গ্যাস উত্তোলনে কনকো ফিলিপস, জাতীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন

বন্দর নগরী চট্রগ্রাম থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরত্বে, বঙ্গোপসাগর অবস্থিত দুটি ব্লক ডিএস ০৮-১০ এবং ডিএস ০৮-১১ এখন যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কনকোফিলিপস এর আওতাধীন। ৩০০০-৩৫০০ ফুট গভীরতা সম্পন্ন ব্লক দুটি গভীর সমুদ্রে ৫১৫৮ বর্গ কিঃমিঃ(১২,৭০,০০০ একর) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান “শেভরন কর্পোরেশন” ২০০৭ সালে ‘কনকো ফিলিপস’ প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয়। তেল ও গ্যাস উৎপাদন এবং মজুদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কনকোফিলিপসকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তেল ও গ্যাস উৎপাদনের দায়িত্ব দেয় “শেভরন কর্পোরেশন”। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় হাইড্রোকার্বন জরিপ চালিয়ে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার   আন্তর্জাতিক বাজারে দ্বরপত্র আহবান করে। বঙ্গোপসাগরের ৮টি ব্লকের জন্য কনকোফিলিপস প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রে অংশগ্রহণ করলেও রহস্যজনকভাবে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান এই দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। একই বছর ২ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর টহল জাহাজ ‘বি.এন.এস নির্ভয়’ বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিরোধপূর্ণ জলসীমার ২০০ মিটার ভিতরে মিয়ানমার নৌ-বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ সহ খনন যন্ত্র সম্পূর্ণ আরও ৪টি জাহাজকে চিহ্নিত করে। অত্র এলাকায় মিয়ানমার সরকার, দক্ষিণ কোরিয়ার গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান “ড্যাইউ কর্পোরেশন” এবং সুইজারল্যান্ডের গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান “ট্রান্স ওশান”-এর মাধ্যমে জরিপ চালিয়ে বিপুল পরিমান গ্যাস এর মজুদ  আবিস্কার করে। বিরোধপূর্ণ সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ মিয়ানমার এর এই গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এর মাঝে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। মিয়ানমার সরকার, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিরোধপূর্ণ জলসীমায় তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে। অবশেষে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় উদীয়মান পরাশক্তি চীনের মাধ্যস্থতা উভয় দেশের মাঝে বিদ্যমান উত্তেজনা হ্রাস পেতে শুরু করে।

পরবর্তী পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গভীর সমুদ্রের ৮টি ব্লকের ভূগর্ভস্থ তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদনের জন্য কনকোফিলিপস-কে নির্বাচিত করার বিষয়ে কোন প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। পরে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সফর শেষে নির্বাচন করে জয় লাভ করে, এবং যা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন রূপে স্বীকৃতি লাভ করে। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ  সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মধ্য অর্থাৎ জুলাইয়ে বঙ্গোপসাগরের ৯টি ব্লকের মধ্যে ৩টি ব্লকের জন্য দরপত্র আহবান করে। এই ৯ টী ব্লকের মধ্য ডিএস ০৮-১০ ও ডিএস ০৮-১১ এর ৩০ ও ১৫ শতাংশ এলাকাসহ বাকি ৭টি ব্লক ছিল বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমায়।

অপরদিকে উইকিলিকস এর বরাত দিয়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বর এ গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়, কনকোফিলিপস প্রতিষ্ঠানটিকে গ্যাস ব্লক ইজরা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহি চৌধুরীকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন মরিয়ার্টি চাপ প্রয়োগ করছিল। পত্রিকায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সালের জুলাইয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়াটি এক বৈঠকে গ্যাস ব্লকগুলো ইজরা দেয়ার বিষয়ে এবং গ্যাস রপ্তানি করতে দেয়ার বিষয়ে জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহি চৌধুরীকে অনুমোদন দিতে বলে। ফলে একই বছর বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ৩টি ব্লকের মধ্য ডিএস ০৮-১০ এবং ডিএস ০৮-১১ ব্লক দুটি কনকোফিলিপস এবং অন্যটি আইরিশ কোম্পানি “টাল্যো”কে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১০ ও ১১নং ব্লক দুটির অবস্থান বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিরোধর্পূণ সমুদ্রসীমায় হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীপরিষদের সাথে কনকোফিলিপস একটি বৈঠকের আয়োজন করে। কনকোফিলিপস প্রাথমিক পর্যায়ে ডিএস ০৮-১১ ব্লকের ৮৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বৈঠকে সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমার এর সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর পেট্রোবাংলা ১০ ও ১১নং ব্লকের বাকি ৩০ ও ১৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কনকোফিলিপস এর সাথে অপর একটি চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা এর পরিচালনায় মোঃ ইমাম উদ্দিন গনমাধ্যমগুলোকে বলেন বাংলাদেশ বিরোধর্পূণ সমুদ্রসীমাগুলো অর্জন করতে পারলে কনকোফিলিপস ১০ ও ১১নং ব্লকের বাকি ৩০ ও ১৫ শতাংশ এলাকায় তাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।

২০১১ সালের ১৬ জুন পেট্রোবাংলার প্রধান কার্যলয়ে কনকোফিলিপস এবং পেট্রোবাংলার মাঝে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (production sharing contract) স্বাক্ষরিত হয়। এর দুই দিন আগে তেল গ্যাস ও বন্দর রক্ষা কমিটির এক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে নির্মমভাবে হামলা চালিয়ে পুলিশ তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ এই চুক্তি দেশের জন্য আত্মঘাতী এবং জাতীয় স্বার্থের বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন।

কনকোফিলিপস এর ব্যাপারে বাংলাদেশ কতৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরধীতা করে ভারত ও মিয়ানমার সরকার এ ক্ষেত্রে ভারত বিরোধীতার কারণ ছিল গ্যাস ব্লকগুলোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমা। এই বিরোধীতার জের ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাঝে পুনরায় স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তীতে আকস্মিকভাবে মিয়ানমার এর জান্তা সরকার সীমান্তে তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে। সীমান্তে উত্তেজনা হ্রাস করার লক্ষ্যে নাসাকা ও বিজিবি-র মাঝে কায়েক দফা পতাকা বৈঠক হয়।

অবশেষে মিয়ানমার এর সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আওয়ামীলীগ সরকার জাতিসংঘের সামুদ্রিক আইন বিষয়ক সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যস্থতা কামনা করে সদস্য রাস্ট্রগুলো বাংলাদেশের পক্ষে ৩০টি এবং মিয়ানমার এর পক্ষে মাত্র ১টি ভোট দেয়। ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে ৬৬,৪৮৬ বর্গমাইল এলাকা বাংলাদেশের পক্ষে দাবি করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালের বর্গমাইল এলাকা বাংলাদেশ অর্জন করে, সেটা দেশবাসীর কাছে সমুদ্রবিজয় রুপে পরিচিতি লাভ করে।

সমুদ্রবিজয়ের পর ২০১২ সালের ২৪ জুলাইয়ে এক বৈঠকে কনকোফিলিপস বাংলাদেশ গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্প্রসারণে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী পর্যায়ে দরপত্রে অগ্রধিকার লাভের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করে। কনকোফিলিপস প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ল্যাফরান্দ্রে এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর টমাস জে আর্লে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর সাথে বৈঠক করে। বৈঠক শেষে প্রতিষ্ঠানটির এই উচ্চপদস্থ দুই কর্মকর্তা বৈঠকে আলোচ্য বিষয়াদি সম্পর্কে কিছু জানাতে রাজি হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলেন পরবর্তী দরপত্রে কনকোফিলিপস এর অগ্রধিকার পাওয়া উচিত এ মর্মে তারা তাদের মতামত ব্যক্ত করে। এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার এর সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে  বিরোধ থাকার কারণে তারা এতদিন গ্যাস ব্লকের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি, তারা এখন কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তিনি আরও বলেন সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর বাংলাদেশ যে সব ব্লকগুলো অর্জন করেছে সেখানে তারা এখন কাজ করতে চায়।

ইতোমধ্য বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপে ২০১৪ সাল নাগাদ  যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ভারত এর সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত  বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারনের পরিকল্পনা রয়েছে। সমুদ্র বিজয়ের এই পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রকৃত সমুদ্র বিজয় কি আদৌ নিশ্চিত হবে কিনা তা নিয়ে জনমনে সংশয় বিরাজ করছে। মুল্যো বৃদ্ধির প্রতিবাদ করলেও রহস্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিপক্ষে এবং বিরোধর্পূণ সমুদ্রসসীমা নিয়ে ভারতের বিপক্ষে কোন কথা বলেনি। এছাড়া ২০১২ সালে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পর ভারত স্বার্থের বিরোধীতা না করার মাধ্যমে এবং এ বছর ভারতিয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে দেশের স্বার্থের পক্ষে কোন কথা না বলার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রকৃত দাবি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

চুক্তির শর্ত অনুসারে ‘কনকোফিলিপস’ প্রতিষ্ঠানটি গভীর সমুদ্রে গ্যাস উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের লক্ষ্যে ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক গ্যাস আহরন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পর কনকোফিলিপস বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা এবং বাংলাদেশের অন্য তৃতীয় যেকোন পক্ষ আন্তর্জাতিক মুল্যে কনকোফিলিপস এর কাছ থেকে এই গ্যাস কিনতে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানটি এই প্রাকৃতিক গ্যাসকে তরল গ্যাসে পরিণত করে বহিঃবিশ্বে রপ্তানি করবে। বাংলাদেশের গ্যাস বিক্রি করে কনকোফিলিপস যে মুনাফা অর্জন করবে বাংলাদেশ তার ৫৫-৮০ শতাংশ পাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে এবং ৬০-৮৫ শতাংশ পাবে তেলের ক্ষেত্রে। এ লভ্যাংশের পুরোটাই বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে অর্জন করবে পেট্রোবাংলা।

আন্তর্জাতিক মুল্যে গ্যাস ক্রয়ের ফলে প্রতিনিয়ত পরিবহন খতে পাল্লা দিয়ে ভাড়া বেড়েই চলবে এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাবে। তা ছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্যাসের দামও বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের গ্যাস বিক্রি করে অর্জিত আয় বাংলাদেশ থেকে কনকোফিলিপস তা মার্কিন ডলারে পরিণত করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাবে। এতে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কেন্দীয় ব্যাংকের ডলার রিজার্ভ প্রতিনিয়ত কমতে থকবে। ফলে মুদ্রাস্ফিতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দাম বাড়তে থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশের সার কারখানা যানবাহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং রান্না বাবদ মোট গ্যাসের চাহিদা ২৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের যোগান মাত্র ১৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

বর্তমানে ‘কনকোফিলিপস’ প্রতিষ্ঠানটি গ্যাস উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে নানা পর্যায়ে টালবাহানা শুরু করেছে।ইতোমধ্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সরকারকে নতুন করে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরের অনুরোধ করেছে। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার এর ব্লকগুলোর উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তিতে গ্যাসের মুল্যো অণেক বেশী, বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর টমাস জে আর্লে র কথায় ১০ ও ১১নং ব্লকগুলোর উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তিতে গ্যাসের দাম অণেক বেশী না হলেও ১২, ১৬ ও ২১ ব্লকগুলোর উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তিতে গ্যাসের মুল্যো বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের হস্তক্ষেপে নতুন করে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির বিভিন্ন ধারার পরির্তনের সুযোগ রয়েছে এমন আভাষ পাওয়া যায়। পেট্রোবাংলা এর চেয়ারম্যান মো: হুসেইন মন্সুর এক বিবৃতিতে বলেন, “We are happy that international oil firm is to begin its work on time as we are deeply short of natural gas”

বর্তমান শাসন ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণেই বিএনপি-আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে চরম ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে আজ দেশের জ্বালানি সম্পদের এই করুণ অবস্থা। মানুষের সার্বভৌমত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতা এই শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে সীমাবদ্ধ আর এই ক্ষমতাবানরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তারা ইচ্ছামত নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে আইন তৈরী করে জ্বালানি সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে পারে অথচ নিজেরা থাকে সকল আইনের উর্ধ্বে। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে স্বেচ্ছাচারী এই শাসকগোষ্ঠী জনগণের দায়িত্ব কাঁধে তো নেয়ই না, উপরন্তু তাদেরকে কারো কাছে কোন জবাবদিহি করতে হয়না। কারো কাছে তারা দায়বদ্ধ নয়। অর্থাৎ তাদের অবাধ ও নিরংকুশ ক্ষমতা আছে কিন্তু কোন দায়বদ্ধতা নেই। আর তাই এরা বাংলাদেশে জ্বালানী খাতের উন্নয়নের জন্য বেসরকারী খাত বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী তেল ও গ্যাস কোম্পানীগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং জানাচ্ছে। জ্বালানী সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে একটি শক্তিশালী আত্মনির্ভরশীল দেশে পরিণত করার কোন ভিশন, পরিকল্পনা বা সংকল্প বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের নেই। অথচ এদেশে আছে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা-তেল-ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ। আমাদের শুধু দরকার প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ, সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও পরিকল্পনাকারী নেতৃত্ব; যে নেতৃত্বের থাকবে ভবিষ্যতের রূপকল্প এবং দৃঢ়সংকল্প; যে নেতৃত্ব সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সঠিক দিক-নিদের্শনা দিয়ে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিবে।

আলাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষ ও বিশ্বজগৎ সৃষ্টির সাথে সাথে মানুষকে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দিয়েছেন খিলাফত শাসন ব্যবস্থা। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার প্রধানতম মূলনীতি হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক একমাত্র আলাহ্ সুবহানাহুওয়াতায়ালা। অর্থাৎ তিনিই একমাত্র আইন প্রণেতা। সুতরাং, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান (খলীফা, যিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তথা একই সাথে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান) নিজে কোন আইন তৈরী করতে পারবেন না। তাই তাঁর স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী হবার কোন সুযোগ নেই। ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা মানুষের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য। তিনি মানুষের জ্বালানির চাহিদা অবশ্যই পূরণ করবেন। আর খলীফা তার নিজের কাজের জন্য আলাহর কাছে এবং জনগণ তথা মুসলিম ও অমুসলিম সকল নাগরিকের কাছে ইসলামের জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নে জবাবদিহি করতেবাধ্য। তাই খিলাফতের ভিশন হবে জনগণকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল, উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। জ্বালানী খাতের উন্নয়ন তাই সবদিক থেকেই রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে খিলাফত সরকার নিন্ম লিখিত বিষয়ে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে:

  • জ্বালানীসম্পদ কখনোই বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া হবে না কিংবা কোন ব্যক্তি বা বিদেশী কোম্পানীর মালিকানাধীনে দেয়া হবে না। রাসূলুলাহ্ (সা) ইরশাদ করেন,“তিনটি জিনিষের মাঝে সকল মানুষ শরীক। এগুলো হচ্ছে পানি, চারণ ভূমি এবং আগুন” । সুতরাং, জ্বালানী গণমালিকানাধীন সম্পদ অর্থাৎ জ্বালানী সম্পদের উপর সমগ্র দেশবাসীর অধিকার রয়েছে। দেশবাসীর পক্ষ থেকে এই সম্পদের ব্যবস্থাপনার ভার খলিফার উপর ন্যস্ত।
  • খিলাফতসরকার জাতীয় জ্বালানী নিরাপত্তা নীতি নির্ধারণ করে বাংলাদেশকে একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার দেশের জ্বালানী সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবে এবং বিদেশী কোম্পানীসমূহের সাথে যে সমস্ত অযৌক্তিক বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করবে।
  • খিলাফতরাষ্ট্র জ্বালানী সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি বা দক্ষ জনশক্তির জন্য বিদেশের উপর নির্ভরশীল হবে না। জ্বালানী সম্পদ খনন, উত্তোলন, পরিশোধন ও বিতরণের প্রযুক্তি এদেশে গড়ে তুলবে এবং মানব সম্পদ উনড়বয়নে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিণের ব্যবস্থা করবে।
  • খিলাফতরাষ্ট্র দেশীয় জ্বালানী সম্পদভিত্তিক শিল্প উৎসাহিত করবে, শিল্পায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে এবং যে কোন ধরনের বিদেশী নির্ভরশীলতা নির্মূল করবে। জ্বালানী সুবিধা জনগণের হাতের নাগালে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে খিলাফত রাষ্ট্র সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। খিলাফত রাষ্ট্র শুধু বর্তমান চাহিদা নয়, ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণও নিশ্চিত করবে এবং জ্বালানী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

– তন্ময়

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply