সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতি সঙ্কটের আবর্তে ঘুরছে যদিও বা এই সঙ্কট কৃত্রিম এবং এই সঙ্কট আমেরিকা-ব্রিটেন ও ভারতের তৈরি। এবং বাংলাদেশে এটি নতুন কিছু নয় প্রতিবারই যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসে তখনই এই ধরণের পরিস্থিতি সাম্রাজ্যবাদীরা তৈরি করে থাকে যাতে তাদের সুযোগ্য অনুগত দালাল আগামীবার ক্ষমতায় আসে এবং তাদের স্বার্থ অনুগত দাসের মত করে রক্ষা করে। তাই বাংলাদেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক গতি বিধি নির্ধারণ করতে গেলে আমাদের বাংলাদেশকে ঘিরে মার্কিন, ব্রিটিশ ও ভারতের নীতি সমূহের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। যা হল:
১. আমেরিকা এ অঞ্চলে ইসলামী খিলাফতের পুনরুত্থান ঠেকানোর পরিকল্পনা করছে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রসমূহের বলয় দ্বারা চীনকে ঘীরে রাখতে চাচ্ছে এবং এ অঞ্চলের বাণিজ্য পথ (বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী) তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছে । এ অঞ্চলে তার ঘনঘন সামরিক মহড়া এবং নানা অজুহাতে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, এ পরিকল্পনারই অংশ, যা এখন তার পররাষ্ট্রনীতির প্রধান ভিত্তি, যা ‘এশিয়ান পিভট’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সাথে মার্কিনীদের কৌশলগত ও নিরাপত্তা সংলাপ, তার এ নীতি বাস্তবায়নের একটি অংশ।
২. তাছাড়া, ভারত যাতে তার হয়ে কাজ করে, এজন্য ভারতকে নিয়ে মার্কিন নীতি হচ্ছে ভারতকে তার আওতাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা; যাকে তারা ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ বলে উল্লেখ করছে। অর্থাৎ, ভারতকে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছাড় দেয়া কিংবা ফায়দা লুটের সুযোগ করে দেয়া, কারণ, আমেরিকা অনুধাবন করতে পেরেছে যে, এটা ছাড়া ভারতকে ঐতিহাসিকভাবে চলমান বৃটিশ প্রভাব বলয় (বিশেষত : কংগ্রেস পার্টির মাধ্যমে জারি রাখা) থেকে বের করে আনা যাবে না।
৩. কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং ভারতকে ফায়দা লুটের সুযোগ করে দেয়ার মার্কিন এ নীতির অর্থ হচ্ছে, ভারতের প্রতিবেশী দুই মুসলিম দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে, বশীভুত দাস রাষ্ট্রে পরিণত করা, যাতে এই দুই রাষ্ট্রের শাসকরা সবকিছু জলাঞ্জলী দিয়ে হলেও ভারতকে যেকোন সুবিধা কিংবা ছাড় দিতে কুণ্ঠাবোধ না করে। যেমন, ভারতের স্বার্থ রক্ষায় মার্কিন হুকুমে, পাকিস্তানের দালাল শাসকরা কাশ্মিরের মুসলিমদের পক্ষ ত্যাগ করেছে।
তাই বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনে সেই দলই ক্ষমতায় আসবে যে কিনা মার্কিন-ভারত এর জন্য কৌশলগত ভাবে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। বিশেষ করে যে দল ক্ষমতায় আসলে ভারত নিজেকে নিরাপদ মনে করবে ও আধিপত্যবাদী আচরণ বজায় রাখতে পারবে সে দলই ক্ষমতায় আসবে। অর্থাৎ আমেরিকা ভারতকে অখুশি করে কাউকে ক্ষমতায় আনবে না। আর আমেরিকাও ভারতকে কৌশলে খুশি মনে তার নীতিতে তার পরিকল্পনার মাঝে নিয়ে আসবে অর্থাৎ ভারত আমেরিকার দেখান পথে চলবে যাতে ভারতের স্বার্থও রক্ষা হবে আবার দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে মার্কিন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। একটি উদাহরণের সাহায্যে এই বিষয়টিকে বোঝান যাক “আমেরিকা হচ্ছে সেই পিতা যে কিনা তার সন্তান (ভারত) কে খেলার মাঠে খেলতে দিচ্ছে, এবং সন্তান যখনই চোখের বাইরে অথবা বিপদে পড়তে যাচ্ছে তখনই ধরে তাকে আবার নির্দিষ্ট খেলার জায়গায় নিয়ে আসছে”
ভারত একটি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র। তাই আদর্শিক দৃষ্টিকোন তার মাঝে নেই। তাই যখনই ভারত এমন কোন কিছু করছে যা আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া ভিত্তিক নীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তখনই আমেরিকা তাকে নিয়ন্ত্রন করছে।
তাই আমরা মার্কিন নীতির পরিবেষ্টনে ভারতের নীতির বাস্তবায়নের আলোকে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে দেখব।
প্রথমত ভারত আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনতে চায় কারণ,
– আওয়ামীলীগ ভারতের পরিক্ষিত বন্ধু, শেখ হাসিনা গান্ধী পরিবার ও প্রনবের একান্ত অনুগত দাস।
– আওয়ামীলীগ ISI ও ইসলামী আবেগের প্রভাব বলয় মুক্ত। এবং আওয়ামীলীগের ইসলাম বিমুখতা ভারতের ইসলাম বিদ্বেষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভারত বিরোধী ইসলামী আবেগ মুক্ত।
– ভারতের শত্রু বাংলাদেশ সেনাবাহিনকে দুর্বল করার জন্য ভাল সহযোগী।
কিন্তু, আওয়ামীলীগের সরকার পরিচালনায় অদক্ষতা, শেয়ার মার্কেটে লুটপাট সর্বপরি অর্থনীতি ধ্বংস, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ও ইসলামী আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পারার কারনে তার ভিত খুবই নড়বড়ে করে ফেলেছে তাই আওয়ামীলীগের আবার ক্ষমতায় আসা অনেকটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ:
– আমেরিকা প্রথম থেকেই আওয়ামীলীগকে পরামর্শ দিচ্ছিল জামাতের সাথে বসে যুদ্ধ অপরাধ বিয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য এবং হাসিনা সেই পথে এগুচ্ছিল কিন্তু বাম পন্থিরা তাকে আশ্বস্থ করে; জামাতকে নির্মূল করা সম্ভব এবং মুক্তিযুদ্ধের আবেগ দিয়ে জামাতকে নির্মূল করে বিএনপিকে কোণঠাসা করে ত্বত্তাবধায়কের দাবি ও সরকারে সকল ব্যর্থতা ঢেকে আগামী নির্বাচনে জেতা যাবে। এবং হাসিনা সেই পথে এগুয়। কিন্তু শেখ হাসিনা বুঝতে পারেনি বামদের দিয়ে যারা কিনা ৯০ ভাগ মানুষের অনূভুতি বুঝতে অক্ষম তাদের কাধে চরে এবং ইসলামী আবেগের সাহায্য ছাড়া বাংলেদেশে রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়।
– বর্তমানে আমেরিকার বিশ্বব্যাপি ইসলামের ব্যপারে নীতি হল ইসলামকে নির্মূল করা নয় ইসলামের চিন্তায় বিষ ঢুকানো, সে ইসলামী আবেগকে দবিয়ে না রেখে তাই অপব্যবহার করে এবং জামাত ও অনান্য গণতান্ত্রিক ইসলামী দল না বুঝে তার এই পরিকল্পনার অংশ। তাই তাদের নিষিদ্ধ করা মানে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী খিলাফতের উত্থানকে এগিয়ে দেওয়া। আমেরিকা ভারতের এই পদ্ধতিতে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনাকে সঠিক মনে করে না, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন তা বুঝিয়ে দিয়েছে এবং ইসলামের ফুসে ওঠা আবেগকে ঠাণ্ডা করেছে। আমেরিকা বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা পছন্দ করে না কারণ এখানে সে তার ঘাঁটি করতে চায় ও রাজনৈতিক শুন্যতা তৈরি করতে চায় না যা কিনা তার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় ও ইসলামের রাজনৈতিক উথান হয়ে যায়। তাই বিএনপি, জামাত ও ইসলামী দলগুলোর ব্যপারে ভারতকে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ক্রমাগত ভাবে তাগিদ দিচ্ছে।
আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আসতে হলে বামদের বুঝিয়ে বা বাদ দিয়ে ইসলামপন্থীদের তার সাথে আনতে হবে, এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বানানোর লোভ দেখিয়ে জাপা কে হাতে রাখতে হবে, জামাতকে কোনভাবে আপোষে আনতে হবে যা কিনা মোটামুটি আসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু আওয়ামীলীগ পুরনো পদ্ধতিতে দমন নিপীড়ন ও মামলা হামলা দিয়ে বিএনপি-জামাতকে ঠেকাতে যাচ্ছে যা হিতে বিপরীত হচ্ছে। তবে বর্তমানে আওয়ামীলীগ ইসলাম পন্থীদের হাতে আনার চেষ্টা করছে যাতে আবার বাম পন্থীরা ক্ষিপ্ত হচ্ছে। তাই হাসিনার ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা ক্রমাগত অনিশ্চিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি জোট
বিএনপি মূলত আমেরিকা পন্থী দল এবং যে জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে ভারত বিরোধীদের আবেগকে ও ইসলামের আবেগকে পুজি করে চলা দল। কিন্তু যত বারই বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে সে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে এগিয়েছে যতটুকু আমেরিকা তাকে করতে বলেছে। যেহেতু এখন ভারত এবং আমেরিকা কৌশলগত মিত্র তাই আমেরিকার খাস দালাল খালেদা ভারত সফরে যায় এবং ভারত বিরোধী আবেগকে না উস্কানো ও ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ ভারতের নিরাপত্তা রক্ষায় বিএনপি ভারতের নীতির মত চলবে বলে দাস খত দেয় এই আশায় আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আশার জন্য যেন ভারত সহযোগিতা করে। কিন্তু বিএনপির এই দাসখতে ভারত পূর্ণ আস্থা আনতে পারে নি কারণ বিএনপির মাঝে এখনও একটি অংশ রয়েছে যারা বরাবরই ভারত বিরোধী ও ISI এর সাথে সখ্যতা রাখে এবং জামাত ই ইসলাম যারা কিনা তাদের আদী শত্রু বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ। তাই ভারত আবার আওয়ামীলীগকে আনার ব্যপারে বেশি আগ্রহী হয় এবং আওয়ামীলীগকে না আনতে পারলেও যেন বিএনপির ভারত বিরোধী অংশ ও জামাত ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তাদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভারতের বামদের কাধে আওয়ামীলীগকে চড়ানো ‘৭৫ এর ভুলের পুনঃপ্রয়োগ যা কিনা ইসলামী আবেগকে উস্কে দেয়া এবং দেশকে অস্থিরতার সম্মুখীন করে ইসলামের রাজনৈতিক উথানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। যা আমেরিকার দক্ষিণ এশিয় নীতিকে চরম ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারত। তাই মার্কিনীরা ইসলামের এই আবেগকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে ও ইসলামের আবেগকে গণতন্ত্রের রাজনীতির বলয়ে নিয়ে আসে ও বিএনপির হাতে তুলে দেয় যাতে আওয়ামীলীগ এখন প্রায় কোণঠাসা। এবং বিএনপি ও ইসলামী দল গুলো আরও বেশি মার্কিন অনুগত হয়।
আগামী বছর ভারতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবং বিজেপি ক্ষমতায় আসার সম্ভবনা প্রবল এবং খালেদার ভারত সফরে আমরা বিজেপির সাথে বৈঠকে দেখি এবং বিজেপি যেমন ভারতের আমেরিকা পন্থী দল বিএনপি তেমন বাংলাদেশে আমেরিকা পন্থী দল। তাই বাংলাদেশে যেমন বিএনপি ক্ষমতায় আসার সম্ভবনা প্রবল হচ্ছে তেমনি ভারতে বিজেপি। তাই আগামিতে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণে বিএনপি ও বিজেপির রসায়ন আমেরিকার ১ম পছন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এরশাদ নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর হিসেবে দেখাতে চায় এবং সম্প্রতি সে ভারত ও আমেরিকা সফর করে এবং সে শেষ পর্যন্ত সেদিকেই ঝুকবে যেদিকে আমেরিকা-ভারতের এক হওয়ার হওয়া বইবে।
তৃতীয়ত, সেনাবাহিনী বা সেনা সমর্থিত সরকার। ভারত-ব্রিটেন-ইইউ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় আসা পছন্দ করে না আর সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসা মানে আমেরিকা বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে তার শেষ অস্ত্র ব্যবহার করেছে। আর আমেরিকাও এই মুহূর্তে সেনাবাহীনিকে ক্ষমতায় আনতে চায় না, কিন্তু খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানোতে এই অপশনটি আলোচনায় আসে। কিন্তু বর্তমানে সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি আমেরিকার নীতি হল তাকে তার অনুগত একটি বিগ্রেডে পরিণত করা। যার জন্য দরকার সেনাবাহিনীর মাঝে শূন্যতা তৈরি ও আমেরিকার দ্বারা তা পূরণ। যেমনঃ পিলখনা হত্যা কাণ্ডের পর আমেরিকা বাংলাদেশের সেনা-বাহিনীর সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেয় এবং প্রচুর সামরিক চুক্তি ও মহড়ার আয়োজন করে এতে করে সেনা নেতৃত্ব আরও বেশি আমেরিকা মুখি হয় এবং পেশাদার হয় যাতে তারা ভাড়ায় আমেরিকার জন্য খাটে। আবার সেনা ও নৌ বাহিনীর প্রচুর সারঞ্জাম আমেরিকা দেয় তার প্রশিক্ষণের নামে সম্পর্ক আরও পেশাদারী পর্যায়ে নিয়ে আসে। এবং এই সময়ে আমেরিকা চায়না এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হোক বরং সে খালেদার মাধ্যমে শুধু ভয় লাগিয়েছে।
আর একটি বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন, যা আমেরিকা-ব্রিটেন-ভারতকে এক জায়গায় নিয়ে আসছে তা হল ইসলামী খিলাফতের উত্থানে সেনাবাহিনীর আগ্রহ, কারণ শুনা যায় গত বছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির অফিসাররা খিলাফত প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল যা সকল সাম্রাজ্যবাদীদের ভাবিয়ে তুলেছে এবং বাংলাদেশে অস্থির পরিবেশ তৈরি হওয়া মানে সে ইচ্ছাকে আরও বেশি উস্কে দেয়া, তাই আমেরিকা বার বার তাগিদ দিচ্ছে যে ক্ষমতার পরিবর্তন আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে কোন সংঘাতের মাধ্যমে নয় যাতে এই অঞ্চলে ইসলামের উত্থান আরও তরান্বিত না হয়। এবং ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি TIB, CPD যারা কিনা সাম্রাজ্যবাদীদের ডলার-পাউন্ড পুষ্ট তারা সংঘাত বিহীন ক্ষমতার পরিবর্তনের ফর্মুলা দিচ্ছে।