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলগণের) এর যুগে মুসলিমরা ছিল।

— নিজেদের অন্তর থেকে কুফরের সমস্ত আবর্জনাময় চিন্তা আমাদেরকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে এবং এর চাকচিক্য ও উত্তেজনা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে ঠিক তেমনিভাবে যেমনভাবে সাহাবা (রা) গণ ইসলামের প্রবেশদ্বারে জাহিলিয়াতের সমস্ত আবর্জনাময় চিন্তা পরিত্যাগ করে পবিত্র এবং আল্লাহভীরু হিসেবে এতে প্রবেশ করেছিলেন। 

আর এসব বিষয় পালনের জন্য আমাদেরকে পূর্ববর্তী যুগের দিকেই ফিরে যেতে হবে কারণ উম্মাহর পরবর্তী যুগে এমন কিছু পাওয়া যাবেনা যা পূর্ববর্তী যুগের চাইতে উত্তম। মুসলিমদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এটি একটি অপরিহার্য বিষয়। তাদের নিকটবর্তী হওয়া অথবা দূরবর্তী হওয়ার উপর নির্ভর করেই আমাদের অবস্থা ভাল নাকি খারাপ তা বুঝা যাবে।

উপরোক্ত আলোচনার পর এখন পরিষ্কারভাবে বুঝা যাবে ক্রমধাপে ইসলামের বাস্তবায়ন বলতে কি বোঝায়? যারা এই চিন্তাকে ধারণ করে তাদের মতে এতে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে? এই চিন্তাকে ধারণ করার পেছনে কি যুক্তি রয়েছে? এবং এ ব্যাপারে শরঈ হুকুম কি?

ধাপেধাপে ইসলামের বাস্তবায়ন বলতে বোঝায় কোন নির্দিষ্ট শরঈ হুকুমকে একবারে বাস্তবায়ন না করে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করা। একে তারা বলে মারহালিয়্যাহ। এক্ষেত্রে প্রথমে মুসলিমরা এমন একটি হুকুমের দিকে ডাকে যা নিজে শরীয়তসম্মত নয় কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে এটি বিদ্যমান হুকুমের চাইতে শরঈ হুকুমের অধিক নিকটবর্তী। তারপরে তারা শরীয়তসম্মত নয় কিন্তু বিদ্যমান হুকুমের চাইতে শরঈ হুকুমের অধিক নিকটবর্তী হুকুমটিকে ক্রমধাপে পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে প্রকৃত শরঈ হুকুম বাস্তবায়ন করার দিকে আহ্বান করতে থাকে। তারপরে  শরীয়তসম্মত নয় এমন একটি হুকুম থেকে অন্য একটি হুকুম যা নিজে শরীয়তসম্মত নয় কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে বিদ্যমান হুকুমের চাইতে শরঈ হুকুমের অধিক নিকটবর্তী, তাতে পরিবর্তন করে অথবা পরিবর্তন করার আহ্বান জানাতে থাকে যতক্ষণনা তাদের দৃষ্টিতে যা প্রকৃত শরঈ হুকুম তা বাস্তবায়ন করতে পারছে।

এর মানে হচ্ছে অল্পকিছু শরঈ হুকুম বাস্তবায়ন করা এবং বাদবাকি কুফরী হুকুম বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে ততক্ষণ নীরব থাকা যতক্ষণনা শরীয়াহ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ধাপেধাপে ইসলাম বাস্তবায়নের জন্য কোন নির্দিষ্ট ধাপসংখ্যা নেই। এমনকি যারা এর পক্ষে কথা বলে তাদের মতে এর জন্য কোন নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিও নেই। একটি হুকুম বাস্তবায়িত করতে একটি, দুটি, তিনটি এমনকি এর চাইতেও বেশি ধাপের প্রয়োজন হতে পারে। এই ধরনের ক্রমান্বয়িকতার ক্ষেত্রে ধাপসংখ্যা নির্ধারণের উপর পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাব সুস্পষ্টরূপে বিদ্যমান। ধাপসংখ্যা অল্পকিছু অথবা অনেকগুলো হতে পারে এবং প্রতিটা ধাপ বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে।

আক্বীদাগত বিষয়ে ধাপেধাপে ইসলামের বাস্তবায়ন ধারণাটি প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে; যেমন ইসলাম থেকে সমাজতন্ত্র এসেছে অথবা ইসলাম থেকে গণতন্ত্র এসেছে এই মন্তব্যগুলোকে সমর্থন করা। শরঈ হুকুমগুলোও এর অন্তভূর্ক্ত হতে পারে যেমন এই বিষয়টিকে অনুমোদন করা যে একজন নারী হাঁটুর সামান্য নিচ পর্যন্ত কাপড় পরবে এবং প্রকৃত শর’ঈ হুকুম অনুযায়ী পোশাক পরিধানের জন্য সে কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে যাবে। আবার ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত বিষয়ের ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে যেমন শরীয়ার দৃষ্টিতে হারাম হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যমান ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান করা এমনকি যারা ক্রমান্বয়িকতার পক্ষে কথা বলে তাদের মতেও বিষয়টি হারাম। যাই হোক তারা এরূপ দাবী করেনা যে এ বিষয়ের বাস্তবায়নই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য বরং কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে ইসলামী শাসনব্যবস্থা অর্জনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং এটিই হচ্ছে প্রকৃত শরঈ হুকুম যা আমাদের উপর একটি বাধ্যবাধকতা। এর ফলে দেখা যাবে তারা চেষ্টা করছে নির্দিষ্ট কয়েকটি শরঈ হুকুম বাস্তবায়ন করতে এবং বিদ্যমান বাদবাকি অনৈসলামী হুকুমসমূহের বাস্তবায়িত থাকার ব্যাপারে এই আশায় নীরব থাকতে যে একসময় শরঈ হুকুমসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সেগুলোর প্রভাব বেড়ে যাবে এবং তাদেরই সংখ্যার আধিক্য থাকবে;তারপরে তা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং এভাবে চলতে থাকবে।অথবা এই বিষয়টি দাওয়াতের ক্ষেত্রেও হতে পারে যখন লোকজনকে তারা এসব বিষয় বাস্তবায়নের দিকে ডাকে তখন।সুতরাং ক্রমান্বয়িকতার ধারণায় যারা বিশ্বাসী তারা লোকজনকে তাদের এই ধারণার দিকে ডাকার জন্য এজাতীয় ধরনসমূহ ব্যবহার করে থাকে।এসব ধারণার দিকে যারা লোকজনকে ডাকে তারা অনেকক্ষেত্রে এতটা আল্লাহভীরু হয়ে থাকে যে নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে কোনরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করেনা কিন্তু তারপরও বিষয়টিকে গ্রহণ করে অন্যদের সুবিধা বিবেচনা করে।কারণ তারা ভাবে এরূপ না করলে লোকজন ইসলামের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করবে; ফলে কোন কিছু না পাওয়ার চাইতে কিছু পাওয়াটাকেই তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে।

ধাপেধাপে ইসলামের বাস্তবায়ন বা মারহালিয়্যাহ এর পক্ষের যুক্তিসমূহ এবং সেগুলোর খণ্ডন প্রসঙ্গে এবার আসা যাক। যারা এভাবে অগ্রসর হওয়ার পক্ষপাতী তারা কিছু যুক্তির উপরে নির্ভর করে যেগুলোর ব্যাপারে তারা মনে করে যে এগুলো তাদের চিন্তা এবং দাওয়াতের পক্ষে সমর্থনকারী।ফলে তারা যা করতে চাচ্ছে তার পক্ষে যুক্তি হিসেবে এগুলোকে উপস্থাপন করে থাকে যদিও প্রকৃতপক্ষে তারা এক্ষেত্রে দলীলসমূহ এবং তাদের সঠিক নির্দেশনার অনুগত থাকেনি বরং নিজেদের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য তারা এসব দলীলকে ভুলভাবে ব্যবহার করেছে Ñযা আমরা সামনে দেখতে পাব।নিচে তাদের সেসব যুক্তিসমূহ এবং সেগুলোর খণ্ডন নিয়ে আলোচনা করা হলো।

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply