ইসলামী ব্যাংকিং-এর প্রয়োজনীয়তা ও বিকল্প

একটি যুক্তি প্রায়ই উপস্থাপিত হয় যে ইসলামী ব্যাংক পুরোপুরি ইসলামী না হলেও মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য এটি আবশ্যক। আরেকটি যুক্তি হল মানুষ যেমন ত্রুটিহীন নয় ইসলামী ব্যাংকও তেমন ত্রুটিহীন নয়, কিন্তু তারা ক্রমাগত চেষ্টা করছে ইসলামী শারিয়াহ যথাযথভাবে অনুসরণ করে ‘ব্যাংকিং’ সেবা দান করার। এবং এই ক্রমাগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যাংকিং-এর একটি যথার্থ ইসলামী বিকল্পধারা তৈরি হবে। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ইসলামী ব্যাংককে সহযোগিতা করা।

প্রথমেই দেখছি প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। কোন বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা পরিমাপের জন্য একটি মানদণ্ড প্রয়োজন। আমি এখানে সেই মানদণ্ডকে নির্ধারণ করছি “কোন ‘আইনসিদ্ধ অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আবশ্যকীয় উপায়” হিসেবে। এখন দেখা যাক ইসলামী ব্যাংক মানুষের কোন কোন মানবিক সমস্যার সমাধান দিচ্ছে এবং তার কোন বিকল্প হতে পারে কিনা।

(১) অর্থের হেফাজত (Custodial Service): এটি একটি বৈধ অধিকার এবং যেকোনো ব্যাংক থেকেই এই সেবা গ্রহণ করা যায়। এখানে ইসলামের কোন বিধিনিষেধ নেই। সব ব্যাংকের চলতি হিসাব (Current Account) এই সুবিধা প্রদান করে থাকে। ইসলামী ব্যাংক এখানে কোন বিশেষ সেবা প্রদান করেনা। তাই প্র্যজনিয়তার যুক্তিটি এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাচ্ছেনা।

(২)ব্যবসায়ে অর্থের সংস্থান (Financing Business): ব্যবসায়ে ক্রমাগত অর্থের সংস্থান পাওয়া কারো অধিকারের পর্যায়ভুক্ত নয়। আর অর্থের বিনিময়ে অর্থের সংস্থান তো অবৈধই। ব্যবসা হচ্ছে একাধিক ব্যক্তির শ্রম অথবা শ্রম ও পুঁজির সমন্বয়ে লাভের প্রত্যাশায় উৎপাদন বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। এবং এই একত্র হওয়া ব্যক্তিদের পারস্পরিক পরিচিতি তাদের ব্যবসায়িক চুক্তির জন্য অপরিহার্য। ব্যবসা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট সুযোগ আমাদের সমাজে বিদ্যমান। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত জনদের একত্র করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। কেউ বলতে পারেন এই প্রক্রিয়ায় বৃহৎ পুঁজি গঠন কঠিন। এর উত্তরে বলা যায় বৃহৎ পুঁজি গঠন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তাছাড়া বৃহৎ পুঁজি গঠন কারো অধিকারও নয়। ব্যবসায়ীগন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবসা প্রসারিত করবেন। এটিই সুস্থ চিন্তা।

(৩) বিনিয়োগ (Investment): উদ্বৃত্ত বিনিয়োগকে ইসলাম উৎসাহিত করে। ইসলামী ব্যাংক বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অর্থবহ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিনিয়োগকারীর পক্ষে পুঁজি-প্রার্থী ব্যবসার ঝুকি ও আর্থিক সম্ভাব্যতা (Financial Feasibility) যাচাই, বিনিয়োগ পরামর্শ, এবং উভয়ের ভিতর যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীর পক্ষে ব্যবসায়ে প্রতিনিধিত্বও (Wakala/Representation) করতে পারে। অনুরূপভাবে ব্যবসায়ীগণও উত্তম বিনিয়োগকারী সন্ধানের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সেবা গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংকগুলো অনেকটা Private Equity বা Venture Capital Firm-এর মত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। কাজগুলো যেহেতু ব্যাংকের সংগে বিশিষ্ট নয়, যেকোনো যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই সকল সেবা প্রদান করতে পারে। অর্থাৎ, এই কাজগুলো পরিচালনার জন্য ‘ব্যাংকিং’ লাইসেন্সের কোন প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন উঠতে পারে অল্প পুঁজির মালিক যার নিয়মিত আয় প্রয়োজন কিন্তু অধিক ঝুকি নিতে সক্ষম নয় সে কিভাবে বিনিয়োগ করবে? এর উত্তরে বলা যায় সামগ্রিক প্রকৃত অর্থনীতি (Real Economy) যদি আয় সৃষ্টি করতে পারে তবে বিনিয়োগকারীগণও তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের উপর আয় করতে সক্ষম। যদিও সমগ্র অর্থনীতির ভিতর কিছু ব্যবসা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। বিনিয়োগকারীকে অবশ্যই ব্যবসার ঝুকি গ্রহণ করতে হবে। ব্যবসার অর্থ প্রবাহের প্রকৃতির (Cash Flow Pattern) উপর তার আয় বা লাভ পাওয়ার সময়কাল নির্ধারিত হবে। পূর্ব থেকে এটা নির্ধারণ করা যাবেনা যে বিনিয়োগকারী প্রতি মাসে বা প্রতি বছর ব্যবসা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় পাবে, কারন এটা ব্যবসার প্রকৃতি বিরুদ্ধ। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা অবশ্যই তার বিনিয়োগকৃত ব্যবসার প্রকৃতির সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোন প্রত্যাশা তার চাহিদা বা অধিকার নয়।

(৪) ভোক্তা ঋণ (Consumer Credit): ভোক্তা ঋণের আওতায় ভোক্তাগন যে সকল দ্রব্য ক্রয় করে থাকে তা তাদের জীবন ধারনের জন্য অপরিহার্য নয়। যেমন গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি, এসি, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি। এই দ্রব্যগুলো শুধু তাদের জীবনযাত্রার মানকে বৃদ্ধি করে এবং তাদের ভোগের সময়কাল এগিয়ে আনে। ভোক্তা সহজেই তার ক্রয়ক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে। তাই এই ধরনের ঋণ তার প্রয়োজনকে প্রতিষ্ঠা করেনা।

(৫) বৈদেশিক বাণিজ্য (Foreign Trade): আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালনা করা মানুষের বৈধ অধিকার। যে কোন ব্যাংকের মাধ্যমে ১০০%-মার্জিন লেটার অব ক্রেডিটের (LC) বিপরীতে আমদানিকারক বিনা সুদে পণ্য আমদানি করতে পারে। অনুরূপভাবে পণ্য রপ্তানিও করতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাংককে তার সেবার বিনিময়ে শুধু কিছু চার্জ দিতে হয়। সুতরাং, মানুষের এই প্রয়োজন পূরণের বৈধ পন্থা বিদ্যমান। ইসলামী ব্যাংক এখানে অপ্রয়োজনীয়।

উপরের আলোচনা থেকে এটা বোঝা যায় যে ইসলামী ব্যাংকের অবর্তমানেও মানুষ তাদের বৈধ প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে সক্ষম। সুতরাং, ইসলামী ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তার যুক্তিটি এখানে ব্যর্থ হচ্ছে। বস্তুতঃ মানুষের বৈধ প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য ‘ব্যাংকিং’ (তার প্রকৃত অর্থে) অপরিহার্য নয়।

সবশেষে ত্রুটিহীন হবার প্রচেষ্টার যুক্তিটি যাচাই করছি। এটা সত্য যে আমরা কেউ ত্রুটিহীন নই। আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে (Private Sphere) প্রতিনিয়ত পরিশুদ্ধ হবার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের বিষয়টি জনসাধারণের সংগে লেনদেনের প্রকাশ্য আহবানের (Public Offer) সংগে সম্পর্কিত। কোন আইনের খণ্ডিত অনুসরণের মাধ্যমে সেই আইন অনুসৃত হচ্ছে এমন দাবী গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও তার প্রায়োগিক দুর্বলতা থাকতে পারে। সুতরাং, রূপ ও মাত্রার ভিন্নতার কারনে এই ব্যক্তিগত এবং প্রকাশ্য বিষয়দুটি তুলনাযোগ্য নয়।

Mahmud Saadiq

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply